টিংটিংটুংটাং
৫.
সেবার আমাকে বিক্রি করে দেবার নাম করে রঞ্জন আমাকে নিয়ে এলেন আমার বাড়িতে। এতদিন পর মা-বাবাকে পেয়ে আমি ভীষণ আবেগাপ্লুত হয়ে উঠলাম। রঞ্জনকে প্রায় ভুলেই বসলাম। দুপুরে খাওয়ার সময়ও তার কাছে যাইনি। অনেকটা পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি। এজন্য যে রঞ্জন আমার সঙ্গে অভিমান করেছেন, তা ভালো করেই জানি।
বিকেলে ছাদে ছিলাম। কাজিনরা মিলে আড্ডা হচ্ছিল। আমি রেলিংয়ের একপাশে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিলাম। নিচে দেখলাম, রঞ্জন আর বাবা একসাথে কোথায় যেন যাচ্ছেন। রঞ্জনের পরনে এখনো সেই সকালের শার্ট। ক্লান্ত লাগছে দেখতে। মুখটা অল্পসল্প ফুলিয়ে রেখেছেন। বেশি রাগ করেছেন কি? উনার বাচ্চাদের মতো আচরণ দেখে আমি একটু হাসলাম। তাকিয়ে তাকিয়ে উনাকে পরখ করার সময়টাতেই রঞ্জন হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে উপরে তাকালেন। আমার ওপর নজর পরতেই মা’রা’ত্ব’ক তীক্ষ্ণ করে ফেললেন দৃষ্টি।
আমাদের বাড়ির গেট-টা লোহার তৈরি। পাশেই বড়োসড়ো একটা শিউলি গাছ দারোয়ানের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে। মাথার ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা-কমলা রঙের ফুল আর সবুজ পাতার ঘনত্বের জন্য সূর্যের আলো পৌঁছাতে পারেনা। ছায়া-আলোর লুকোচুরিতে লুটোপুটি খায় সিমেন্টের মেঝে। রঞ্জন ঠিক সেখানটাতেই দাঁড়িয়ে আছেন। মাঝে মাঝে বাতাসের ছোঁয়ায় শিউলি ফুলগুলো ঝরে তার চুলে, কাঁধে এসে পরছে। আমি ছোটবেলা থেকেই খুব কল্পনা করতে ভালোবাসি। বিয়ের আগ মুহুর্তেও কল্পনায় আমার একটা রাজকুমার ছিল। যে আমাকে ভালোবাসবে, স্নেহ করবে। আমাকে নিয়ে যাবে তার সুখ সুখ পৃথিবীতে। যেখানে দুঃখ পৃথিবীর কেউ আমাকে ছুঁতে পারবে না। বিয়ের পর আমি এই কল্পনাটাকে পুরোপুরি মাটিচাপা দিয়ে দিয়েছিলাম। অথচ কখনো ভাবিনি, রঞ্জন নামক আমার ভীষণ অপছন্দের মানুষটাই আমার কল্পনার রাজকুমার হয়ে একদিন আমার কাছে ফিরে আসবে।
রঞ্জন দৃষ্টি ফিরিয়ে চলে গেলেন। গেট লাগানোর ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে আমার ঘোর ভাঙ্গতে গিয়েও ভাঙ্গলো না। আমি মিইয়ে রইলাম আবারও সেই পুরোনো ভাবনায়। কিন্তু সেখানে কোথাও কিশোরী বয়সের আবেগমাখা প্রথম ভালো লাগাকে খুঁজে পেলাম না। আমার মস্তিষ্ক বারংবার এক নামই উচ্চারণ করছিল, “রঞ্জন! রঞ্জন! রঞ্জন!”
–
রঞ্জন ফিরলেন সন্ধ্যায়। আমি তখন রুম গোছাচ্ছিলাম। রুমের একপাশে লাগেজ রাখা ছিল। সেই লাগেজের অবস্থা দুরবস্থা করে রেখেছেন সে। জামা কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে এলাহী কান্ড! চেইনের একপাশ ভেঙ্গে গেছে। আমার রাগ লাগেজের ওপর উগড়ে দিয়েছেন হয়তো। মুখ দেখে মনে হচ্ছে, এখনো রাগ কমেনি। ভ্রু দ্বয়ের মাঝখানে দৃঢ় ভাঁজ পরে আছে। আমি একবার আড়চোখে তাকালাম। রঞ্জন শার্ট খুলছেন। প্রচন্ড গরমে ফর্সা ত্বক রক্ত বর্ণ ধারণ করেছে। শার্ট দেখে মনে হচ্ছে, বৃষ্টিতে ভিঁজে এসেছেন। ঝটপট আমার কাছে এসে শার্ট-টা ছুঁড়ে মারলেন আমার গায়ে। গোছানো লাগেজ থেকে টান দিয়ে শার্ট বের করতে গিয়ে পুরো লাগেজটা আবার এলোমেলো করে দিলেন।
এবার আর চুপ থাকতে পারলাম না। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে শুধালাম, “কোনো কাজ কি ঠিক মতো করতে পারেন না? এভাবে কেউ কাপড় নেয়?”
উনি যেন কথাটা কানেই তুললেন না এমন ভাবে বললেন, “টাওয়াল কই?”
“বারান্দায়।”
“নিয়ে আসো।”
দিরুক্তি করিনি। উনাকে অস্বাভাবিক লাগছে। কণ্ঠও শান্ত নয়। গম্ভীর। ভীষণ গম্ভীর। যেন জোর করে কিছু চেপে রেখেছেন। আমি টাওয়াল আনতেই হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে নিলেন। ওয়াশরুমে যেতে যেতে সাবধানী বাণী ছুঁড়লেন, “ভুলেও রুম থেকে বের হবে না। আমি না আসা পর্যন্ত চুপচাপ ভালো বাচ্চা হয়ে থাকবে। যদি আবারও পালানোর চেষ্টা করো, আমি কি করবো আমি নিজেও জানি না।”
কথাগুলো শুনে একটু অবাকই হলাম। রঞ্জনকে এতটা রেগে যেতে কখনো দেখিনি। উনার এই রাগটা কি শুধুই আমার ওপর, নাকি অন্য কোথাও? দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাগেজ আবারও গোছাতে শুরু করলাম। রঞ্জনকে আমি কখনো বুঝে উঠতে পারিনা। তার একেক সময় একেক রুপ আমাকে দ্বিধায় ফেলে দেয়। মানুষটা আসলে চায় কি? সে কি আমাকে ভালোবাসে? লাগেজ গুছিয়ে চেয়ারের ওপর একটু শান্ত হয়ে বসার চেষ্টা চালালাম আমি। হাতদুটো আড়াআড়ি ভাবে টেবিলে রেখে সেখানে মাথা গুঁজে দিলাম। আমার যখন খুব মন খারাপ হয়, আমি এভাবেই পড়ার টেবিলে মাথা এলিয়ে দেই। পুরোনো অভ্যাস। শরীর, মন, মস্তিষ্ক একটু চাপ মুক্ত হতেই রঞ্জন একেবারে গোসল সেড়ে বেরিয়ে এলেন। চুল না মুছেই ভেঁজা টাওয়াল ছুঁড়ে মারলেন বিছানায়। এ লোকের হয়েছে কি? এত ছুঁড়াছুঁড়ি করছে কেন আজকে? আমার ধৈর্য শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। আমার আত্মা রুষ্ট হয়ে মনে মনে বেশ চেঁচালো, “ইয়া মাবুদ! আমাকে ধৈর্য, শক্তি দুটোই দাও।”
কিন্তু অকপটে খুব সুন্দর করে বললাম, “কি হয়েছে? চুল না মুছে টাওয়াল বিছানায় রেখেছেন কেন? বিছানা ভিঁজে যাচ্ছে।”
“চুল মুছে দাও।” তার দৃঢ় গলার স্বর। আরও একদফা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি উঠে দাঁড়ালাম। মুখের উপর মানা করাটা জানি না বলে আজকে এইদিনও দেখতে হচ্ছে।
চুল মুছতে গিয়ে আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। রঞ্জনের এতটা কাছাকাছি আমি কখনো হয়নি। তবে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, রঞ্জনের চুলগুলো অনেক ঘন। একটু খাড়া খাড়া হয়ে থাকে। ছোটবেলায় মা বলতেন, জেদি মানুষের চুল খাড়া খাড়া হয়। রঞ্জন যে ভ/য়ং;কর রকমের জেদি, তার কোনো সন্দেহ নেই। আমতা আমতা স্বরে বললাম, “নাস্তা আনবো?”
আগের মতো রুক্ষ গলায় বললেন, “নাহ্।”
আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুপ থাকলাম। নিজেকে ধাতস্ত করলাম ক্ষীণ। তারপর আবার বললাম, “আপনি কি এখনো রেগে আছেন? আমি আর করবো না।”
—“কি করবে না?”
—“আর দূরে দূরে থাকবো না।”
—“অথচ তুমি শুরু থেকেই দূরে দূরে আছো।”
রঞ্জন কি একটু হাসলেন? আরেকটুর জন্য খেয়াল করিনি। আমি নিশ্চুপ ভাবে চুল মোছা শেষ করলাম। চলে যেতে নিলেই রঞ্জন আচমকা আমার হাত ধরে তার পাশে বসালেন। তার পুরুষালি রুক্ষ হাতটা আমার কোমড়ের উন্মুক্ত অংশ চেপে আছে। একটু দৃঢ় ভাবেই। ব্যাথা পাচ্ছি। কিছু বলার আগেই সে গমগমে গলায় প্রশ্ন করলেন, “আয়মান কে তুলি?”
চমকালাম, খুব বাজে ভাবে। আয়মান! আমার কিশোরী বয়সের আবেগের নাম। রঞ্জন কিভাবে চেনেন ওকে? হতবাক হয়ে চাইতেই রঞ্জন আবার বললেন, “এজন্যই আমাকে ভালোবাসো না?”
রঞ্জনের কণ্ঠস্বর মোটেও শান্ত না। তবে তার চোখে আকুতি দেখতে পাচ্ছি আমি। একজোড়া বিষণ্ণ, উদাসীন নয়নে আমাকে না পাওয়ার তীব্র আফসোস দেখতে পাচ্ছি। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় আমি কথা বলতে পারছিলাম না। চোখ পিটপিট করে নতুন রঞ্জনকে দেখছিলাম।
জবাব না পেয়ে রঞ্জন একটু বিচলিত হলেন। পরক্ষণেই আমার কাঁধে আলতো করে কপাল ঠেকিয়ে জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিতে লাগলেন। ওভাবেই বললেন, “আমি একটু তৃপ্তি চাচ্ছি তুলি। একটুখানি তৃপ্তি কি আমার পাওনা নয়?”
রঞ্জনের গলা বুঝি একটু কাঁপলো? কেঁপেছে হয়তো। আমি বোঝার আগেই সে আমাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। নিজেই টাওয়াল বারান্দা মেলে দিয়ে আসলেন। আমি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। কিঞ্চিৎ স্তব্ধ হয়ে। সে বললেন, “তোমার সার্টিফিকেট, বই সব গুছিয়ে রাখো। আমি তোমার স্যারের সাথে কথা বলেছি। কলেজে ক্লাস করা লাগবে না। শুধু পরীক্ষার সময় এখানে এসে পরীক্ষা দিবে।”
আমি জানি, আমার উচিত ছিল রঞ্জন রুম থেকে বের হওয়ার আগেই তাকে আটকানো। এই ভুল বোঝাবুঝির সমাপ্তি টেনে বলা, “আয়মান আমার কেউ না।”
কিন্তু আমি পারিনি। চুপচাপ নিস্তব্ধ, বদ্ধ ঘরে বসে ছিলাম অনেক্ষণ। রাতে শোয়ার সময়টাতেও রঞ্জনকে কথাটা বলতে পারিনি। আমাদের দুজনের শরীরের দূরত্ব কিঞ্চিৎ মাত্র ছিল। তবে মনের দূরত্বটা বোধহয় পরিমাপ করা যাবে না। আমি সারারাত এক মিনিটের জন্যও ঘুমাতে পারিনি। এপাশ-ওপাশ করেছি। অশান্তিতে নিশ্বাস নিতে পারিনি। বলবো, বলবো করে রঞ্জনকে টু শব্দ পর্যন্ত বলতে পারিনি। দ্বিধা-দ্বন্দে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। মিস্টার আলফাজ রঞ্জন, আপনি আমাকে কি করে দিলেন বলুন তো? জাদুটোনা কিছু জানেন বুঝি? আমি তো আপনাকে চাইনি। আপনি নিজেই এসেছেন। এসে আমাকে এলোমেলো করে দিয়েছেন। আমি তো এমন ছিলাম না।
________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা