‘ঝরা পাতা উড়ে যায়’
পর্ব-২০
শাহাজাদী মাহাপারা
বাড়িতে মেহমানদের আনাগোনা শুরু হয়ে গিয়েছে। মুহিনের বাবা নাতিকে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাবারের তদারকিতে ব্যস্ত৷ তার মুখের হাসি এগাল ওগাল হয়ে যাচ্ছে। শেষ কবে সবাই তাকে এতো খুশি দেখেছিলো মনে নেই৷ মাহতাবের জন্য সোনার চেইন, কাপড় সবই এনেছে মুহিনের ফুফুরা। দুই ফুফু মুহিনের এবং দুই মামা, এক খালা। সবাই স্ব পরিবারেই এসেছেন। এতো শর্ট নোটিসে কাছা কাছি গ্রাম হওয়ায় চলে এসেছেন। মুহিন সবাইকে সালাম করছে জরিয়ে ধরছে।ভাতিজা বলতে অন্তপ্রাণ ফুফুরা কান্নায় ভেঙে পড়ছেন একমাত্র ভাইয়ের ছেলেকে দেখে৷ আহা কি দৃশ্য৷ খালা বুকে জরিয়ে রাখলেন বেশ খানিকক্ষণ। মিলা বুঝতে পারলো মুহিন আসলে খুব ভালোবাসার মাঝে বড় হয়েছে। এজন্যই সে গ্রামের বাহিরে পড়তে যেতে চায় নি। এমন পরিবারতো সবার কাম্য। মাহতাবও নিশ্চই এদের ভালোবাসায় বেড়ে উঠবে। মিলার ভালো লাগছে৷ আত্মীয় স্বজন বাড়িতে আসা যদিও মিলার খুব একটা পছন্দ না। তবে এ বাড়ির সকলেই একটু অন্যরকম। অন্তত মিলার পরিবার থেকে তো ফার বেটার।
আশেপাশের পাড়া প্রতিবেশিরাও বউ দেখে যাচ্ছেন। তার শাশুড়ি কে টিটকারিও করে যাচ্ছেন।
“ছাত্তারের বউ তোমারতো রাজ কপাল। দুই দুইটা বউ আনাইলা বাড়িতে রূপ চেহারায় কেউ কারো চাইয়া কম না।”
” হ তাইতো৷ ইডাতো আগেরটার চাইয়াও সুন্দর।”
” পয়লাডা তো বনে বাদারে পাক পাড়তো ইডা
কিরহম?”
মিলা কথাটা স্পষ্ট বুঝতে না পারলেও বুঝলো যে স্নেহার ঘুরে বেড়ানোর স্বভাবকে নিয়ে কথা বলছে।
” পাক পাড়তো আবার কি কথা! গ্রামে শহর থিকা বউ আইলে গ্রাম তো ঘুইরা দেখবেই। কি কও ইগিনা? ” বললেন বড় ফুফু।
মিলাকে দুটো শাড়ি উপহার দিলেন তিনি টাঙ্গাইল শাড়ি৷ খুব সুন্দর। মাহতাবের জন্যেও তারা জিনিস নিয়ে এসেছে। এ বাড়ির মেয়েদের বাপের বাড়ি কিছু নিয়ে আসা নিষেধ শশুড়ালয় থেকে তাই ভাইয়ের জন্য কিছুই আনে নি কেউ৷ অথচ ভাইকে তারা খুব ভালো বাসে। মিলা সালাম করতে চাইলে ছোটফুফু বললেন আমরা তোমার মডার্ন ফুফু শাশুড়ি রুদমিলা। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা খুবই ব্যাকডেটেড। তুমি মুখেই সালাম করো।তারিন ফিসফিসিয়ে বললো, “ভাবি ছোট ফুফু কিন্তু স্কুলের টিচার৷ সমাজ পড়ায়।” ফুফুর ইন্টারে থাকতে বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু ফুফারা ভালো ফ্যামিলির ছিলো তাই ফুফুকে পড়তে সুযোগ দেয়।” মিলা অবাক হয় তখনকার দিনে মেয়েদের পড়াশোনার বিষয়টা খুব রেয়ার। তবুও সে চমৎকৃত হয়। এ বাড়ির সবাই যে শিক্ষিত তা বোঝাই যায় এজন্যই হয়তো গ্রামে তাদের বেশ কদর। মিলা দেখলো মুহিন দাঁড়িয়ে আছে এক কোনায় তাকে দেখছে।
মিলাকে সবাই দেখে দেখে যাচ্ছে। বাবা মা কি করে, পড়াশোনা কেমন, ইত্যাদি প্রশ্ন করছে। ছোট ফুফু মিলার জন্য স্বর্ণের আংটি এনেছিলেন তা পরিয়ে দিতে মুহিনকে ডাকলেন। সে ঘরেই ছিলো৷ সামনে এসে আংটি পরালো মিলার অনামিকায়। ফুফু তার মাথায় হাত দিয়ে খুব দোয়া করে দিলেন। মাহতাবের জন্যেও খেলনা, গিফটস এনেছেন তারা। সে দেখলো মিলার কপালে টিপ আছে কিন্তু হাতে চুড়ি নেই। হয়তো তার ভালো লাগেনি ভেবে সে উঠে পড়লো। কিছুক্ষণ পরেই তিন্নির মারফত মিলাকে নিজেদের ঘরে ডাকলো সে। মিলাও ওয়াশরুমের বাহানা করে উঠে রুমে গেলো৷ কিন্তু রুম খালি। খট করে দরজা বন্ধ হবার শব্দে চমকালো সে৷ মুহিন দাঁড়িয়ে আছে। মিলা জিজ্ঞেস করলো, ” এখানে ডাকিবার হেতু কি? ”
মুহিন হাসলো। তার হাতের চুড়িগুলো নাচিয়ে দেখালো। সে মুখ বাঁকালো।
” আমি কাঁচের চুড়ি পরি না।”
” আপনার বাসায় দেখেছি আলনা ভরতি কাঁচের চুড়ি। ”
” ও সব মিতার।”
” মোটেও না।”
” সরুন আম্মার কাছে যাবো৷ মিথ্যা বলে এখানে এসেছি। সবাই কি ভাববে! ”
” কিছুই ভাববে না।”
মিলা দরজার সামনে থেকে মুহিনকে টেনে সরাতে চাইছিলো। কিন্তু সম্ভব হলো না৷ মিলা ৫’২ ইঞ্চির মানুষ ৫’৯” ইঞ্চির মানুষকে টেনেও সরাতে পারবে না৷ মুহিন তার হাত ধরে ফেললো। স্বযত্নে হাতে চুড়ি গুলো পরিয়ে দিলো। মিলার কান্না আসছে৷ অসময়ে আবেগি হওয়া৷ অথচ মুহিন দেখলো তার চোখে হাসি এবং অশ্রু একসাথে চিকচিক করছে৷ সে মিলাকে জড়িয়ে ধরলো ঘন আবেগে। মিলার মনে হলো এ পরম আশ্রয়স্থল৷ এখান থেকে পালাবার আর সুযোগ নেই৷ মিলার কানে কানেই মৃদুস্বরে মুহিন বললো,
” আপনাকে আমার চাই মিলা। আজই চাই, এক্ষুনি সম্ভব হলে আরও উত্তম।” সে কথায় কি ছিলো কে জানে মিলা হাসলো, হাসলো মুহিনও।
” এই মুহূর্তে অসম্ভব স্যার৷ ”
” তবে কখন সম্ভব।”
” জানিন।”
মিলা মুহিনের পেটে আঙ্গুল দিয়ে খোঁচা দিয়েই সরে গেলো। মুহিন যখন ব্যথায় কাতর সে দরজা খুলে দ্রুত পালালো। মিলার কপাল দিয়ে ঘাম বের হচ্ছে। সবাই এখন হাতে চুড়ি দেখে কি ভাববে! যাহ আগে পরলেই হতো৷ ভালো হয়েছে৷ খুব শখ হয়েছিলো না মুহিনের হাতে চুড়ি পরার।
মিলার শাশুড়ি মিলাকে বললো, ” তুমি আর মুহিন উঠানে গিয়ে টেবিলে বসো খেয়ে নাও। বৃষ্টি গতকাল না হলে এখন দেখতা সবাই মেঝেতে কেমন লাইন ধরে বসে খাচ্ছে। বৃষ্টি হওয়ায় এই বন্দবস্ত। তবে আজ সারাদিনই লোকজন আসবে খেতে। ”
মিলা বুঝলো এরা লোকজন ডেকে খাওয়াতে পছন্দ করে খুব। একটা ওকেশন হলেই হলো। সন্ধ্যে পর্যন্ত লোকজন খেতেই এলো এ বাড়ি৷ অনেকে বাড়িতে নিয়েও গেলো খাবার৷ মিলা তার শাশুড়ির ধৈর্য দেখে বেশ অভিভূত হলো।সেও ধৈর্যশীলা তবে তার শাশুড়ির তুলনায় সে কিছুই নয়। অথচ মুহিন আর তিন্নি এতো ছটফটে চঞ্চল। মিলা ভেবেছিলো মুহিন হয়তো গম্ভীর৷ অথচ বাড়ি না এলে বুঝতেই পারতো না মুহিন যে কি দূরন্ত ডানপিটে ছিলো। মাহতাব তার দাদীর মতো শান্ত স্বভাবের হয়েছে। হয়তো আরেকটু বড় হলে বাবার মতোই চঞ্চল হবে। এ দুদিন মিলা মাহতাবকে তেমন করে কাছে পায়নি। সবাই একপ্রকার কারাকারিই করছে তাকে নিয়ে। মাহতাব বেশ মিশুক একটুও বিরক্ত হচ্ছে না। বিগত দেড় বছরে সে আর তার বাবা যতটা একাকীত্বে ছিলো আজ তা সবটাই পূরণ হয়ে যাচ্ছ।
মুহিনের বাল্য বন্ধুরাও এসে দেখা করে গিয়েছে বিকেলে। মিলার নিজেরই এখন ক্লান্ত লাগছে৷ তিন্নি আর সব কাজিনরা মিলে তাকে নিয়ে ঘরে গেলো। মিলা ঘরে গিয়ে চমকালো। এটা কখন করেছে এরা। পুরো ঘরে গোলাপের সুবাস।
তিন্নি রসিকতা করেই বললো,” ভাবি তোমার জন্য ভাইয়ার বন্ধুরা যে বুকি এনেছিলো তা দিয়েই রুম সাজিয়ে ফেলেছি দু দিন গেলেতো তা নষ্ট হবেই এর চেয়ে ভালো কোনো কাজে লাগা৷ তোমার পছন্দ হয় নি বলো? এই ফেইরি লাইট গুলো আমি অর্ডার করেছিলাম দুমাস আগে। আজ যে এতো সুন্দর করে কাজে লেগে যাবে ভাবিনি। দেখো এই সেন্টেড ক্যান্ডেলও অর্ডার করেছিলাম৷ হিহিহি। আমি মনে হয় মনে মনে বুঝে গিয়েছিলাম তোমাদের যে বাসর হবে ।”
সবাই হাসলো তিন্নির কান্ডে।
ঢপ দিতে এই মেয়ে ওস্তাদ। ওইসব ক্যান্ডেল সে গতকালই কিনিয়েছে কাজিনকে দিয়ে বড় বাজারের নাইনটি নাইনের শপ থেকে। রিসেন্টলি ওগুলো এইসব দোকানে পারচেজ করা হচ্ছে। অবশ্য এই দোকানের বর্তমান মালিক সাবের আমিন তিন্নিকে খুব পছন্দ করেন। অন্যরকম পছন্দ। তাই তিন্নি যখন যা বলে তাই কিনে আনেন তিনি। তার দোকানটাও বেশ ভালো ব্যবসা করছে তিন্নির পছন্দের জিনিস আনায়। তাদের কসমেটিকসের দোকানে তিন্নি একবার গিয়েছিলো মেকাপের জিনিস কিনতে পুরোনো দিনের মেকাপ দেখে সে বেশ বকাঝকা করে আসে দোকানিদের। তারপর সেই মালিক নিজেই বাড়ি বয়ে এসে কি কি প্রডাক্ট নতুন পারচেজ করা যায় তা তিন্নির সাথে যোগ পরামর্শ করে নতুন জিনিস দোকানে তুললেন। দ্রুতই ব্যবসায় উন্নতি দেখলেন। তারপর থেকেই তিন্নির জন্য ভদ্রলোকের দূর্বলতা কাজ করে। যদিও তিনি তা মুখে প্রকাশ করতে পারেন না। তিন্নি কিন্তু এতে অখুশি না সেও নব্য তরুণের মনের কথা বুঝতে পেরে আন্দলিত হয়। তারিয়ে তারিয়ে সে তা উপভোগ করে৷ তিন্নি ভেবেছিলো তাদের হয়তো একটাই কসমেটিক্সের দোকান। পরে জানতে পারলো এদের গাজীপুরে, উত্তরায় মিষ্টির দোকান, জুতার শোরুম, গহনার শোরুম, কাপড়ের দোকান, কিচেন এপ্লায়েন্সের দোকান আর গ্রামে দুটো কসমেটিক্স সহ ডেইরি ফার্মও রয়েছে। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি মেঝজন। ছোটটা এখনো স্কুলে। এলাহি কারবার। তিন্নি একটু দূরত্ব বজায় রাখে তাই। কিন্তু গতকাল প্রয়োজনেই কল করেছিলো। আজ প্রয়োজনীয় জিনিস হাজির৷ ভদ্রলোককে একদিন এক কাপ চা খাওয়ানোই যায়৷
মিলার মন ভালো হয়ে গেলো তিন্নির আয়োজন দেখে। অবশ্য লজ্জাও লাগলো। মুহিন ঘরে আসালো এগারোটায় সবাই গল্প করছিলো মিলার সাথে। মুহিন রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে থমকে গেলো। মিলা বিছানার মাঝে বসা বাকিরা সবাই পাশে গোল হয়ে বসে আছে রুমের চেহারাই বদলে গিয়েছে। সবাই মুহিনের পথ আগলে দাঁড়ালো। টাকা ছাড়া ভিতরে প্রবেশ নিষিদ্ধ। মুহিন বিনা বাক্য ব্যয়ে গুণে গুণে পাঁচ হাজার ধরিয়ে দিলো। সবাই তা নিয়ে বেশ হাসি ঠাট্টা করলো। মিলাও হাসলো।
মুহিন ঘরে গিয়েই দরজা দিলো। সবাই কান পাতলো দরজায় তবে মিনিট দশেক পরেও যখন কিছু শোনা না গেলো সবাই বিরক্ত হয়ে চলে গেলো। মিলা আর মুহিন তখন জানালার কাছে। মৃদু বাতাসে তার শাড়ীর আঁচল আর চুল উড়ে মুহিনের গায়ে এসে লাগছে। সে এই সুন্দর মুহূর্তটাকে ফোনের ক্যামেরায় বন্দী করলো।চুমু খেলে মিলার কপালের টিপে সহস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলো মিলার চেহারা। মিলাকে খুব করে ভালোবাসতে চাইছে সে। কিন্তু কিছু একটা তার মনের দ্বিধার দেয়াল ভাঙতে পারছে না। মিলা কি কিছু বুঝতে পারছে? অনেক জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মিলাই এগিয়ে গেলো মুহিনের কাছে। মুহিন ডুব দিলো রুদ্মিলার মাঝে গহীন থেকে গহীনে। আজ ভালোবাসারা ভেসে ভেসে বেড়াক মিলা মুহিনের আকাশ জুড়ে।