ডুমুরের ফুল
১১.
শেষ পর্ব!
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর জাদিদকে ফোন দেয়ার কথা ছিলো। কিন্তু সন্ধ্যা পার হয়ে যায় হেমলতার ফোন আসেনা। জাদিদ বিরক্ত হয়ে হেমলতাকে ফোন করলো। দুইবার রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ হলো।
– হেমলতা!
– হেমলতা তো অসুস্থ। তুমি কে বাবা?
জাদিদ কণ্ঠ শুনে প্রথমে একটু ভড়কে গিয়েছিলো। হেমলতা এমনকি অসুস্থ যে ফোন রিসিভ করতে পারলো না। ফোন কেটেও দেয়া যাবেনা। তাহলে সন্দহের চোখে দেখবে। সাহস করে বলেই ফেলল
– জাদিদ, হেমলতার ফ্রেন্ড।
– ওহ আচ্ছা।
কন্ঠ শুনে বুঝতে পারলো। ইনি হেমলতার কাছের কেউ। আর হেমলতার অসুস্থতায় তিনি বেশ চিন্তিত।
– হেমলতার কী হয়েছে?
– আরে বাবা কী বলবো বলো। প্রাকটিক্যাল পরীক্ষায় লবণ দিছে। ভালো কথা তুই বুঝতে পারছিলি না যে কোন লবণ। কাউকে জিজ্ঞেস করলেই হতো। তা না মেয়ে আমার নিজেই লবণ চেখে দেখেছে। ডাক্তার বলল অল্প পরিমাণ পেটে গেছে আর একটু বেশি হলেই ওকে আর…….
হেমলতার বাবা আর কিছুই বলতে পারলেন না।
জাদিদ বুঝতে পেরেছে যে ইনি হেমলতার বাবা।
– আংকেল এখন ও কোথায়?
– ডায়াবেটিক হাসপাতালে।
– আংকেল এখন তো কেবল সন্ধ্যা। আমি আসলে সমস্যা হবে না তো?
– আরে না। আসো। ওর তো তেমন কোনো ফ্রেন্ড নাই। মিম্মা না মিমি ও এসে দেখা করে গেছে। হেমের মন খুব খারাপ। ফ্রেন্ড তো ফ্রেন্ডই তার আবার ছেলে বা মেয়ে কি।
– কতো নাম্বার রুম?
– পুরাতন বিল্ডিং এর ৩ তলার হাতের ডান পাশের রুম।
জাদিদ ফোন রেখে দিয়ে তাড়াহুড়ো করে বাসার জামা পাল্টে নিলো। রুম থেকে বের হওয়ার সময় বাবার মুখোমুখি হয়ে গেলো। ছেলেকে এই সময় বের হতে দেখে একটু অবাক হলেন। এই বয়সের ছেলেরা রাতেও আড্ডা দেয়। কিন্তু জাদিদ তা করেনা।
ছেলের দিকে হেসে বললেন
– কই যাওয়া হচ্ছে?
– এইতো বাবা। আমার এক ফ্রেন্ড অসুস্থ হাসপাতালে ভর্তি তাই তাকে দেখতে যাচ্ছি।
– তোমার সাথে গেলে কি তুমি বিরক্ত বোধ করবে?
– না। দুজনে গল্প করতে করতে গেলে ভালোই হবে।
– চলো ।
জাদিদ বাবার দিকে তাকিয়ে বলল
– তুমি এই পোশাকে যাবা?
– খারাপ কী?
– নিজের দিকে তাকাও তো?
নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে বুঝতে পারলেন আসলেই এই পোশাকে বের হওয়া যায়না। তাইলে একটু দাড়া।
তাদের বাড়ি থেকে মাত্র ৫ মিনিটের রাস্তা। তারপরো বাবা ছেলে রিক্সায় উঠলেন।
কেবিন খুঁজে পেতে বেশি সময় লাগলো না। দরজা আটকানো না কিন্তু ভেজানো। তাই নক করতে হলো।
দরজা খুললেন হেমলতার বাবা। মেয়ের সাথে গল্প করছেন।
জাদিদকে দেখে চেনার কথা না কিন্তু ও ছাড়া তো আর কেউ আসার কথা না তাই তিনি বুঝতে পারলেন জাদিদ এসেছে। হাসার চেষ্টা করলেন কিন্তু সেটা আর হাসি হলো না।
– আসো।
দরজা পুরোটা খুলে দিলো। মাঝারী আকারের রুম। রুমের দুকোণায় দুটো খাট পাতা। একটি রোগীর জন্য সেটাতে হেমলতা কাথা গায়ে দিয়ে আধ শোয়া অবস্থায় আছে। আরেকটাতে এখন কেউ নেই। রোগীর সাথে রাতে থাকার জন্য এই বিছানা রাখা হয়েছে।
দুটো টুল এগিয়ে দিয়ে মনোজ সাহেব বলল
– বসো বাবা। আর ইনি তোমার বাবা?
জাদিদ টুলে বসতে বসতে বলল
– জি।
জাদিদ হেমলতার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখছে এই একটা দিনের অসুস্থতায় মেয়েটার চোখের নিচে কালি পরে গেছে। চুল গুলো উশখু খুশকু। খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। তারপরও হেমলতাকে অসম্ভব ভালো লাগছে জাদিদের কাছে। হেমলতা কোনো কথা বলছে না।
মনোজ আর জাদিদের বাবা কথা বলতে বলতে রুম থেকে বাহিরে চলে গেলেন।
হেমলতা এখনো কোনো কথা বলছে না। জাদিদ টুল নিয়ে হেমলতার বিছানার পাশে বসলো। তারপর হেমলতার হাত তার দুহাতের মুঠোয়ে নিয়ে আলতো চাপ দিলো।
হেমলতা জাদিদের এভাবে হাত ধরাতে চমকে উঠে বলল
– একি? তুমি এভাবে হাত ধরেছো কেন? হাত ছাড়ো। বাবা দেখলে কী মনে করবে?
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলতে গিয়ে হেমলতা হাঁপিয়ে উঠলো। সারাটা দিন তার খুব কষ্ট হয়েছে। পরীক্ষা হল থেকে বের হওয়ার ৫ মিনিটের মধ্যে বমি শুরু হলো।নানী অসুস্থ, বাবা কাজে তাই কেউ আসেনি। মিম্মা মনোজ সাহেবকে ফোন করে
তারপর হাসপাতালে নিয়ে আসেন। বমি তো থামছিলো না তার উপর আবার চোখ উল্টে যাচ্ছিলো। হেমলতার এই অবস্থা দেখে মিম্মা ভয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দেয়।
বিকালের দিকে হেমলতা একটু স্বাভাবিক হয়।রাতে থাকবেন লাইলী বানু। মিসেস জয়নবের শরীর বেশ খারাপ। সে নিজেই তো কিছু করতে পারেনা সে আবার কেমনে অন্য কারো সেবা করবে।
জাদিদ হেমলতার দিকে না তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল
– লবণ এর কি অভাব ছিলো?
হেমলতার মুখ এমনিতেই ফ্যাঁকাসে এই প্রশ্ন শুনে আরো ফ্যাঁকাসে হয়ে গেলো। মাথা নিচু করে রইলো। এতক্ষণ হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলো। প্রশ্ন শুনে সেটা বন্ধ হয়ে গেলো।
জাদিদ আগেকার মতো করেই বলল
– তুমি একজন সাইন্সের স্টুডেন্ট। একজন মানবিক বা ব্যবসায়ী শাখার স্টুডেন্ট এই ভুল করলে একটা লজিক ছিলো। যে তারা এই ব্যাপারে জানে না। কিন্তু একজন সাইন্সের স্টুডেন্ট এর জন্য এইসব ব্যাপার জানা তো ক, খ জানার মতো। যদি খারাপ কিছু হয়ে যেতো?
হেমলতা জাদিদের দিকে তাকিয়ে রইলো। সে জাদিদের ভাব ভঙ্গি কিছুই বুঝতে পারছিলো না।
জাদিদ হেমলতার হাত দুটো তার ঠোঁটের কাছে নিয়ে আলতো করে চুমু এঁকে দিলো।
জাদিদের আলতো স্পর্শে হেমলতার শরীরে কারেন্টের শকের মতো লাগলো।
হেমলতা তাড়াতাড়ি তার হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না।
জাদিদ হেমলতার চোখে চোখ রেখে বলল
– হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করবা না। এমনিতেই আমার শক্তি বেশি তার উপর আবার তুমি অসুস্থ।
হেমলতা চোখ সরিয়ে বলল
– সবাই খারাপ কিছু ভাববে।
– কেউ দেখছে না তো। আর আমরা তো খারাপ কিছু করছি না তো।
হেমলতা ইতস্ততভাবে বলল
– ফ্রেন্ড রা তো এগুলা করেনা।
জাদিদ টুল ছেড়ে দিয়ে হেমলতার বিছানায় বসে পড়লো। হেমলতা দূরে সরে গেলো।
– দেখো বাবা তোমার বাবাকে আপাতত এখানে আসতে দিবেন না।
– বুঝলাম না?
– তোমার আমার মাঝে প্রথমে ফ্রেন্ডশিপ ছিলো কিন্তু সেদিনকার পর থেকে অন্য একটা অনুভূতি আমাকে তাড়া করে ফিরছে।
আমি জানি না কেন এমন হলো।
জাদিদ হেমলতার উশখু খুশকু চুলে বিলি কাটতে শুরু করলো।
জাদিদের এমন আচরণ হেমলতার কাছে খুব অচেনা লাগছিলো। অস্বস্তি লাগছিলো আবার জাদিদের স্পর্শও ভালো লাগছিলো। মিশ্র অনুভূতি খেলা করছে তার মনে।
জাদিদ হেমলতার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল
– তুমি না খুব সুন্দর। অসম্ভব সুন্দর। আমার তোমাকে খুব ভালোলাগে।
হেমলতা ভাবতেও পারছেনাজাদিদ তাকে পছন্দ করতে পারে। অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে। হেমলতা এতক্ষণ অন্য দিকে তাকিয়ে ছিলো। জাদিদের এই কথা শোনার পরেই সে জাদিদের দিকে তাকালো।
জাদিদ তার ডান হাতের দুই আংগুল দিয়ে হেমলতার গালে আলতো করে ছুঁয়ে দিলো।
হেমলতা কেঁপে উঠলো।
হেমলতার কেঁপে ওঠাতে জাদিদ হেসে ফেললো।
হেমলতা বলল
– তুমি কী বলছো? বুঝতে পারছো?
– হ্যা আমি বুঝতে পারছি। তোমাকে খুব ভালোলাগে। মনে হয় তোমার প্রেমে পড়েছি।
হেমলতা এই কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।
জাদিদ আবার বললো
– মনে যা হচ্ছে আমি তোমাকে ভালবাসি।
দেখো হেম আমি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলতে পছন্দ করি না। তারপর ও মাঝেমাঝে বলে ফেলি। আর আমি আগামীকাল চলে যাবো ঢাকায়। যাওয়ার আগে তোমার প্রতি আমার ফিলিংস গুলো জানিয়ে দিলাম। এখন তোমার ইচ্ছা তুমি কী করবা। আমি তোমাকে কোনোরকম ফোর্স করবোনা।
হুট করে জাদিদের মুখে যে উজ্জ্বলতা ছিলো সেটা উবে গেলো। হেমলতা খেয়াল করলো ব্যাপার টা।
জাদিদ বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। হেমলতা বুঝতে পেরেছিলো এখন কিছু না বললে আর কোনোদিন ও ওর বলা হবেনা।
জাদিদের হাতের মুঠো থেকে ওর হাত মুক্ত হয়ে গেলো।
হেমলতা জাদিদের হাত ধরলো। তারপর আস্তে আস্তে বলল
– আমাকে ভালোবাসার কারণ আমার জানা নেই। জানার ইচ্ছাও নাই। কিন্তু একটা কথা কি তোমাকে ভালবাসার অনেক কারণ আছে।
ভালবাসার কোনো কারণ থাকে না। কিন্তু আমার ভালবাসায় আছে। তোমাকে তো প্রথম দেখাতেই ভালবেসেছি। কিন্তু মিশতে চাই নেই। আমার মতো এতো সাধারণ মেয়ে তো তোমার যোগ্য না।
তারপর ও তোমাকে পাওয়ার ইচ্ছেটা মনের একটা স্থানে আটকে ছিলো।
তুমি ফ্রেন্ড হওয়ার কথা বললে তখন ভয় হয়েছিলো খুব। আমার ভিতরকার ফিলিংস টা যদি বেড়ে যায়?
জাদিদ মুচকি হেসে বলল
– আর বলতে হবেনা। বুঝেছি আমি। অসুস্থ মানুষের এতো কথা বলা ঠিক হবেনা। হেমলতা কখনো ডুমুরের ফুল দেখেছো?
– নাহ!
– ডুমুরের ফুল ডুমুরের ফলের মধ্যেই থাকে। উদ্ভিদবিজ্ঞান এ তো ছিলো আমাদের। তুমি না ভারী ফাঁকিবাজ।
যাই হোক। ফুল সৌন্দর্যের প্রতীক। ভিতর থেকে ফুল তার সৌন্দর্য টা ফলের গায়ে ছড়িয়ে দেয়। ফলের সেই সৌন্দর্যে পাখি রা আকৃষ্ট হয়।
হেমলতা তোমার সৌন্দর্য টা মনের ভিতর। যে তোমার মনের সৌন্দর্য টা উপলব্ধি করতে পারবে সেই তোমাকে ভালবেসে ফেলবে। তুমি হচ্ছো ডুমুরের ফুল। তোমার মনের সৌন্দর্য টা যেমন আমাকে আকৃষ্ট করেছে ঠিক তেমন ভাবে তোমার সাধারণ রূপ আমাকে ভালবাসতে বাধ্য করেছে। তোমার হাসিতে সরলতা খেলা করে।
জাদিদের বাবা বুঝতে পেরেছিলেন তার ছেলে এই মেয়েকে পছন্দ টছন্দ করে। ছেলের ওই মেয়ের দিকে তাকানো দেখেই ব্যাপার টা আড়ো বেশি পরিষ্কার হয়েছে তার কাছে। দুজনকে একটু আলাদা কথা বলার সুযোগ করে দেয়ার জন্য তিনি মনোজ সাহেবকে নিয়ে বাহিরে বের হয়েছেন। ছেলে এই মেয়েকে যদি ভালবেসেই থাকে বাসুক না। জাদিদের পছন্দ সে ভালো ভাবেই জানেন। ছেলে অবশ্যই ভদ্র মেয়েকেই বেছে নিয়েছে।
অনেকদিন পর আজকে তার খুব ফ্রেশ লাগছে তার। মনে আনন্দের সমুদ্র বয়ে যাছে। তার ছেলে প্রেমে পড়েছে। তার অর্থ এইযে তার ছেলে সুস্থ স্বাভাবিক।
জাদিদ হেমলতার হাতে আলতো করে চুমু দিয়ে বলল
– আর কোনোদিন এরকম করবে না।
হেমলতা ঘাড় নাড়িয়ে বলল
– হুম।
– লবণ খাওয়ার সখ মিটেছে?
– হুম।
হেমলতা মাথা নিচু করে বলল
– তোমায় ভালবাসি, বড্ড বেশি ভালবাসি।
জাদিদ বলল
– জানি তো। কেশবতী আমার! শুধুই আমার!