কার মুখ দেখে যে আজ কাজে এসেছি। সকাল থেকে একটার পর একটা বাজে রোগী আসছে। চারটা রোগী শেষ করতেই রিসেপশন থেকে ফোন এলো, ডক্ তোমার সাথে পুলিশ দেখা করতে এসেছে, তোমার এক রোগীর ব্যাপারে। শুনেই পেটের মধ্যে দিল এক মোচড়। কোন রোগী আবার কি আকাজ করলো, নাকী আমিই কিছু উল্টাপাল্টা করেছি কে জানে?
– হ্যালো, ডক্? তুমি তিন সপ্তাহ আগে এলানাকে দেখেছিলে। গত সপ্তাহে ওকে নিজের ঘরে মৃত পাওয়া যায়। সুইসাইড কেইস। প্রাথমিকভাবে ধারনা করা হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত হতাশার ঔষধ খেয়েছে সে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেলে বোঝা যাবে। তোমার একটা স্টেটমেন্ট লাগবে সাথে ওর সব মেডিকেল রেকর্ড।
সব কাগজ বুঝিয়ে দিয়ে পুলিশকে বিদায় করে রিসেপশনে জানাই আমি কিছুক্ষণ পরে থেকে রোগী দেখবো আবার। ডাক্তার হিসেবে কোন মৃত্যুই আমাদের কাছে আকাঙ্খিত নয়। তার ওপর মাত্র ষোল বছর বয়সী একটা মেয়ের মৃত্যু তো কিছুতেই নয়। মনে করার চেষ্টা করি কি ছিল ওর হতাশার কারণ।
এক বছর আগে এলানা যখন আমায় প্রথম দেখাতে আসে সে নিজ থেকে কোন কথাই বলতে চায়নি। ওর মা ই কথা বলে ওর হয়ে। একটু মোটা ধাঁচের দেখে সে স্কুলে বুলিংয়ের শিকার। কেউ ওর বন্ধু হতে চায়না। কেউ যদি এগিয়েও আসে বাকিদের হাসাহাসিতে সেই নতুন জনও সরে যায়। অন্যদিকে বাসায় যখন তখন মদ্যপ স্বামীর মুখ আর হাতের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হওয়া মায়ের, বাবার সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ায় মা আর মেয়ের সংসারের ভার পরে পুরোপুরি মায়ের ওপর। আর বাবা মায়ের প্রায় সবগুলো মারামারি হয় এলানার সামনেই। মনের মধ্যে একটু একটু করে জমতে থাকা ঘরের কষ্ট, বাইরের কষ্ট তাকে দিনদিন মনের দিক থেকে একঘরে করে দেয়। ঔষধ, কাউন্সেলিং করেও যখন সেভাবে কাজ হচ্ছিলোনা মা তখন কাজ কমিয়ে মেয়েকে সময় দিতে চেষ্টা করে।
কিছু কিছু মানুষ থাকে যারা চাইলেও সহসা মনের দূর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনা। এলানা ছিল অনেকটা সেরকম। বাসায় বা স্কুলে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও মনে মনে তার দুঃখবোধের ঘরটুকু বুঝি সবসময় খোলাই থাকতো। এরকম মন খারাপের সময়েই টম আসে তার জীবনে বন্ধু হয়ে। আনন্দে কাটে বেশ কিছুদিন। মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন মেয়ে সুস্থ হয়ে গেছে ভেবে। এমনকি এলানা নিজে এসে জানিয়ে যায় সে খুব ভালো আছে। আর সে ঔষধ খেতে চায়না।
এদেশের আর দশটা টিনেজারের মতো টম এলানার সম্পর্ক খুব বেশী দূর গড়ায়না। মানসিক ভাবে অশক্ত এলানা আবারো ভেঙে পরে দারুনভাবে। শুরু হয় আবারো কাউন্সেলিং আর হতাশার ঔষধ। দিনের নিয়মে দিন কেটে মাস গড়িয়ে যায় এলানা আসেনি এর মাঝে দেখা করতে। ভেবেছি হয়তো ঔষধে ভালো আছে তাই আর মাথা ঘামানো হয়নি। অবশ্য রোগী না এলেতো আর বাড়ি বয়ে খবর নিয়ে আসা সম্ভব না। তাই জানা হয়নি এলানা দিনকে দিন কতটা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। সপ্তাহ তিনেক আগে একবার এসেছিল ঠান্ডা কাশি নিয়ে। ও নিজে কিছু না বলায় নতুন করে মনের খবর আর নেয়া হয়নি।
মানুষ আসলে কতটা সাহসী না কি বোকা হলে নিজের হাতে নিজের মৃত্যুর উদ্যোগ নেয় আমার জানা নেই। পুলিশকে বলেছিলাম, কি আসে রিপোর্ট বা তাদের তদন্তে কি কারণ পায় আমাকে যেন একটু জানায়।
……………
এর মাঝে কেটে গেছে আরো কয়েক মাস। আরো হাজারো রোগীর ভীড়ে এলানা হারিয়ে গেছিলো স্মৃতির গহ্বরে। আজ পুলিশ অফিসার দেখা করতে এসে সেই স্মৃতিটুকু জাগিয়ে দিল।
ফেসবুকে টমের সাথে তার নতুন গার্লফ্রেন্ডের ছবি দেখে এলানা কান্নায় ভেঙে পরে টমের কাছে তার কি দোষ ছিল তার কারণ জানতে চায়। টম তাকে জানিয়ে দেয় ওর মতো মোটা মেয়ের সাথে সে সম্পর্ক করেছিল সেটাতেই সে লজ্জিত এখনো। টমের এই ধরনের কথা বুঝি তার মনের গভীরে জমতে থাকা কষ্টের আগ্নেয়গিরিকে জাগিয়ে দেয় পুরোদমে। সেই রাতেই তার কাছে যত রকম ঔষধ ছিল সব মিশিয়ে খেয়ে নেয়। এদেশে তখন গভীর রাত। পাশের রুমে ঘুমিয়ে থাকা মা ও জানতে পারেনি কন্যার মনের কথাটুকু।
খাওয়ার পরে বুঝি একটু খানিক বেঁচে থাকার আকুতি জেগেছিল মনে। তাই ফেসবুকে স্ট্যাটাস লেখে কয়েক লাইন। ঐ যে বললাম গভীর রাত হওয়াতে এদেশের ওর বন্ধুস্থানীয় কেউ জানতেই পারেনি কি হয়েছে। কিন্তু দূরদেশে থাকা তার আরেক বন্ধু দেখে ফেলে সেই স্ট্যাটাসটি সেদেশে তখন সদ্য ভোর হওয়ার সুবাদে। সেই বন্ধু ফোন দেয় এখানকার পুলিশ স্টেশনে। সবকিছু ভেরিফাই করে পুলিশ এলানার বাসায় যখন পৌঁছে ততক্ষণে পেরিয়ে গেছে বেশ কয়েক ঘন্টা। এলানা ততক্ষণে অন্য পৃথিবীর বাসিন্দা।
থম ধরে বসে রইলাম অনেকটা সময়। একটা প্রাণ একটা জীবন কি এতোই মূল্যহীন হয়ে যেতে পারে শুধুমাত্র কিছু লোকের বাজে কথায়? জীবন কি এতোই ঠুনকো? একটা জীবন আনন্দ খুঁজে বেঁচে থাকা কি খুব কষ্টের? জীবন নিয়ে হতাশ মানুষগুলোর জন্য বোধহয় আসলেই তা ভীষণ কষ্টকর। আহা বাচ্চাটা, জীবনের আনন্দময় অংশ না দেখেই বিদায় নিল জীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে। কিংবা হয়তো আরো কষ্টের জীবন দেখার থেকে চিরমুক্তি নিয়েই সুখী হলো।
তবু প্রার্থনা পৃথিবীতে আর কোন এলানা এমন একলা কষ্ট নিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে হারিয়ে না যাক। পৃথিবীকে দেখিয়ে দিক জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া নয় শক্তভাবে জীবনকে মোকাবিলা করে বেঁচে থাকাতেই জীবনের যত সুখ।
ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস