‘ঝরা পাতা উড়ে যায়’
পর্ব-২১
শাহাজাদী মাহাপারা
ঠান্ডা সকাল, বাহিরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরছে। মিতার ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণ আগে৷ হোয়াটসঅ্যাপে আপার গতকালের ছবি। মিতা জিজ্ঞেস করেছে এটাই কি তার বৌভাত নাকি? মিতার টেক্সটের কোনো রিপ্লাই আর আসেনি। মিতা আরেকটা টেক্সট দিয়ে ঘুমিয়েছিলো ‘এঞ্জয়’। এরপর মিলার আরেকটা টেক্সট এসেছিলো যা মিতা এখন দেখলো তাতে লেখা, ‘সেইম গোজ টু ইউ।’ মিতা হাসলো ফারদিনের দিকে তাকালো সে উলটো হয়ে ঘুমাচ্ছে। এক হাতে মিতাকে বগল দাবা করে রেখেছে যেনো খাটের নিচে না পরে যায়। তার সাথে এতো ড্রামাটিক বিয়ে না হলে এতোক্ষণে সে ভালোবাসায় গদগদ হয়ে যেতো৷ অথচ ভাগ্যের পরিহাস মনে হয় তার কাছে সব। ফারদিনের সামান্য স্পর্শও তাকে অস্থির করে তোলে। সারাক্ষণ লেপ্টে থাকতে ইচ্ছে করে। আগে এমন ছিলো না৷ ইদানীং এমন হচ্ছে। ফারদিন চলে যাবে ভাবতেই আরও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে৷
মিতা বৃষ্টির ধারার দিকে তাকিয়ে ভাবছে ফারদিন যেভাবেই তার সাথে সম্পর্ক তৈরি করুক তাতে কি তার সায় ছিলো না? ফারদিনের স্পর্শেতো সে কখনো বাধা দেয় নি। নিজের কাছে সত্যি বলতে পিছপা হওয়া উচিৎ না। ফারদিন কখনো তাকে জোর করেনি। শারিরীক টান থেকেই তার কাছে এগিয়েছে হয়তো ভালোবাসাটা মানসিক বা আত্মিক ছিলো না। কিন্তু শারিরীক যে ছিলো না তা কিন্তু না৷ ফারদিন হয়তো তাকে জিজ্ঞেস করেনি, কিন্তু সে কেনো বাধা দেয় নি? বাসর নিয়ে অল্প বিস্তর সবারই ফ্যাসিনেশন থাকে মিতারও ছিলো। কিন্তু তার বাসর কি সত্যিই অতটা ম্লান ছিলো? নাহ তার এতে সায় ছিলো এবং অতি অবশ্যই ফারদিনের সংস্পর্শে সেই সময় তার কল্পনার চেয়েও রোমাঞ্চকর ছিল৷ জোর করে করা বিয়েতে সে কি নিজেও আক্রোশের বসেই কাজটা করেছিলো? হ্যাঁ। তার ঘৃণা হয় নি একবারও ফারদিনকে। তখন তার বোধজ্ঞানই ছিলো না। কি আশ্চর্য! ভাবলে তার বিষণ্ণ লাগে। ফারদিনের জন্যও খারাপ লাগে। সেতো মিতাকে জোর করেনি। মিতা স্বেচ্ছায় এগিয়েছে৷ ফারদিনের স্পর্শে সে শিহরিত হয়েছে, উদ্দম ভালোলাগায় ভেসেছে অথচ এরপরের রাত গুলো সে নির্জীব ছিলো। সে সাড়াও দেয়নি বারণও করেনি৷ তবুও ফারদিন তাকে অসম্মান করেনি অন্ততঃ। তারপর ফারদিনের কেয়ার তার প্রতি দিন দিন পাল্লা দিয়ে বেড়েছেই। এই যে এখন তার সাথে সেটে আছে তার কি ভালো লাগছে না? অসম্ভব৷ এর কারণ কি? সে ফারদিনকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। এটা শারিরীক ভালোবাসা নয়, এটা মন থেকে আসছে৷ সে রোজ একটু একটু করে মিতার মনে জায়গা করে নিচ্ছে। বয়সে সে মিতার নয় বছরের বড় অথচ এইজ গ্যাপ্টা তার কাছে এখন আর মেটার করছে না৷ রোজ কোনো না কোনো কারণে সে প্রেমে পড়ছে। হয়তো ফারদিন তাকে পোক করে কথা বলে কিন্তু তাতেও সে কষ্ট পায় না। সে নিজেই বা কম কিসে? সেও তো ছুরির মতো ধারালো জবাব দেয়৷
মিতা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে নিজের লক্ষ্য থেকে সরতে চায় না৷ ফারদিন চলে যাবে এবং সেও নিজের জীবন আবার গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে৷ ফারদিন ভালোবাসলে ফিরে আসবেই। সে জোর করবে না, বাধাও দিবে না৷ সে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। সে তার নিজের জন্য যোগ্য হয়ে উঠবে যেনো হীনমন্যতা তার কাছে না আসতে পারে৷ জীবনে আবারও সুন্দর করে বাঁচবে। হয়তো পথে অনেক বাঁধা আসবে কিন্তু সে হাল ছাড়বে না। কিন্তু এখনের মতো যে কদিন ফারদিন কাছে আছে সে কোনোভাবেই এই মুহূর্ত গুলোকে বিষাদ করে তুলবে না। সে নিজের জন্য কিছু অপার্থিব স্মৃতি তৈরি করবে আর ফারদিনকেও কিছু মনে রাখার মতো দিন উপহার দিবে৷ এরপর আর নাইবা দেখা হলো, নাইবা পাওয়া হলো। আফসোস জিয়িয়ে রাখবে না৷
ফারদিন মিতার ঘাড়ে গরম নিশ্বাস ছাড়লো। মিতা টের পেলো তার উষ্ণ চুমু৷ ফারদিন জিজ্ঞেস করলো, ‘ বাহিরে তাকিয়ে কি ভাবছো?’ মিতা উত্তর দিলো না তার হাতটা কম্ফোর্টারের নিচে নিয়ে শক্ত করে ফারদিনের হাত জড়িয়ে রইলো। কাটুক এ কদিন সুখ স্বপ্নের মতো৷
***
আগামীকাল দুপুরের ফ্লাইটে ফারদিনরা ফিরে যাবে৷ কয়েকদিনের মধ্যেই সে চলে যাবে তাই সবকিছু গোছগাছ করে নিতে হবে৷ সে আসলে মিতার দিক থেকে সাড়া পাচ্ছে না তাই ভাবছে মিতাকে কিছুদিন একা থাকতে দেয়াই ভালো হবে৷ হয়তো এই সময়ের মাঝে মিতা তাদের সম্পর্কটাকে আরেকটা সুযোগ দেয়ার চেষ্টা করলেও করতে পারে৷ আর নইলে সে মিতাকে মিতার সর্তে জীবন কাটাতে দিবে। সে পর্যন্ত মিতার দায় ভার তার। ঢাকায় আবার বাবা মা বৌভাতেরও আয়োজন করেছে৷ মিতা যদি শেষ পর্যন্ত তাকে ভালো না বাসতে পারে তখন কি তাকে ছেড়ে চলে যাবে? অবাক কান্ড ফারদিন নিজে দেশ ত্যাগী হচ্ছে অথচ ভাবছে মিতার চলে যাবার কথা। মিতা চলে গেলে সে কিভাবে থাকবে? আগের কথা ভিন্ন কিন্তু এখন পাশের বালিশে মিতা না থাকলে তার ঘুম আসবে কি করে? মিতার নিশ্চই কিছু বছর পর আবার বিয়ে হবে! মিতা অন্য লোকের সাথে সুখী সংসার করবে৷ সেও কি মিতাকে তার মতো করে মাতাল করে তুলবে রোজ? কি ভাবছে সে এসব! সেও কি বিয়ে করবে না ভবিষ্যতে? তখন! কিন্তু দ্বিতীয় কাওকে কি এভাবে ভালোবাসতে পারবে? মিতা আর তার মাঝেতো কোনো সম্পর্কের তিক্ততা নেই৷ তাদের সম্পর্ক তো শুরুই হয়নি। তাহলে কিভাবে থাকবে সে? যদি বিয়ে করেও একটা রিজন তো লাগবে অন্য জনকে ভালোবাসার। তার কাছেতো কোনো কারণই নেই৷ মিতাকে সে ঠিক অন্যরকম ভাবে ভালোবেসেছে৷ হয়তো জীবনে মিতার পর আরও ভালোবাসা আসবে কিন্তু মিতার মতো করে ভালোবাসতে পারবে না৷ হয়তো ভালোবাসা এমনই৷ সংজ্ঞাহীন। একেক জনের প্রতি একেক ধরনের ভালোবাসা৷
আবল তাবল কত চিন্তা মাথায় ঘুরপাক দিচ্ছে ফারদিনের৷
আজকেও বার্মিজ মার্কেটে লো ঘুরতে গেলো ওরা। কিছু কেনাকাটাও করলো। যদিও মিতা একটু ইতস্ততবোধ করছিলো ফারদিনের কেনা জিনিস নিতে বা ওর অর্থে কেনা জিনিস নিতে। কিন্তু ফারদিন চমৎকার ভাবে সেই পরিবেশটা বদলে দিলো। শাড়ির দোকেনের সামনে দিয়ে যেতেই একটা শাড়ি খুব পছন্দ হলো ফারদিনের ডার্ক কোরাল পিংক৷ চট করে সে শাড়িটা মিতার গায়ে জড়িয়ে দিলো। মিতা প্রথমে অবাক হলো৷ ফারদিন বললো, তোমাকেতো এখনো কিছুই গিফট দেয়া হয়নি। এটা যদি নিতে৷ তাছাড়া তুমি ভেবো না আমার পকেট খালি করলে তোমার আত্মসম্মানে আঘাত আসবে। আসলে আমার পকেট খালি না করাটাই বরং ভুল সিদ্ধান্ত। স্বামীর টাকায় স্ত্রীর সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে।
এরপর আর হেজিটেশন সাজে না।খুশিমনেই অনেক কিছু নিলো সে। ফারদিনও খুশি হলো মিতার আগ্রহ দেখে। শপিং পছন্দ করে বোঝাই যাচ্ছে। মিতা ফারদিনের জন্যেও একটা হ্যাট কিনলো।
দুপুরে বাহিরেই লাঞ্চ সারলো তারা এরপর বিকেলে বিচে গেলো ঘুরতে। ফারদিনের আগ্রহে তারা হর্স রাডিং করলো। মিতার খুব শখ হচ্ছিলো ঘোড়ার পিঠে চড়ার৷ খুব ছোটবেলায় ফুফারর সাথে চড়ে ছিলো। ফারদিন দেখলো মিতা তাকিয়ে আছে ঘোড়ার দিকে। সে বললো, ” হর্স রাইডিং পারো মিতা? আমি অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে শিখেছিলাম।”
মিতা বললো,” খুব ছোট বেলায় ফুফার সাথে যখন আমি, মিলা আপু আর রাহিল ঘুরতে গিয়েছিলাম৷ তখন ফুফা আমাদের হর্স রাইডিং করিয়েছিলেন।”
ফারদিন বেশ কিছুক্ষণের জন্য একটা ঘোড়া ভাড়া নিলো। এরপর মিতাকে সামনে বসিয়ে বিচে ঘুরলো। মিতার মনে হচ্ছিলো ফুফুর ছোট বেলায় বলা ফেইরিটেইলে সেই ঘোড়ায় চড়া রাজা হচ্ছে ফারদিন আর সে তার রাজ্যের রাণী। এতো আনন্দ হলো মিতার মনে৷ ফারদিন মিতাকে শামুকের দুটো চুড়িও কিনে দিলো। মিতা বেশ খুশি মনে সন্ধ্যায় কটেজে ফিরলো। আজও কটেজে ডিনার প্ল্যান আছে৷ আজ সব সি ফুড আইটেম ডিনারে। মিতা শুধু কাকড়াই খেয়েছে সি ফুড বলতে। আজও তাই খেলো। গান বাজনা হলো। রাতে তারা রুমে চলে এলো।
বাথরুমে ঢুলে মিতার আজ খুব ইচ্ছে করলো জাকুজিটায় বসে থাকতে কিছুক্ষণ। মিতা সব গুলো ক্যান্ডেল জ্বালিয়ে জাকুজিটা ফিল করে বাথরোব পরেই জাকুজিটায় বসলো। এতো আরাম আগে লাগেনি। স্যান্টেড ক্যান্ডেলগুলো যেনো অন্যরকম আবহ তৈরি করেছে। মিতার রিলাক্সড লাগছে। বাথটাবে গোসলের সৌভাগ্য তার আগে হয়নি। তবে ফারদিনদের বাথরুমে বাথটাব রয়েছে। কিন্তু সে কখনো বাথটাবে সময় নিয়ে বসে থাকেনি। মিতা আরামে ফারদিনের কথা ভুলেই গিয়েছিলো। ফারদিনেরও যে ফ্রেশ হতে হবে তা বেমালুম ভুলে গিয়ে অর্ধতন্দ্রায় চলে গিয়েছে৷
ফারদিন কয়েকবার নক করলো ওয়াশরুমে। তারা সারা না পেয়ে স্লাইডিং ডোরটা সামান্য খুলে উঁকি দিলো। মিতা জাকুজিতে। বেহুশ হয়ে গিয়েছে ভেবে সে উদগ্রীব হলো। মিতার তন্দ্রা কাটলো ফারদিনের ডাকে৷ ভয় পেয়ে সে ছিটকে সরে গেলো৷ পানি ছিটকে ফারদিনের গায়ে গিয়েও লাগলো।
” কি হয়েছে?”
” তুমি বলো তোমার কি হয়েছে? সময়ের খেয়াল আছে কখন থেকে ডাকছি।”
মিতা মুখের উপরে লেপ্টে থাকা চুল গুলো সরিয়ে বললো, ” ক্লান্ত লাগছিলো তাই একটু চোখ লেগে গিয়েছিলো।”
” বাহ! আর আমি যে ফ্রেশ হবো ভুলে গিয়েছো?”
” সরি। এই জাকুজিটা এতো সুন্দর আগামীকাল তো চলেই যাবো তাই এটার সদব্যবহার করতে চেয়েছিলাম।” হাসলো মিতা। ফারদিন খেয়াল করলো আশেপাশে সেন্টেড ক্যান্ডেলগুলোর ছোট ছোট আলো আর মোহনীয় সুবাস। মাথায় দুষ্টুমিরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো তার,
” জাকুজির সাইজ দেখেছো? কাপল সুইটে তুমি একা বসেতো আর সব আনন্দ নিতে পারো না তাই না? দাঁড়াও তোমায় এটার আসল ব্যবহার দেখাচ্ছি।”
টিশার্ট খুলে ফারদিনও নামলো তাতে।
মিতার কাছে যেতেই মিতা বসে পরলো৷ সে মিতার গালে কোমল স্পর্শ করলো৷ সে ভেবেছিলো মিতা লজ্জায় উঠে চলে যাবে। মিতা নড়লো না চোখ বন্ধ করেই বসে রইলো৷ ফারদিন শব্দ করেই হাসলো।
” তুমি তোমার জাকুজি বিলাস করো৷ ঠান্ডা লাগলে খবর আছে৷ ”
বলেই উঠে চলে যেতে চাইলো। মিতা ফারদিনের হাত টেনে ধরলো। সে অবাক হলো। মিতাকে জিজ্ঞেস করলো,
” কিছু লাগবে?”
মিতা উত্তর দিলো না৷ ফারদিনকে জড়িয়ে নিলো আলিঙ্গনে।
আকাশ মেঘে ঢাকা আর আবহ মিষ্টি। না চাঁদ রয়েছে, না তারকারাজি৷ মোমের আলোয় মিতার স্বচ্ছজলে ভেসে বেড়াবার আহ্বান কি ফারদিন বুঝতে পারলো?