ডুমুরের ফুল
২.
সারদা সুন্দরী কলেজের সামনে এসে রিক্সা দাঁড়ালো। হেমলতা রিক্সা থেকে নেমে বাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল
– বাবা আসি
– আচ্ছা মা যা।
পকেট থেকে ১০০ টাকার নোট বের করে মেয়ের হাতে গুঁজে দিয়ে বলল
– রাখ মা। আজকের দিনে এতে তোর হবে?
মেয়ে ১০০ টাকার নোট ব্যাগে রেখে বলল
– হবে বাবা!
মনোজ সাহেব রিক্সা নিয়ে চলে গেলেন। হেমলতা পড়তে গেলো।
৯ টায় পড়া শেষ হওয়ার পর হেমলতা আর তার বান্ধবী মিম্মা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ইন্টারের টেস্ট এক্সাম শেষ তাই ক্লাস অফ।
হেমলতা খেয়াল করলো ঠিক তাদের বিপরীতে টেরাকোটার সামনে জটলা। ১০-১২ জন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই খুব হাসাহাসি, গল্পে ব্যস্ত। কিন্তু একজন গোমড়া মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।গোমড়া মুখেই ছেলেটাকে বেশি সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে হাসলেই ছেলেটার সৌন্দর্য টা হাওয়া হয়ে যাবে।
নীল রঙের জিন্সের সাথে লাল রঙের ফুল হাতা গেঞ্জি পড়েছে। এই পোশাকে এই ছেলেকে বেশ ভালোও লাগছে না আবার খারাপও লাগছে না। মাথায় এক ঝাক কোঁকড়া চুল। ঘুম থেকে ওঠে আচড়াতে ভুলে গেছে। তাতে কাউয়ার বাসার মতো লাগছে। প্রচুর ফর্শা, ঠোট পাতলা। লম্বা মাঝারি, স্বাস্থ্য ভালো।
চেহারা দেখে মনে হচ্ছে খুব চিন্তায় আছে।
এই ছেলেটাকে হেমলতা আজকেই প্রথম দেখলো। হেমলতা মিম্মা কে বলল
– মিম্মা
– হু বল
ইশারায় ছেলেটাকে দেখিয়ে বলল
– চিনিস ওই ছেলেকে?
– কোন ছেলে?
– আরে গাধী উইজে টেরাকোটার সামনে লাল ফুল হাতা গেঞ্জি পড়া ছেলেটা!
– আরে ও। ওর চিনে লাভ নাই লাইন মারতে পারবি না।
– ধুত্তুরি আমি কি লাইন মারার জন্য বলছি নাকি? ছেলেটাকে এই প্রথম দেখলাম।
– তুই তো সারাদিন তোর ওই ব্রিটিশ রাজ্যে বাস করিস। তোর আবার অন্যের খবর রাখার সময় আছে?
– শোন আমাদের সাথের প্রায় ছেলেকে আমি নামে হলেও চিনি। কিন্তু এরে তো মনে হচ্ছে ফরিদপুরে নতুন।
– নাহ। ফরিদপুরের স্থানীয়। ওর নাম জাদিদ ইবনে হাইসাম। ফরিদপুরের টপার স্টুডেন্ট। এবার এইচএসসি ক্যান্ডিডেট দের মাঝে জাদিদ ১ নাম্বারে আছে। আর হাবিব স্যারের মতে ওর মতো মেধাবী ১০০ বছরে ১ টাই পাওয়া যায়।
– এতো ভালো স্টুডেন্ট তাহলে একা একা কেন দাঁড়িয়ে আছে? ফ্রেন্ডস কই?
– ওর কোনো নির্দিষ্ট কোনো ফ্রেন্ড নাই। যেই ওর সাথে কথা বলতে আসে ও তার সাথেই কথা বলে। পড়াশোনার ব্যাপারে যতো রকমের হেল্প লাগবে ও এক পায়ে রাজি। কিন্তু…!
– কিন্তু কী?
– এক্সাম হলে বোম মারলেও কাউকে দেখাবে না কিছুই।
হেমলতার কেন যেন ছেলেটাকে ভালো লাগলো। এক দৃষ্টিতে জাদিদের দিকে তাকিয়ে আছে। কপাল কুঁচকিয়ে, চোখ বন্ধ করে, হা করে জাদিদ কী যেন চিন্তা করছিলো।
হেমলতার এই অবস্থা দেখে মিম্মা হাসতে হাসতে বলল
– দোস্ত প্রেমে পড়ার মানুষ পাইলা না।
মিম্মার টিটকারি শুনে হেমলতা রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল
– কে বলেছে আমি প্রেমে পড়েছি? একটা ছেলের দিকে তাকালেই কী প্রেমে পড়া হয়ে যায় নাকি?
– যাই হোক। একটা কথা বলে রাখি ওর প্রেমে পড়ে লাভ নাই। ওইরকম টপার স্টুডেন্ট রা বই ছাড়া কিছুই বুঝে না।
– তুই এতো কিছু কীভাবে জানলি?
– সবার কাছ থেকে শুনি। নিফার কাছ থেকে বেশি শুনেছি।
– ক্যান নিফা ওর জিএফ নাকি?
– মাথা খারাপ নাকি? নিফার বিএফ জাদিদের সাথে ঘোরাফেরা করে।
মিম্মার ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। মিম্মা ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে গেলো।
হেমলতার চোখে জাদিদের চিন্তাভরা মুখখানা ভেসে আসছে।
নিজের উপর ধিক্কার দিয়ে নিজেকে মনে মনে বলল
– হেম তুই মানুষ আর পাইলি না। এই কাউয়ার বাসার কথা চিন্তা করছিস।
বিকাল ৩ টায় হাবিব স্যারের কাছে পড়া।
স্যার পড়ানো শুরু করবে এই সময় সেই কাউয়ার বাসা আইসা হাজির।
হেমলতা খেয়াল করলো ছেলেটা এখনো সেই একই পোশাক পড়ে আছে। স্যারের সাথে হেসে হেসে খুব আস্তে আস্তে কী কী যেন বলছিলো।
হেমলতার কানে শুধু সূত্র, গাণিতিক যুক্তি, ব্যাখ্যা শব্দ আসছিলো।
সে উতলা হয়ে ভাবছিলো
– কী নিয়ে কথা বলে?
কিছুক্ষণ পর স্যার জাদিদের পিঠে চাপড় মেরে বলল
– সাবাস!
সবাই শুনলো। জাদিদ খুব মিষ্টি করে হেসে বিদায় নিয়ে যাচ্ছিলো তখনি হেমলতা জাদিদের ফেস পুরোপুরিভাবে দেখতে পেলো। এতক্ষণ পিছন ঘুরে ছিলো।
হেমলতা সকালের সেই চিন্তাসহ গোমড়া মুখ আর নাই। এখন চেহারায় বিজয়ের হাসির ঢেউ উপচে পড়ছে।
মিম্মা হেমলতার এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল
– আর তাকাস না এভাবে।
হেমলতা ধরা পড়ে যাওয়ায় লজ্জা পেলো। তারপর বলল
– আরে না তেমন কিছুনা।
রাতে পড়া শেষ করে ঘুমানোর আগে হেমলতা ফেসবুকে কিছুক্ষণ থাকে। তারপর ঘুমায়।
হেমলতা জাদিদের ফেস মনে করতে পারছিলো না। আজকেই তো ২ বার সে দেখেছে আর এখনি মনে করতে পারছেনা। তার খুব মেজাজ খারাপ হচ্ছিলো।
ছেলেটার নাম তার মনে আছে। হেমলতা ফেসবুকে পুরো নাম ইংলিশে লিখে সার্চ দেয়ার সাথে সাথেই অনেক আইডি চলে আসলো।
এখন সমস্যা হচ্ছে কোনটা কাউয়ার বাসার আইডি।
একদম প্রথম আইডি তে ডোরেমন এর ছবি দেওয়া। আর ৫ মিউচুয়াল ফ্রেন্ড। কাভার পিকে ৩ জন ছেলের ছবি তার মধ্যে একজন তো নাফির বিএফ আর দ্বিতীয় জন জাদিদ।
সেন্ড রিকুয়েস্ট অপশনে গিয়ে হেমলতা থেমে গেলো।
না ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠানো যাবেনা।
পিকচার দেখতে শুরু করলো। প্রত্যেকটা পিকচারে চুল আচড়ানো না। আর হাসি কী রে মাইরি?
দাঁতের উপর দাঁত দিয়ে জগত কাঁপানো হাসি।
আর প্রায় প্রত্যেকটা ছবিতে ফুল হাতা গেঞ্জি পড়া। হাফ হাতা গেঞ্জি পড়া পিকচার ২-৩ টা।
নানীর পায়ের শব্দ শুনে হেমলতা ডাটা কানেকশন অফ করে ঘুমের ভান ধরলো।
মিসেস জয়নব নাত্মীর কাছে এসে তার মশারী টানিয়ে দিলেন।
তারপর কিছুক্ষণ ঘুমন্ত চেহারা দেখে চলে গেলেন তার রুমে।
ঘুমানোর আগে মিসেস জয়নব তার বাড়ির সব খবর ভালোভাবে নেন। মেইন গেট, কেঁচি গেট, বাড়ির সদর দরজা লাগানো হয়েছে কিনা। তারপর তিনি প্রেশারের মেডিসিন খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। এই রুটিন অনুযায়ী সে সবকিছু করে ঘুমিয়ে পড়লেন।
এইদিকে হেমলতা ঘুমের ভান ধরতে গিয়ে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছে।
হেমলতার ঘুম খুব পাতলা। খুব আস্তে শব্দতেও ওর ঘুম ভেঙে যায়। মিসেস জয়নব এর কড়া হুকুম ওর ঘুমের সময় যেন কেউ তার রুমের আশেপাশেও যেন না থাকে!
চলবে…!