‘ঝরা পাতা উড়ে যায়’
অন্তিম পর্ব
শাহাজাদী মাহাপারা
মিতা শপিং এ এসেছিলো তারিনের সাথে। নিজের জন্য টুকটাক কেনাকাটা করে ফারদিনের জন্য একটা ফাউন্টেনপেন আর একটা ঘড়ি কিনলো। এর চেয়ে বেশি কি দেয়া যায় গিফটে তা সম্পর্কে তার কোনো আইডিয়া নেই। ফারদিনের ফ্লাইট সম্ভবতঃ পরশু৷ সে মোটামুটি টুকটাক গোছগাছও করেছে। মিতা কোনো প্রশ্ন করেনি। ফারদিনও কিছু বলেনি।
মিতার অস্থিরতা কি তারিন বুঝতে পারছে?
তারিন বললো, ‘ ভাবি তোমার সাথে একজনের পরিচয় করাতে চাই৷’
‘আপু আপনি প্লিজ নাম ধরেই ডাকুন। আমি কমপক্ষে আপনার চার বছরের ছোট৷ আমার খুবই লজ্জা লাগে যখন আপনি ভাবি ডাকেন। ‘
তারিন হেসে ফেললো।
‘আমি তোমার ননদ৷ বড় ভাইয়ের বউকেতো ভাবিই ডাকে। আর তুমি এত মিষ্টি একটা মেয়ে তোমায় ভাবি না ডেকে উপায় আছে বলো?যাই হোক,তুমি এখন আমার সাথে একটা ক্যাফেতে যাবে৷ আমরা সেখানে কিছুক্ষণ গল্প করে এরপর বাড়ি ফিরবো। ‘ মিতা না করলো না।
ড্রাইভারকে বিদায় করে দুজন একটা ক্যাফেতে ঢুকলো। মিতা তারিনকে অনুসরণ করলো৷
একটা টেবিলে বসে তারা অর্ডার করলো৷ স্ন্যাক্স অর্ডার করলো দুজনে। কিছুক্ষণ পরই টেবিলে একজন এসে উপস্থিত হলো। মিতা মাথা তুলে তাকালো।
‘ স্যরি৷ বেশি অপেক্ষা করাইনি নিশ্চই।’
‘মারুফ স্যার।’
মারুফ চমকে তাকালো।
‘ রুস্মিতা৷’
তারিন একটু অবাক হলো।
‘ ইউ গাইজ নোউ ইচ আদার?’
‘ হ্যাঁ মিতা আমার স্টুডেন্ট ছিলোতো। সে অনেক বছর আগে। প্রায় ছ, সাত বছর তো হবেই।’
‘ মিতা কাষ্ঠ হাসার চেষ্টা করলো৷
‘ তুমি কি করে চেনো রুস্মিতাকে?’
‘ আমার ভাবি৷’
মারুফ যারপরনাই চমকালো।
‘ কি? এইটুকু মেয়ে? ওর বয়স জানো তোমরা?’
মারুফের এমন কথায় তারিন অফেন্ডেড ফিল করলো৷
‘ তোমায় সব ঘটনা আগেই বলেছি মারুফ৷ সিন ক্রিয়েট করবে না কাইন্ডলি৷ তাছাড়া পরিস্থিতি আমাদের হাতে ছিলো না। মিতা ভাবিকে কেউই জোর করেনি সে স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছে। এন্ড শি ইজ নট আ মাইনর।’
মিতা বুঝতে পারছে না কিছু। তবে তারিন তার ভাই কে ডিফেন্ড করছে এটুকু বুঝলো। তারও উচিৎ নিজের বর কে ডিফেন্ড করা৷
মিতা হেসে বললো,
‘ একেক জনের একেক রকম স্বপ্ন থাকে স্যার৷আর তাছাড়া ভাগ্য বলেও কিছু আছে। আপনি তো জানতেনই আমার ড্রিম ছিলো বউ সাজার। দ্রুত বিয়ের ইচ্ছে থেকেই এখন আমি ফারদিন এর ওয়াইফ, তারিনের ভাবি। আমি ভুল না ভেবে থাকলে তারিন আপনার বিশেষ কেউ একজন। সব ঠিক ঠাক থাকলে আমি আপনারও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধীর স্ত্রী, সম্পর্কে আপনার ভাবি হবো৷ তাছাড়া আমার বর কিন্তু বেশ হ্যান্ডসাম স্যার। দেখেছেন সবার সব ইচ্ছে পূর্ণতা না পেলেও আলহামদুলিল্লাহ আমার ইচ্ছে গুলো ঠিক পূরণ হয়েছে৷ আমি খুবই খুশি এখানে৷ ‘
মারুফ দেখছে তার সামনে বসা রুস্মিতা আর ক্লাস এইটে পড়া কিশোরী রুস্মিতার মধ্যে বিশাল পার্থক্য৷ পূর্বের দুষ্টু আর মিষ্টভাষী রুস্মিতার মধ্যে পার্থক্য হলো ব্যক্তিত্বের৷ প্রচন্ড অহংবোধ আর ব্যক্তিত্ববোধের সামনে বসা রুস্মিতা তাকে সত্যিই অবাক করেছে।
সে হয়তো সে সময় রুস্মিতাকে প্রত্যাখ্যান না করলে এই রুস্মিতা আজ তার থাকতো। কিন্তু সত্যিই কি এমন হতো? হতো না৷ কারণ এই রুস্মিতা এখন যেমন ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি করেছে তাকে সে গ্রহণ করতে পারতো না হয়তো। তারিনকে সে ভালোবাসে, পছন্দ করে কারণ তারিন স্পষ্টভাষী এবং স্বল্পভাষী, এছাড়া তারিন খুবই নরম স্বভাবের। মিতা তেমন না। মিতা ভিন্ন৷ আর কিশোরী মিতার ইনফ্যাচুয়েশন গ্রহণ করবে তেমন ব্যক্তিত্ব তার কখনোই ছিলো না৷ শিক্ষক হিসেবে সে মিতার সর্বাত্মক মঙ্গলই চাইতো এতে সন্দেহ নেই৷
মিতা নিজেও কৃতজ্ঞ মারুফের প্রতি। তিনি সত্যিই একজন চমৎকার শিক্ষক ছিলেন। তবে তার প্রত্যাখ্যান ভুলেনি সে। ভোলা উচিৎ ও নয়৷ আগামী দিন গুলোতে মিতা অতি অবশ্যই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করবে । যদিও এতে বড়াই এর কিছু নেই।
সিরিয়াস টপিক বাদ দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তারা সেখানে কথা বলেই কাটালো। মারুফ যে মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে পজিশন হোল্ডার তা জানালো। মিতা ফারদিনের সাথে অস্ট্রেলিয়া স্যাটেল হবে এটাও তারিন জানালো। মিতা শুধু হু হা তেই উত্তর করলো।
*****
মিলার ফোনে নোটিফিকেশন এলো টুপ করে। মাহাতাবকে কোলে নিয়ে সে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে। নোটিফিকেশন ওপেন করতেই তার এগাল ওগাল হাসি বিস্তৃত হলো। অবশেষে মুহিন তার স্ট্যাটাস চেইঞ্জ করেছে৷ কমপ্লিকেটেড থেকে ম্যারিড টু রুদ্মিলা হয়েছে। প্রোফাইলে তাদের গ্রামে তোলা আংটি পরানোর মুহূর্তের ছবি। আবার নোটিফিকেশন এলো। এবার দেদারছে ছবি দিয়েছে সে। গ্রামে যখন যত ছবি তুলেছে প্রায় সবই আছে। অনেক অনেক রিয়েকশন্স সাথে কমেন্টবক্সে অভিনন্দনের সয়লাব। শুভাকাঙ্ক্ষীদের এমন সয়লাব মিলার পক্ষ থেকেও৷ মিলা ছবি গুলো দেখছে৷ তারা ঠিক করেছে আবার যাবে গ্রামে মুহিনের নেক্সট ছুটিতে। ছোটবেলায় বান্ধবীদের মুখে শুনতো তাদের গ্রামের বাড়ির গল্প। কিভাবে গ্রামীণ জীবন তাদের টানে। নিজের গ্রামের বাড়ি থাকতেও মিলা মিতারা তেমন একটা টান খুঁজে পেতো না। অথচ এবার মুহিনের গ্রামে গিয়ে বুঝতে পেরেছে আসলে টানটা সৃষ্টি হয় সম্পর্কগুলো থেকে। পরেরবার ফারদিন আর মিতাকেও নিয়ে যাবে সে। খুব খুশি হবে তারা।
*****
ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন ল্যান্ড করার পরই মিতার বিশ্বাস হলো যে তারা সিলেট পৌঁছেছে।
নিজেকে এতো বোকা লাগছে মিতার। গতকাল সারা রাতই সে ফারদিনের বুকে শুয়ে কেঁদেছে। ফারদিনও তাকে একবারও বুঝতে দেয় নি যে কি হচ্ছে। ফারদিন যখন বুঝতে পেরেছে যে মিতা ভাবছে যে সে তাকে ফেলেই অস্ট্রেলিয়া ব্যাক করবে কাউকে কিছু না জানিয়া সে নিজেই বোকা বনে গিয়েছিলো। তারপর তার সে কি হাসি। মিতাকে বার কয়েক টিজও করেছে সে। মিতা বেচারি কাঁদোকাঁদো মুখ করেই তাকে নিজের কেনা গিফটগুলো দিয়েছে। ফারদিন এটা নিয়েও হেসেছে৷ তবে ভেতরে ভেতরে সে যে পুলকিত হয় নি তা কিন্তু না৷ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছে মিতার কান্ড।
ফারদিন এ কদিন ঘুরে ঘুরে মিতার জন্য শপিং করেছে। সব এনে একটা লাগেজে গুছিয়ে রেখেছে৷ বাকি একটা লাগেজ তার নিজের। ফারদিন যে আরও একমাস এখানে থাকবে মিতাকে তা বলা হয়নি। বেচারি কতটা ভয়ে ছিলো ভাবতেই ফারদিনের মন খারাপ হয় কিন্তু হাসিও পায়। এতো বোকা কেউ হয়? সাহস করে জিজ্ঞেস করলেই হতো। তাতে কি! মিতা যে তাকে কতটা ভালোবেসে ফেলেছে তা সে আজ উপলব্ধি করলো৷ এর থেকে ভালো আর কিছুই হতে পারে না৷ আর তাছাড়া সে সত্যিই যে চলে যেতে চেয়েছিলো তা তো মিথ্যে নয়। শুধু মিতাদের বাড়ি যাবার পরেই তার আশেপাশের সবকিছু বদলে যেতে থাকে, সে নিজেও।
মিতারা তাদের সেই সিলেটের দাওয়াতে এসেছে। এছাড়াও এটা আরেকটা ছোট হানিমুন তাদের৷ ফারদিন ফ্লাইটে আসতে আসতে জানিয়েছে মিতার ভিসা প্রসেসিং এর জন্যও দেয়া হয়েছে৷ এছাড়া মিতা সিডনিতে কোনো ইউনিভার্সিটি তে এডমিশন নিতে চাইলে নিতে পারে। মিতা এপ্লাই করেছে তাও জানালো।
মিতা যখন কাঁদছিলো ফারদিনকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে ফারদিন তখন মিতার সমস্ত মুখে অজস্র চুমু খেয়েছে। এবং সৃষ্টি কর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে মিতাকে তার করে দেয়ার জন্য৷ এমন মায়া যেনো তাদের মাঝে সবসময় থাকে সেই প্রার্থনাই সে করেছে৷
পরিশিষ্টঃ
অটাম শেষের দিকে প্রায়। দ্যা ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া তে আজকে কনভোকেশন ডে কোনো এক ব্যাচের। সবার ফ্যামিলি উপস্থিত আছে আজ। স্টেইজে রুস্মিতা তার গ্র্যাজুয়েশন সার্টিফিকেট নিতে উঠেছে৷ চারপাশ থেকে করতালির সম্ভাশন সাথে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। ফারদিন সকল ছবি ক্যামেরা বন্দিতে ব্যস্ত। রুদ্মিলা আর মুহিন কেও দেখা যাচ্ছে সেখানে। মিলার কোলে আরেকটা দেবশিশু। মাহতাবের বয়স এখন ৬ বছর। সিঙ্গাপুরে দেড় বছরের যুদ্ধের পর মিলা মা হতে পেরেছে। সন্তান সুখ তার ভাগ্যে নেই তা ভেবেই নিয়েছিলো সে। আর এটাও একটা এক্সিডেন্টই ছিলো বলা চলে৷ তবে মিলা হার মানে নি। তার আর মুহিনের অদম্য প্রচেষ্টা আর সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় তার নিজের জীবনও আজ কানায় কানায় পূর্ণ। মিলা মিতা একসাথে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু ছবি তুলছে মিতা গ্র্যাজুয়েশন ক্যাপটা মিলার মাথায় পরিয়ে দিচ্ছে৷ মৃদু মন্দ বাতাসে ঝড়া পাতাগুলো উড়ে যাচ্ছে।
সমাপ্ত।