‘ঝরা পাতা উড়ে যায়’
পর্ব-২২
শাহাজাদী মাহাপারা
ভালোবাসার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ হয় কিভাবে? ফারদিনের জানা নেই। তবুও মিতা তাকে ভালোবাসে কি না তা নিয়ে তার দ্বিধা এখনো কাটেনি৷ এইজে সুন্দর তার দেহের উপর লেপ্টে ঘুমাচ্ছে এই রহস্যময়ী নারী৷ আচ্ছা সে কি নারী? বয়সই বা কত তার? মাত্রই তো বিশ। টিন এইজ পার করে এসেছে মাত্র। অথচ তার কথা বার্তা কত স্পষ্ট, তীক্ষ্ণ। প্রত্যেকটা কাজই গোছানো। এবং ভঙ্গুর না। অত্যন্ত শক্ত মানসিকতার মেয়ে, শুধু ধৈর্য কম। এতো বড় ধাক্কা সয়ে গিয়েও সে দিব্যি আছে তবুও ফারদিনের মনে হচ্ছে মিতাকে ঢাকায় ফিরে একবার কাউন্সিলিং এর জন্য নিতে হবে৷ শুধু মিতা না তার নিজেরও যাওয়া উচিৎ। তাদের সম্পর্কটাকে সুন্দরভাবে শুরু করতে চাইলে এইটা প্রথম প্রয়োজন৷ এতে মিতার মানসিক শান্তিটাও ফিরে আসবে৷
গতকালের রাতটা কতটা হেভেনলি ছিলো শুধু ফারদিনই জানে। এই মিতার সাথে আগের মিতার কোনো চেনা পরিচিতি নেই৷ মিতা যেন প্রথমবার খোলস ছেড়ে বেড়িয়েছিলো। কি অদ্ভুৎ মায়াময় একটা সময় কেটেছে তাদের৷ ভালোবাসা সবটুকু নিঙড়ে নিয়ে যেনো দ্বিগুণ হারে ফিরিয়ে দেয়া। ফারদিন মিতার দিকে তাকিয়ে হাসছে। দুপুরে ফিরতে হবে৷ মিতাকে কি এখন জাগানোটা ঠিক হবে? সমুদ্রের ঢেউগুলো যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাদের৷ কত কিছুই তো তাদের একসাথে দেখা বাকি৷ প্রথম দিন দুই তো বৃষ্টি আর অসুস্থতা নিয়েই কাটলো তাদের। ফারদিন ঠিক করলো আবার ফিরবে তার রুস্মিতাকে নিয়ে সমুদ্রের কাছে তাদের জীবনের মাধুর্যময় সনেট লিখতে৷
*****
মিলা হাঁটছে আইল দিয়ে৷ তার জলপাই রঙা শাড়িটা সবুজ ধানের সাথে একদম মিশে মিশে যাচ্ছে। মিলা হাসছে মুক্তঝরা হাসি। মুহিন বেশ কিছু ছবি তুললো তার। একটা ছোট ছাগলের বাচ্চা মিলার কোলে। কি সুন্দর মুহূর্ত গুলো৷ শিশির পরেছে ঘাসে ঘাসে। মুহিন আঙুল উঁচু করে করে মিলাকে দেখাচ্ছে তাদের ফসলী জমির সীমানা। মিলা দেখছে অবাক চোখে। মুহিন শক্ত করে মিলার হাত ধরে আছে। মাঠের একপাশে বড় একটা গাছে দোলনা বাধা মিলা দৌড়ে দোলনায় গিয়ে চড়লো৷ মুহিনের কি কারো কথা মনে পড়ছে? না। মনে করতে চাইছেও না সে। শুধু মাহতাব বাদে বাকি সবকিছুই পেছনে ফেলে আসা, অপ্রয়োজনীয়। সে শুধু এখন মিলাকে অনুভব করতে চায়। মিলা এখন আর তার কাছে অপরিচিতা নয়। তার সহধর্মিণী, বন্ধু, দোসর,তার তৃপ্তি, প্রাপ্তি এমনকি ভালোবাসাও। ভালোবাসারা সবসময় একই আদলে আসে না মুহিন তা গতকাল রাতের পর মানতে বাধ্য। স্নেহার জন্য তার ভালোবাসা ভিন্ন ছিলো। আর মিলার প্রতি ভালোবাসার মাত্রা ভিন্ন। সে ভেবেছে, মিলাকে নিয়ে। তার ভালোবাসা কি সত্যিই ভালোবাসা? নাকি শুধু মাত্র মিলা মাহতাবকে ভালোবাসে বলেই তাকে সে পছন্দ করে৷ নাকি মিলার প্রতি সিম্প্যাথী থেকেই সে কিছুটা দূর্বল। সে তার যথাযথ উত্তর পেয়েছে৷ রুদ্মিলাকে সে সত্যিই ভালোবাসে। হয়তো সময়ের সাথে তা বাড়বে বা ফিকে হবে কিন্তু নিঃশেষ হবে না। এক অদ্ভুৎ সুন্দর রাত কেটেছে তার৷ মিলার জন্য প্রথম হলেও তার প্রথম ছিলো না৷ অথচ নিজেকে আজ পরাজিত সৈনিক মনে হচ্ছে যে রাণীর কাছে পরাস্ত। এতো ভালোবাসতে জানে মেয়েটা৷ কিভাবে তার মর্যাদা ধরে রাখবে সে চিন্তায় বিভর সে। মিলাকে ছাড়া যে তার এক মিনিটও চলবে না সে বুঝে গিয়েছে। এখন শুধু মৃত্যু বাদে সে তাকে কাছ ছাড়া করতে নারাজ। এই যে তার এথেনা সামনে বসে খিলখিল করে হাসছে প্রাণখোলা হাসি। মিলাকে কখনো এভাবে হাসতে দেখেনি সে।
“কি দেখছেন? এতো দেখলে চোখ ক্ষয়ে যাবে৷”
” যাক৷ অন্ধ হলেও আমি তোমার হাসি খুব করে অনুভব করতে পারবো৷ ”
” খুব ফ্লার্টিং চলছে তাই না? অবশ্য ইউনিভার্সিটি তে তো আপনার পেছনে এর জন্যই আপা সমাজের লাইন লেগে থাকতো। ”
” সে বহু পুরোনো কথা। এখন আমার সবটা জুড়েই একজন। তার আমার স্বামীগত অধিকার ফ্লার্ট করা৷ ”
মিলা হাসছে।
” সত্যি করে বলো তুমি কি হার্ট হয়েছো? এটা সফট ফ্লার্টিং বুঝলে? আসলে সব মেয়েরাই চায় তাদের বড় ম্যাচিউর এন্ড ফ্লার্টিস দুটোই হবে। ”
” বাহ! খুব পিএইচডি করেছেন তাই না মেয়েদের উপর?”
” আরে নাহ৷ আমি বলছি কার আমি মনে হয় সত্যিই একটু রিসার্চ করেছি।ওহ পিএইচডি তে তো রিসার্চই করা হয় তাই না?”
মিলা আবারও হেসে ফেললো। মুহিন চমৎকার মানুষ৷ প্রচন্ড দুষ্টু কিন্তু কাছে না গেলে বোঝার উপায় নেই। এ কদিনে মনে হচ্ছে মুহিন তার পুরোনো স্বত্তাকে ফিরে পেয়েছে। চেহারা থেকে হাসি সরছেই না। মিলার খুব ভালো লাগছে। মুহিন যদি সব ছেড়ে ছুড়ে এখানে কৃষিকাজও করে খায় তাও মিলা সুখী সুখী মুখ করে রোজ তার জন্য খাবার নিয়ে আসবে এই আইল বেয়ে গামছায় বেঁধে। যাহ ওইসব দিন আছে নাকি এখনো! নিজের অদ্ভুৎ কল্পনায় হাসলো সে। সামনের বাড়িটা থেকে কেউ হাত নেড়ে ডাকছে মুহিনকে। মুহিন দেখলো তাদের এক চাচী৷ মিলার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো সে। সে পড়িমরি করে মাথায় আঁচল টানলো।
গ্লাস ভরা ডাবের পানি।
” নতুন ভাবী ডাবের পানি খাও। আজকে আমাদের এই গাছের ডাব সব পাইরা ফেলবো। প্রথম ডাবের পানিটা তোমার।”
মিলা গ্লাস হাতে নিলো৷ এত্তো ভালো লাগছে তার। চাচী বললেন,
” আর কয়দিন আছো বাপ? তুমি চইলা গেলেই ওই বাড়ির হইচই কইমা যাবে। সব নীরব হইয়া যায়। গত দুই বছরতো ফুচ্চিও দেও নাই। তোমার আম্মা কাইলকা নাতিরে নিয়া কত খুশি ছিলো। তোমার বাপেরেও দেখলাম চোখ ভিজা যাইতাছিলো সবার। মাতবর বাড়িতে কতদিন ধইরা এমন আনন্দ হয় না।”
চাচী শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন। মিলা অবাক হলো৷ তিনি কাঁদছেন কেনো। মুহিনেরও কি মন খারাপ লাগছে? একি তার নিজের চোখেও পানি। না না কান্না করা যাবে না৷
মিলা বললো,
” চিন্তা করবেন না চাচী৷ এখন থেকে প্রায়ই আমাদের দেখবেন। দেখতে দেখতে হাপিয়ে যাবেন।”
সবাই হাসলো। মুহিন মিলার দিকে তাকালো। পরিবেশ হালকা করার মতো গুণও তার বউয়ের আছে।
” চমৎকার বউ পাইছো মুহিন ভাই।”
সবাই আরেক দফা হাসলো।
মিলা ডাবের শ্বাস খেয়ে মুহিনের সাথে সাথে নামলো।
” চলেন বাজারে যাবো৷ আজ ওইখানেই নাস্তা করবো৷ ডিম পোচ, বুটের ডাল, পরোটা আর সাথে হালুয়া এবং গরম এক কাপ মালাই চা। চলবে?”
” চলবে মানে? দৌড়াবে, উসাইন বোল্টের মতো।”
মুহিন হাসলো। তার খুব করে বউকে চুমু খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু সম্ভব না। মুহিন দৌড়ে উপরে গেলো আবার ফিরলো চাচীদের বাড়ি থেকে চাচাতো ভাইয়ের সাইকেল টা ধার করে নিয়ে।
মিলা সাইকেলের পিছনে বসলো মুহিনের টিশার্ট শক্ত করে ধরে আছে সে৷ মুহিনের কথা বলা থামছেই না। মিলা দুবার তার পিঠে নাক ঘষলো। মুহিন বিরক্ত হলো না৷ হেসে বললো, ” আপনি এমন দুষ্টু হওয়া বন্ধ করুন। নইলে হয় আমি এক্সিডেন্ট করবো নইলে সাইকেল ঘুরিয়ে সোজা বাড়ি যাবো। তারপর সারাদিনে আর রুম থেকে বের হওয়া যাবে না।”
মিলা হেসে কাত৷ চাপড় দিলো মুহিনের গায়ে বার দুয়েক। মুহিনও হাসলো।
মেয়েরা বেশি কিছুতো চায় না৷ লোকে বলে ভদ্র ছেলে রেখে মেয়েরা সব সময় খারাপ ছেলেদেরই মন দেয়। বিষয়টা কি আদৌ এমন? মোটেই না। ম্যাক্সিমাম মেয়েই সম্ভবতঃ ম্যাচিউর বর চায় যে সবার সামনে নিজের পারসোনালিটি ধরে রাখবে। শুধু তার সব দুষ্টুমি,আহ্লাদ আর ফ্লার্ট তার জন্যেই বরাদ্দ থাকবে৷ ব্যস এইটুকুন খায়েশ।
বাজারে খেয়ে মিলারা বাড়ি ফিরলো। ফেরার সময় আরেক বাড়ির চাচী একটা বড় গরুর দুধের বোতল ধরিয়ে দিলো৷
দুপুরের রান্নার আয়োজন চলছে। ফুফুরা এখনো আছেন। আগামীকাল চলে যাবেন। মিলারা যাবে পরশু। মুহিন দুধের বোতল মায়ের হাতে দিয়ে বললো ঘন করে ক্ষীর রাধতে। মুহিনের গুড়ের ক্ষীর খুব পছন্দ৷
মিলা হাত মুখ ধুলো রান্না ঘরের পাশের টিউবওয়েল এর ঠান্ডা পানি দিয়ে। তার শ্বশুর বাড়িতে আধুনিক সবই আছে। কিন্তু পুরোনো কিছুই ফেলে দেয়া হয় নি৷ এই উঠানের এক পাশে বড় উনুন আছে। অথচ গ্যাস সিলিন্ডারও আছে বাড়ির ভেতরের রান্না ঘরে। এছাড়া টিউবওয়েল আছে এমন কি ঢেঁকির মতো বিলুপ্ত প্রায় জিনিসও আছে। আজ কয়েক পদের পিঠা বানাবেন ফুফুরা। তাই ঢেঁকিতে পার দেয়ার শব্দ আসছে। মিলা ঝুকে শাশুড়ির আঁচল দিয়ে হাত মুখ মুছেই ঢেঁকির কাছে ছুটে গেলো। এক উচ্ছ্বল কিশোরী। বড় ফুফু চাল দিচ্ছে ঢেঁকির সামনে আর ছোট ফুফু পার দিচ্ছে। মাহতাব তিন্নি আর কাজিনদের কাছে। মাহতাবের দিনকালও বেশ আনন্দে কাটছে। মিলাও কার্ণিশে উঠে আঁচল কোমড়ে পেঁচিয়ে শাড়ি উঁচু করে উপরে ঝোলানো বাঁশে হাত দিয়ে ঢেঁকি পার দিচ্ছে। মুহিন মিলার অবস্থা দেখে হো হো করে হাসছে।
” রাতে প্রচুর পা ব্যথা করবে দেখে নিয়েন৷”
ছোট ফুফু বললো,
” তুই টিপে দিবি পা। তোকে রাখা হইছে কেন? স্ত্রী সেবা বড় সেবা।”
মিলা আর বড় ফুফু হাসলেন।
মুহিনের খুব আনন্দ হচ্ছে।
চলবে।