ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-৫+৬

0
140

“ঝরা পাতা উড়ে যায়”
পর্ব- ০৫

শাহাজাদী মাহাপারা

মিলা সেই কখন থেকে সবার কথা শুনছে। মুহিনের অপেক্ষায় অপেক্ষায় বিরক্তি হচ্ছে। এখনো আসছে না কেনো? এই বাড়ির জঞ্জাল পরিষ্কার করতে অনেক সময় লেগে যাবে। দুতিন দিন তো লাগবেই একদিনে অসম্ভব। লুবা জিজ্ঞেস করলো, ” বার বার ঘড়ি দেখো কেন নতুন বউ? বরের অপেক্ষা আর সয় না তাই না?”

” হয় হয় অমন নতুন নতুন সবার হয়।” মরজিনার কথা শুনে সবাই নিচু স্বরে হাসলো।

শিফা বললো, ” এত কথা হলো কিন্তু আসল কথাইতো হলো না রেশমি আপা। ওদের বিয়েটা নোটিশ ছাড়াই কিভাবে হলো? ”

” হ্যাঁ তাইতো!” কলি বললো।
মিলা বুঝতে পারলো আজ সব গর্ত খুড়া হবে। রেহায় নেই। এরা এতো কথা বলে কেনো? কলিং বেলের আওয়াজে মিটিং পন্ড হলো। মিলা যেন এই বেলেরই অপেক্ষায় ছিলো। উড়ে গিয়ে দরজা খুলে এতো মিষ্টি করে হাসলো যে মুহিন ভেবাচেকা খেয়ে গেলো। হাতের থেকে বাজারের ব্যাগ নিয়ে সে বললো, ” আপনি চিলে এসেছেন? এতো দেরি হলো যে?” ভিতরে গিয়ে সে সোজা রান্না ঘরে গেলো। ব্যাগে লেবু দেখে লেবুর শরবত বানিয়ে এনে মুহিনের মুখের কাছে গ্লাসটা ধরলো৷

মুহিন দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকেই প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তার স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে মুহূর্তেই পরিস্থিতি সামাল দিলো। সালাম দিয়ে কুষলাদি জিজ্ঞেস করলো। মিলার বসা চেয়ারে গিয়ে সেও বসলো। ভাবিরা টিটকিরি করেই বললাও,”কি বউ আনছো মুহিন? প্রথম দিনেই তোমারে দৌড়ানি দেয়াইছে বাজারে।”

টিপ্পনী কাটা যেনো আনন্দের।হেসে হেসে তারা বলেও ফেললো, ” রেশমি ভাবির বোনকে বিয়ে করলে না তুমি, ম্যাজিস্ট্রেটের মেয়ে দেখাইলাম বিয়ে করলে না। অথচ এক দিনের বিনা নোটশে বউ ঘরে তুলছো। তুমি তো একটা ঘাঘু।”

মুহিন বোকা বোকা হাসলো প্রতি উত্তর করলো না। রেশমির ঋণ অনেক মুহিনের উপর৷ মুহিন রেশমি বলতে বোঝে আপন বড় বোন। সে রেশমিকে সম্মান করে, শ্রদ্ধা করে৷ বিপদে রেশমিকেই সবার আগে পাশে পেয়েছে সে। কিন্তু রেশমি যখন নিজের বোনের সাথে তার বিয়ের কথা বলেছিলো তখন সে রাজি হয়নি। এর পিছনেও কারণ রয়েছে যা সে রেশমিকে বলেনি।

মুহিন হেসে বললো, ” হুট করে বিয়ে করার জন্য দুঃখিত ভাবি। তবে পরিস্থিতিই অমন ছিলো যে কাওকে জানাবার সুযোগ হয়নি। ক্ষমা করে দিবেন। আপনারা সবাই আমার বিপদে আপদে পাশে ছিলেন কিন্তু আমি গতকাল অকৃতজ্ঞের মতো কাজ করেছি।”

মন গললো সবার। রেশমি বললেন,
” আরে এটা নিয়ে এতো পেরেসান হবার কি আছে? ও কি আজীবন এমন থাকবে নাকি? ওর বাচ্চাতো খুব ছোট। বিয়ে না করলেই বরং অস্বাভাবিক হতো বিষয়টা৷ তোমরা যে কেন ছেলেটার পেছনে লেগেছো?”

সবাই রেশমিকে খুশি করতেই বললো, ” ঠিক বলেছেন ভাবি। তবে আমরা মুহিনের সাথে মজা করবো বলেই বলছিলাম। ভাই মুহিন তোমার প্রতি আমাদের কিন্তু কোনো রাগ নেই। তুমি একদম ঠিক কাজ করেছো। কিন্তু কি এমন হয়েছিলো যে এইভাবে হুট করে বিয়ে করলে? পারসোনাল হলে বলো না।”

মুহিন পাশে দাঁড়ানো মিলার দিকে তাকালো। মুহিন জানে এখন কারণটা বললে মিলার অস্বস্তি হবে। তাই সে বললো, ” আমার অফিসের বসের সম্বন্ধির মেয়ে মিলা। বসের কথাতো ফেলা যায় না ভাবি। চাকরির ব্যাপার সেপার বোঝেনই তো। তাই আরকি। তাছাড়া মিলাও মাহতাবকে পছন্দ করেছে।”

লুবা বললো, ” আর তোমাকে করেনি বুঝি?”
মুহিন না চাইতেও লজ্জা পেয়েছে এমন ভাব করে মিলার দিকে তাকালো। একি! কি আশ্চর্য!
মিলা কি সত্যিই লজ্জা পেয়েছে? অমন মাথা নিচু করে হাসছে ঠিকাছে কিন্তু ওর ফর্সা গাল জোড়া লালাভ হয়ে আছে কেনো? সত্যিই কি লজ্জা পেয়েছে! নাকি গরমে এমন হচ্ছে?

সবাই চলে যেতেই মিলা ধপ করে সোফায় বসলো। ক্লান্ত লাগছে তার। সবাই বলে গিয়েছে পরে সময় করে এসে মিলার চেহারা দেখার জন্য গিফট দিয়ে যাবে। ওরাও সম্মতি দিয়েছে। মুহিন দরজা আটকে এসে সোফায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো, “ওরা কখন এসেছিলো?”
মিলা বললো, ” এক ঘন্টা আগে। আপনি এতো দেড়ি করলেন কেনো?”
” আপনার বিয়ের শাড়িটা লন্ড্রিতে দিয়ে এসেছি এইজন্যই আরেকটু দেড়ি হয়ে গেলো।”

মিলা ফের জিজ্ঞেস করলো, ” আচ্ছা,আপনি তাদের সত্যিটা বললেন না কেনো?” মুহিন চোখ সরিয়ে নিলো।

” লেবুর শরবতের জন্য ধন্যবাদ।”
” কথা এড়াচ্ছেন কেনো?”
” কথা এড়াচ্ছি না। আমি গিয়েছিলাম আপনার ফুফার বাসায়। স্যার কয়েকদিন যাবৎ অফিস আসছেন না। কিছু ফাইল সাইন করানো দরকার ছিলো। চাইলে পিয়নের হাতে পাঠিয়ে দিতে বলতে পারতেন। কিন্তু তিনি আমাকে নিজে গিয়ে তা দিয়ে আসতে বলেছেন। আমিও গিয়েছিলাম সেই উদ্দেশ্য থেকেই। অথচ গিয়ে দেখি আপনি প্রায় কনে সেজে বসে আছেন। আপনার বিয়ের শাড়িটা কিন্তু আমার কেনা না । আপনার ফুফুই কিনে রেখেছিলেন৷ মিলা আমি হয়তো আপনাকে পরিস্থিতিটা ঠিক ভাবে বুঝাতে পারছি না। ”

মিলা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
” থাক বাদ দিন। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। নামাজে যাবেন। আমি রান্না চড়াই৷ এমনিতেই সময়ের সাথে কুলানো যায় না তার উপর উটকো ঝামেলা।”
মুহিনের লাগলো।
” উঠকো ঝামেলা বলবেন না মিলা। বিপদের সময় এনারাই আমার পাশে ছিলো। একদিন দেখবেন আপনার পাশেও দাঁড়িয়েছে। ওইযে রেশমি ভাবিকে দেখেছেন না? সবার আগে উনিই ঝাপিয়ে পড়বে।” মুহিন আর মিলার উত্তরের অপেক্ষা করলো না। দৌড়ে কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। আজ বাথরুমটা মানুষের বাথরুমের মতো লাগছে। সকালেই মিলা পরিষ্কার করেছে বাথরুম। আজ বাথরুম আর বসার ঘর পরিষ্কার করার কথা ছিলো। সমস্যা হচ্ছে মিলা সবকিছুতেই শর্ত জুড়ে দিয়েছে। শর্তে শর্তে জর্জরিত জীবন। শর্ত গুলো নিয়ে পরে ভাবা যাবে। এখন যা জরুরি তা হলো মিলাকে বোঝা। তাকে বুঝতে না পারলে সম্পর্কটা নিয়ে এগুনো সম্ভব না। মিলা রগচটা। সম্ভবতঃ সবকিছুতেই তার বিরক্তি। কিন্তু মনের দিক দিয়ে ভালো। খাঁটি মানুষ।

মিলা মাহতাব কে ঘুম থেকে উঠিয়ে খায়িয়ে দিয়েছে। সে নিজেও গোসল করে নিয়েছে মাহতাবকে ঘুমে রেখে। মিলা মাহতাবকে অপছন্দ করে না৷ প্রশ্নই আসে না। তার ভাইয়ের বাচ্চাটাও মাহতাবের মতোই মাত্র দু মাসের বড়। মিলার মন খারাপ হয় বাচ্চাটা কেমন মা ছাড়া৷ মা থাকতেও নেই৷ তার মতই কিছুটা অভাগী। তার মা তাকে বুঝতে পারেনা। এই দুঃখ তার কোনোদিনই ঘুচবে না। মুহিনের অপেক্ষা করছে সে। সবাই নামাজ পড়ে চলে এসেছে মুহিনেরই দেরি হচ্ছে। এই লোক সবকিছুতেই ঢিলা কিন্তু বিয়ের সময় একদম ঠিক টাইমে পৌঁছে গিয়েছিলো। বারান্দা থেকে দেখা যাচ্ছে মুহিন গেইটের ভিতরে ঢুকছে। হাতে কি? স্প্রাইটের বোতল৷ মিলার হঠাৎ মনে হলো সে বিবাহিত। সত্যিই তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। অদ্ভুত অনুভূত হলো।

খাবার টেবিলে বসে মুহিন বললো, ” মাহাতাব খুব বিরক্ত করছে কি? আসলে আমি ছাড়া ও খুব একটা কারো সাথে মিশে নি।”
” বিরক্ত হবো বলেইতো এসেছি।”
মুহিন বুঝলো না মিলার কথাটা। সে ফের বললো,
” আসলে মাহতাব শুধু আমার আর রেশমি ভাবির কাছেই যা থেকেছে। এছাড়া তেমন কাউকে চিনে না। তাই যদি বিরক্ত করে বেশি আপনি প্লিজ একটু ধৈর্য নিয়ে হ্যান্ডেল করবেন।”

” আপনাকে মাছের মাথাটা দিবো? রুইয়ের মাথা। টমেটো আর নতুন ফুলকপি দিয়ে রেঁধেছি। একটু খেয়ে বলুনতো কেমন লাগে?”

মুহিন ভেবেছিলো মিলা এমনটাই বলবে কারণ মুহিনের প্লেটে সাদা ভাত বাড়া। মিলা চামচ নিয়ে তরকারির বাটিতে ঘাটছে।
মিলা কিছুই বললো না। নিজের প্লেটে মাছের চাকা টুকরো তুলে নিলো। মুহিন কিছুক্ষণ মিলার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেই বেড়ে খাওয়া শুরু করলো। এই নারী বড়ই নির্লিপ্ত। এর সাথে সংসার করা খুবই কঠিন কর্ম হবে।

চলবে…

“ঝরা পাতা উড়ে যায়”

পর্ব-০৬
শাহাজাদী মাহাপারা

অফিস থেকে ফেরার পথে মুহিনের ফোনে কল এলো। মুহিনের বস বলবে নাকি ফুফা শ্বশুর বলবে তিনি কল করেছেন। রিসিভ করে সালাম এবং কুশল বিনিময় করে তিনি মুহিনকে জানালেন মিলার আব্বা আম্মা তাদের মিলাদের বাসায় যেতে দাওয়াত দিয়েছেন। মুহিন বুঝলো না উত্তরে কি বলা উচিত!কারণ যে পরিস্থিতি থেকে তারা এসেছিলো আর তাছাড়া মিলার বাবারই উচিৎ ছিলো তাদের কল করা৷ ফুফা শ্বশুরকে দিয়ে কল দেয়ানোটা বেক্ষাপ্পা লাগে। যদিও তিনিই সবকিছুর কর্তা৷ মুহিন বললো, সে মিলাকে জিজ্ঞেস করে জানাবে। মিলা যদি রাজি থাকে তবেই তারা দাওয়াত গ্রহণ করবে৷

মুহিন বাসায় ঢুকতেই তার চোখটা জুড়িয়ে গেলো। বিগত একবছরে এই বাসার যে পরিবর্তন হয়েছিলো তা চোখে দেখার মতো ছিলো না৷ তার মনে দু ধরণের অনুভূতি খেলছে। এক ভালো লাগার আরেক বিষাদের। মিলা কি সুন্দর করে ড্রয়িং রুমটা সাজিয়েছে। নতুন সোফা কাভার লাগিয়েছে। এই মেয়ের কি বাজে খরচের ধাত আছে? না থাকলেই ভালো। নইলে তার পকেট “আমদানি আঠান্নি খরচা রুপিয়া” প্রবাদের মতো হয়ে যাবে। গত এক বছরে বুয়ার পিছনে যাওয়া যে পয়সা সে বাঁচিয়েছে সব শেষ হবে মনে হচ্ছে।

সোফায় হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো সে। কুসনের কাভার গুলো সুন্দর। রুচি আছে মিলার। মিলা রুমে ঢুকে বললো,” সোফা কাভার রেশমি ভাবিরা গিফট করেছেন। ওনারা আসলে বিকেলে বাসায় এসেছিলেন অনেক কিছু নিয়ে। বললেন বিয়ের গিফট। আমাদের উচিত সবাইকে একদিন দাওয়াত করে খাওয়ানো।”

মিলা কথা বলার সময় তার গলা দিয়ে খুশি বেয়ে পড়ছিলো৷ অথচ দুদিন আগেও এই বিয়েতে তার কি ভীষণ আপত্তি ছিলো।
” গিফট পেয়ে খুব খুশি মনে হচ্ছে। দেখেছেন বিয়ের কিন্তু লাভও আছে।”
মিলার হাসি পেলেও সে হাসলো না । উলটো টিপ্পনী কাটলো।

” হ্যাঁ। তাতো অবশ্যই। আপনার বাসার যে হালত ছিলো এক বছরে। বিনা পয়সার বুয়া পেয়েছেন সাথে নয়া নয়া জিনসপত্র উপহার পাচ্ছেন আপনার সংসার সাজানোর জন্য। লাভ তো অবশ্যই আছে।”

মুহিন ধরাশায়ী হলো। এই মহিলার সাথে মজাও করা যাবে না। মানুষকে নাস্তানাবুদ করতে সে পারদর্শী।

” কথায় কথায় খোঁচা দিয়ে অপমান করার ট্রেনিং কোথায় করায় আমাকে যদি বলতেন তাহলে আমিও ভর্তি হতাম ক্লাস করতে। ”
মিলা দমলো না।

” রুদমিলা’স পোক এন্ড ইনসাল্ট ট্রেনিং সেন্টারে। আপনার জন্য বিশেষ ছাড় থাকবে।”

মুহিন কিছুক্ষণ ভেবলার মতো তাকিয়ে থেকে ঘর কাপিয়ে হাসলো। মিলার কোলে মাহতাব ছিলো তাকে সোফায় শুয়িয়ে দিয়ে সে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে দিলো মুহিনের সামনে।

“আমি শুধু কুসন কাভার গুলো অর্ডার করেছিলাম সোফার কাভারের সাথে। যখন চলে যাবো তার আগে সব হিসাব চুকিয়ে দিয়ে যাবো। আমি খাতায় নোট করে রাখছি কোথায় কত খরচ করছি।”

মুহিন পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে মিলার দিকে তাকালো। বিশেষ কিছুই বললো না। ঢকঢক করে গ্লাসের পানি খালি করে মাথা ঝাকালো।

” আপনার ফুফা কল করেছিলেন।”
” কি বললেন?”
” আপনার বাবা আমাদের দাওয়াত করেছেন। ”
” ও৷ আপনার সময় হলো একদিন যাবো।”
মুহিন একটু অবাক হলো। মিলা সত্যিই সে বাড়িতে যেতে চাচ্ছে?
যেতে চাইতেই পারে। সারা জীবন কি সব ধরে রেখে বসে থাকা যায়? বাবা মায়ের সাথে বেশিদিন অভিমান করে থাকা যায় না।

******
খাবার টেবিলে বসে সবাই খাচ্ছে। হঠাৎ গমগমে কন্ঠ ভেসে এলো বা পাশ থেকে। মিতা মাথা নিচু করে আছে। ভদ্রলোক বললে,
“তুমি ফিরবে কবে?”
পাশ থেকে আরেকটা ভারী কন্ঠ বললো,
” মাস খানেক পর ফিরবো। তাছাড়া মিতার পাসপোর্ট আর ভিসা করতে দিয়ে যাবো। হয়ে এলে ওকে পাঠিয়ে দিবেন।”
মহিলা কন্ঠ বললো,
” কেনো? ওর আবার কিসের পাসপোর্ট,ভিসা? শোনো ফারদিন ওর সাথে তুমি কোনো প্রকার স্বাভাবিক বৈবাহিক সম্পর্কে যাবে না। এই মেয়েকে আমি যেভাবে নিয়ে আসছি ওইভাবেই ফেরত পাঠাবো। কতবড় বাটপার গুষ্টি এরা। দেখো কিভাবে মাথা নিচু করে দেখছে সব ভাব খানা এমন ভাজা মাছ উলটে খেতে জানে না। উলটে দিবো তোমার মাছ?” মিতার প্লেটে তখন সত্যিই একটা ভাজা মাছ ছিলো।
” আহ! তামান্না।” ভদ্রলোকের কন্ঠে বিরক্তি।
” তুমি এক কি প্যাঁচাল শুরু করেছো অশিক্ষিত মহিলাদের মতো। আর বাটপারের গুষ্টি আবার কি? ভুলে যাও কেন ওটা আমার চাচার ছেলে। আমার ভাই হয়।”
মুখ ঝামটালেন তামান্না খানম। ফাররুখ জামান সাহেব সেদিকে পাত্তা দিলেন না।
ফারদিন চুপচাপ খাচ্ছে তার এইসবে কোনো মাথা ব্যথা নেই। মিতার গলা দিয়ে আর খাবার নামতে চাইলো না। সে তবুও প্লেটের অবশিষ্ট খাবারটুকু শেষ করলো। তামান্না এই নিয়েও একচোট কথা শুনালেন।
” দেখো দেখো কেমন গোগ্রাসে গিলছে। কি হাভাতারে মেয়ে।” মিতা না পারতেই বললো,
” খাবার অপচয় করা উচিত না। আল্লাহ পছন্দ করেন না। আমার বাটপার আব্বাও পছন্দ করেন না।”
তামান্না সহ টেবিলে থাকা ফারদিন, ফাররুখ আর তারিন কে অবাক করে দিয়ে সে উঠে হাত ধুয়ে নিজের প্লেট ধুয়ে রুমে চলে গেলো।

মিতার সবকিছুতেই বিরক্তি বোধ হচ্ছে। গহনা,কাপড়, মেকাপ সবকিছুই তার কাছে তুচ্ছ মনে হচ্ছে। অথচ এইতো এক মাস আগেও তার শাড়ি,গহনার কত কত শখ ছিলো। জানালা দিয়ে মস্ত বড় একটা চাঁদ দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলোয় পুরো রুমটা রুপালি রঙ ধারণ করেছে। অথচ তার কাছে তাও যেন বিষাক্ত লাগছে। এমন রাতগুলোতে আপা আর সে এক বিছানায় জড়াজড়ি করে ঘুমাতো। গলা ছেড়ে গান গাইতো।

মিতার চোখের কোন বেয়ে নেমে আসা অশ্রুও চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে। ফারদিন রুমে ঢুকেছে কখন টের পায়নি সে। পেটে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো। আবার!
ভয়ে শরীর কাঁপছে তার।

এইযে কিছুক্ষণ আগে এই লোকটার মা তাকে নিষেধ করলো মিতার সাথে কোনো প্রকার শারীরিক, মানসিক সম্পর্কে যেতে। কি বিশ্রী ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি৷ অথচ এই লোকটার আসল চেহারা সে তার মাকে দেখাতে পারেনি। আজ চার দিন চলছে মিতার বিয়ের। প্রথম রাত থেকে মিতার শরীরের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে এই লোক। রাতভর এমন শক্ত পেশির নিচে পিষ্ট হচ্ছে সে। দমবন্ধ হয়ে আসতে চায় অথচ চিৎকার করতে পারে না। মিতার ফের ভয় হলো এই লোক তাকে শুধু ভোগবস্তু হিসেবেই দেখে। সদ্য বিশে পা দেয়া মিতার নরম শরীরের আজ একটুও শক্তি নেই। আজ মিতার শাশুড়ি তাকে দিয়ে চারটা বিছানার চাদর ধুয়িয়েছে। এতো ভারি চাদর সে কখনো ধোয়নি। এমন কি তাকে কখনো শক্ত কোনো কাজও করতে হয় নি৷ সে রান্নায় নিপুণা কিন্তু ভারী কাজ করতে পারেনা। এত গুলো চাদর ধুয়ে ছাদে নেড়ে দিয়ে এসে সে একটু শুতে চেয়েছিলো। তিনি তার বান্দবীদের চা নাস্তার দাওয়াত দিয়েছিলেন। মিতাকে পটের বিবি সাজিয়ে তাদের সামনে শোপিস করে বসিয়ে রেখেছিলেন। দুপুরের খিদে আর ঘুমে মিতার ঘাড়ের রগ টনটন করছিলো ব্যথায়। বমিও চলে আসছিলো একেক জনের বিদেশি পারফিউমের ঘ্রাণে। তার শাশুড়িকে চুপিচুপি সে বলেছিলো। অথচ ভদ্রমহিলা বলেছে এমন মিথ্যা ছুতো দিয়ে সে উঠে গেলে নাকি তার মান ক্ষুন্ন হবে। জোড় করেই তাকে বসিয়ে রেখেছে।

এখন ব্যথায় তার সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসতে চাইছে। ফারদিন মিতাকে ফিরিয়ে তার ঠোঁটের কাছে ঠোঁট নিতেই মিতা আর সহ্য করতে পারলো না। সমস্ত শক্তি দিয়ে ফারদিনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। তাতেও শেষ রক্ষা হলো না। ফারদিনের সাদা টিশার্ট মিতার বমিতে মাখামাখি অবস্থা। মিতা মুখ হাত দিয়ে চেপে দৌড়ে ওয়াশরুমে গেলো। রাগে ফারদিনের চ্যখের শিরাগুলো লাল হয়ে আছে। সে বাথরুমের দরজায় তার বিশাল হাত দিয়ে কয়েকবার থাবা দিলো। মিতা বের হলো না। তার নিজেকে নাড়ানোর শক্তিটুকু নেই। ফারদিন দ্রুত গেঞ্জি খুলে বাথরুমের সামনে ছুড়ে ফেললো। নিজের আরেকজোড়া ট্রাউজার গেঞ্জি নিয়ে বাহিররের ওয়াশরুমে ঢুকলো। তার ঘৃণা লাগছে। ফারদিনের যাবার আওয়াজ শুনে মিতা বাথরুম থেকে বের হলো। ফারদিনের গেঞ্জি দিয়েই মেজের বমি মুছলো। ফের ধুয়ে এনে আরেকটা মোছা দিয়ে। তা সাবান পানিতে চুবিয়ে রাখলো। কাল বুয়াকে দিয়ে ধোঁয়াবে। আর নইলে ওটাকে ঘরে পা মুছার কাপড় বানাবে। এ ঘরে শুধু একটা পাপস। বাসার কাজের লোকেরাও স্লিপার পড়ে হাটে। শুধু তার পা খালি। তাই ময়লা বাঝে বেশি। ভালো হলো একটা পাপস পাওয়ায়। সে হাত মুখ ধুঁয়ে এসে কম্ফোর্টার টেনে শুয়ে পড়লো।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে