‘ঝরা পাতা উড়ে যায়’
পর্ব-২৩
শাহাজাদী মাহাপারা
দুপুরে ঘন ডাল, লাল চালের ভাত, ডিম ভূনা, বিভিন্ন রকমের শাক আর ছোট, বড় মাছের তরকারি দিয়ে লাঞ্চ সেরেছে মিলা। মিলা খাবারের ব্যাপারে খুব চুজি। নাক সিটকানোর মতো৷ কিন্তু আজ বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছে৷ আচ্ছা মা বেঁচে থাকলেও কি এভাবেই রেঁধে খাওয়াতো?
মিলা ঘাসের উপর বসে আকাশ দেখছে৷ কিছুক্ষণ আগেই সে ভাত ঘুম থেকে উঠেছে৷ এ বাড়িতে এতো আনন্দ হচ্ছে তার ইচ্ছে করছে এখানেই থেকে যেতে। মৃদু বাতাসের দুলুনিতে ধান গুলো কি সুন্দর দুলছে৷ পাখি গুলো ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে৷ সূর্য কন্যা সুন্দরী আলো ছড়িয়েছে আকাশ জুড়ে। মিলা তার শাশুড়ির দেয়া একটা কাঁচা হলুদ রঙা শাড়ি পরেছে। সূর্যের সোনালী রঙ তার চোখে মুখে অন্য রকম দীপ্তি ছড়াচ্ছে। শাড়ির রঙটা যেনো তা আরও দ্বিগুণ করে দিলো। মুহিন বেশ কিছু ছবি মুঠোফোনে বন্দী করলো৷ মিলা দু হাতে ঘাসে হেলান দিয়ে মাথা এলিয়ে দিতেই তার এলোকেশ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে৷ সে প্রাণ ভরে শ্বাস নিচ্ছে এতো সুন্দর বাতাস কি এর আগে সে স্পর্শ করতে পেরেছে? বাতাসে মিলার শাড়ির আঁচল কোমড় থেকে সরে তার পেটের কিছু অংশ দৃশ্যমান করে তুললো৷ সূর্যের আভায় যেনো তা আরও ঐশর্গীক মনে হতে লাগলো মুহিনের কাছে। মিলাকে সোনালী আভা ছড়ানো কোনো গ্রীক দেবীর ন্যায় লাগছে। মুহিন মিলার পেছনে এসে বসে তার পেটে হাত রাখলো। মিলা এ স্পর্শ চেনে৷ মুহিন গতকাল এখানেই শুয়ে নিদ্রায় গিয়েছিলো। মিলা জিজ্ঞেস করলো,
” ঘুম শেষ? মাহতাব উঠে গিয়েছে?”
মুহিন মিলার কাঁধে চিবুক রেখে উত্তর দিলো,
” মাহতাব আম্মুর কাছে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় দিয়ে এসেছি। আমার ঘুম ভেঙে তোমায় না পেয়ে এখানে চলে এসেছি।”
” আপনাদের গ্রামটা কি সুন্দর। আপনার পরিবারটাও।”
” তুমিও৷ এই সবই এখন তোমার মিলা৷ আমিও।”
মিলা আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। সূর্য ডুববে কিছুক্ষণ পর। এবার উঠতে হবে। রাতে আজ পিঠা বানানো হবে। সংসার পিঠা, সিদ্ধ পুলি, ছিট রুটি, হাসের মাংস, ক্ষীর,শেয়ই পিঠা, ম্যারা পিঠা ইত্যাদি৷ আরও অনেক ঐতিহ্যবাহী পিঠা রয়েছে টাঙ্গাইলের। এছাড়া টাঙ্গাইলের বিখ্যাত চমচম, দই যা বড় ফুফু এনেছিলেন এত্ত স্বাদ ছিলো মিলা দু বাটি খেয়েছে। টাঙ্গাইলে সরিষা, কাসুন্দি, শাড়ি, বিখ্যাত মানুষ জন, জমিদার বাড়ি সবই ঐতিহ্য বহন করে।
সবাই মিলে বড় উনুনের কাছে বসেছে পিঠা বানাতে। হাসের মাংস আর সিদ্ধ পুলি গ্যাসে চড়িয়েছেন মিলার শাশুড়ি। ক্ষীর বিকেলেই রান্না করেছিলেন। মুহিন খুব মজা করে খেয়েছে। বাড়ির সবাই খেয়েছে৷ তিন্নি, মিলা আর কাজিনরা মিলে সংসার পিঠার জন্য ছোট ছোট লুচি বেলছে কেউ, কেউ আবার তা কেটে তাতে মুরগির মাংসের পুর ভরছে৷ মিলার শাশুড়ি খোলা চুলায় তেলে তা ভাজছেন৷ গল্পের আসর জমে উঠেছে৷ পুরনো দিনের গল্প। মুহিনের দাদা, বড় আব্বাদের সময়কার গল্প,রয়েছে জ্বীন ভূতুরে গল্পও। মিলার গা কিছুটা ছমছমিয়ে উঠছে৷ মুহিন পাশে বসে মিলাকে দেখছে মাহতাব কোলে খেলনা নিয়ে খেলছে৷ মাঝে মাঝেই হা হা হিহি করে হাসির রোল পড়ছে। সময়টা এভাবেই বয়ে যাচ্ছে৷
রাতের আকাশে শত সহস্র তারার মেলা৷ গুণে শেষ করার উপায় নেই৷ পাখিরা ঘরে ফিরেছে বহু আগেই। মুহিনের মনে হচ্ছে বহু বহু যুগ পারি দিয়ে সেও ফিরে এসেছে তার চিরচেনা নীড়ে৷ সাথে রয়েছে তার রাণী আর রাজপুত্র৷ সে খুব করে প্রার্থণা করলো স্রষ্টার নিকট এই আনন্দঘন মুহূর্ত গুলো যেন বার বার বহুবার তার জীবনে ফিরে ফিরে আসে৷ এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেও ভুললো না সে।
*****
বৌভাতের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে প্রায় তিন দিন আগে। মিতারা কক্সবাজার থেকে ফিরেছে আট দিন হতে চললো। হাতে সময় আছে আর পাঁচ দিনের মতো৷ বিগত আটদিন স্বপ্নের মতো কেটেছে মিতার৷ এতো দ্রুত সময় পাখা ঝাপটে উড়ে যাচ্ছে কেনো? কোনো উপায় কি নেই সময় কে বেধে ফেলার?
মিতার বৌভাতে মিলার আসা নিয়ে বেশ হাঙ্গামা করেছে তার শাশুড়ি৷ তবে তা বেশিক্ষণ চলতে পারেনি৷ ফারদিন বেদম ক্ষেপেছিল সেদিন। মিলাকে সেদিন মুহিনের সাথে দেখে খুব ভালো লেগেছিলো মিতার৷ তার আপাকে সে এতো হাসিখুশি কখনোই দেখেনি৷ তাদের পরিবারে আপা বেশ খানিকটা উদবাস্তুর মতনই বড় হয়েছে৷ তাদের পরিবার বলছে কেনো? আসলেতো আপার পরিবারেই তার মা আর সে ঢুকে পড়েছিলো। আপাকে মা কখনো খাবারের কষ্ট দেয়নি। পোশাকেরও না৷ তবে কষ্ট দিয়েছে ব্যবহার দিয়ে, ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করে। তাই হয়তো আপা মাহাতাবের প্রতি যেনো এই অন্যায় না হয় তাই খুব স্বচকিত এই ব্যাপারে। মিতার মা বাবা চাচা, ফুফুরাও এসেছিলেন পার্টিতে৷ মিতাকে অপ্সরীর মতো লাগছিলো দেখিতে। মিষ্টি গোলাপি রঙের কাজ করা জর্জেট শাড়িটা যেনো তার গোলাপি দেহের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো। মিতার শ্বশুর বাড়ির সবাই বেশ প্রশংসা কিরছিলেন ছেলের জন্য এত সুন্দরী বউ আনায়। কিন্তু তিনি খুব একটা খুশি হলেন না।
বৌভাতের পর মিতাদের দিন কাটছে ফারদিনদের বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনদের বাসায় দাওয়াতে গিয়ে গিয়ে৷ ঢাকা ছাড়াও ফারদিনদের সিলেটেও আত্মীয় রয়েছে৷ সেখানেও দাওয়াত রয়েছে। তবে সময় স্বল্পতার জন্য ফারদিনরা যেতে পারছে না। এ কয়দিন ফারদিন বেশ কিছু জায়গায় শপিং করে করেই কাটালো। মিতার সময় কাটছে বিভিন্ন বেসরকারি ইউনিভার্সিটি তে ভর্তির প্রিপারেশন নিয়ে। সে নিজের মাইন্ড ডাইভার্ট করতেই এখন এদিক ওদিক খুঁজছে। অস্ট্রেলিয়ার এক ইউনিভার্সিটিতেও এপ্লাই করেছে শুধু মাত্র ফারদিনের জন্য৷ তবে হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে ফারদিন এখনো ক্লিয়ার করে বলছে না তার চলে যাওয়ার ব্যাপারে। বাসায় এখনো কেউ জানে না৷ মিতা কারও সাথে শেয়ারও করতে পারছে না বিষয়টা। গুমরে মরছে ভিতরে ভিতরে। মিতা ঠিক করলো সেও যাবে শপিং এ ফিরে যাবার আগে ফারদিনকেওতো কিছু দিতে হয়। সে কারও পিছুটান হতে রাজী নয়। এতে তার আত্মসম্মানে যে আঘাত আসবে তা সে সহ্য করতে পারবে না। স্বাভাবিক বৈবাহিক জীবন সবাই চায় তবে ওদের এই আকস্মিক বিয়েটাকে ওরা এখনও মেনে নিয়েও মেনে নিতে পারছেনা। শারীরিক টান থেকে আসা ভালোবাসা আর মায়ার মাঝে যেন এখনো একটা দ্বিধার দেয়াল রয়েই গিয়েছে। মরিচীকার ন্যায় হাতরে বেড়াচ্ছে শুধু।
*****
মাহতাবকে সামান্য আলু গাজরের আর একপিস মাঝের খিচুড়ি খাওয়াচ্ছে মিলা। মা হওয়াটা আসলে কঠিন ব্যাপার। গর্ভে ধারণের চেয়ে বড় করে তোলাটাই কষ্ট সাধ্য। মিলার মাহতাবের প্রতি টান রয়েছে। হয়তো নিজের গর্ভজাত সন্তান নয় তবুও মিলা চায় না আরেকটা মিলা এই পৃথিবীতে তার নিগ্রানীতে বেড়ে উঠুক। তার কাছে যখন সৃষ্টিকর্তা একটা সুযোগ দিয়েছে অতএব তাকে সেই সুযোগের সঠিক ব্যবহার করতে হবে এবং সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে যে জন্মসূত্রেই নয় শুধু মাতৃত্ববোধ আর কর্মসূত্রেও মা হওয়া যায়৷ মা হতে বিশেষ কিছুর প্রয়োজন নেই একটা সুস্থ মন আর মানসিকতা ছাড়া৷ যেমন ফুফু তার জন্য তার মা হয়ে উঠেছিলেন একদিন৷ তেমনি মিলাও মাহতাবকে একটু একটু করে আগলে নেবে। জীবনটাকে সুন্দর করতে নিজেদের ছোট ছোট প্রয়াসই যথেষ্ট৷ এই যে মুহিন রোজ একটু একটু করে নিজেকে মিলার কাছে মেলে ধরছে এটা কি ভালোবাসার প্রকাশ নয়? হয়তো আরও কিছু বছর পর তাদের মাঝেও আর দশটা কাপলদের মতো সম্পর্ক হবে। মান অভিমান, রোজকের টুকটাক খুটিনাটি নিয়ে ঝগড়া খুনসুটি। হয়তো একটা সময় মায়া বেড়ে বেড়ে বিশাল সমুদ্রের আকার ধারণ করবে। মিলার ছন্নছাড়া চিন্তারা পাখা মেলে উড়ে বেড়ায় তাদের এই ছোট্ট বেডরুমটায়৷ হয়তো তখন এই বাসা থাকবে না, বেডরুম থাকবে না, দখিনের জানালাটাও থাকবে না কিন্তু মিলার জীবনে মুহিন থাকবে আর থাকবে মাহতাব। মায়া, আদর, স্নেহ, যত্ন সব দিয়েই সে এক বিশাল আঁচল রাঙাবে।
চলবে।