ডুমুরের ফুল ২১.

0
2366

ডুমুরের ফুল ২১.

– আমি তো টেনশন ফ্রী হয়েই হাঁটছি।
– ইমরান, মিথ্যা বলবা না।
– তোমাকে মিথ্যা বলবো কেনো?
– আমি নিজেও জানিনা তুমি কেনো আমাকে মিথ্যা বলো।
– আজকে একটু বেশি খাওয়া হয়েছে। তাই আরকি পেট ভার ভার লাগছে।
– আরো খেলেই তো পারতে। পেট ফুলতে ফুলতে ব্লাস্ট হতো।
– আর তুমি বিধবা হয়ে যেতে।
– ইমরান, আমি তোমার স্ত্রী নই এখন। তাহলে বিধবা কীভাবে হবো?
ইমরান মোল্লা কিছুক্ষণ ভেবে বললেন
– ভুলেই যাই বয়স হয়েছে বুঝোই তো।
– বয়স কই হয়েছে তোমার? জাদিদ কেবলমাত্র এইচএসসি দিলো।
– বিয়ে করেছি কি অল্পবয়সে?
– আমার মনে আছে বিয়ের দুদিন পরেই তোমার ৩৪ বছর পড়লো।
– জাদিদের বয়স ১৮ বছর ১১ মাস। এখন হিসাব করো আমার বয়ে কতো।
– তোমার যখন ৩৬ বছর হবে হবে তখন জাদিদ জন্ম নিলো। ওইতো ৫৪ বছরের কাছাকাছি হবে।
– জাদিদ হলে এক্সাক্ট এজ বের করে দিতে পারতো।

হোটেলের রিসিপশনের ছেলেটা খেয়াল করলো ইমরান মোল্লা একা একাই কথা বলছেন। একটু আগেই এখানে একটা রুম বুক করে গেছেন তাই নামটা স্পষ্ট মনে আছে। দেখে তো মাতাল মনে হচ্ছেনা। খুবই স্বাভাবিক লাগছে। অনেক মানুষ আছে যারা একা একাই কথা বলে। হয়তোবা উনি ওই শ্রেণির একজন। ইমরান মোল্লার দিক থেকে নিজের মনোযোগ সরিয়ে আনলো ছেলেটি।
প্রতিদিন ২০-৩০ জন মানুষ আসে এই আবাসিক হোটেলে। একেকজন একেক রকম হবে এটাই স্বাভাবিক।

এই বয়সের পুরুষেরা অল্পবয়সী মেয়ে নিয়ে আসে। ইনি আনেননি হয়তোবা পরে আনবেন।

জাদিদ বই গুলো সেল্ফে গুছিয়ে রাখছে। ঘুম আসছেনা বিধায় কিছু একটা করা দরকার। একাকী ভালো লাগছিলোনা এদিকে হেমলতার ঘুমে ব্যস্ত। কী করবে কী করবে ভাবতে ভাবতে বইগুলো যে এখনো বাক্সবন্দী হয়ে আছে মনে পড়লো জাদিদের।
সময় কাটানো হয়ে যাবে এদিকে বইগুলো গুছানো হয়ে যাবে। সকাল ১০ টায় ওরিয়েন্টেশন ক্লাস। দেয়াল ঘড়িতে কেবল ৫ টা বেজেছে।
আরো ৫ ঘণ্টা!
মোবাইল হাতে নিয়ে হেমলতাকে ফোন দিবে ভেবেও ফোন দিলোনা জাদিদ।
কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে কথা বলার কোনো মানেই হয়না।
কিন্তু জাদিদেরও সময় কাটতে চাচ্ছেনা। টেবিলের উপর রাখা বাংলা বইটার দিকে জাদিদের চোখ আটকে গেলো।
বইটায় সে কখনো শান্তি খুঁজে পায়নি। বইটা খুললেই তার মন খারাপ হয়ে যায়। যতো পৃষ্ঠা উল্টাবে মন খারাপের মাত্রা তত বেড়ে যাবে। অদ্ভুত!
মন অস্থির হয়ে আছে তার আবার যদি মন খারাপও হয় তাহলে তো জটিল দিকে এগিয়ে যাবে।
আর এই জটিলতা কাটাতে হেমলতাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে কথা বলতে হবে। এটা করা যাবেনা।
জাদিদ দ্রুত ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে সিড়ি বেয়ে নামতে লাগলো।
বিল্ডিংয়ের মেইন গেট তালা দেয়া। দারোয়ান গ্রাউন্ড ফ্লোরের ছোট্ট একটা রুমে ঘুমিয়ে আছে।
জাদিদ তাকে ডেকে তুললো।
২০ – ২২ বছরের অতিরিক্ত শুকনা ছেলেটা একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো
– এতো ভোরে কেউ কাউরে ডাইক্কা তোলে নাকি?
জাদিদ চশমাটা ঠিক করে বললো
– হ্যাঁ ডেকে তোলে।
– ক্যাডা নাম হুনি তো।
– আমি।
– আমি কারো নাম হয়?
– আমার নাম জাদিদ।
ছেলেটা কথা না বাড়িয়ে বিল্ডিংয়ের মেইন গেট খুলে দিয়ে বললো
– বিল্ডিংয়ে ডাকাইতি হইলে আফনের দোষ। হুনছেন কি কইছি?
জাদিদ মাথা নাড়িয়ে দ্রুত রাস্তায় পা বাড়ালো।
ঝাকড়া চুলের ছেলেটা হ্যাঁ বললো নাকি না বললো বুঝতে পারলোনা।
গেট খুলে রাখা রিস্ক ভেবে আবার তালা দিয়ে ঘুমাতে চলে গেলো কায়েস।
দারোয়ান না হলে এতো বিচিত্র চরিত্রের মানুষের সাথে দেখা হতোনা তার।
ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লো কায়েস।

হেমলতার ঘুম ভাঙলো তখন ঘড়িতে ৯ টার মতোন বাজে।

মিসেস জয়নাব ফজরের নামাজ পড়ে, হেঁটে এসে নাস্তা করে তার সকালের ঘুমের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। কিন্তু হেমলতার ঘুমই ভাঙছেনা।
এদিকে মিসেস জয়নাব টেনশনে ঘুমাতে যেতেও পারছেননা।
মেয়েটা কি রাতে ঘুমাতে পারেনি?

হেমলতা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। এতো দেরি করে ঘুম ভাঙলো তার? নানী তাকে নিশ্চয়ই আজকে অনেক রাগ করবেন।
মাথাটা হালকা ভার ভার লাগছে তার। এতো রাত অবদি ফোনে কথা বলার ফলাফল। কিন্তু জাদিদকেও তো না করা যায়না।
কোনোমতে ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে গেলো হেম।
চা বানানো নেই। নিজেকেই বানিয়ে খেতে হবে।
লায়লা বানু হেমকে রান্নাঘরে দেখে বললেন
– আপনারে খালাম্মায় ডাকে। যান শুইনা আসেন।

এতো দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে বলে রাগ করবে না তো? নাকি রাত জেগে জাদিদের সাথে ফোনে কথা বলেছে, ব্যাপারটা জেনে গেছে?
মোবাইলের ডায়াল লিস্টেই জাদিদের নাম্বার। নাম্বারটা ডিলিট করে রাখা উচিৎ ছিলো।
হেমলতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লাইলি বানু বললেন
– বললামই তো আপনারে ডাকতাছে। যান না ক্যান শুনি?
– না মানে আমি চা খেয়ে গেলে হবে না?
– আপনে খালাম্মার রুমে যান। আমি চা নিয়ে আসতাছি।

হেমলতা অনিচ্ছাসত্ত্বেও নানীর রুমে আসলো। মিসেস জয়নাব আধশোয়া অবস্থায় বিছানায় আছেন।
হেমলতাকে দেখে বললেন
– এতো দেরিতে ঘুম ভাঙলো যে?
হেমলতা মিথ্যাটা সাজিয়ে নিয়ে বললো
– রাতে ঘুম আসছিলোনা তাই।
– আমাকে বললেই তো পারতে।
– ভাবলাম তুমি ঘুমাচ্ছো। বিরক্ত করা হবে।
– মোবাইলে তো ৮১৩ টাকা ব্যালেন্স ছিলো। সকালে মিম্মাকে ফোন করতে গিয়ে দেখলাম ৭০৯.৫০ টাকা আছে।
– না মানে মিম্মার সাথে কথা বলেছিলাম। ঘুম আসছিলোনা তাই।
– মিম্মার নাম্বারে ফোন দিলাম ৫ – ৬ বার কিন্তু রিসিভ করলোনা। যাইহোক তোর শরীরের অবস্থা কেমন?
– ভালো। নাস্তা তো করিসনি?
– না।
– যা গিয়ে নাস্তা করে নে। আমি এখন ঘুমাবো।

হেমলতা কথা না বাড়িয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। লাইলি বানু চা নিয়ে রুমের দিকে আসছিলেন। হেমলতা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে নিজের রুমে এসে দরজা আটকে দিলো।

জাদিদ রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছে। কিছুই ভালোলাগছে না তার। আশেপাশের দুই একটা দোকান কেবল খুলছে দোকানীরা।
হাতের ঘড়িটা আনলে ভালো হতো এক্সাক্ট টাইম জানা যেত। রুম থেকে যখন বের হলো তখন ৫ টা ২৫ বাজে। এখন কয়টা বাজতে পারে, ৫ টা ৩৫?
কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি ১০ মিনিট পার হয়ে গেলো কীভাবে? ফ্ল্যাটে তিন ঘণ্টা তিন যুগের মতো লাগছিলো।
সময়টা জানতেই হবে তার।
দোকান খুলছে একজন বৃদ্ধ। তার দিকে এগিয়ে গিয়ে জাদিদ জিজ্ঞেস করলো
– কয়টা বাজে বলতে পারবেন?
এলোমেলো চুলের বিদধ্বস্ত ছেলেটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। ট্রাউজার আর সেন্ডো গেঞ্জি পড়েই ছেলেটা রাস্তায় চলে এসেছে।
– ৫ টা ৪৫ বাজে।
জাদিদ শুধু, ওহ বলে আবার হাঁটতে শুরু করলো।
যাক সময় তার মতো এগোচ্ছে। বিনাকারণে সময় নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছুই নেই।

চলবে……

( আসছে – যেখানে সীমান্ত তোমার আমার)

© Maria Kabir

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে