(শ্রমদিবস স্পেশাল)
মূহুর্মূহু করতালিতে পুরো অডিটোরিয়াম কাঁপিয়ে তোলে শ্রোতারা, শ্রমদিবসে জামান সাহেবের দরদী বক্তব্য শুনে। সেরা বক্তা ও মানবসেবীর পুরস্কার ও হাতে ওঠে তার।
উফ স্যার আপনি যে কি দারুন বক্তৃতা দিলেন এখনো কানে বাজছে। আপনাদের মতো জনদরদী মানুষ আছে বলেই দেশের শ্রমিকরা ন্যায্য পারিশ্রমিক পাচ্ছে।
– আরে না কালাম, তুমি একটু বাড়িয়ে বলো। এসব শ্রমিকদের যত্ন নেয়াতো আমাদেরই দায়িত্ব।
চলেন স্যার আপনাকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেই।
– আর বলনা, হারামজাদা ড্রাইভারের কে নাকি অসুস্থ দুইদিনের নাম করে গেছে আজ পাঁচদিন হলো ফেরার নাম নেই। এইসব ছোটলোকগুলোকে মারের ওপর রাখতে হয়।
জ্বি স্যার কি বললেন?
– না না বললাম ড্রাইভারের কি যেন সমস্যা হয়েছে। আমিই বললাম ছুটি নাও আরো দুদিন। আমি যাই, দেখি রিকশা গাড়ি কিছু পাই কি না।
…………..
এই খালি যাবা? সেগুনবাগিচা?
– জ্বি স্যার আসেন।
এই রিকশা তুমি কোন রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছো?
– রিকশায় উঠসেন আপনের ইচ্ছায় নামবেন আমার ইচ্ছায়। আশেপাশে যতডি রিকশা যাইতাসে সব আমার ইয়ার দোস্তরা চালাইতাসে। বুঝা গেসে?
কি চাও তুমি আমার কাছে?
– আপনে আমার সব দোস্ত আর রাস্তার মানুষের সামনে আমার কাছে মাফ চাইবেন। তারপর এইখান থেইকা হাঁইটা আপনের বাড়িত যাইবেন। কারণ আজকা বিকালে আপনে আমার ন্যায্য ভাড়াতো দেনই নাই লগে দুইটা থাপ্পর দিয়া রিকশা থেইকা নামসেন।
জামান সাহেব তারপরও কিছুক্ষণ হম্বিতম্বি করার চেষ্টা করলেও চারপাশে এগিয়ে আসা রিকশাওয়ালা শ্রেনীর মানুষদের দেখে ভয়ে সিঁটিয়ে যান। আর ওনার অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন। বাড়ি ফেরার পথে হাঁটতে হাঁটতে ওনার কোন অনুশোচনাতো হয়ই না বরং রাগে ওনার শরীর কাঁপতে থাকে। মনে মনে ভাবেন যে করেই হোক এই রিকশাওয়ালাকে উনি দেখে নেবেন। আসলে আজীবন রিকশাওয়ালাদের মানুষের কাতারে হিসেব না করা জামান সাহেব এতো সহজে বদলে যাবেন সেটা ভাবাটাই তো আকাশকুসুম কল্পনা।
এই ফাঁকে আমরা একটু জামান সাহেবের বাসার দুপুরের ঘটনা জেনে নেই। জামান সাহেব বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার পরপরই ওনার স্ত্রী রিনি হাতের বেলন দিয়ে বেদম মার দেয় কাজের মেয়ে,মুন্নিকে। তার নাকি কোন কাজে মন নেই। রান্নাঘর হাতড়ে শিক কাবাব বানানোর লোহার শিক খুঁজে না পেয়ে মেজাজ ওঠে যায় আরো চরমে। ফলাফল পাশে রাখা খুন্তি গরম করেই মুন্নির পিঠে আর হাতে দু তিনবার স্যাঁকা দিয়ে অবশেষে নিজের রাগ কমান রিনি।
আজ বিকেলে রিনিদের মহিলা সংগঠনের শ্রম দিবসের একটা আলোচনা সভায় যাওয়ার প্ল্যান থাকাতে তড়িঘড়ি দুপুরের খাওয়া খেয়ে সেজেগুজে বেরিয়ে যান রিনি। অন্য সময় বাসার দরজা বাইরে থেকে আটকে দিয়ে গেলেও দেরী হয়ে যাওয়ায় তালা না দিয়েই ভেতর থেকে লক করে যায়। মার খেয়ে রান্নাঘরের মেঝেতে কুঁকড়ে পরে থাকা মুন্নির জায়গা থেকে নড়ার সাহসই হবেনা সেটা রিনির চেয়ে ভালো আর কে জানে? আজকেই তো আর প্রথম মারলেন না মুন্নিকে।
……………..
দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে ক্লান্ত জামান সাহেব আর রিনি প্রায় একসাথেই বাসায় ঢোকেন। দরজার মুখে জমে থাকা ময়লার বালতি দেখেই ক্লান্ত জামান সাহেব খেকিয়ে ওঠেন, ‘তোমার কাজের মেয়েটা ময়লার বালতি নিচে দিয়ে আসে নাই কেন? গন্ধে টেকা যাচ্ছেনা।’
– দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা বদ মেয়েটাকে।
কিন্তু এ কি মুন্নিতো বাসার কোথাও নেই। দৌড়ে নীচের দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করতে নেমে যান রিনি। দরজা তালা না দিয়ে রিনি বেরিয়েছে জানতে পারলে জামান সাহেব আরো রেগে যেতে পারেন। দারোয়ানের মুখোমুখি হতেই রিনির দুই পাশে দুই মহিলা পুলিশ এসে দাঁড়িয়ে যায়।
‘ বাসায় চলেন ম্যাডাম, আপনার আর আপনার স্বামীর নামে ওয়ারেন্ট আছে।’
– কি কি কি কিসের ওয়ারেন্ট?
‘আপনার স্বামী জামান সাহেবের সামনেই বলি। বারবার আপনাদের মতো সভ্য মানুষদের নামে নোংরা কথা বলতে ভালো লাগেনা।’
রিনির সামান্য তালা লাগানোর ভুলের সুযোগটুকু নেয় মুন্নি। অবশ্য নিজের জীবন রক্ষার তাগিদে ছোট মেয়েটার আর কি ই বা করার ছিল? জামান সাহেবের ব্যবহার নিয়ে দারোয়ান, ড্রাইভার কেউই সন্তুষ্ট ছিল না। মুন্নির শরীরের দগদগে ঘা আর তার অবিরাম কান্নায় বিচলিত দারোয়ান তাকে নিয়ে যায় বাড়িওয়ালার বাসায়। তারা খবর দেন তাদের পরিচিত জনৈক মানবাধিকার সংস্থাকে। সেই সংস্থাই বাদী হয়ে মামলা করে জামান সাহেব আর রিনির নামে গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের।
পরদিন সব পত্রিকায় ফলাও করে খবর আসে, ‘শ্রম দিবসের পুরস্কারপ্রাপ্ত জামান চৌধুরী ও তার স্ত্রী গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের দায়ে রিমান্ডে।’
সেই খবর পড়ে কেউ হাসে, কেউ এড়িয়ে যায় আর কেউ হয়তো শেয়ার করে সরগরম করে ফেসবুকের পাতা। বদলায় আদতে কয়জন?
…………..
কেউ ঠেকে শিখে আর কেউ দেখে শিখে। জামান সাহেবের মতো লোকেরা যদি গল্পের মতো রোজদিন ঠেকে শিখতো আর খবরের কাগজের লেখাটুকু পড়ে যদি কেউ দেখে শিখতো তবে বোধহয় আমাদের প্রতিদিন সেবা দিয়ে যাওয়া ঐ সব শ্রমজীবী মানুষগুলোর জীবন আরেকটু স্বস্তির আর আনন্দের হতো।
#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস