টিংটিংটুংটাং
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
২.
এতগুলো মানুষের সামনে ভিঁজে শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে আমার প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছিল। বাহিরে বৃষ্টি তখনো থামেনি। আচমকা আচমকা ঠান্ডা বাতাসেরা শরীর ছুঁতেই শরীর শিরশির করে উঠছে। দাঁতে দাঁত লেগে একটা বিশ্রী শব্দে আমি নিজেই বিরক্ত হচ্ছি। আমার শ্বাশুড়ি মা তাড়াতাড়ি করে এগিয়ে এলেন। হাতের তোয়ালে আমার মাথায় মেলে দিয়ে কড়া গলায় রঞ্জনকে বললেন, “তোরা এভাবে ভিঁজেছিস কিভাবে? সত্যি করে বল!”
রঞ্জন দাঁত বের করে হেসে বললেন, “গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছিল আম্মু।”
—“আচ্ছা? আমার কাছে ড্রাইভারের নাম্বার আছে। পরে তোর খবর করছি।”
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, “আমার সাথে আসো।”
আমার শ্বাশুড়ি মা অদ্ভুত ধাঁচের মহিলা। একেক সময় ভালো তো একেক সময় খারাপ। আমাকে দেখতে আসার দিনই আমি নিশ্চিত ছিলাম, তার সাথে আমার কোনো কালেই বনবে না। মুখ একটা গম্ভীর করে রাখেন তিনি। কম কথা বলেন। এখনো এই বাড়ির কর্ত্রী বলেই কিনা!
ভেঁজা শরীর নিয়ে রুমে ঢোকা মাত্রই তিনি কেমন গম্ভীর গলায় শুধালেন, “ভিঁজলে কিভাবে? রঞ্জন কিছু করেছে?”
আমি একটু ইতস্তত করলাম, “কিছু করেনি আন্টি।”
“আন্টি? আন্টি কি? বাপের বাড়ি থেকে কিছু শিখে আসো নি? শ্বাশুড়িকে কেউ আন্টি বলে?”
কথাটা বুকে বিঁধলো। আমি এসব শুনতে মোটেও অভ্যস্ত নই। তবে চোখের কোণে পানি জমা হতে দিলাম না। আস্তে করে বললাম, “স্যরি, মা।”
শ্বাশুড়ি মা আর কিছু বললেন না। বুঝতে পারলাম, আমার ওপর বেশ বিরক্ত তিনি। কাজের মেয়েটাও ততক্ষণে লাগেজ নিয়ে এসেছে।
–
আমি যতটা বাজে, পাগল ভাবি রঞ্জনকে, সে আসলে তেমন না। একটু বেশিই মিশুক প্রকৃতির। সবার সাথে মিশতে পছন্দ করে। আমি যখন শীতে কাঁপাকাঁপি করে কম্বলের নিচে শুয়ে ছিলাম, সে এসেই আমাকে দেখে হেসে ফেললো। তার শরীরে তখনো ভেঁজা চিটচিটে পাঞ্জাবি। একহাতে চুলগুলো ঝারতে ঝারতে বললো, “কি মেয়ে, একটু ভিঁজেই এই অবস্থা? বাসর ঘরের তো বারোটা বাজিয়ে দিয়েছো। ফুলটুল ছিঁড়ে এক অবস্থা! কম্বল পেলে কোথায়?”
আমার গলা থেকে কথাই বের হচ্ছে না, “আলমারি থেকে। মা দিয়েছেন।”
কথাটা এত আস্তে ছিল যে, আমি নিজেই নিজের কথা শুনতে পেরেছি কিনা সন্দেহ। কিন্তু রঞ্জন বুঝলেন। মাথা দুলিয়ে বললেন, “বেশি ঠান্ডা লাগছে?”
—“হ্যাঁ।”
—“আমি তো একটু পর এসি চালিয়ে দেব। তখন কি করবে?”
চোখ বড় বড় করে বললাম, “এই শীতে এসি চালু করবেন মানে?”
—“বলেছি না আমার মাথায় সিট আছে? আমার গরমকালে শীত আর শীতকালে গরম লাগে।”
আশ্চর্য হয়ে মুখে তালা লেগে গেল। ইনি কি আসলেই কলেজের প্রফেসর? প্রশ্নটা মাথায় কিলবিল করছে খুব। শরীরটাও কেমন গরম হয়ে আছে। থেকে থেকে কাঁপছে। জ্বর আসবে হয়তো। আমি আর কথা বাড়ালাম না। দেখলাম, রঞ্জন আলমারি থেকে প্যান্ট, টি-শার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকছেন। মিনিটের মাঝে বেরিয়েও এলেন। আমি ভয়ে ছিলাম একটু। আমি রঞ্জনকে মোটেও মেনে নেইনি। সে যদি কাছে আসতে চায়? বাঁধা দিলে যদি রেগে যায়? মনে মনে ভয়ে সিটিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সে কাছে এলো না। এসিও চালালো না। বড়, লম্বা টেবিলে বসে কিসব কাগজ ঘাটতে লাগলেন। আমাকে বললেন, “তুমি ঘুমাও তুলি। আমি একটু কাজ করবো। লাইট জ্বালানো থাকলে সমস্যা হবে?”
আমি তৎক্ষণাৎ মাথা নাড়ালাম। সে যত দূরে থাকবে ততই ভালো। কিন্তু আমি বুঝিনি, সে আসলে আমার অস্বস্তি টের পেয়েই কাছে আসেনি। কাজের বাহানায় আমাকে সময় দিয়েছে।
আমি জানি না তখন কটাবাজে। তবে আন্দাজ করা যায়, গভীর রাত। সম্ভবত দুইটা, তিনটা। জ্বরে আমার ঘুম হঠাৎ করেই ভেঙ্গে যায়। আমার আবার মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। মাথার যন্ত্রণা আমি তখন সহ্য করতে পারছিলাম না। থরথর করে শরীরের কাঁপুনি আমাকে আরও দূর্বল করে দিচ্ছিল। মুখ থেকে অজান্তেই গোঙানির শব্দ বেরিয়ে যাচ্ছিল। হয়তো কাঁদছিলামও। আচমকা টের পেলাম, আমার পাশে কেউ বসেছে। আস্তে আস্তে ভেঁজা কাপড় আমার কপাল ছুঁচ্ছে। এত শান্তি লাগলো তখন! আমি আস্তে করে তাকালাম। রঞ্জন চিন্তিত মুখে আমার দিকেই চেয়ে আছেন। আমি তাকাতেই উদ্বীগ্ন হয়ে বললেন, “বেশি কষ্ট হচ্ছে তুলি?”
আমি খুব আস্তে আস্তে নিশ্বাস নিচ্ছিলাম। কথা বলতে পারছিলাম না। সে এবার একটু ঝুঁকে আমার গাল আলতো করে ধরলো। নরম সুরে বললো, “আ’ম স্যরি মাই এঞ্জেল। এমনটা হবে আমি একদমই বুঝতে পারিনি।”
আমার চোখে হঠাৎ করেই তূর্যয় ভেসে উঠলো। আমার আবেগ! ছোট্ট কাল থেকে বয়ে বেড়ানো অনুভূতি! আবার রঞ্জনের চিন্তিত মুখটাও আমার ভেতরটা নাড়িয়ে দিলো। তূর্যয়ের সাথে রঞ্জনের কোনো মিল নেই। চেহারায়, আচরণে কিচ্ছুতে না। আমার তূর্যয়কে মনে পরলো ঠিক, কিন্তু এই প্রথম রঞ্জনকে পাশে পেয়ে নির্ভয় হলাম। আমার যন্ত্রণা হঠাৎ করেই একটু কমলো। ভীষণ আস্তে বললাম, “আমি আপনাকে একদমই পছন্দ করিনা।”
সে হাসলেন, “জানি।”
—“কখন থেকে জানেন?”
—“বিয়ের আগ থেকে।”
—“তাহলে বিয়ে করেছেন কেন?”
—“তোমাকে ভালো লেগে গিয়েছিল।”
—“ভালোবাসেন আমাকে?”
—“একটু আগেও বাসতাম না। এখন বাসি।”
—“আমি আপনাকে কখনো ভালোবাসবো না।”
মুহুর্তেই রঞ্জনের মুখটা মলিন হয়ে গেল। তুলতুলে কাপড় আমার কপাল থেকে সরিয়ে পানিতে ভেঁজালেন, হাতে চিপে পানি ঝড়ালেন, তারপর আবার কপালে রেখে বললেন, “আমার এক ব্যাচমেটকে আমি একটুও পছন্দ করতাম না। ওর নাম সবনম। ও কিন্তু ছেলে ছিল। ওর সাথে আমার একদমই বনতো না। আমি ওকে সবসময় ওর নাম নিয়ে খেপাতাম। বই ছিঁড়ে দিতাম। ও-ও কম না, পরীক্ষার হলে একদিন আমাকে চুরির আপবাদ দিয়ে আমার একটা পরীক্ষাও বাতিল করে দিয়েছিল। একবার তো মারপিটের মাত্রা এত বেশি ছিল যে আরেকটু হলে টিসিই হয়ে যেত। সেই সবনম একদিন রাস্তা পার করতে গিয়ে বিরাট এক্সিডেন্ট করে ফেললো। এ খবর শুনে আমি কি করেছিলাম জানো? উল্টো প্যান্ট পরে দিলাম এক দৌড়! হাসপাতালের সুন্দরী মেয়েগুলো আমাকে দেখে সেকি হাসি! এ নিয়ে আমি ওর সাথে হাসপাতালেই একটা ভ’য়াব’হ ঝগড়া বাঁধিয়ে ফেলেছিলাম। ভাবতে পারছো? এখনো অবশ্য করি। ও আমার আজীবনের শত্রু। আমরা প্রায় বারোবছর ধরে একে অপরের শত্রু।”
আমি চুপচাপ শুনছিলাম। চোখজোড়া রঞ্জনের দিকেই স্থির। উনি আমার নাক টেনে বললেন, “তাহলে এখন কি বুঝলে? বন্ধু থেকে শত্রুরা বেশি আপন হয়। বন্ধু সবসময় খোঁজ খবর না নিলেও একমাত্র শত্রুই তোমার ক্ষতি করার জন্য সবসময় তোমার খোঁজ রাখে, রাখবে। আমিও হলাম তোমার আজীবনের শত্রু।”
এরপরের কিছু আমার আর মনে নেই। সকালে শ্বাশুড়ি মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গল। তিনি আমার পাশেই বসে ছিলেন। আমার ঘুম ভাঙ্গতেই নাক কুঁচকে বললেন, “তুমি তো দেখি ভালো জাতের মেয়ে না। বিয়ে হতে না হতেই জ্বর বাঁধিয়ে শুয়ে আছো। এত মেহমানকে এখন আমি কি বলবো?”
কথাগুলো শুনে আমার মাথা নুয়ে গেল। কষ্টগুলো দলা পাকালো গলার একদম মধ্যখানে। তার পরপরই শ্বাশুড়ি মা নিজ থেকে আমাকে শোয়া থেকে উঠিয়ে বসালেন। আবার নিজ হাতে আমাকে নাস্তাও খাইয়ে দিলেন। পুরো আমার মায়ের মতো। আমি এতটা বিস্ময় নিতে পারছিলাম না। রোবটের মতো দরজার কাছটায় তাকাতেই দেখলাম, রঞ্জন দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মিটিমিটি হাসছেন। তাদের বাসার সবাই কি এমনই পাগল? হতে পারে। আমি তো এখনো বাড়ির কারো সাথে তেমন পরিচিতই হয়নি।
_________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা