টিংটিংটুংটাং
শেষ পর্ব.
মিস্টার আলফাজ রঞ্জন, শুনতে পাচ্ছেন? আমি কিন্তু মোটেও আপনাকে পছন্দ করি না। ভালবাসি না। কিন্তু আমাকে এমনতর বাজে বিরহ দহ’নে এলোমেলো করার জন্য আপনার ক’ঠিন কা’রা’দ’ণ্ড হওয়া উচিত। এইযে, আপনি আমার সঙ্গে ঠিকঠাক কথা বলছেন না। এড়িয়ে চলছেন। আগের মতো বারান্দায় বসে পুরো দিনের কার্যকলাপ বর্ণনা করছেন না। কেন বলুন তো? ভীষণ অভিমান করেছেন কি? কিন্তু আমি কি করবো? আমি ভীষণ অন্যরকম। অভিমান ভাঙ্গানো, জড়তা ছাড়া নিজের মনের কথা বলা— এসব আমি পারি না। ভবিষ্যতের কথাও বলতে পারছি না। তবে আপনি তো আমাকে বুঝেন। আমি বলার আগেই আমার মনের কথা পড়ে নেন। তাহলে এখন পড়ছেন না কেন? নাকি ইচ্ছে করে পড়েটড়ে আমার পরীক্ষা নিচ্ছেন? লাভ নেই। এই পরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণ হবো না। বড় বড় দুটো ঘোড়ার ডিম পেয়ে ফেল করবো। তবে একটা সত্য কথা বলি? কানে কানে বলবো। আপনিও চুপিচুপি এক কান দিয়ে শুয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দেবেন। আমাকে বলবেন না, লজ্জাও দিতে পারবেন না। আমি আসলে প্রথমে মিথ্যে বলেছিলাম। আমি শুরুতে আপনাকে অপছন্দ করলেও এখন প্রচন্ড পছন্দ করি। এভাবে আমাকে এড়িয়ে চলবেন না। আমার খারাপ লাগে। খুব খারাপ লাগে। আমার সাথে বেশি বেশি কথা বলবেন, ঠিকাছে?
এটুকু লিখে থামলাম। টেবিলে তিনটে বই এক এক করে সারিবদ্ধ হয়ে পরে আছে। প্রথম বইটা বাংলা। মাঝখান দিয়ে হা করে খুলে রেখেছি। রবীন্দ্রনাথের একটা বিখ্যাত গল্প পড়তে নিয়েছিলাম। পড়া হচ্ছে না। আড়চোখে রঞ্জনকে বারবার দেখছি। উনি একটু আগেই বাসায় ফিরেছেন। গোসল সেড়ে মাত্র বিছানায় একটা বই নিয়ে বসেছেন। মূলত উনার জন্যই পড়ায় মন বসছে না। আগের পরিস্থিতি হলে এখন কতই না গল্প জুড়ে দিতেন! এখন বোবা বনে আছেন। কোনো সাড়া নেই, শব্দ নেই, কথা নেই। কি বিরক্তিকর! আমি পড়া বাদ দিয়ে উনার নামে হাজারটা অভিযোগ লিখতে লাগলাম খাতায়। একসময় সেটাতেও ক্লান্তি চলে আসল। আমি রঞ্জনের সাথে কথা বলতে চাই। এ কয়েকদিনে বাজে অভ্যাস হয়ে গেছে। বিয়ের আগে যেখানে রাত এগারোটা হলেই ঘুমিয়ে কাঁদা হয়ে যেতাম, এখন একটা বাজলেও ঘুম চোখে ধরে না। আমাদের মাঝখানে ইন্ডিয়া, পাকিস্তানের বর্ডার হয়ে থাকা কোলবালিশটাকে দূরে ছুঁড়ে মেরে ঘুমের ভান ধরে থাকা রঞ্জনকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বারান্দায় নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। জ্যোৎস্না বিলাশ করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পূর্বের মতো কিছুই হয়না। আমি কিন্তু অনেক চেষ্টা করেছি আয়মানের কথা রঞ্জনকে বলতে। ভুল বুঝাবুঝি শেষ করতে। কিন্তু মাঝপথে আটকে যাই। আমি রঞ্জনকে খুব ভরসা করি, আপন ভাবি। কিন্তু বোঝাতে পারিনা। কেন পারিনা? আমি চাইলেই তো পারি, পারবো।
রঞ্জন ইংরেজি একটা বই পড়ছিলেন। পড়তে পড়তে আমার দিকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাকালেন। আমাকে চেয়ে থাকতে দেখে একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললেন, “কি হয়েছে? পড়া বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে?”
আমি মাথা নাড়ালাম। পড়া বুঝতে আমার মোটেও অসুবিধে হচ্ছে না। আমার অসুবিধে হচ্ছে পুরোনো রঞ্জনকে না পাওয়ায়। আমি তাকে খুঁজছি, কিন্তু সে ধরা দিচ্ছে না।
রঞ্জন আবারও হাতের বইটাতে নিজের সমস্ত মনোযোগ ঢেলে বললেন, “আমার দিকে না তাকিয়ে পড়ো। সামনে পরীক্ষা।”
আমি অস্ফুট স্বরে বললাম, “পড়তে ইচ্ছে করছে না।”
রঞ্জন মাথা তুলে আবার তাকালেন আমার দিকে। শান্ত চাহনি। মুখের ভাবভঙ্গিও অস্বাভাবিক রকমের স্থির। জানতে চাইলেন, “তাহলে কি করতে ইচ্ছে করছে?”
—“কথা বলতে।” কথাটা বলে বুঝলাম, আমি সাহসী হয়ে গেছি। আমার মতো আজব মেয়ে তো এরকমের কথা বলতেই পারে না।
রঞ্জন বললেন, “মায়ের কাছে যাও। কথা বলো। তারপর আবার পড়তে বসবে।”
—“আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই।”
—“আমরা তো কথাই বলছি।”
মুহুর্তেই অধৈর্য হয়ে উঠলাম। হাতের কলমটা মুঠোয় চেপে ধরে বললাম, “এমন না। আগের মতো। আগে যেভাবে কথা বলতেন, সেভাবে। চলুন না রঞ্জন, বারান্দায় বসে কথা বলি।”
—“সম্ভব না তুলি। এখন একটু ব্যস্ত আছি।”
—“আপনি সবসময়ই ব্যস্ত থাকেন। ইচ্ছে করে ব্যস্ত থাকার ভান ধরছেন। এমন কেন করছেন রঞ্জন?”
রঞ্জনের উত্তর নেই। আমি নিজের স্বভাব থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে এলাম। একটু একটু গুছিয়ে রাখা কথাগুলোর যতটুকু মনে পরলো ততটুকুই বলতে চাইলাম, “ছোটবেলা থেকে আয়মানকে আমি পছন্দ করতাম। ওর জন্যই আমি আপনাকে প্রথম প্রথম মেনে নিতে পারিনি। কিন্তু…”
রঞ্জন বলতে দিলেন না। বই রেখে আচমকা উঠে দাঁড়ালেন। ভীষণ ব্যস্ততা দেখিয়ে রুম থেকে চলে যেতে যেতে বললেন, “পড়ো তুলি। শুধু শুধু কথা বাড়াচ্ছো।”
মাথার ওপর ফ্যান চলছে। একলা ঘরে আমি একা বসে আছি। অবহেলাগুলো শরীর বি’ষি’য়ে দিচ্ছে। আমার ঠোঁট ভেঙ্গে আসছে কান্নায়। শরীর থেকে থেকে কাঁপছে। এত কষ্ট বোধহয় আমি জীবনে অনুভব করিনি। রঞ্জন কেন আমাকে সঙ্গ দিচ্ছেন না? একটু কথা বলছেন না? আমি মিনতি করছি আপনার কাছে আলফাজ রঞ্জন। আকুতি ভরা চোখে বারবার অনুরোধ করছি কথা বলতে। আপনি এত পাষাণ? আমার অনুরোধ দেখেও পায়ে ঠেলে দিচ্ছেন?
–
দুটো চড়ুই পাখি বারান্দার রেলিংয়ে বসে আছে। অল্পসল্প কিচিরমিচির শব্দে স্তব্ধ পরিবেশ টিকে থাকতে পারছে না। ফ্যানটা কি বন্ধ? এত গরম লাগছে কেন? শরীর থেকে কাঁথা সরিয়ে ফেললাম। পাশ ফিরে কোলবালিশ জড়িয়ে ধরতে গিয়েই বুঝলাম, পাশে কোনো বালিশ নেই। হাতড়ে বুঝতে চাইলাম রঞ্জন আছেন কি-না। নাহ্! রঞ্জনও পাশে নেই। কোথায় গেলেন?
আমার ঘুমটা পুরোপুরি ভেঙ্গে গেল। উঠে বসতে বসতে একদফা শরীরের ম্যাচম্যাচ অনুভূতিতে মেজাজ টুঙ্গে পৌঁছালো। হাত দুটো এত ব্যাথা করছে! চোখ দুটো দুহাতে কচলে আশেপাশে তাকালাম। সদ্য ঘুম ভেঙ্গে ওঠা সূর্যের একফালি রোদ্দুর সাদা পর্দার বাঁধা ডিঙ্গিয়ে আলো আলো করে ফেলেছে সারা ঘর। পুরো ঘর খালি। বারান্দা, বাথ্-রুমেও কারো উপস্থিতি নেই। এত সকাল সকাল রঞ্জন কোথায় গেলেন? ঘড়িয়ে মাত্র পাঁচটা। এসময় তো কখনো ঘর থেকে বের হন না।
আমার আঁখিদ্বয় টেবিলের ওপর পরতেই স্থির হয়ে গেল। চেয়ারে আমার ওড়না রাখা। মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। হঠাৎ মনে পরলো, আমি রাতে টেবিলেই ঘুমিয়ে পরেছিলাম। রঞ্জন আমাকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিলেন। ঘুমু ঘুমু অবস্থায় জোর করে ভাতও খাইয়ে দিয়েছিলেন। তারপর… তারপর কি হয়েছিল? আমি তাড়াতাড়ি উঠে টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সর্বনাশ! রঞ্জনকে নিয়ে লেখা আমার অভিযোগের খাতাটা অবহেলিত ভাবে পরে আছে। কালকে যেগুলো লিখেছিলাম? ঠিক ওই পৃষ্ঠাটাই মেলে রাখা। রঞ্জন কি পড়ে ফেলেছেন লেখাগুলো? আমি চট করে ওড়না গায়ে জড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পরলাম। বাসার কেউই এখনো ঘুম থেকে উঠেননি। শ্বাশুড়ি মা বোধহয় উঠেছেন। কিন্তু তিনি এখন রুম থেকে বের হবেন না। রান্নাঘরে কাজের খালা মাত্র হাতমুখ ধুঁয়ে নাস্তা বানাতে শুরু করেছেন। আমাকে দেখে বললেন, “কি ভাবী? কিছু লাগবো?”
আমি আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম, “উনাকে দেখেছেন?”
খালা ভ্রু কুঁচকালেন,
—“কারে?”
—“রঞ্জনকে।”
আমি এমন কি বললাম? খালা হো হো করে হাসতে হাসতে কেঁদে দিচ্ছিলেন প্রায়। ঠাট্টার সুরে বললেন,
—“আপনের উনারে দেহি নাই ভাবী। ক্যান? রুমে নাই?”
—“নাহ্।”
—“তাইলে মনে অয় বাইরে গেছে।”
আমি চুপচাপ চলে আসলাম রুমে। কিছু ভাল্লাগছে না। রঞ্জন আবার আগের মতো কখন হবেন? আমার পুরোনো রঞ্জনকে খুব মনে পরছে।
ভোরের আকাশ শেষে দুপুর হতে চললো। রঞ্জন তখনো আসেননি। আমি কয়েকবার ফোন দিয়েছিলাম। সেটাও ধরেননি। মন খারাপ নিয়ে রান্নাঘরে কাজ করছিলাম। শ্বাশুড়ি মা ডাইনিংটেবিলে বসে পান সাজাচ্ছেন। পান সাজানো শেষে সেটা মুখে পুরে আমাকে হঠাৎ ডেকে বললেন, “রঞ্জনকে আজকে সকালে দেখলাম না যে? কোথায় ও?”
আমি কি উত্তর দেব? আমি নিজেও তো জানি না। মৃদু স্বরে বললাম, “আমাকে বলে জাননি মা।”
—“কখন গেছে বাহিরে?”
—“ভোরে বোধহয়। আমি তখন ঘুম ছিলাম।”
শ্বাশুড়ি মায়ের মুখে আঁধার ছেয়ে গেল। চোখ-মুখ কুঁচকে বললেন, “তুমি কই থাকো? ওর খবর রাখতে পারো না?”
আমি ধারণা করেছিলাম, তিনি এমন কিছুই বলবেন। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম পরবর্তীতে আবার কি বলেন। হয়তো আমার পড়ালেখা নিয়েই বলবেন৷ এবং সেটা অবশ্যই ভালো কিছু।
সত্যি সত্যি মা পড়ালেখার বিষয়বস্তু টেনেই কথা শুরু করলেন, “তোমার পড়ালেখা কেমন চলছে? ভাল ভাবে পড়ো তো নাকি?”
—“পড়ছি মা। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।”
—“ভালো করে পড়ো। ফেল করলে কিন্তু আর পড়াবো না। রেজাল্ট শুনে যেন পাড়াপ্রতিবেশি চমকে যায়, এমন ভাবে পড়বা।”
আমি শুধু মাথা দুলালাম। আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। শুরুতে আমার পড়ালেখা নিয়ে আপত্তি করলেও এখন বেশ যত্নবান হয়ে গেছেন তিনি। পড়ালেখা করার সময়টাতে কোনো কাজ করতে দেননা। প্রায়ই রাত্রিবেলা এটা সেটা বানিয়ে রুমে নিয়ে আসেন। রঞ্জনের মা একটু অদ্ভুত ধাঁচেরই। এই ভালো তো এই খারাপ। আমি প্রথম প্রথম খুব জানতে চেষ্টা করতাম, উনি আসলে কি চান? এমন করেন কেন? এখন সেসব ছেড়ে দিয়েছি। থাক না। ইদানিং সংসারটা আপন আপন লাগে। এসব জেনে আমার কাজ কি? আমি তো ভালোই আছি।
–
রঞ্জন যখন এলেন, তখন আকাশে একফোঁটা আলো নেই। চাঁদটাও মেঘে ঢেকে আছে। বাসায় কারেন্টও নেই। বিকাল বেলা ঝড় হয়েছিল। সেই ঝড়ে কি যেন সমস্যা হয়েছে। আমি অন্ধকার রুমে মোম জ্বালিয়ে শুয়ে আছি। জুতার খটখট শব্দে রঞ্জন রুমে ঢুকলেন। আমার দিকে একবার তাকালেন আড়চোখে। হাতে অনেকগুলো কাগজ রোল করে ধরে আছেন। সেগুলো টেবিলে সশব্দে রেখে বললেন, “তোমার কলেজে গিয়েছিলাম। যে যে নোট লাগবে বলেছিলে, নিয়ে এসেছি।”
একটু থামলেন। শরীরের শার্টটা খুলে নতুন টি-শার্ট গায়ে জড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, “কারেন্ট নেই কখন থেকে?”
আমি উত্তর দেইনি। রঞ্জনও উত্তরের অপেক্ষাতে নন। ব্যস্ত ভঙ্গিতে কাকে যেন ফোন করে নিজেই জেনে নিলেন কারেন্টের অবস্থা। আমি খুব বিরক্ত হলাম। এত কিসের ব্যস্ততা উনার? এত ব্যস্ততা কাকে দেখাচ্ছেন? সকাল থেকে উধাও হয়ে নাটক করছেন আমার সাথে?
ফোনে কথা বলা শেষে রঞ্জন আবার বললেন, “আজকে আর কারেন্ট আসবে না তুলি। টেবিল লাইট কোথায়? মোম জ্বালিয়ে বসে আছো কেন?”
আমি এবারও উত্তর দেইনি। উনি কি বুঝতে পারছেন না আমি অভিমান করেছি? সে তো এত অবুঝ নন।
রঞ্জন নিজেই টেবিল লাইট খুঁজে জ্বালিয়ে দিলেন। আমি প্রথম বারের মতো ভীষণ বিরক্তি নিয়ে বললাম, “লাইট জ্বালিয়েছেন কিজন্য?”
সাথে সাথে লাইট-টা বন্ধ করে দিলেন রঞ্জন। তারপর চুপচাপ বারান্দায় চলে গেলেন। আমি কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলাম। এভাবে বলা উচিত হয়নি। কিন্তু ভেতর ভেতর কে যেন খুব আনন্দ পাচ্ছে রঞ্জনকে বকে।
আমি শোয়া থেকে উঠলাম। আস্তে আস্তে বারান্দায় গিয়ে ঠিক রঞ্জনের বাম পাশটায় জড়ো পদার্থের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। রঞ্জন সিগারেট খাচ্ছিলেন। আমি আসার সাথে সাথে ফেলে দিলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, “এখানে অনেক অন্ধকার। রুমে যাও।”
আমার মোলায়েম অনুরোধ, “কথা বলব।”
রঞ্জন বোধহয় লম্বা নিশ্বাস ফেললেন। শুনতে পেয়েছি। বললেন, “পাশে বসো। কি কথা বলবে শুরু করো।”
সময় নষ্ট করলাম না। রঞ্জনের গা ঘেঁষে বসে পরলাম। আমি জানি না আমার কি হয়েছে। কিন্তু রঞ্জনের রাগ, অভিমান যেটাই থাকুক আজকে আমাকে ভাঙ্গাতে হবে। এভাবে থাকা সম্ভব না। দম বন্ধ হয়ে আসে।
—“আপনি আয়মানকে কিভাবে চেনেন?”
—“ছবি দেখে।”
অবাক চোখে তাকালাম, “ছবি দেখে?”
—“তোমার রুমের আলমারিতে শার্ট রাখতে গিয়ে একটা ছবি পেয়েছিলাম।”
আফসোস, দীর্ঘশ্বাসে একাকার হয়ে গেলাম। আয়মানের ছবি একটা আমার কাছে ছিল। আমি অনেক যত্নে ছবিটার পেছনে লিখেছিলাম, “আমার স্বপ্নপুরুষ আয়মান, আমি তোমাকে চাই।” রঞ্জন নিশ্চই সেটা পড়েছেন? আমি অনুভব করলাম, আমি ভয় পাচ্ছি। ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে। কি বলে কৈফিয়ত দিবো? আমার কি চিল্লিয়ে বলা উচিত, চাই না আয়মানকে। শুধু রঞ্জনকে চাই।
ঠোঁট জোড়া শুষ্ক হয়ে গেছে৷ জিভ দিয়ে আলতো ভিঁজিয়ে নিলাম। কাঁপা গলায় খুব আস্তে শুধালাম, “আপনি কি আমাকে অবিশ্বাস করছেন?”
রঞ্জনের শক্ত কণ্ঠের উত্তর, “না।”
তবুও… মন শান্ত হলো না। আস্তে করে ডাকলাম, “রঞ্জন?”
সে জবাব দিলেন না। আমার দিকে শূণ্য চোখে তাকালেন। দৃষ্টিটা আমার পছন্দ নয়। কেমন পর পর। বুকের ভেতরের তোলপাড়গুলো অশ্রু হয়ে চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরলো। আমি আচমকা রঞ্জনের হাত শক্ত করে ধরলাম। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে যেটুকু দরকার সেটুকু শক্তি, বিশ্বাস, সাহস আর জোর সঞ্চয় করে বললাম,
—“আয়মানকে আমি ভালোবাসি না রঞ্জন। ও শুধু আমার ভালো লাগা ছিল। ও আমার কেউ না।”
—“আর আমি? আমি তোমার কে?”
সরব, আমি চমকে তাকালাম। রঞ্জনের মুখশ্রী মোটেও কোনো কৌতুক করছে না। সে বড্ড থমথমে। আমার গলা কাঁপলো। কণ্ঠনালি হ’র’তাল জানালো, কথা বলবে না। আমি তবুও বললাম, “আপনি আমার বিশেষ কেউ।”
রঞ্জন নড়েচড়ে উঠলেন, “বিশেষ বলতে?”
“কাছের মানুষ।”
“কত কাছের?”
“একদম কাছের।”
“বেশি বেশি কাছের?”
“অনেক বেশি কাছের।”
“কিন্তু তুমি তো আমাকে পছন্দ করো না।”
“কে বলেছে?”
“খাতায় লিখেছো।”
“পছন্দ করি তো।”
“মিথ্যে বলছো।”
“না, সত্যি করি।”
“আর দূরে দূরে থাকবে?”
“থাকবো না।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে বলো, ভালোবাসি।”
আমি একটু সময় নিলাম। রঞ্জন অধীর হয়ে চেয়ে আছেন। চোখ খিঁচে বন্ধ করে আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, “ভালোবাসি।”
কয়েক মুহুর্ত। আমি আবিষ্কার করলাম, আমি রঞ্জনের বা পাশটায় মাথা এলিয়ে আছি। সে খুব শক্ত করে ধরে আছেন আমাকে। বিড়বিড় করে বলছেন, “আমি আরও বেশি ভালোবাসি তুলি। তোমার থেকেও বেশি। অনেক বেশি। তুলি, আমি কি আনন্দে পাগল হয়ে যাচ্ছি?”
____________
সমাপ্ত~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা