ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠা পর্ব-০৬

0
23

#ডায়েরির_শেষ_পৃষ্ঠা
#পর্ব_৬
#সমৃদ্ধি_রিধী

ছয়টা ডায়েরি তো একসাথে পড়া সম্ভব নয় তাই মাহিদ একটা ডায়েরি নিয়ে পড়া শুরু করেছিল। দুর্ভাগ্যবশত মাহিদ গল্প লিখার ডায়েরিটা পড়ে। মাহিদ অহমির লিখা গল্পগুলো পড়ে অবাকই হয়েছিল। মেয়েটার এমন সুপ্ত প্রতিভাও থাকতে পারে মাহিদ তা কল্পনাও করেনি। মাহিদ জীবনে একাডেমিক বই ছাড়া অন্য কিছু পড়েনি। এখনও কেবল নিজের পড়াশোনা, কাজ আর পেসেন্ট রিলেটেড জিনিসপত্রই পড়ে। আর এই মেয়ের লেখা সবকিছুই হাই কেয়ালিটির। এইজন্য অবশ্যই বেশ রিসার্চও করতে হয়েছে। প্রায় ওর দু’ঘন্টা মতো লেগেছে পুরো গল্পের ডায়েরিটা শেষ করতে। ডিনারের সময় হয়ে যাওয়ায় অন্য ডায়েরিগুলো পড়ার সময় পায়নি।

ডিনার শেষ হওয়ার পর মাহিদ রুমে এসে প্রথমে আলমারির কিছু অংশের জামাকাপড় এলেমেলো করে ফেললো। অহমির প্যান্টিং এর জিনিসপত্র থেকে রং একটু নিয়ে খাটের পায়ার কাছের ফ্লোরটায় মেখে নিলো। অহমির চুল ঝড়ে রুমের ফ্লোরে পড়ে থাকে বলে মাহিদ ওকে চুল আঁচড়ে ঝরে যাওয়া চুল একটা পলিথিনে ভরে রাখতে বলেছিল। অহমিও তাই করে কথা মতো। মাহিদ সেই পলিথিন থেকে কয়েকটা চুল নিয়ে বাথরুমের দেয়ালে, সাবানে রেখে দিলো। আহির ওকে অ্যাটেলোফোবিয়ার কথা বললেও মাহিদ নিজে তা পরীক্ষা করে দেখতে চায়। বাকিটা অহমির রুমে আসার পর দেখা যাবে। কিন্তু সাড়ে এগারোটা বাজার পরও যখন অহমি রুমে আসে না। মাহিদ এদিক থেকে ওদিক পায়চারি করতে থাকে। রুমের এই অবস্থা দেখে ওর গা খিটখিট করছে যেন। মাহিদ তাই কিচেন থেকে ধরে-বেঁধে অহমিকে আনতে গেল।

আর বাইপোলার ডিসওর্ডার আছে কিনা সেটা মাহিদ অহমির আচার-আচরণ দেখে পেশাগত অভিজ্ঞতা থেকে কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেও বাকিটা একদিন নিজের চেম্বারে নিয়ে ডিএসএম-ফাইভ, স্ক্রীনিং টুলস ব্যবহার করে সিউর হয়ে নিবে। আর যদি অহমির বাইপোলার ডিসওর্ডার না থাকে তবে ব্রেন টিউমার, ভিটামিন বি-টুয়েলভ এবং ডি এর ঘাটতির ফলে মুড চেঞ্জের প্রবলেম হতে পারো। অথবা হাই-থাইরয়েডের প্রবলেমও হতে পারে। টেস্ট করতে হবে। এইসবের লক্ষণও যেহেতু বাইপোলার ডিসওর্ডারের সাথে মিলে, তাই মাহিদ সিউরলি বলতে পারছে না অহমির এটা আছে নাকি নিছক ওর সন্দেহ।

__________________________________________________

অহমি ব্যবহৃত থালাবাসনগুলো ধুয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে চোখ বুজে সোফায় গা এলিয়ে দেয়। আজকেও মাথাটা চিনচিন করে ব্যাথা করেই যাচ্ছে। ঔষধ খেতেই হবে এমন অবস্থা।

“তুমি এখনও রুমে যাওনি যে?”

অহমি চোখ খুলে দেখতে পায় মুগ্ধ পানির বোতল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অহমি তো বলতে পারে না তোমার ভাই এর পল্টিবজির জন্য যাবো না।

“এইতো যাচ্ছি।”

মুগ্ধ ওর পাশে সোফায় বসে বলে, “তোমার কি শরীর খারাপ?”

“তেমন কিছু না, মাথা ব্যাথা করছে। ঔষধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে।”

“আরেহ ঔষধ খেতে হয় না। তুমি আইসক্রিম খেয়ে দেখো মাথা ব্যাথা পুরো গায়েব হয়ে যাবে। নিয়ে আসবো? ফ্রিজে আছে এক বক্স।”

অহমি স্মিত হেঁসে বলে, “লাগবে না। তাছাড়া কালকে হোস্টেলে চলে যাবে। এখন এতকিছু করতে হবে বা। গিয়ে ঘুমিয়ে পরো।”

মুগ্ধ চোখ-মুখ কুঁচকে বলে, “উফ তুমি খেলে আমিও খেতাম।”

“এই না। হোস্টেলে গিয়ে ঠান্ডা-কাশি বাঁধানোর দরকার নেই। ঘুমচাপ গিয়ে ঘুমাও।”

“মুগ্ধ ঘুমাতে যা।”

হঠাৎ মাহিদের কণ্ঠস্বর শুনে মুগ্ধ আর অহমি দুইজনই চমকে উঠে। মাহিদের কণ্ঠে অত্যন্ত গাম্ভীর্যের ছোঁয়া ছিল। সচারাচর মাহিদ এতোটা ক্ষুব্ধ থাকে না। মুগ্ধ তাই কিছু না বলে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। হাসি-ঠাট্টার সম্পর্ক হলেও মুগ্ধ ভাইকে ভালোই ভয় পায়।

“অহমিকা তুমিও রুমে এসো।” অহমিও দিরুত্তর না করে মাহিদের পিছন পিছন রুমে প্রবেশ করলো। মাহিদ দরজা লাগিয়ে মুখটা যথাসম্ভব কঠিন করে বলে, “তোমাকে আমি কতোবার বলেছি রুম সবসময় গুছিয়ে রাখতে? তাও এমন অগোছালো হয়ে থাকো কেনো?”

প্রথমত মাহিদ এমন কড়া সুরে সেই গাজীপুরের ঘটনার পর একবারও কথা বলেনি। দ্বিতীয়ত, ও তো রুম গুছিয়েই রাখার চেষ্টা করে। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে অবাক হয়ে সুধায়, “রুম তো গুছানোই। জায়গার জিনিস জায়গা মতোই রাখা।”

মাহিদ এবারও বেশ কড়া সুরে অহমির হাত টেনে আলমারির কাছে নিয়ে অগোছালো হয়ে থাকা জামাকাপড় দেখিয়ে বলে, “তাহলে এগুলোর এই অবস্থা কেনো?কাপড়চোপড় এভাবে রাখা আমার পছন্দ নয় জানো না?”

অহমি অবাক হয়ে বলে, “আমি এগুলো সত্যিই করিনি। তাছাড়া কালকেই তো সবকিছু গুছালাম।”

“তাহলে আমি করেছি? তোমাকে ইচ্ছা করে দোষ দিচ্ছি? ”

অহমির মুখটা কালো হয়ে গেল। ধীমে কণ্ঠে বলে, “আচ্ছা আমি গুছিয়ে রাখবো।”

“সে নাহয় গুছাবে, ফ্লোরের রং এর দাগ, সবান, দেওয়ালে যে চুল লাগানো সেগুলো কে করবে?”

অহমি আনমনে বলে ফেললো, “আচ্ছা আমি এখনই সব ঠিক করে দিচ্ছি।”

তবে অহমির পুরোটা সময় মনে হচ্ছিলো ও তো সবকিছু ঠিকঠাক করেই রেখেছিল। কিন্তু কনফিডেন্সের সাথে বলতে পারেনি। অহমি পুরোটা সময় ভ্রু কুচকে কাজ করতে লাগলো। সাবানে চুল লাগার বিষয়টাতে ওর বেশি সন্দেহ হচ্ছিলো। আবার ভাবলো ভুলে কোনো কারণে মনে হয় করে ফেলেছিল। কিন্তু প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করার কারণে আর বেশি একটা ঘাটলো না বিষয়টা।

মাহিদ তখন বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে। ও অহমির সব আচরণ, গতিবিধি বেশ সুক্ষ্ম চোখে পর্যবেক্ষণ করছিলো। অহমি কাজগুলো শেষ করে টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছে রুমে এসে বিছানায় বসতেই মাহিদ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে উঠে,” তুমি একটা কাজও ঠিকঠাক করতে পারো না। পারফেকশন নামে কোনো ওয়ার্ডই তোমার কাছে নেই। এইযে বিছানায় ভিজা টাওয়ালটা রাখলে চাদরটা ভিজে গেলো না?”

অহমির গলা মনে হয় চেপে ধরলো। হাত-পা গুলো ঠান্ডা হয়ে গেলো। একেই তো প্রচন্ড মাইগ্রেনের ব্যাথা। তারউপর মাহিদের এমন কথা। গা কাঁপতে কাঁপতে বিছানার কিনারা থেকে ফ্লোরে পড়ে গেলো। মাহিদ নিজের বিস্ময় প্রকাশ করার অবকাশটুকুই পায়নি। “ওওহ শিট!” বলে দৌড়ে অহমিকে ফ্লোর থেকে টেনে তুলে। অহমির চোখ দুটো শান্ত, নিষ্প্রাণ। কেবল চোখের কিনারায় পানি চিকচিক করছে।

__________________________________

দুপুর ২টা। লাঞ্চ আওয়ার। মাহিদ আজ লাঞ্চের জন্য খাবার আনেওনি আর ক্যান্টিনেও যাচ্ছে না। হসপিটালের ক্যাবিনের ডেক্সের উপর রাখা পেপারওয়েট’টার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পাশেই স্তুপ আকারে অহমির ডায়েরিগুলো রাখা। মাহিদ ওগুলো সবগুলো পড়েছে। এবং ওর অনেক বেশি রিগ্রেট হচ্ছে অহমির ব্যাপারে পুরো সবটা না জেনে গতকালকের স্টেপটা নেওয়া। সাধারণত ওরা পেসেন্টের ফ্যামিলি মেম্বার বা খোদ পেসেন্ট থেকেই তাদের সম্পর্কে আগে জেনে তারপর ট্রিটমেন্ট করে। কিন্তু অহমির ব্যাপারে নিজে থেকে পরীক্ষা করতে গিয়ে এই কাজটা করলো।

অহমিকে কালকে রাতে মেডিসিন দিয়ে কেনো রকম ঠিক করে মাহিদ ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু মেয়েটা সকাল থেকে একবারও তার সাথে কথা বলেনি। অনেকবার চেষ্টা করেও অহমির মুখ থেকে একটাও শব্দ বের করতে পারেনি। এমন অ্যাটাকের কারণ প্রথমে না বুঝতে পারলেও ‘অহমিকার ডায়েরির বিভিন্ন পৃষ্ঠা’ নামক শিরোনাম দেওয়া ডায়েরিটা পড়ার পর মাহিদের নিজের প্রতি ভীষণ রাগ হচ্ছিলো। দুই হাত দিয়ে মাথার চুল ধামছে ধরলো। এমন সময় কেউ ক্যাবিনের দরজায় দুবার নক করলো। মাহিদ ডেক্সের উপর থেকে মাথা না তুলেই বলে, “কাম।”

“অহমের কি অবস্থা? ” আহির মাহিদের মুখোমুখি চেয়ারে বসতে বসতে প্রশ্ন করলো।

মাহিদের দৃষ্টি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিলো। তেছড়া কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, “আপনার ভাই হিসেবে লজ্জা হয় না?”

“মানে?”

“আপনি, আপনার সো ক্লড দাদি, ফুফু কিভাবে ভাবতেন আপনার বাবা মারা যাওয়ার জন্য অহমিকা দায়ী? আমার ধারনা যদি সঠিক হয় তবে আপনাদের জন্য অহমিকা এখন কমরবিডিটির মতো প্রবলেমে ভুগছে।”

“কমরবিডিটি?” আহিরের কণ্ঠে বিস্ময়। “দুটো প্রবলেম একসাথে?”

“ইয়েস। একটা অ্যাটেলোফোবিয়া আরেকটা আমি সন্দেহ করছি বাইপোলার ডিসওর্ডার। যদিও কেনো যেন বাইপোলার ডিসওর্ডার না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি মনে হচ্ছে, তাও আমি চেক করবো। ”

“বাইপোলার ডিসওর্ডার?”

“সিউর না, সন্দেহর বশে কিছু বলতেও পারছি না।”

আহিরের মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। অ্যাটেলোফোবিয়ার কথা আন্দাজ করেছিল। কিন্তু ও সাইক্রিয়াটিস্ট না, সার্জন হওয়ায় এইসব খুব গভীরভাবে বুঝতে পারেনি।

“আপনার দাদি, ফুফু ওরা সেকেলে, আপনিও কিভাবে অহমিকার সাথে এমন আচরণ করতেন? অযথাই মারতেন, নিজে বই খাতা ছিড়ে ওর নাম দিয়ে মায়ের হাতে মার খাওয়াতেন? সকালে খেতে দিতেন না? দুপুরে খাবারে পানি ঢেলে দিতেন? মে মাসের তীব্র গরমে স্কুলে আসা-যাওয়া করার ভাড়া দিতেন না? ওর ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত এমন করেছেন?”

“আমি তখন ছোট ছিলাম মাহিদ। আর দাদি আমাকে যা করতে বলতো তাই করতাম আমি। ”

“প্লিজ আর নিজের দোষ ঢাকতে যাবেন না। অহমিকার ক্লাস ফাইভ মানে আপনি এসএসসি পরীক্ষার্থী। এতোটাও ছোট না যে ছোট বোনের সাথে কেমন বিহেব করতে হবে বুঝতেন না।”

“তুমি আমাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে না জেনে কথা বলতে পারো না।”

“আপনার থেকেও ডিফিকাল্টি আমি ফেস করেছি। আমার এডমিশানের মতো এতো বড় একটা টাইমে আমার বাবা সেকেন্ড ওয়াইফ নিয়ে বাসায় আসে। তখন মুগ্ধর মাত্র দশ কি এগারো বছর। বাবা-আম্মির সেপারেশন হয়। আপুর গ্রেডুয়েশান কমপ্লিট হয়নি। আমাদের খুব ভালো অবস্থা ছিল না। তাও আমরা পরিবারের কাউকে পরিস্থিতির অযুহাত দিয়ে ফেলে যায়নি। ” “হাহ অহমিকার ডায়েরি না পড়লে এমনও পরিবার, ভাই হয় তা জানতেও পারতাম না।”

মাহিদ নিজের কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। আজকে অনেক
অয়েন্টমেন্ট আছে। আবার আজকেই অহমির এমন অবস্থা। অন্যদিকে আহির সন্দিহীন আসলেই কি ওর দোষ আছে? ওর দাদি ওকে অনেক স্নেহ করতো, তাই যা বলতো তাই তাই করতো। এতোকিছু ভাবেনি কখনো। বোনের প্রতি অনেক বেশি অন্যায় করে ফেললো না? কিন্তু পরে তে অহমির সাথে স্বাভাবিক হওয়ার অনেক চেষ্টা করেছে। অহমির পছন্দের অনেক কিছু করে দিতে চেয়েছে। সর্বোচ্চ খেয়াল রাখার চেষ্টা করেছে। ভাই হিসেবে পরবর্তীতে করা অন্যায়ের শাসন করাও কি ভুল ছিল।
_______________________________

মাহিদ সচারাচর বাসায় ফিরে রাত সাড়ে দশটার মধ্যে। কিন্তু আজকে ফিরতে ফিরতে সাড়ে এগারোটা বেজে গেল। জ্যামে বসে থাকতে হয়েছে অনেকক্ষণ। এক্সট্রা চাবি দিয়ে বাসায় ঢুকেই আবহাওয়া খুব শান্ত দেখলো। ফিরোজা বেগম ঘুমিয়ে পড়েছেন। ওনার রুমের লাইট অফ। এমনকি মাহিদের রুমের লাইটও অফ। অহমি তো এতো তাড়াতাড়ি ঘুমায় না।

মাহিদ রুমে গিয়ে আগে লাইট জ্বালালো। রুমে চোখ বুলাতেই দেখে ওয়াড্রবের সামনে হাঁটুতে মুখ গুঁজে অহমি বসে আছে। মাহিদের পিলে চমকে উঠলো। ও দৌড়ে অহমির কাছে গিয়ে অহমির মাথাটা তুলে মুখটা আগলে ধরলো। চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। মাহিদের প্রচন্ড খারাপ লাগে। কিছু কথা বলতে চায়।

“অহমিকা লু……”

শেষ করতে পারে না। তার আগেই অহমি মাহিদের শার্টের কলার খামছে ধরে। একই সাথে মাহিদের গলার কাছটার চামড়ার ছিলে যায়। অহমি মাহিদের কলার ঝাঁকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আপনি কোন সাহসে আমার ডায়েরিতে হাত দিয়েছেন? আপনাকে আমি কোনো অধিকার দেয়নি আমার ডায়েরিতে হাত দেওয়ার। কেনো করেছেন?”

চলমান….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে