#ডায়েরির_শেষ_পৃষ্ঠা
#পর্ব_৫
#সমৃদ্ধি_রিধী
মাহিদের আচমকা কি হলো কে জানে! অহমির হাতে টান মেরে নিজের খুব সন্নিকটে আনে। অহমি মাহিদের বুকে আঁচড়ে পরে। ভারসাম্য রক্ষার্থে অহমি মাহিদের বুকে হাত রাখে। মাহিদ অহমির চোখে চোখ রেখে বলে , “যে মানুষটা এখন থেকে সম্পুর্ন আমার, যার জীবনের সাথে আমার নাম ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িয়ে গেছে তার হাতে শুধু শুধু নাম খুঁজে পাওয়া বা না পাওয়ায় কি লাভ অথবা ক্ষতি হবে অহমিকা আতহার হুসাইন?”
মাহিদের চোখে-মুখে অন্য আভাস। অহমি আর তাকাতে পারলো না ওই চোখের দিকে। সন্তপর্ণে চোখ বুজে নিলো।
______________________________________________
মাহিদ ভীষণ ফিটফাট মানুষ। ও সবসময় সবকিছু গুছিয়ে রাখার চেষ্টা করে। মেঝেতে সামান্য একটু দাগ লেগে থাকলেও বিরক্তিতে ওর চোখ-মুখ কুচকে যায়। আলমারিতে সারি সারিভাবে তার শার্ট, টি-শার্ট গুছানো থাকে। একটাও আগুপিছু অবস্থায় থাকে না। বিছানার চাদর সবসময় টানটান অবস্থায় থাকে।
অহমি ভেবেছিলো মাহিদের সাথে ওর পরবর্তী দিনগুলো খুব ভালো যাবে। কিন্তু শুধুমাত্র রুম অগোছালো অবস্থায় ফেলে রাখার জন্য ও দু-তিনবার মাহিদের কাছে ঝাড় খেয়েছে। অহমি বুঝতে পেরেছে মাহিদ মানুষটা খারাপ না,ওর সবকিছু ঠিকঠাক। শুধু একটু অগোছালো অবস্থায় থাকলেই ওকে ঝাড় খেতে হয়। অহমি নিরানব্বই পয়েন্ট নাই নাই পার্সেন্ট সিউর মাহিদের ওসিডি আছে।
এই বাসায় অহমি মাহিদ ছাড়াও মাহিদের মা আর ওর ছোট ভাই মুগ্ধ রয়েছে। প্রথমেই আসি মাহিদের মায়ের ব্যাপারে। উনি সবসময় সবকিছু পারফেক্টলি করতে চান। মাহিদ যেন পুরোপুরি তার মায়ের স্বভাবই পেয়েছে। উনি চটপট কিভাবে যেন সব কাজ একা হাতে করে ফেলেন। এই কয়দিন অহমিও চেষ্টা করছে ওর শ্বাশুড়িকে টুকটাক সাহায্য করতে। কিন্তু ওর কাজ যে মাহিদের মা ফিরোজা বেগমের খুব একটা পছন্দ হয় না ও তা ভালো ভাবেই বুঝতে পারে। তবে তিনি অহমির কাজগুলোকে শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করে। অহমিও শ্বাশুড়ির কথা মতো কাজ করার চেষ্টা করে। পাছে ওকে যাতে কথা না শুনতে হয়। আর মুগ্ধ, ও অবশ্য হোস্টেলেই থাকে। কলেজ থেকে ওদের বাসার দূরত্ব বেশি হওয়ার কারণে এই অবস্থা। এইযে ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে এসেছিল, কালকেই আবার হোস্টেলে ফিরে যাবে। আর মাহিদের বড় বোন বিয়ে করে স্বামীর সাথে ‘কেএসএ’তে স্যাটেল। দুইবার ভিডিওকলে কথা বলেছিল ওনার সাথে অহমির।
বাসার সকল কিছু বুঝতে অহমির সময় লেগেছে ১৫ দিন। হ্যাঁ আজকে ওদের বিয়ের পঞ্চদশতম দিন। তবে বর্তমানের সমস্যা হচ্ছে মাহিদের সামনে থাকা চটপটে অহমি আবারো গুমরে যাচ্ছে। সবসময় আবারো নিজেকে পারফেক্টশনের খোলসে আবদ্ধ রাখতে চেষ্টা করছে। যদি এমন হতো এখানে আসর পর ও কারো কাছে কোনো প্রকার অভিযোগ শুনতো না, তবে হয়তো প্রফুল্লভাবে থাকতে পারতো। ফিরোজা বেগমের মাঝেমধ্যের বিরক্তিকর চাহুনি, মাহিদের ঝাড় খেয়ে ও আবারো বিষন্নতায় ভুগছে। কিন্তু যেটা প্রকাশ করছে না।
____________________________________________________
মাহিদ একজন সাইক্রিয়েটিস্ট। বিয়ের আগে অহমির সাথে কথা বলার সময় ওর কিছু অদ্ভুত না লাগলেও ওকে যত সামনে থেকে দেখছে মাহিদ নিরানব্বই শতাংশ সিউর অহমির ‘বাইপোলার ডিসওর্ডার’ বা ‘দ্বিমেরু বিকার’ রয়েছে। অর্থাৎ, এতে একজন মানুষ কখনো অত্যন্ত উৎফুল্ল থাকে, আবার কখনো গভীর বিষণ্নতায় চলে যায়। তারা কিছু কিছু মানুষের সাথে মন খুলে কথা বলে আবার কিছু মানুষের সাথে ফ্রি হতেই পারে না। বিয়ের প্রথম দুই তিন দিন অহমি হাসি-খুশি থাকলেও লাস্ট তিন-চার দিন এই গুমরে থাকছে, তো কিছুক্ষণ পর নরমাল হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া মাহিদকে তো আহির অহমির অ্যাটেলোফোবিয়ার কথা আগেই বলেছিল।তাও ও একবার চেক করে দেখবে। সেই হিসেবে ওর দুইটা ডিসওর্ডার একইসাথে আছে। দ্যাসট মিন “কমরবিডিটি।”
মাহিদ পিঠে বালিশ ঠেকিয়ে বিছানায় আধশোয়া অবস্থায়। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে অহমির ব্যাপারেই ভাবছিলো। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো। এই শুক্রবার দুপুরে কি রোদ টাই না ছিল।সন্ধ্যা হওশার সাথে সাথপ আবহাওয়াটা একটু শীতল হলো মনে হচ্ছে। মাহিদ ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুমন্ত অহমির দিকে তাকালো। মেয়েটা যে দুপুরে ভাতঘুম দিয়েছিল এখনো উঠার নাম গন্ধ নেই। তারউপর অহমি খুবই এলোমেলো ভাবে ঘুমায়। গায়ে কাঁথা থাকে না অথচ ঠান্ডায় কুঁকড়ে থাকে। মাহিদ অহমির মাথায় হাত বুলিয়ে পরপর দুইবার ডাকে।
“হুম উঠবো,” ঘুমঘুম কণ্ঠে বলে আবারও ঘুমিয়ে পড়ে।
মাহিদ গায়ের জোড় খাটিয়ে অহমিকে আধশোয়া করে বসায়। অহমি হকচকিয়ে উঠে ।
“রিল্যাক্স! তোমার দুপুরে ঘুমুলে ঘুম ভাঙ্গে না, কিন্তু রাত ঘুম কেনো হয় না? হ্যাঁ?
অহমির চোখ থেকে তখনোও পুরোপুরিভাবে ঘুম কাটেনি।ঘুমে তখনো ঢুলছে।চোখ পিটপিট করছে। মাহিদ বাম হাত বাড়িয়ে অহমিকে ডাকে,”এদিকে এসো।”
অহমি মাহিদের বুকের উপর মাথা রেখে আবারও চোখ বন্ধ করে ফেলে। মেয়েটার ঘুম কাটেনি এখনো। মাহিদ হাত বাড়িয়ে অহমির চুলগুলো গুছিয়ে দিতে থাকে। আস্তে ধীরে বলে, “যাও ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নাও।”
“একটু পরে। প্লিজ।” মাহিদকে ঝাপটে ধরে বলে।
মাহিদ অহমির হাত ছড়িয়ে নিতে নিতে বলে,” অহমিকা আর একটুও পরে না। তুমি অনেকক্ষণ ধরে ঘুমাচ্ছো। তোমার সাথে ঘুমিয়েও আমি আরো ঘন্টাখানেক আগে ঘুম থেকে উঠেছি। যাও। আমি কিন্তু সব কাজ টাইম টু টাইম করা পছন্দ করি।”
“আর পাঁচমিনিট প্লিজ”
মাহিদ এবার যথাসম্ভব কড়া গলায় বলে, “আহমিকা! তুমি আমার কথা শুনবে না, না?”
অহমির আর সাধ্য কোথায় প্রস্তাব নাকচ করবার?
“দূররর!” অহমি উঠে বাথরুমে চলে যায়। মাহিদ পিছন থেকে চিল্লিয়ে বলে, “প্লিজ অহমিকা বাথরুমের সাবানে যাতে চুল লেগে না থাকে। আমার ওইটা সহ্য হয় না। ”
________________________________________
মুগ্ধ ভাবির কাছে আবদার করেছিল মোমো খাবে। যেহেতু মুগ্ধ কালকেই চলে যাবে তাই অহমিও বানিয়ে দিতে রাজি হয়। কিন্তু অহমি মোমো বানাতে পারে না বলে ফিরোজা বেগম ওকে দেখিয়ে দিচ্ছে কিভাবে কি করতে হয় না করতে হয়। ফিরোজা বেগম মোমোর ডো তৈরি করছিলেন আর অহমি মাংসটা রান্না করছিল। মাহিদ এমন সময় রান্নাঘরে এসে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে, “আম্মি এক কাপ চা দিও তো।”
আড়চোখে একবার অহমির কালো হয়ে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মুগ্ধ ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিলো। মাহিদও মুগ্ধর পাশে বসে মুগ্ধর হাত থেকে রিমোটটা কেড়ে নেয়। মুগ্ধ তেতিয়ে উঠে।
“কি সমস্যা ভাই? আজকে টিভি দেখতে দাও। কালকে হোস্টেলে গেলে তো আর দেখতে পাবো না।”
মাহিদ সে কথায় পাত্তা না দিয়ে রান্নাঘরের দিকে ইশারা দিয়ে বলে, ” তোর ভাবির মুখ এমন কালো হয়ে আছে কেনো?”
ড্রয়িংরুমের সে জায়াগাটা থেকে রান্নাঘর পুরোপুরিভাবেই দেখা যায়।
“ভাবি ফ্রিজ থেকে মুরগি যে পলিথিনে রাখা ছিল , সেই পলিথিনটা বের করে আম্মি থালাবাসন ধুয়ে যেপাশে রাখে সেইপাশে রেখেছিল। এরপর আম্মি ভাবিকে বকেছে। সেই থেকেই ভাবির মুড অফ।”
এরপর মাকে ব্যাঙ্গ করে বলে, “অহমি তোমাকে কতবার বলেছি থালাবাসনের জায়গায় অন্য কিচ্ছু রাখবে না? এতদিন বলার পরও ভুল হয় কি করে?”
মাহিদ ভ্রু কুচকে বলে, “আম্মির শুচিবায়ুর স্বভাবটা তো দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে।”
মুগ্ধ মাহিদের গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রিমোটটা কেড়ে নেয়। বলে, “লুক হুউস টকিং।”
মাহিদ চেঁচিয়ে উঠে “ইয়ু বারিশ!! গায়ে কি গন্ধ!! গোসল করিস নি? ছিহ!”
__________________________________________________
মাহিদ রুমে এসে গায়ে আচ্ছা মতো বডি স্প্রে মারে। এমন সময় অহমি রুমে এক কাপ চা নিয়ে প্রবেশ করে। মেয়েটার চোখ-মুখ অসম্ভব আঁধার হয়ে আছে। চা টা ওয়াড্রবের উপর রেখে রুম থেকে বের হতে নিলেই মাহিদ ওর হাত ধরে আকটায়। দরজাটা ভিতর থেকে চাপিয়ে দিয়ে অহমিকে আকড়ে ধরে। অহমির পিঠ গিয়ে ঠেকে মাহিদের বুকের সাথে। মাহিদ অহমির কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে প্রশ্ন করে, ” মন খারাপ?”
অহমি উত্তর দেয় না। মাহিদ ওর সকল আচরণ লক্ষ্য করে। মাহিদের সন্দেহের সাথে অহমির সব আচরণ মিলে যাচ্ছে। মাহিদ আবারও প্রশ্ন করে, “মন খারাপ বউ?”
অহমি মাথা নেড়ে ‘না’ বুঝায়। মাহিদ অহমির ডান গালে অধর ছুঁয়ে বলে, “এখনোও মন খারাপ?”
অহমি মাহিদের চোখে চোখ রেখে আবার মুখ ঘুরিয়ে ফেলে। মাহিদ এবার অহমির বাম গালে পরপর কয়েকবার অধর ছুঁইয়ে আবারও প্রশ্ন করে, “এখনো মন খারাপ বউ?
অহমির অধর কোণে হাসি ফুটে উঠে। চোখ বন্ধ করলেই যেন অহমির সামনে হাজারো প্রজাপ্রতি উড়াউড়ি করছে। কথা ঘুরাতে বলে, “আপনি এই অসময়ে গায়ে এভাবে পারফিউম দিয়েছেন কেনো?”
মাহিদ অহমির কথা ঘুরানো বুঝেও অহমিকে ছেড়ে চায়ের কাপটা নিয়ে এক চুমুক দিয়ে কাপের দিকে ইশারা দিয়ে বলে, ” খাবে?”
অহমি মাথা নাড়িয়ে না বুঝায়।
“তাহলে স্বামীর সাথে ভর সন্ধ্যাবেলা রুমের দরজা আটকে যে থাকছো লজ্জা করছে না? যাও গিয়ে রান্নাঘরে শ্বাশুড়ির সাথে হাতে হাতে কাজ করো।”
অহমি হা করে থাকে । এভাবে কে পাল্টি খায় ভাই? নিজেই তো ধরে বেঁধে আটকে রেখেছিল।অহমি গাল ফুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আসবেই না আজ রুমে। অহমি রুম থেকে বের হতেই মাহিদ তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে ফেলে।ঘুমের ভান করে মাহিদ এই নিয়ে চারবার অহমিকে রাতে রাতে ডায়েরি লিখতে দেখেছে। কাল রাতে সুযোগ বুঝে ডায়েরিগুলো কোথায় রাখে সেটাও দেখে নিয়েছে। আলমারি খুলে অহমির কাপড়ের ভাজ থেকে ডায়েরিগুলো বের করে। হিসেবে মোট ছয়টা ডায়েরি।হয়তো আরো আছে। আগের বাসায়। সেগুলোও কালেক্ট করতে হবে। এইসব থেকে যদি ওর সিমটোমস আরো ভালো বুঝতে পারে। ট্রিটমেন্টটাও যে দ্রুত করতে হবে।
চলমান…….