#ডায়েরির_শেষ_পৃষ্ঠা
#পর্ব_৭
#সমৃদ্ধি_রিধী
মাহিদ তার কথা শেষ করতে পারে না। তার আগেই অহমি মাহিদের শার্টের কলার খামছে ধরে। একই সাথে মাহিদের গলার কাছটার চামড়ার ছিলে যায়। অহমি মাহিদের কলার ঝাঁকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আপনি কোন সাহসে আমার ডায়েরিতে হাত দিয়েছেন? আপনাকে আমি কোনো অধিকার দেয়নি আমার ডায়েরিতে হাত দেওয়ার। কেনো করেছেন?”
মাহিদের গলার বাম সাইডটা পুরো জ্বলে গেল। সে ওইসব পাত্তা দিলো না। অহমির হাত কলার থেকে ছাড়িয়ে দুটো হাত ধরে বলে, “আমি তোমার হাসবেন্ড। আমার রাইট আছে তোমার বিষয়ে সবকিছু জানার।”
অহমি ছটফট করতে থাকে। মাহিদ অহমির গাল দু হাতে আগলে ধরে বলে, “দেখো আমার কাছে লুকানোর মতো কিছু নেই। তুমি মন দিয়ে আমার কথা শুনো তারপর….”
মাহিদ তার কথা সম্পূর্ণ করতে পারে না। অহমি ওর বুকে অনবরত কিল-ঘুষি দিতে দিতে হবে, “আপনি আমার অনুমতি ছাড়া কেনো আমার ডায়েরিতে হাত দিবেন? আমি আপনার কোনো কথাই শুনবো না।”
মাহিদ অহমিকে আগলে ধরে বলে, ” শান্ত হও। আমার পুরো কথা শুনো। আমাকে বলতে দাও।”
অহমি আরো ছটফট করে। মাহিদ এক কাজ করে বসলো। দৃঢ়ভাবে অধরে অধর ছুঁইয়ে দিলো। অহমির ছটফটানিও কমে গেল। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। ফ্লোরে বসেই মাহিদের বুকের সাথে মিশে রইলো। সংকীর্ণ কণ্ঠে বলে, “আপনার আগে আমার থেকে পারমিশন নেওয়ার প্রয়োজন ছিল।”
মাহিদ চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলে, “হাসবেন্ডদের পারমিশন নিতে হয় না।”
তারপর মাহিদ অহমির চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বলে, “অহমিকা কেউই কখনো পারফেক্ট হয় না। যদি পারফেক্ট হতোই তাহলে ‘মানুষ মাত্রই ভুল’ প্রবাদটা কিন্তু আসতো না।”
একটু থেমে অহমির দিকে তাকায়। অহমিকে এতো দ্রুত শান্ত করা যেতো না। আহির যেহেতু বিয়ের দিন অহমির অ্যাটেলোফোবিয়া থাকার আশঙ্কা মাহিদকে জানিয়েছিল, মাহিদ তাই শুরু থেকেই একটু একটু করে অহমির বিশ্বাস, ভরসা, স্বস্তির জায়গা হওয়ার প্রচেষ্টা করেছে। এমনকি ও হতেও পেরেছে। একজন সাইক্রিয়াটিস্ট হিসেবে এই কাজ খুব একটা কঠিন ছিল না মাহিদের জন্য।
মাহিদ অহমির মাথার উপর মাথা রেখে আরেকটু শক্ত করে ধরে বলে, “তুমিও পারফেক্ট হবে না, আমিও হবো না ৷ ভয় পেয়ো না। তুমি মানুষ, যন্ত্র না। আমরা ভুলগুলো ঠিক করে নেবো।”
অ্যাটেলোফোবিয়ার রোগীকে একটু সান্ত্বনা দেওয়াই যথেষ্ট। অহমি স্থির হয়ে রয়। মাহিদকে ওর শুরু থেকেই ভালো লাগে। ওর সাথে থাকলেই অহমির কেমন শান্তি শান্তি লাগে। কিন্ত এবার অহমি ফুঁপিয়ে উঠে। বলে,” আমি কিছু পারি না বলে আম্মু কথা শুনাতো। ভাইয়া কথা শুনাতো। এখন আম্মিও আমাকে বলে। আপনিও কথা শুনান। কালকেও কথা শুনিয়েছেন। ”
মাহিদ কপালে অধর ছুঁইয়ে বলে, “আর বলবো না। সরি বউ।”
“আপনারা সব কথার কথা বলেন। ঠিকই পরে আমাকে কথা শুনাবেন। আমি জানি।”
“কেনো তোমাকে কথা শুনাবো?”
“আমি ঠিকঠাক মতো গুছিয়ে থাকতে পারি না। ভালো রাঁধতে পারি না। আরো কতকি! যা করি তা-ই তো ভুল।”
“নাহ, তুমি অনেক ভালো রাঁধো। আম্মির পরে তোমার রান্না আমার প্রিয়। আপু তো নিজের বিয়ের সময় কিছুই করতে পারতো না। সেই হিসেবে তুমি ভালোই বাঁধো। আর তোমার সব ভুল নয়। তুমি সুন্দর করে গল্পও লিখতে পারো। এগুলো এক্সট্রা অডিনারি কোয়ালিটি অহমিকা। তাছাড়া মানুষ ভুল করে কিন্তু যা করে তা-ই ভুল হয় না।”
“তারপরেও আপনি কথা শুনাবেন।”
“কেউ শুনাবে না।”
“শুনাবেন আমি জানি। আপনি আমার ডায়েরি পড়ে ফেলেছেন। আপনি আমাকে এখন ক্রিন্জ ভাববেন। আমি পুরোই ওয়েটলেস হয়ে গেলাম।”
“কিছুই হয়নি। হাসবেন্ড ওয়াইফের একজন আরেকজনের সম্পর্কে সবকিছু বা কোনো পাস্ট জানলে কিছুই হয় না।”
“হয়, আপনি মনে মনে ঠিকই একদিন ভাববেন কেমন পাগল ছাগল বিয়ে করেছেন। আমাকে মনে মনে ঠিকই ছোট চোখে দেখবেন।”
“তারমানে তুমিও আমার বাবার ইন্সিডেন্টটার জন্য আমাকে ছোট চোখে দেখো? তুমিও তাহলে ভাবো এর বাবা এমন
ক্যারেক্টারলেস,তাহলে ছেলেও এমনই হবে।”
” না, না আমি তেমন কিছুই ভাবি না।” অহমি তড়িঘড়ি করে
বলে।
“আমিও তেমন তোমাকে নিয়ে তেমন কিছু ভাবিও না, ভাববোও না। ”
“আপনি আমাকে এখনই সরি বলবেন। আমার অনুমতি না নিয়ে কেনো ডায়েরি পড়েছেন?”
“কোনো সরি ফরি বলবো না। আমার হকের জিনিস নিয়ে এতো কিসের অনুমতি? তাছাড়া কাব্যিক কথা আছে না কিছু! ‘যাহা তোমার তাহাই আমার’। তুমি আমার ব্যাপারে সবকিছু জানতে পারো, তবে আমিও পারবো।”
অহমি শান্ত হয়ে কিছুক্ষণ ওইভাবেই থাকে। মা, ভাই কেনো ওকে ওইভাবে বুঝাতো না, বুঝতো না! অহমি হঠাৎই মাহিদকে ধাক্কা দিয়ে উঠে যায়। বলে, “যতই সান্তনা দেন না কেনো, আমি ভুলবো না আপনি আমার অনুমতি না নিয়ে আমার ব্যক্তিগত ডায়েরি পড়েছেন।”
অহমি চোখ-মুখ মুছে রাগে গজগজ করতে করতে বাথরুমে চলে যায়৷ মাহিদ অহমির এই কান্ড দেখে মাথা চুলকে নিরবে হেসে ফেলে। নিজেও উঠে বেলকনিতে চলে যায়। যদি বাইপোলার ডিসওর্ডার থাকতো তাহলে অহমি এত দ্রুত শান্ত হয়ে যেতো না। যেহেতু হাইপার হয়ে গেছিলো সো ওইটা ম্যানিক এপিসোড। আর ম্যানিক এপিসোডে রোগীকে এত দ্রুত শান্ত করা যায় না। মাহিদ মন প্রাণে চাইলো অহমির যেন বাইপোলার ডিসওর্ডার না থাকে।
________________________________________
খাবার খেতে বসে অহমি মাহিদকে পুরোপুরি ইগনোর করে গেলো। তবে সর্বোচ্চ খাতিরযত্ন করে খাইয়েছে। মাহিদ অনেকবার কথা বলতে চেয়েছে, কিন্তু অহমি কেবল হু-হা করেই গেছে। অহমি রান্নাঘর থেকে বাসনপত্র ধুয়েমুছে রুমে এসে আড়চোখে একবার মাহিদের দিকে তাকালো। লোকটা আধশোয়া হয়ে বই পড়ছে। অহমি সত্যি সত্যি রাগ করেনি, তবে রাগ করার ভান করে আছে। লাভ কি হলো? মাহিদ তো একবার সরি টরি বলে মানাতেও এলো না!
রাগে গজগজ করতে করতে একেবারে ফ্রেশ হয়ে লাইট নিভিয়ে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ড্রিম লাইট অবশ্য জ্বালালো। মাহিদের এই ড্রিম লাইট খুবই অপছন্দের । তারউপর ও বই পড়ছিলো। লাইটটা নিভালো কেনো? তাও কিছু বললো না। চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিজেও শুয়ে পড়ে।
অহমি মাহিদের দিকে পিঠ করে শুয়েছিল। মানে ছেলেটা অনুমতি না নিয়ে ডায়েরি পড়েছে, এখন অহমি সে বিষয়ে রাগ করেছে কিন্তু মাহিদ কি করলো! ও এখনও মানাতেও এলো না? ঘুমিয়ে গেছে নাকি? ঘাড় ঘুরিয়ে একবার মাহিদের দিকে তাকালো। ওমাহ ছেলে ওর দিকেই তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিল। অহমি চট করে আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে নিলো। মাহিদ চট করে ওকে পিছন থেকে ঝাঁপটে ধরলো। কানের পিছনে অধর ছুঁইয়ে ধীমে কণ্ঠে বলে, “রাগ তো করোনি, তাও কেনো এমন করছো?”
অহমি কণ্ঠে কৃত্রিম তেজ এনে বলে, “কে বলেছে রাগ করিনি?”
“আমি জানি আমার অহমিকা আমার সাথে রাগ করতেই পারে না।” আরো জোরে আঁকড়ে ধরলো।
অহমি দমে গেল। মাহিদ ওকে এতো ভালো করে বুঝে কি করে? মাহিদের সাথে মিশে রইলো। হঠাৎ মনে আসতেই বলে,
“আমার ডায়েরিগুলো আমাকে দিবেন না?”
“নাহ।”
“ওমাহ কেনো?” অহমি জোরালো কন্ঠে বলে উঠলো।
“ওই ডায়েরিতে লিখতে হবে না আর। এখন থেকে যা যা মনে আসবে, সব আমাকে বলবে। কোনো দু:খের কাহিনি লিখতে হবে না। সুখ-দুঃখ যে কথাই থাকুক না কেনো, আমাকে বোলো।”
অহমির মুখ কুচকে গেল।
“সব বলা যায় নাকি?”
“চাইলেই বলা যায়। আমি তোমার তালতো ভাই না যে বলা যাবে না।”
“আমার গল্পের ডায়েরি?”
“সেটা দিয়ে দিবো। কিন্তু একটা কথা দিতে হবে। কালকে আমার সাথে একবার আমার চেম্বারে যেতে হবে।”
অহমি মিনমিন করে বলে, “আচ্ছা সেটা করবো, কিন্তু প্লিজ ডায়েরিগুলো ফিরিয়ে দিয়েন৷”
“কিছুতেই না।”
“আপনি খুব খুব খারাপ।”
“হুম, সেটা প্রায় রাতেই শুনি। নতুন কিছু বলো।”
অহমি বেশ লজ্জা পেলো। মুখ দিয়ে শব্দ বের করতে পারলো না। মাহিদও আর শব্দ করলো না। একটার মতো বাজে। এখন আর বেশি কথা বাড়ানের মানে হয় না। চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।
__________________________________________
তার পরদিন অহমি মাহিদের সাথে গিয়ে বিভিন্ন সাইকোলজিক্যাল টেস্ট, ব্লাড টেস্ট করে এসেছিল। এবং মাহিদের পরবর্তী সন্দেহ সঠিক হয়। অহমির সিমটোমসগুলোকে ও বাইপোলার ডিসওর্ডার এর সাথে তুলনা করেছিল অতিরিক্ত মুড চেঞ্জ হয় বলে। অহমির বাইপোলার ডিসওর্ডার নেই, তবে ভিটামিন বি-টুয়েলভ এবং ভিটামিন ডি এর একত্রে ঘাটতি হওয়ার কারণে অতিরিক্ত মুড সুইং এর প্রবলেম হচ্ছনিয়মিত মেডিসিন নিলে এটা ঠিক করা যাবে। আর মাহিদ ডিসিশন নিয়েছে অহমিকে “টক থেরাপি বা সাইকোথেরাপি ” দিয়ে নিজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে সাহায্য করবে।
মাহিদ মাত্রই ওর চেম্বার থেকে ফিরেছে। রুমে ঢুকেই দেখতে পেলো অহমি বই পড়ছে। ওর অর্নাস ফাইনাল ইয়ারের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। তাই নিয়মিত সংসারের পাশাপাশি টুকটাক পড়াশোনাও করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । অহমি বই এর মাঝে এতটাই মনোযোগী অবস্থায় ছিল, মাহিদের উপস্থিতি টের পায়নি। মাহিদ ওয়ারড্রব থেকে টি-শার্ট আর টাউজার নিয়ে ধাম করে বাথরুমের দরজা লাগিয়ে দিলো। অহমি প্রায় লাফিয়ে উঠলো।
ডিভানের উপর রাখা কালো ব্যাগটা দেখে বুঝতে পারে মাহিদ
এসেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে এগারোটার মতো বাজে। সাধারণত মাহিদ বৃহস্পতিবার এতো দেরীতে তাড়াতাড়ি বাসায় আসে না। আজকে কেনো এলো? পেশেন্টের চাপ নেই নাকি? তারউপর ভদ্রলোক এমন রেগে আছে কেনো? মাহিদ বাথরুম থেকে বের হতেই অহমি মাহিদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মাহিদ অহমিকে পাশ কাটিয়ে বেলকনি থেকে টাওয়ালটা নিয়ে আসে। অহমির ভ্রু কুচকে যায়। এমন করছে কেনো?
অহমি বলে, “আপনি কি রেগে আছেন? ”
“নাহ!”
মানে রেগে আছে। অহমি মনে করার চেষ্টা করে সে তো কিছু করেনি। তাহলে এমন রেগে আছে কেনো? মাহিদ গিয়ে বিছানার উপর আধশোয়া হয় মাথার চুল মুছতে থাকে। অহমি মাহিদের টি-শার্টের হাতাটা টেনে বলে, “আচ্ছা, ডিনার করতে আসেন।”
মাহিদ অহমির হাত ঝাড়া মেরে সরিয়ে দেয়। রাগে ফোসফোস করতে করতে বলে, “তোমার সিফাতকে খাওয়াও।”
অহমি হতভম্ব হয়ে যায়। মাহিদ ওর দিকে রোষানল দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে।
“এই সিফাত আবার কে?” অবাক সুরে প্রশ্ন করে। মাহিদ আবারও রোষানল দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায়।
“আরেহ আমি আসলেই চিনি না।”
মাহিদ উত্তর দেয় না। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চুল মুছতে থাকে। অহমি হাত থেকে টাওয়ালটা কেড়ে দেয়। মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে,
“এই,, সিফাত কে? আমি চিনিও না।”
“মিথ্যা বলছো কেনো?”
“সত্যি! মিথ্যা বলবো কেনো?”
“অহমিকা ভুলে যেও না, তোমার আইডি আমার মোবাইলেও লগ ইন করা।”
“হ্যাঁ তো!”
মাহিদ খাটের পাশে থাকা ছোট্ট টেবিলটার উপর থেকে মোবাইলটা নিয়ে অহমির দিকে কড়া দৃষ্টি দিয়ে বলে, “তোমার পুরা নাম কি?”
অহমি অবাক। আজ মৃধা ওর জায়গায় থাকলে সিউর প্রশ্ন করতো, “আপনি কি ম*দ খাইছেন?না গা*জা?” তবে অহমি সোজাসাপ্টাই উত্তর দিলো, “অহমিকা তাজরীন।”
মাহিদ গ্রুপের মেসেজ কনভারসেশনে গিয়ে কি যেন সার্চ দিয়ে অহমির দিকে মোবাইল তাক করে বললো, “এখানে সাবিহা কেনো তাজরীনকে ট্যাগ দিয়ে বলবে’আজকে তোর ক্রাশ সিফাতকে দেখলাম’? এটা তো তুমিই না?”
অহমির ইচ্ছে হলো মাহিদের মাথায় একটা বাড়ি মারতে। তাও শান্ত দৃষ্টিতে মাহিদের দিকে তাকিয়ে ওদের গ্রুপটার পিপল ওপশানে গিয়ে সাতজনের গ্রুপটার সকলের নাম বের করলো। তারপর মাহিদের দিকে মোবাইল তাক করে বলে, “এইযে এখানে আমার নাম অহমিকা তাজরীন, আর আমার আরেকটা ফ্রেন্ডের নাম তাজরীন আহমেদ। সাবিহা সেই তাজরীনকে ট্যাগ দিয়েছে। আমাকে ওরা অহম বলেই ডাকে।”
চলমান…..