ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠা পর্ব-২+৩

0
37

#ডায়েরির_শেষ_পৃষ্ঠা
#পর্ব_২_৩
#সমৃদ্ধি_রিধী

অহমি বেশ অবাক হলো। অগোছালো সে ঠিক আছে! কিন্তু তা মাহিদ কি করে জানলো? ও তো বেশ পরিপাটি হয়েই বাইরে বের হয়। তবে অহমি সবচেয়ে বেশি অবাক হলো পরের কারণটা শুনে।

-“তোমার নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাই নেই।”

অহমির চোখের পাতা যেন কেঁপে উঠলো। মাথা নিচু করে ফেললো। অহমি বুঝতে পারলো ওর ভাইয়া আর আম্মুর কথায় বিয়ে করতে চাওয়ার কথার পরিপেক্ষিতে লোকটা এই কথা বলেছেন। ও মনে মনে কিছু কথা সাজিয়ে ফেললো। ধীমে কন্ঠে বললো – “আব..আসলে বিষয়টা তেমন নয়, আমি
ভাইয়া আর আম্মুর কথার অবাধ্য হতে চাইনা। ওরা আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছে। আমি চাইছি না ওনাদের কথার অবাধ্য হয়ে ওনাদেরকে আরো কষ্ট দিতে। এর বাইরে কিছুই না। ”

মাহিদ এই প্রসঙ্গে আর কিছু বললো না। তবে ওর বিচক্ষণ চোখ যেন ধারনা করতে পারলো অহমিকা নামক মেয়েটির মধ্যে কেমন একটা চোরা চোরা হাবভাব রয়েছে। নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাওয়ার প্রবণতা। যখন ও আহিরের কাছে পড়তে যেতো তখনও দেখতো মেয়েটা ভীষণ গুমরে থাকে।

তখনই ওয়েটার স্যান্ডউইচ, কফি নিয়ে আসে। অহমি কিছুক্ষণ নিজের স্যান্ডউইচের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে আচ্ছা মতো গালিগালাজ করতে থাকে ক্যাফের মালিককে। এই এগারোটা বারোটা নাগাদ এটা ক্যাফেতে রাখতেই হলো!!

-“খাচ্ছো না যে?”

অহমি অপ্রস্তুতভাবে হেসে বলে- “এই যে খাচ্ছি,” সাথে সাথেই স্যান্ডউইচে একটা বাইট দেয়। মাহিদের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসার চেষ্টা করে। অহমির মুখটা যেন বিষিয়ে গেছে। ছিহ! কি বাজে স্বাদ। মাহিদ এহেন ব্যবহারের কিছুই বুঝলো না। একপর্যায়ে নিজের মতো খেতে খেতে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে-“অহমিকা! আমি তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

-“হ্যাঁ বলুন।”

-“তুমি সিউর বিয়েতে তোমার কেনো আপত্তি নেই? কেউ জোর করছে না তো?”

-“নাহ, আমি মন থেকেই চাইছি। ”

-“তবে ঠিক আছে। মন থেকেই যখন চাইছো তাহলে আশা করি নিজেকে সেইভাবেই বিয়ের জন্য প্রস্তুত করবে। কারণ আমি একবার এই সম্পর্কে এগিয়ে গেলে সেখান থেকে পিছানোর আর কোনো সুযোগ নেই। ইভেন তুমি চাইলেও না।”

অহমি সেই মূহুর্তে ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। মাহিদের কথায় কোথাও একটা প্রবল অধিকারবোধ ছিলো। তাছাড়া ও এতটুকু সময়ে খুব ভালোভাবেই একটা জিনিস বুজতে পেরেছে তা হলো মাহিদ খুবই দৃঢ়তার সাথে নি:সংকোচে কথাবার্তা বলেন। অন্যদিকে অহমি এই পর্যন্ত নিজের ব্যক্তিগত সময় ছাড়া বাকি সময়টা বড্ড ভয়, আত্মগ্লানিতে কাটতো। ইতিমধ্যে তাদের খাওয়া-দাওয়াও শেষ। অহমি মাত্রই মাহিদকে একটা প্রশ্ন করতেই যাবে সেই মুহুর্তে মাহিদের ফোন বেজে উঠলো। মাহিদ একবার অহমির দিকে তাকিয়ে কলটা রিসিভ করে। ওকে ইমারজেন্সি থাকায় তখনই হসপিটালে যেতে হবে। অবশ্য যাওয়ার আগে ওকে রিক্সায় তুলে দিয়েও গেছে। এবং বাসায় পৌঁছে মাহিদকে টেক্সট করে জানিয়ে দিতে বলে। এইসবের মাঝে অহমির আর প্রশ্নটা করা হয়ে উঠলো না।

___________

অহমি বৈশাখের কাঠঠোকরা রোদ মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরলেও মনের মধ্যে এক অন্যরকম প্রশান্তি কাজ করছিলো। আজকের কথাবার্তায় যা বুঝলো মাহিদ বেশ কেয়ারিং একটা ছেলে। আফরোজা বেগমও তখন মাত্রই স্কুল থেকে ফিরেছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরতে উনি কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তবুও এতে কি সংসার চলে? অহমির ফুফু, মামা, চাচারাও কিছুটা দিয়ে সাহায্য করতেন। কিন্তু এখন আহির মোটামুটি স্টেবল হওয়ায় আর কারো সাহায্য নিতে হয় না।

মেয়ে ঘরে ফিরার পর থেকে আফরোজা বেগম এই নিয়ে পাঁচবার মেয়েকে মাহিদের ব্যবহার-আচার-আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করেছে। তিনি মেয়েকে এই বলেও আশ্বাস দিয়েছেন অহমির যদি কোনো কারণে মাহিদের কোনো আচরণ ভালো না লাগে, মাহিদের কথাবার্তা যদি ভালো না হয় তাহলে তিনি এমন ছেলের কাছে মেয়েকে পাত্রস্থ করবেন না। অহমি মায়ের এমন কথা শুনে নিরবে হাসে। মাহিদকে বিয়ে করতে কোনো প্রকার আপত্তি নেই তাও বলে।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে অহমি ভাতঘুম দিয়ে ঘুম থেকে উঠতে উঠতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো। ফ্রেশ হয়ে বেলকনির দরজাটা বন্ধ করে দিলো৷ নাহলে এখন মশার উপদ্রবে রক্ষা পাওয়া যাবে না। রং-তুলি নিয়ে আবারও মেঝেতে বসলো। পরীক্ষার জন্য অনেদিন আঁকাআঁকি করা হয়ে উঠেনি। রেফারেন্সের জন্য পিন্টারেস্টে ঢুকার জন্য মোবাইলটা হাতে নিয়েই চমকে উঠলো। মাহিদের চারটা মিস কল। মনে মনে ভাবে, “আল্লাহ আমি তো বাসায় পৌঁছে জানাতেই ভুলে গেছি।”

অহমি ভয়ে ভয়ে মাহিদকে কল করলো। কালরাতে আহিরই নাম্বারটা সেভ করে দিয়েছে। অহমি ভাবলো কল করবে। পরে কল না করে মেসেজ দিয়ে রাখে, “আমি আসলে বাসায় আসার পর আপনাকে জানাতে ভুলে গিয়েছিলাম।”
মেসেজ পাঠানোর পরক্ষণেই ভাবে – ‘মেসেজ পাঠানো কি ঠিক হয়েছে? কল করেই তো বলা যেতো! আচ্ছা থাক বলবো মোবাইলে টাকা নেই।’

অহমি আর কিছু না বলে রং-তুলি নিয়ে ওর কারুকাজ শুরু করে। একটা টি-শার্টে অনেকদিন যাবত স্ট্রেরি নাইট আঁকার প্লেন করেছিলো। আজ সময় সুযোগ বুঝে তা নিয়েই বসলো। ওর আর্ট প্রায় শেষের দিকে। এমন সময় আফরোজা বেগম হাতে তেলের বাতি নিয়ে প্রবেশ করে। উনি প্রায়ই মেয়ের চুলে তেল দিয়ে দেন। অহমির চুল বেশি বড় না হলেও তুলনামূলক ভাবে ঘন। মেয়ের পিছনে বসে এলোমেলো করে রাখা খোঁপাটা খুলে মাথায় তেল ম্যাসাজ করে দেয়। অহমিও রং তুলি সাইডে রেখে শান্তিতে মায়ের কোলে মাথা এলিয়ে দেয়।

আজরোজা বেগম মাথা আঁচড়ে দিতে দিতে বলে, “মাহিদ আমাকে বিকেলে কল করেছিল।”

অহমি চমকে উঠে। বলে, “তোমাকে? কেনো?”

“তোমাকে কল করে পাচ্ছিলো না, তাই আমাকে কল করেছে। তুমি তখন ঘুমাচ্ছিলে, সেটা ওকে বলতেই বললো তোমার সাথে পরে কথা বলে নিবে। ”

“ওহ, আসলে আমাকে বলেছিলেন বাসায় ফিরে ওনাকে জানাতে। তোমার সাথে কথা বলতে বলতে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। তাই হয়তো তোমাকে কল করেছ। আমি মেসেজ দিয়ে রেখেছি সমস্যা নেই।”

আফরোজা বেগম মেয়ের চুলে বেণী করে দিতে দিতে বলেন, “শুনো এখন তোমার বিয়ে হবে। অনেক দায়িত্ব। এমন ভুলো মনের হলে হবে না। মাহিদ ডাক্তার মানুষ, ব্যস্ত থাকবেই। ভাইকে তো দেখছোই। তোমার তো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না ওদের ব্যস্ততা নিয়ে। তারপরও ও তোমার খোঁজ-খবর নিচ্ছে এইসবের মর্যাদা রেখো। বিয়ের পর মাহিদ, মাহিদের মা ওদের সাথে ভালো করে কথাবার্তা বলবে। তুমি এমনিতেই কম কথা বলো। আশা করবো উল্টোপাল্টা কিছু বলবে না। তাও খেয়াল রেখো। বিয়ের পর থেকে ওরাই তোমার পরিবার কিন্তু।”

অহমি নিরবে মায়ের কথা শুনেই গেল। সে সবটা খেয়াল রাখবে। মনে মনে আরো অনেক কিছু ভেবে রাখলো। আফরোজা বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসেন। মেয়ে সুখী হলেই ওনার আর কি চাওয়ার! উনি রুম থেকে যাওয়ার সাথে সাথে মাহিদ কল করলো। অহমি প্রথমে সরি বলেই শান্তভাবে মাহিদের সাথে কথা বলে। আধা ঘন্টার টুকটাক কথাবার্তায় অহমির ঠোঁটের কোণে সর্বদাই মুচকি হাসি বিরাজমান ছিলো।
____________________

অহমি ওর বন্ধু-বান্ধবের সাথে গাজীপুর রিসোর্টে এসেছে। এটা আবার টুরিস্ট স্পটও। মা,ভাইকে না জানিয়ে এসেছে মিথ্যে ক্লাসের অজুহাত দিয়ে। মোট ৫ জনের গ্রুপ ওদের। অহমি, মৃধা, ইতি, সাবিহা, তানহা। এটা সাবিহার মামার রিসোর্ট। আক্দ উপলক্ষে ট্রিট দিতে আজ ওদের এই রিসোর্টে এনেছে। এখানে আসার প্লেন হয়েছিল রাত ২ টায়। সেজন্য অহমিকে আবার ২:৩০ টায় আবার শ্যাম্পু করতে হয়েছে। মা, ভাইকে না জানিয়ে এই প্রথম অহমি এতো দূরে একা এসেছে। কিছুটা এক্সাইটম্যান্ট, কিছুটা ভয় একসাথে কাজ করছে।

ওরা এখানে এসেছে সকাল দশটায়। প্রায় দু-তিন ঘন্টা ঘুরাঘরি করে ওরা মাত্রই খেতে বসেছে। তাড়াতাড়ি ফিরতেও হবে তাই। অহমি ওদের সাথে থাকলেই সবসময় হাসি-খুশি থাকে। এখানে ওকে গুমরে থাকতে হয় না। সেলফি তুলেছে, একজন আরেকজনকে রোস্ট করেছে। রোস্ট করার বিষয়ও আজকে অহমি।কারণ মাহিদ। নতুন নতুন বিয়ের কথা উঠলে বন্ধুরা যেভাবে রোস্ট করে ঠিকভাবেই। লাঞ্চে সকলে কাচ্চি বিরিয়ানি খেলেও অহমি চিকেন বিরিয়ানি অর্ডার করে। কারণ ও খাসির মাংস খুব একটা পছন্দ করে না। খাওয়া-দাওয়ার এক পর্যায়ে অহমির চোখ সামনের টেবিলে আটকে যায়। মানুষটাকে চিনতে অহমির একটুও ভুল হয় না। মাহিদ!! আরো কয়েকজন আছেন সাথে। মাহিদ এখানে কি করছে??

অহমি দ্রুত টেবিলের নিচে বসে পড়ে। মা, ভাইকে বলে আসলে সমস্যা ছিলো না। না জানিয়ে আসাতেই এত ভয়। মাহিদ ওকে দেখেছে কিনা কে জানে? অহমি ওর বন্ধুদের টেবিলের নিচ থেকেই মাহিদের এই রিসোর্টে উপস্থিত থাকার ব্যাপারে বলে। দ্রুত ফিরে যেতেও বলে। সাবিহা যেহেতু রিসোর্টের সব জায়গাই চিনে তাই ওকে নিয়ে দ্রুত ওই জায়গা থেকে পুলের সাইডে চলে যায়। এখন ওরা রিসোর্ট থেকে বেরও হতে পারবে না। কেননা মাহিদরা যেই জায়গায় আছে সেখানটাতেই রিসোর্টের বাইরে যাওয়ার পথ। বাকি তিনজনও পুল সাইডে চলে আসে। ঠিক তখনই মাহিদ অহমিকে কল করে। প্রথম দুইবার ভয়ে অহমি রিসিভ করে না।

তখন ইতি ওকে ধমকে বলে, ” অহম কলটা রিসিভ কর। এমনও হতে পারে নরমাললি কথা বলার জন্য তোকে কল করেছে। এইভাবে কল রিসিভ না করলে আরো সন্দেহ করবে।”

তানহাও ওকে সমর্থন করে। অহমি ভয়ে ভয়ে তৃতীয়বারের কলটা রিসিভ করে সালাম দেয়। মাহিদও সালমের উত্তর দেয়। পরপরই ডিরেক্ট জিজ্ঞেস করে, “অহমিকা তুমি কোথায়?”

অহমির কথা বন্ধ হয়ে যায়। শ্বাস-প্রশ্বাসও যেন বন্ধ হয়ে আসে। ধীর কন্ঠে বলে -” এইতো, এই..মানে এই..”

মাহিদ মৃদু স্বরে ধমকে বলে, “কোথায় জানতে চেয়েছি, এই বা এইতো নামের কোথাও তেমার থাকার জায়গা নেই।”

অহমি উত্তর দেয় না। নি:শ্বাসও ফেলতে পারছে না মেয়েটা।

“অহমিকা? তুমি কি বাসায়?”

মোবাইল লাউডে দেওয়া থাকায় বাকিরাও শুনতে পেলো। মৃধা ইশারায় হ্যাঁ বলতে বুঝালো। অহমি ধীর কন্ঠে হুম বলতেই মাহিদ আবারো ধমকে বললো “গাজীপুর রিসোর্টে তোমার বাসা? হুম? পুল সাইডে তোমার রুম?”

অহমি ওখানেই জমে গেল। কণ্ঠ থেকে শব্দ বের হতে চায় না আর। ওরা দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলো। ওর হাত ভয়ে জমে গেল। কোনোমতে সাবিহার হাত চেপে বলে, “মাহিদ কি পিছনে?”

সাবিহাও পিছনে একবার তাকিয়ে আবারো নিজের বন্ধুদের দিকে তাকায়। সাবিহা ছাড়া সকলেই না বলে এসেছে। এখন অহমি ছোটখাটো বাঁশ খেলে বাকি তিনজনও খাবে। সাবিহাও ধীর কণ্ঠে ভয়ে ভয়ে বলে, “হুম, মাহিদ ভাইয়া ঠিক তুমি বরাবর পিছনে।”

চলমান…….

[হ্যাপি রিডিং]

#ডায়েরির_শেষ_পৃষ্ঠা
#পর্ব_৩
#সমৃদ্ধি_রিধী

মাহিদ একদৃষ্টিতে অহমির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ ঘুরিয়ে বাকি চারজনকেও দেখে নিলো। বাকি চারজন মোটামুটি স্বাভাবিক থাকলেও অহমি যেন একদম স্ট্যাচু হয়ে গিয়েছে। একদৃষ্টিতে পায়ের দিকে তাকিয়েই আছে। ক্রমশ ওর হাত-পা ঘেমে যাচ্ছে। মেয়েটা এসির মধ্যে থেকেও বারবার ঘেমে যাচ্ছে। মাহিদ টিস্যু বক্স থেকে একদলা টিস্যু নিয়ে অহমির দিকে এগিয়ে দিলো। বলে, “টেক ইট।”

অহমি মুখ তুলে একবার ওকে দেখে আবারও মাথা নিচু করে ফেললো। ওর অনেক রিপেন্ট হচ্ছে কেনো এখানে আসতে গেলো!! না আসলে তো এতো সমস্যার মুখোমুখি হওয়া লাগতো না। মাহিদ যদি এখন আহিরকে বলে দেয়? আম্মু যদি কথা শোনায়! অহমি বারবার একটা না একটা ভুলভাল কাজ করবেই। কে জানতো সাবিহার হাসবেন্ড মাহিদের কলিগ হাসান? মাহিদের কলিগকেও আজই ট্রিট দিতে হলো? তাও মামাশ্বশুরের রিসোর্টে? ওহ সরি! এই রিসোর্ট তো হাসানের বাবার।

“টিস্যুগুলো নিতে বলেছি না? এসির মধ্যেও ঘামছো। আর কিছুক্ষণ পরই প্যানিক এট্যাক করবে বুঝা যাচ্ছে। নাও।”

অহমি কম্পিত হাতে টিস্যুগুলো দিয়ে কপালের ঘামটা মুছে নিলো। মাহিদের অন্যান্য কলিগরা নিজেদের গন্তব্যে ফিরে গিয়েছে। কেবল মাহিদ, হাসান আর ওরা পাঁচজন রয়ে গিয়েছে। হাসান সাবিহার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তোমরা এখানে আসবে ভালো কথা, আমাকে একবার বলে আসলে কি হতো?’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,” যাই হোক এখন ফিরে যাও, বিকাল তো হয়েই এলো। এখন রওনা না দিলে দেরী হয়ে যাবে।”

মাহিদ আড়চোখে অহমির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে “কিভাবে ফিরবে তোমরা? গাড়ি এনেছো কেউ?”

মৃধা উত্তর দেয় সে সাথে গাড়ি নিয়ে এসেছে। ড্রাইভারও আছে। মাহিদ তখন বলে, “অহমিকা আমার সাথে ফিরবে। আশা করি কারো কোনো সমস্যা হবে না?”

মাহিদের কণ্ঠে গাম্ভীর্যের ছোঁয়া। অহমি একবার মাহিদের দিকে তাকিয়ে নিজের যাবতীয় জিনিস নিয়ে আসতে গেল। ওর কিছুক্ষণ পরপর গলা, ঠোঁট কেঁপে উঠছে। কিন্তু কাঁদল না। ওর পিছন পিছন মৃধা, ইতি, তানহাও ছুটলো। সাবিহা ওখানেই বসে মাহিদ আর হাসানকে বুঝানোর চেষ্টা করতে থাকলো বাকিদের কোনো দোষ নেই। সাবিহাই কনভিন্স করে ওদের নিয়ে এসেছে।

_______________________________________________

হাইরোডের উপর গাড়িটা খুবই ধীর গতিতে চলছে। সামনেই আবারও বিশাল একটা জ্যাম। অহমি পুরাই জানালার সাথে আঁটসাঁট হয়ে বসে আছে। মাহিদ ওকে একটা প্রশ্নও করেনি। অহমিরও ওকে কিছু আগ বাড়িয়ে বলা উচিত কিনা বুঝতে পারছে না। ভাবনার মাঝে ঠিক তখনই অহমির মোবাইলটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ভাইয়া নামটা দেখে চোখে-মুখে আতঙ্ক ফুটে উঠেছে। এইবারো অহমি কলটা রিসিভ করতে পারে না। ওর ভয় হচ্ছে ভাইয়াকে কি বলবে? জ্যাম থাকবার কারণে তিনটায় রওনা দিয়েও পাঁচটা বাজালেও ওরা পৌঁছাতে পারে না৷

“পিক আপ দ্যা ফোন অহমিকা। তুমি কি একবার রিং বাজলে কখনোই ফোন উঠাতে পারো না?” মাহিদের কণ্ঠে বিরক্তির ছাপ। কিন্তু ততক্ষণে কলটা কেটে গিয়েছে।

অহমি চমকে উঠে। খাপছাড়া কণ্ঠে মাহিদকে প্রশ্ন করে, “ভাইয়াকে কি বলবো?”

মাহিদ অত্যন্ত কাঠঠোকরা কণ্ঠে বলে, “সেটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। না বলে আসার আগে মনে ছিল না যে জ্যাম পড়লে আমার লেট হতে পারে পরে ভাইয়াকে কি জবাব দিবো?”

অহমিকার এহেন কণ্ঠস্বর শুনে কান্না আসে। সবাই ওর সাথে এভাবেই কথা বলে। এমনকি মাহিদও এখন এইভাবে কথা বলছে।অহমির ভীষণ কান্না পেল। কিন্তু ও তো সকলের সামনে কাঁদে না। ওর নাকের পাটা কেঁপে উঠল। কেউ যেন গলাটা চিপে রেখেছে।

” আহির স্যার কল করলে বলবে তুমি আমার সাথে ছিলে। তোমার ভার্সিটির ক্লাস শেষ হওয়ার পর আমি তোমাকে নিয়ে তোমার ভার্সিটির পাশের রেস্টুরেন্টে লাঞ্চের জন্য গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফিরতি পথেই আমরা জ্যামে বসে আছি।”

অহমিও ভাবলো এটাই বলবে। গাজীপুর যাওয়ার কথা শুনলে ভাইয়া আর আম্মু অনেক কথা শুনাবে। তার চাইতে ভালো যদি মিথ্যে বলে বেঁচে যায়। ভাবনার মাঝে আহির আবারও কল করে। অহমিও তোতাপাখির মতো মাহিদের বলা কথাই আহিরকে রিপিট করে।

আহির ছোট একটা শ্বাস ফেলে। বলে,”আচ্ছা,মাহিদকে দে।”

অহমির ফোন থেকে আহির আর মাহিদ কি কথা বললো কে জানে! অহমি কেবল অপর প্রান্ত থেকে মাহিদের ‘জি’, ‘আচ্ছা’, ‘ঠিক আছে’ শুনতে পেলো। মোবাইলটা রাখতেই মাহিদ অহমিকে প্রশ্ন করে, “তুমি এর আগেও এমন না বলে দূরে কোথাও গিয়েছ?”

অহমি দ্রুত মাথা দুইপাশে নাড়িয়ে না বোধক বুঝালো। তড়িঘড়ি করে বলে, “এই প্রথম বিশ্বাস করুন। সাবিহা অনেক জোর করায় আসতে রাজি হয়েছি। ভাইয়াকে বললে মোস্ট প্রোবাবলি আসতে দিতো না। তাই না জানিয়েই এসেছি। ”

মাহিদ বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে,”তোমাকে কেনো বিশ্বাস করতে যাবো? যে একবার এমন করার সাহস করতে পারে, সে যে আগেও এমন করেনি তার কি গ্যারান্টি?”

অহমি দমে গেল। মাহিদ ওকে কি সত্যিই বিশ্বাস করেনি? একটা সম্পর্ক শুরুই হতে পারিনি তার আগেই কি মাহিদের মনে কি অবিশ্বাসের বীজ বুনে ফেললো? অহমি নিজের পক্ষ থেকে শেষ একটা সাফাই গাইলো, “আপনি বিশ্বাস করবেন নাকি করবেন না, তা আপনার ব্যক্তিগত কারণ। তবে আমার পক্ষ থেকে আমি সম্পুর্ন ক্লিয়ার। তাছাড়া আমি এর আগে এমনটা করিনি দেখেই এভাবে ভয় পাচ্ছি। ”

মাহিদ পুরাটা রাস্তায় আর কথা বললো না। অহমিও চুপচাপ ছিলো সবসময়ের মতো। নিজের প্রতি কেমন একটা বিতৃষ্ণা জমে। ওর ভুলটা কোথায়? ও কি একটুও মজা-ঠাট্টা, বিনোদন নিতে পারে না? সূর্য প্রায় ডুবেই গেছে। তখন মাহিদ অহমির বাসার সামনে এসে গাড়ি থামিয়ে দিল। অহমি একবার নিজের পাঁচতলা বাড়ির দিকে তাকিয়ে মাহিদের উদ্দেশ্যে বলে, “প্লিজ আমি যে গাজীপুর গিয়েছি ভইয়াকে বলবেন না।”

মাহিদ ওর এই কথার উত্তর দেয় না। গাড়ি থেকে নেমে অহমির পাশের দরজা খুলে দিলো। গলায় খাদ নামিয়ে বলে, “আমি রাতে ফোন করবো। প্রথম কলেই যেন ফোনটা ধরা হয়। দ্বিতীয়বার যাতে কল না দিতে হয়। এন্ড ঘুমাচ্ছিলে এমন অযুহাতও যেন না দেওয়া হয়, তুমি যে রাত জাগো আমি খুব ভালো করেই জানি।”

________________________________________________

বাড়ি ফিরেই অহমি মায়ের কাছে একগাদা বকা শুনেছে। সন্ধ্যার পর থেকে অহমি রুম থেকেই বের হয়নি। কেঁদেকেটে চোখগুলো ফুলিয়ে ফেলেছে। এখন ডিনার করার টাইমে আফরোজা বেগম ডাকতে আসলেও অহমি দরজা না খুলেই বলে সে খাবে না। আহির এমনিতেই ওর উপর রেগে ছিল। অনমির রুমের সামনে গিয়ে দুইবার জোরে দরজায় বারি মারতেই অহমি দরজা খুলে।

“টেবিলে যা।”

আহির কখন বাসায় এসেছে অহমি জানে না। তবে ভাইয়ের গলার স্বর শুনেই অহমি বুঝতে পারে আহির প্রচন্ড পরিমাণ রেগে আছে। মাহিদ কি তবে গাজীপুর যাওয়ার ব্যাপারে বলে দিয়েছে? অহমি আর ভাবতে পারলো না, এমনিতেই ওর প্রচুর মাথা ব্যাথা করছে। আফরোজা বেগমও সন্ধ্যার বকাবকির পর অহমিকে আর কিছু বলেননি। তিনি তো মা, জানেন মেয়ে নাজুক স্বভাবের। টেবিলে তিনজন চুপচাপ খাওয়া শেষ করে। অহমি উঠতেই যাবে এমন সময় আহির মায়ের উদ্দেশ্য বলে, “তোমার মেয়ে আম্মু ভালোই বড় হয়েছে। আজকাল বাইরে থাকে কিন্তু মা ভাই থেকে পারমিশন নেওয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না।”

আফরোজা বেগম বিরক্তির সুরে বলে, “আহির থামো। অহমি তো বলেছেই এখন থেকে আমাদের কোথাও যাওয়ার আগে বলে যাবে। আর গেলেও তো মাহিদের সাথে দেখা করতেই গেছে। ”

আহির ছোট থেকেই বদমেজাজি। নিজে যা বুঝবে তাই। হুঙ্কার দিয়ে বলে, “মাহিদের সাথে দেখা করতে হবে কেনো? কালকে কথা হয়নি? তাহলে প্রতিদিন কিসের এত দেখা করা?”

অহমির দিকে তাকিয়ে, “তোকে তো ওর ফোন নম্বর দিয়েছিই, তাহলে রোজ রোজ কেনো দেখা করতে হবে? কাল সব কথা বলে বুঝে আসতে পারিস নি?”

অহমি কোনো উত্তর দেয় না। আহির আবারও গর্জে উঠে জিজ্ঞেস করে, “কেথায় গিয়েছিস ওর সাথে?”

অহমি বুঝলো এখন উত্তর না দিলে আহির আরো রেগে যাবে। ধীর কণ্ঠে বলে, “কুঁড়েঘরে।”

“কোথায়?” চেঁচিয়ে উঠে।

“আমাদের ভার্সিটির পাশের রেস্টুরেন্টে।”

“রেস্টুরেন্ট থেকে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়? শিখাস তুই আমাকে?”

আসলেই তো! এভাবে ভেবে দেখেনি তো। অহমি কেনো রকম করে বলে,” রেস্টুরেন্ট থেকে চন্দ্রিমা উদ্দ্যানে হাঁটতে গিয়েছিলাম।”

“এই তোর সাথে ওর বিয়ে হইছে? না আক্দ হইছে? কোনো ভদ্র পরিবারের মেয়ে বিয়ের আগে এতো মেলামেশা করে?”

অহমির কোনো যেনো কথাটায় খুব খারাপ লাগলো। হ্যাঁ ও যায়নি মাহিদের সাথে, কিন্তু গেলেও বা এমন রিয়েক্ট করার কি আছে? মাহিদের সাথে তো ওর বিয়ে হবেই। অহমির মতে ওর ভাই এখন বেশি বেশিই করছে।

নিজের রাগটা কন্ট্রোল করতে না পেরে বলেই ফেলে, “তুমি এবার অতিরিক্ত করছো, খাবার খেতেই তো গিয়েছি, হাঁটতে গিয়েছি, অন্যকিছু করেছি? অন্যায় তো করিনি। তুমি সবসময়ই এমন বাড়াবাড়ি করো।”

“থাপ্পর দিয়ে গালের দাঁত ফেলে দিবো বেয়াদব। মুখে মুখে তর্ক করার সাহস হয় কিভাবে?” আহির অহমিকে থাপ্পড় মারতে তেড়ে আসে। আফরোজা বেগম ছেলেকে কোনোমতে হাত ধরে আটকায়।

অহমি কিছু বলতে যাবে তার আগেই আফরোজা বেগম ধমক দিয়ে উঠেন। বলেন,”অহমি চুপ করো, রুমে যাও। আর আহির সমস্যা কি? মাহিদকে তো তুমি চিনোই। আর রাগারাগি কোরো না। বোন বড় হচ্ছে তোমার।”

অহমি জিদ দেখিয়ে রুমে চলে আসে। ও রুম থেকেই শুনতে পাচ্ছে ‘সন্ধ্যা ছয়টার পরে কোনো ভদ্র পরিবারের সন্তান বাসায় ঢুকে না। দিনকেদিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে। জন্মের আগে থেকেই আমাদের অশান্তিতে রেখেছে।’ আর আফরোজা বেগম ছেলকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করছেন। অহমির মনে হয়-মা তো পারতো আজ ভাইয়াকে শাসন করতে। সবসময় তিনি অহমিকেই ধমকে চুপ করিয়ে দেন। আহিরকে কিছু বলেন না। এখনও ছেলেকেই লাই দিচ্ছেন। অহমি আসলেই সকলের কাছে ঝামেলা। অবহেলার।

বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। ভাই এখনও ওকে বকেই চলেছে। আরেকটা বালিশ দিয়ে নিজের কানও চেপে রাখলো। এর কিছুক্ষণ পর মাহিদ কল করলো। অহমি একবার রিং হতেই রিসিভ করলো। সবসময় ও কলের শুরুতে সালাম দেয়। কিন্তু এখন দিলো না। একটা ছ্যাবলামি করেই ফেললো। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো, “আমাকে বিয়ে করবেন মাহিদ, খুব তাড়াতাড়ি করবেন? আমি আর এই বাসায় থাকবো না। কিছুতেই থাকবো না।”

চলমান…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে