টিংটিংটুংটাং
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
আমাদের এলাকা মফস্বলের কাছাকাছি। মফস্বলই বলা চলে। সেই সমাজের রীতি ধরেই আঠারো পেরোতে না পেরোতেই বিয়ে করতে হয়েছে। যার সাথে বিয়ে হয়েছে, তার নাম আলফাজ রঞ্জন। আগে রাজনীতি-টীতি করতেন। এখন সেসব ছেড়ে চট্টগ্রামের একটা কলেজে অধ্যাপক হিসেবে নতুন চাকরি নিয়েছেন। বয়স আমার তুলনায় বেশিই। এই ধরুন, উনার ২৬ বছর হবে হয়তো। বিয়ের দশ দিন আগে আমি তাকে প্রথম দেখেছিলাম। আমাকে দেখতে আসার দিন। সাধারণ প্যান্ট, টি-শার্ট পরে সোফায় বসে ছিলেন সটান হয়ে। যেন পাত্রী দেখতে নয়, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই নাস্তা খেতে এসেছেন।
আমি বরাবরই একটু চাপা স্বভাবের। গোছালো ধরণের মেয়ে। তার এমন অগোছালো রুপ দেখে আমার তাকে একটুও পছন্দ হয়নি। কিন্তু পরিবারের চাপাচাপি, আত্মীয়সজনের উৎসুক দৃষ্টির বাহিরে বাবার প্রতি সম্মানের দোহাই দিয়ে আমি কাউকে মানা করতে পারিনি। বিয়ের আগে অবশ্য তার সাথে কথা হয়েছিল। ৫মিনিটের ছোট্ট আলাপ। আমার স্পষ্ট মনে আছে, গায়ে হলুদের ঝামেলা মিটিয়ে আমি মাত্রই ঘুমানোর জন্য বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছিলাম। ফোনটা বাজলো তক্ষুণি। কল ধরার পর আলাপটা শুরু হয়েছিল অনেকটা এমনভাবে,
—“তুলি বলছো?”
প্রচন্ড পুরুষালি গলার আওয়াজ। মনে হচ্ছে রেগে কথা বলছে। শুনলে ভয় লাগে। আমি ধীরেসুস্থে উত্তর দিলাম, “জি।”
—“চিনেছো আমাকে? আমি রঞ্জন। নাম্বার সেভ আছে তো?”
—“জি আছে।”
—“অনুষ্ঠান শেষ তোমাদের?”
—“জি।”
আমার মনে হলো, সে অকারণেই একটু হেসেছে। নিঃশব্দে। তবে অনুভব করার মতো। রয়েসয়ে সুধালো,
—“তুমি কি খুব কম কথা বলো?”
এভাবে হঠাৎ জিজ্ঞেস করায় আমার একটু অস্বস্তি হলো। ছোট্ট করেই বললাম, “জি।”
—“ভেরি গুড। আমার কাছে আসার পর তুমি আর কম কথা বলতে পারবে না।”
রঞ্জনের আশেপাশে বোধহয় তার বন্ধুবান্ধব ছিল। তাদের হৈ-হুল্লোড়ের আওয়াজ আমার কান পর্যন্ত আসছিল। এত এত অশ্লীল কথা! তাও আবার গলা ফাটিয়ে পুরো এলাকাকে শুনিয়ে দিচ্ছে।
রঞ্জন তাদের ধমক দিয়ে এরপর আমাকে কি যেন প্রশ্ন করলেন। লজ্জায় আমি উত্তর দিতে পারলাম না। তার মুখের ওপর কল কেটে দিলাম। সে আবারও কল দিলো। আমি সাইলেন্ট করে রেখে দিলাম। আমি কেন যেন তখনো রঞ্জনকে মেনে নিতে পারছিলাম না। তাকে আমার একটুও পছন্দ হচ্ছিল না। একটু না।
বিয়ের দিন আমি তাকে দ্বিতীয় বারের মতো দেখলাম। এবার সে অগোছালো হয়ে না, বরং সুন্দর, পরিপাটি, সুদর্শন একজন মানুষ হয়ে আমাকে নিতে এসেছেন। হাসি হাসি মুখ করে না থাকলেও তার চেহারায় এক আলাদা তৃপ্তি খেলা করছিল। তবুও আমি তার সাথে সহজ হতে পারছিলাম না। বিদায়ের পর গাড়ির একপাশ চেপে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিলাম। অজানা কারণে মনে হচ্ছিল, সে এক হিং”স্র পশু। কিছু থেকে কিছু হলেই রেগে ধমকে উঠবেন। অথচ আমাকে চমকে দিয়ে রঞ্জন হঠাৎ করেই হু হা করে হেসে উঠলেন। যেই সেই হাসি নয়, একদম শরীর কাঁপানো হাসি।
—“আমি কি দেখতে খুব বাজে? আমাকে ভয় পাচ্ছ কেন?”
আমার মিথ্যে বলার অভ্যাস নেই। কিন্তু এ প্রশ্নের পিঠে সত্যি বলতে ইচ্ছে করলো না।
—“ভয় পাবো কেন? পাচ্ছি না।”
—“অথচ তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি এখনই কেঁদে দেবে।”
আসলেই কি এমন লাগছে? আমি মনে মনে একটা আয়না খুঁজলাম। হাতের কাছে না পেয়ে নিজেকে ধাতস্ত করার চেষ্টা করলাম। এতেও কাজ হচ্ছে না। রঞ্জন হেসেই চলেছেন। ওভাবেই ড্রাইভারকে বললেন, “মকবুল? পানি আছে সাথে?”
সাথে সাথে সামনে থেকে খসখসে কণ্ঠের উত্তর এলো, “আছে, ভাইজান।”
—“দাও তো।”
ড্রাইভার পানির বোতল দিতেই রঞ্জন বোতলের ডাকনা খুলে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। বাহিরে ততক্ষণে প্রচন্ড বাতাসেরা আন্দো’লন শুরু করে দিয়েছে। গাড়ির ভেতর সেই বাতাস আসতে না পারলেও এসি চলছে। হঠাৎ করেই ভীষণ ঠান্ডা কাবু করে ফেলল আমাকে। তবে ভালো লাগছে। মুহুর্তটাকে উপভোগ করা শিখে গেছি যেন। অনুভব করলাম, রঞ্জন আমার দিকে একটু এগিয়ে আসছেন। সঙ্গে সঙ্গে অনুভূতিগুলো উড়ে গেল। শক্ত হয়ে গেল শরীর। রঞ্জন যদিও বেশি কাছে আসলেন না। আমার থেকে এক-দুই ইঞ্চি দূরত্ব রেখেই বসলেন। একটু হেসে বললেন,
—“আমাকে দেখে কি তোমার রাগী মনে হয়?”
আমি উত্তর দিলাম না। উনি বোধহয় উত্তরের অপেক্ষাও করলেন না। বলে গেলেন, “হতেই পারে। সবার মনে হয়। কিন্তু আমি স্বভাবের দিক দিয়ে মোটেও রাগী, শান্ত নই।”
কথাটা আমি বিশ্বাস করে ফেলেছি। করতে বাধ্য। একজন রাগী মানুষ কখনোই এভাবে কথা বলতে পারে না। রঞ্জনের প্রতি আমার ধারণা একটু হলেও বদলে গেল। কিন্তু জড়তা একফোঁটাও কমলো না। পানি খেয়ে আমি বোতলটা আমাদের দুজনের মাঝে একটা অদৃশ্য দেওয়াল হিসেবেই রেখে দিলাম। রঞ্জন দেখতে খারাপ নন। আমার ভেবে রাখা হিং’স্র মানুষটিও সে নন। কিন্তু তাকে আমার এখনও ভালো লাগছে না। এর কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, আমি একটা ছেলেকে পছন্দ করতাম। প্রেম-ট্রেম কিছু নয়, শুধুই পছন্দ। আমার আবেগের বয়স। তাকে নিয়েই যত জল্পনা-কল্পনা করেছি। হুট করে মাঝখানে রঞ্জনের ঢুকে পরাটা আমি মেনে নিতে পারিনি। বাহিরে পাতাদের উত্তাল ছোটাছুটির মতো আমার মনের ভেতরেও প্রচন্ড তোলপাড় হচ্ছিল। আমার কতকিছু বলার ছিল সবাইকে! কাউকে বলতে পারিনি। বুকটা নিঃশব্দেই খা খা মরুভূমি হয়ে গেল, কেউ টের পায়নি।
গাড়ির চাকা আচমকা থমকে গেছে। ভাবলাম, রঞ্জনের বাড়ি বুঝি পৌঁছে গেছি। কিন্তু না, গাড়ি কোথায় থেমেছে ঠিক ঠাওর করতে পারছি না। এক টুকরো আলো নেই কোথাও। আমি অবাক চোখে পাশ ফিরে তাকালাম। রঞ্জনকে দেখা যাচ্ছে না। ড্রাইভার গাড়ির সব বাতি বন্ধ করে দিয়েছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভয় না পেলেও পাশে থাকা মানুষটাকে আমার ভয় লাগছে। পেছন থেকে দেখলাম রঞ্জনদের বাড়ির গাড়িগুলো সাঁ সাঁ শব্দে এগিয়ে গেছে। ওদের সাথে আমার বোন তারাও আছে। আমার সাথে বৌভাত পর্যন্ত সেখানেই থাকবে। কথা ছিল আমার গাড়িতে থাকার। রঞ্জন নাকি দেননি।
—“গাড়ি কি নষ্ট হয়ে গেছে? এখানে থামিয়ে রেখেছেন কেন? সবাই যে চলে গেল।”
রঞ্জনের চেহারা এখনো দেখা যাচ্ছে না। এত অন্ধকার! শুধু অনুভব করলাম, গাড়ির দরজা কেউ খুলছে। পরপরই রঞ্জন আমার হাত ধরে বেরিয়ে গেলেন বাহিরে। বিস্ময়ে আমার তখন হার্ড অ্যা’টাক করার মতো অবস্থা। আমি প্রায় চিল্লিয়ে উঠলাম, “বাহিরে বেরিয়েছেন কেন? আপনি রঞ্জনই তো?”
—“ভিঁজে ভিঁজে যাবো। চলো।”
—“মানে কি?”
—“আমার মাথায় সিট আছে তুলি। আমার কখন কি করতে ইচ্ছে করে আমি নিজেও জানি না।”
তারপর ড্রাইভারকে বললেন, “আমি ফোন না করা অব্দি এখান থেকে নড়বে না মকবুল। বাবা ফোন করলেও ধরবে না।”
এরপর আবার আমাকে বললেন, “সামনেই বাড়ি। বেশি হাঁটতে হবে না। চলো।”
ভ-য়াব-হ বিস্ময়ে আমি কথা বলা ভুলে গেলাম। মন বললো, এ লোক রাগী, গম্ভীর না। এ লোক পাগল। পাগলের সাথে বিয়ে হয়েছে আমার।
কিন্তু তাই বলে যে আমি মুহুর্তটা অনুভব করিনি, তা নয়। বৃষ্টি আমার পছন্দের। বৃষ্টিতে ভিঁজলে মনে হয় সব গ্লানি বৃষ্টি তার সঙ্গে নিয়ে গেছে। রঞ্জনের হাতে হাত রেখে হেঁটে চলাটাও আমার এক মুহুর্তের জন্য ভীষণ ভালো লেগে গিয়েছিল। আমি যেন তখন রঞ্জনকে দেখতে পাচ্ছিলাম। হাসতে থাকা প্রানবন্ত আলফাজ রঞ্জন।
____________
চলবে~