ডুমুরের ফুল
৩.
জাদিদ তার বাবার একমাত্র সন্তান। মা বাবার ডিভোর্স এর পর মা চলে যান গ্রিসে আর জাদিদ বাবার সাথেই বাংলাদেশে থেকে যায়। জাদিদের বাবা ইমরান মোল্লা হাইসাম। মোল্লা সাহেব পেশায় একজন নাবিক। বর্তমানে তিনি প্রধান নাবিক । একমাত্র ছেলেকে তিনি ঢাকা রাখতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার বৃদ্ধা মার জন্য ছেলেকে ফরিদপুরে রাখতে হয়েছে।
বছরের বেশিরভাগ সময় তিনি সমুদ্রে থাকেন। ২ মাসের ছুটিতে ১ মাস ছেলে ও মায়ের সাথে কাটান বাকি ১ মাস বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়ান।
ঝিলটুলিতে থাকে জাদিদ আর তার দাদী। অর্ধ পাগল এই বৃদ্ধার সাথে জাদিদের অবসর সময় থেকে শুরু করে ব্যস্ত সময়ও কেটে যায়।
৩ তলা বাড়ির তিন তলাতেই থাকে জাদিদ আর তার দাদী। একজন কাজের মহিলা আর বাড়ির দারোয়ান থাকেন। বাজার করা থেকে বাড়ির সকল কাজ দারোয়ান করে থাকেন। ৩ দিন ধরে জাদিদের মাথায় হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি বিষয়ক একটা গণিত মাথায় ঢুকেছে। সমাধান আর করতে পারছে না। মাথায় একবার কোনো কিছু ঢুকলেই হলো খাওয়া দাওয়া ভুলে যায়। ঘুম ও থাকে না তার চোখে। হাবিব স্যারকেও সে বলেছে সমস্যার কথা। স্যার বলেছে তুমি পারবা, চেষ্টা করো।
৩ দিনের দিন পারলো। তারপর স্যারকে বলে বাসায় এসে গোসল করে খেয়ে দেয়ে ঘুমালো বিকালে।
এইরকম সমস্যার সমাধানের পর সে লম্বা এক ঘুম দেয়। এক ঘুমে সকাল।
সকাল ৭ টায় জাদিদের ঘুম ভাংলো।
ঘুম ভাঙার সাথে সাথেই সে ফ্রেশ হয়ে নিজ হাতে চা বানিয়ে খায়। আজকেও সে চা হাতে নিয়ে ছোট বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে ফেসবুকে ঢুকলো। অনেকদিন ফেসবুকে আসা হয়না ভাবতে ভাবতে চায়ে চুমুক দিচ্ছিলো।জাদিদের চা বানানোর সময় টুংটাং আওয়াজে বৃদ্ধার ঘুম ভেঙে গেছে।
ছোট বারান্দায় এসে ফ্লোরে বসে পড়লো।
এই ঠাণ্ডার মধ্যে দাদীকে ফ্লোরে বসতে দেখে জাদিদ চেয়ার থেকে উঠে বলল
– young lady ফ্লোরে কী করছো? চেয়ারে বসো।
বৃদ্ধা হেসে বলল
– থাক ভাই তুই বয়। আমি এইখানে ঠিক আছি।
কথাগুলো বলতে বলতে চেয়ারে বসলেন। তারপর একটু হেসে বললেন
– তোর বাপ রে আরেকটা নিকা করতে কস না ক্যান?
চায়ের কাপ ফ্লোরে রেখে দিয়ে জাদিদ বলল
– তোমার ছেলেকে তুমি রাজি করাও। আমি ছেলে হয়ে বাবাকে কীভাবে বলবো বিয়ের কথা? আর বাবার যদি ইচ্ছা না থাকে তাহলে কী দরকার?
– কোন কুলক্ষুণে তোর মায়তে পোলাডা বিয়া করছিলো। জীবন টাই গেলো আমার পোলার।
জাদিদ খেয়াল করেছে যে তার বাবার ছুটিতে আসার সময় হলেই তার দাদী বিয়ে করানো নিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
আরেকটু সময় এখানে থাকলে দাদী কেঁদে কেটে পরিস্থিতি খারাপ করে ফেলবে। তাই জাদিদ চুপচাপ তার রুমে এসে দরজা বন্ধ করে পড়তে বসলো।
অনেক পড়া তার বাকি। তাকে অনেক পড়তে হবে। ঢাবি তার চাই!
হেমলতা প্রতিদিনের মতো ফজর নামাজ পড়ে নাস্তা করে পড়তে গেলো। আজ তার বাবা আসেনি।
বাবাকে সে খুব ভালবাসে। মার মুখটা সে মনে করতে পারে না। মায়ের সাথের কোনো স্মৃতী তার মনে নেই।
মার ছবি তার কাছে আছে। কিন্তু তারপরও কেন যেন মনের স্বাদ মেটে না দেখে।
এই শীতের সকালে তার মা যেন তাকে খুব কাছে ডাকছে।
মিম্মার কাছে শোনা জাদিদের কথাও তার মনে পড়ছে। গোমড়া মুখ আর হাসিখুশি মুখ। দুটোতেই ছেলেটাকে ভালো লাগে।
জাদিদ সকালের নাস্তার সময় খেয়াল করলো কয়েকজন মুরুব্বী গোছের লোক ড্রয়িংরুম এ বসে আছে। ব্যাপার টা কী?
দাদী কি আবারো বাবার জন্য মেয়ে দেখছে? এরা কী তাদের লোক? এই প্রশ্নগুলো জাদিদ তার দাদীকে করতে যেয়েও করলো না। প্রশ্নগুলো এর আগেও একবার করেছিলো এবং বাসায় ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছিলো। দাদী ইঁদুর মারার বিষ খেয়েছিলেন। তারপর বহুত কষ্টে তাকে বাঁচানো হয়েছে।
জাদিদ তার দাদীকে ডাকলো
– দাদী, দাদী
– কিরে ডাকোস ক্যা?
– বাসায় মেহমান এসেছে নাস্তা দাও নি?
– সেটাই তো করছি রে।
দাদী বিরক্ত হয়ে চলে গেলেন।
জাদিদ ও নাস্তা করে ব্যাগ গুছিয়ে পড়তে বের হলো।
টেরাকোটার সামনে আসতেই তার মনে হলো গতকাল একজন কেশবতী তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। মেয়েটার তাকিয়ে থাকার কারন সে জানে। কিন্তু এতক্ষণ তাকিয়ে থাকার কারন কি বুঝতে পারছেনা।
কাকে জিজ্ঞেস করবে?
দূর থেকে যতটুক বোঝা গেছে মেয়েটার চেহারা খারাপ না।
মেয়েটাকে একদিন ভয় দেখাতে হবে বা চমকে দিতে হবে। হাবিব স্যারের কাছেও মেয়েটা পড়ে।
আমাকে না হয় জোকারের মতো লাগে তাই বলে এভাবে তাকাবে ক্যান?
অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করতে হবে। প্ল্যান করতে হবে যখন সামনে পাবো। তার আগে করলে প্ল্যান মাটি হয়ে যাবে।
হেমলতার আজকে ১০ মিনিট দেরি হয়ে গেছে। কেন যেন ইংলিশ পড়তে আসলেই তার দেরি হয়। প্রায় দৌড়ে এসে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। স্যার ওর দিকে তাকিয়ে বললেন
– আজকেও লেট?
ক্লাস শুদ্ধু সবাই হেসে উঠলো।
হেমলতার অবশ্য অভ্যাস হয়ে গেছে কথা শোনার। তাই সে মন খারাপের ভান করে বলল
– sorry স্যার আর হবে না।
স্যার ধমক দিয়ে বললেন
– হইছে প্রতিদিন একই কথা বলো আর একদিনও তো পূরণ করো না।
হেমলতা সহ ক্লাস শুদ্ধু সবাই চুপ হয়ে গেলো।
স্যার কিছুক্ষণ চুপ হয়ে রইলেন। তারপর বললেন
– আসো। দাঁড়িয়ে থেকে কী লাভ? ক্লাসেই বসে থাকো।
হেমলতা চুপ করে পিছনের বেঞ্চে গিয়ে বসলো।
তারপর স্যার এবং পুরো ক্লাসের স্টুডেন্ট স্বাভাবিক হয়ে গেলো। যেন কিছুই ঘটেনি।
আগামীকাল দুপুর ৩ টায় হাবিব স্যারের কাছে পরীক্ষা। কিন্তু হেমলতার কিছুই পড়া হয়নি। ব্যাখ্যা মূলক প্রশ্নের থেকে গাণিতিক সমস্যাই বেশি। কী পরীক্ষা দিবে এই নিয়ে মিম্মার সাথে কথা হচ্ছিলো হেমলতার
– মিম্মা দোস্ত প্লিজ লাগে আমার পাশে বইসো।
– হেহ আইছে। আমি নিজেও বা কী পড়ছি?ঘুম এতো বাড়ছে।
– আমার ফিজিক্স বই দেখলেই ভয় লাগে। আবার সকালে রসায়ন এর জৈবযৌগ চ্যাপ্টারের উপর পরীক্ষা।
– আমি যাবোনা।
– আমার তো যাওয়াই লাগবে। নানী তো রুটিনের ফটোকপি তার রুমে টানায় রাখছে। না যাওয়ার উপায় নাই।
– চিন্তা না কইরা পড়। সাদা খাতা তো জমা দেয়া যায় না।
– আচ্ছা।
পড়তে পড়তে কখন যে টেবিলেই ঘুমায় পড়ছে সেই খেয়াল হেমের নাই।
ফজরের নামাজের সময় নানী এসে তাকে ডেকে তুললেন।
রসায়ন পরীক্ষা খারাপ হয়নি। রাতে তো রসায়ন পড়ছে।
মিম্মা আসেনি। তাই সে আর একা একা টেরাকোটার সামনে না গিয়ে বাসায় চলে আসলো।
কোনোরকম ফিজিক্স পড়েছে।এভাবে কী পরীক্ষা দিবে সে ভাবছিলো। হাবিব স্যার প্রশ্ন দিলেন।
একটা গাণিতিক সমস্যা বাদে কিছুই কমন পড়ে নাই। এমনকি ছোট প্রশ্নও ভুলে গেছে।
গাণিতিক সমস্যা সমাধানের সময় তার মনে পড়লো ক্যালকুলেটর ভুলে টেবিলের উপর রেখে আসা হয়েছে।
– মিম্মা ক্যালকুলেটর টা দে
মিম্মা, হেমলতার থেকে ৩ বেঞ্চ পিছনে বসেছে।
হেমলতা খেয়াল করলো মিম্মা লেখেই যাচ্ছে। হাত থামছে না। খাতার দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় বলল
– আমার এখন লাগবে। পরে দিবো।
কী আর করার চুপ করে বসে থাকা ছাড়া।
সবার শেষে এসেছে বলে তাকে সবার সামনের সিংগেল চেয়ার টেবিলে বসতে হয়েছে। কী কপাল? আগে আসলে মিম্মার সাথে বসিলেই হতো।
স্যার একটু দূরে চেয়ারে বসে ছিলেন।
কেউ একজন বলল
– স্যার আসতে পারি?
স্যার হেসে বললেন
– আসো।
আরে এতো সেই জাদিদ। হেমলতা ১ বার তাকিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলো।
ছোট্ট একটা ভাগে এসেই সে থেমে আছে। ক্যালকুলেটর ছাড়া সে কিছুই করতে পারেনা।
জাদিদ স্যারের কাছে বই চাইলো।
স্যার বলল একটু দাড়াও। আমি নিয়ে আসছি।
জাদিদ ইচ্ছাকৃত ভাবে এখন এসেছে। মেয়েটা একেবারে সামনেই বসে আছে। একটু চমকে দেয়া যাক। কী করা যায়? কী করা যায়?
জাদিদ মেয়েটার দিকে এগিয়ে এসে খাতার দিকে ঝুকে দেখলো কী করছে মেয়েটা।
জাদিদকে এই রুমে থাকা প্রত্যেকটা মেয়ে চিনে। সবাই অবাক। জাদিদ, হেমলতার দিকে ঝুকে আছে কেন?সবার একই প্রশ্ন মুখে আটকে আছে।
হেমলতাও অবাক।প্রায় আতকে উঠে চাপা স্বরে বলল
– একি। আপনি এভাবে আছেন কেন? সরে দাঁড়ান।
জাদিদ মুচকি হেসে বলল
– তুমি এতো সহজ একটা ভাগ পারছো না?
হেমলতা কী উত্তর দিবে? ভাবতেও পারছেনা। মাথা নিচু করে বলল
– আপনি যান তো এখান থেকে।
– আরে বোকা মেয়ে ১০০০ কে ৩ দিয়ে ভাগ করলে ভাগফল হয় ৩৩৩.৩৩। উত্তর টা লেখো।
তারপর ব্যাগ থেকে ক্যালকুলেটর বের করে হেমলতার বেঞ্চের উপর রেখে বলল
– রেখে দাও।পরে একদিন নিয়ে নিবো।
চলবে…….!