‘ঝরা পাতা উড়ে যায়’
পর্ব-১৯
শাহাজাদী মাহাপারা
আজ সমুদ্র খানিকটা শান্ত। বাহিরে মৃদু বাতাস হচ্ছে। মিতা একটু আগেই বাহিরে থেকে হেটে এসেছে। বেশিদূর যায়নি কটেজের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো। গতকালের ঘটনা তেমন মনে নেই। যা মনে আছে সবটাই আবছা। দুপুরের খাবারের পর ঘুমিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত স্পষ্ট মনে আছে। এরপর যা ঘটেছে সবটাই অস্পষ্ট। এখানের রিসিপশনের লেডির সাথে দেখা হওয়ায় জিজ্ঞেস করলো,” ম্যাডাম এখন কেমন আছেন?”
মিতা ভালো আছি বলে সেখান থেকে সরতে চাইলো। মেয়েটা আবার বললো, ” গতকাল রাতে আপনি অনেকটাই ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন। স্যার খুব চিন্তায় ছিলেন।”
বিরক্ত লাগলো তার৷ এতো কথা কেনো বলছে স্টাফ হয়ে! বলতেই পারে তারা হয়তো ফারদিনের সাথে পরিচিত৷ ফারদিনের বন্ধুর কটেজগুলোই তো সব৷ তাছাড়া গতকাল রাত কেমন গিয়েছে সেতো ঠিকঠাক জানেই না৷ ফারদিন এখনো ঘুমাচ্ছে। মেয়েটা কি রাতে এখানেই ছিলো, বাসায় যায় নি?
” আমার হাজবেন্ড আর আমি গতকাল নাইট ডিউটিতে ছিলাম। নেক্সট শিফট এলেই আমরা চলে যাবো। ” মেয়েটা কি বুঝে গিয়েছে তার অভিব্যক্তি? আগেই উত্তর দিয়ে দিলো।
“আচ্ছা। আপনাকে ধন্যবাদ। ” বলেই মিতা সামনে হেটে চললো।
গতকাল সন্ধ্যায় ফারদিনের ঘুম ভেঙেছিলো। চা কফির ব্যবস্থা ছিলো এখানে৷ দুকাপ কফি বানিয়ে সে মিতাকে ডেকেছিলো৷ সারা না পাওয়ায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার ডেকেছে। মিতা কম্ফোর্টার গায়ে টেনে নিয়ে কাঁপছিলো। ফারদিন মিতার কপালে হাত দিতেই ঘাবড়ে গিয়েছিলো। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে সে। থার্মোমিটারের আর মেডিসিনের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলো। মিতাকে ওষুধ দিয়ে মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু রাত যত বেড়েছে জ্বরও বেড়েছে৷ মৌসুম ভালো নেই তার উপর এতো রাত যে ডাক্তার পাওয়া দুষ্কর। সারা রাত এক অস্থিরতায় কেটেছে ফারদিনের। রাত তিনটার দিকে মিতার জ্বর নেমেছিলো। তারপর ফারদিন ঘুমিয়েছে। মিতার শুধু মনে আছে যতবার সে চোখ খুলেছে ফারদিনকে পাশে বসে থাকতে দেখেছে।
ফারদিনের ঘুম ভাঙলো বেশ বেলা করে। নাস্তা করেই তার বের হলো সামনের সমুদ্রটা ঘুরে দেখতে। মিতাও আপত্তি করলো না। তার না নেই কোনোকিছুতেই৷ সারা সকালে তাদের মাঝে যা কথা হয়েছে তা হলো,
” শরীর কেমন এখন?”
” ভালো। ”
” বাহিরে বের হবে?”
” আচ্ছা।”
” তৈরি হয়ে নাও।”
মিতা যা শাড়ি এনেছে তা আর পরে বের হবার মতো না৷ বিয়ের পর তারিনকে দিয়ে কিছু শপিং করিয়েছিলো তাই নিয়ে এসেছে। মাত্র তিনজোড়া সালওয়ার কামিজ৷ একটা জর্জেট বাকি দুটো সুতি। তবে তারিনের পছন্দ ভালো৷ সে জর্জেটটাই পরে নিয়ে বের হলো।
এদিকটা কিছুটা জন মানব শূণ্য। ফারদিন মিতার থেকে দূরে দাঁড়িয়ে আছে৷ মিতার ভালো লাগছে৷ মৃদু বাতাস৷ তবে সাগরের লোনা পানির গন্ধে একটু অস্বস্তি হচ্ছে। আবার এত বড় সমুদ্র দেখে তাতে একটু পা ভেজানোর ইচ্ছেটাও প্রবল। কিন্তু ফারদিন পানিতে নামতে নিষেধ করেছে। গতকালের মতো ঝামেলা নিতে সে প্রস্তুত না৷ মিতার কি মন খারাপ হয়েছিলো ফারদিনের কথায়?
হয়েছে বটে। তবে স্বস্তিও পেয়েছে৷ অন্ততঃ অসুস্থ স্ত্রী কে হেলা করেনি সে। যথাযথ যত্ন নিয়েছে। মিতা কৃতজ্ঞ৷
ফারদিন বেশ কিছু ছবি তুললো ইন্সটাগ্রামে পোস্ট দেয়ার জন্য। সবাই বৌভাতের দাওয়াত চায় সাথে মিতার সাথে কাপল ছবিও চায়। আগে ফারদিনের বিরক্ত লাগতো। তারিন অবশ্য নিজের আইডি থেকে মিতা আর ফারদিনের বিয়ের একটা চমৎকার ছবি দিয়ে কংগ্রাচুলেশনস জানিয়েছিলো। হাস্যকর একটা বিয়ে ছিলো তবুও বিয়েতো। ছবিটা কিছুটা এমন যে, একটা বড় ওড়নায় মিতা আর ফারদিনের মাথা ঢাকা আর আয়নায় ফারদিন আর মিতার চেহারা দেখা যাচ্ছে। এবং কারো মুখেই হাসি নেই। যদিও ক্যামেরা ম্যান হাসতে বলেছিলো৷ তবে আর যাই হোক বউ বদলালেও বিয়েতে কোনো নিয়মই বাদ যায় নি৷ ব্যস ওই একটা ছবিই তার কাছে আছে। বিয়েটা নিয়ে ফারদিন তিন দিন আগেও এতোটা সিরিয়াস ছিলো না। সে যদিও মা কে ভয় দেখিয়েছিলো মিতাকে নিয়ে বিদেশ চলে যাওয়ার কিন্তু তার আসল উদ্দেশ্য ছিলো মাস শেষেই চলে যাওয়ার। সে রিটার্ন টিকিট ও করে ফেলেছে। বাসায় এ ব্যাপারে এখনো কেউ জানে না৷
ফারদিন দেশে বিয়ে করতে আসেইনি৷ তাকে জোর করেই আনা হয়েছে৷ সে ভালোবাসতো একজনকে তাকে আনা হয়েছে আরেকজনকে বিয়ে করতে৷ তারপর আবার তার সাথেতো বিয়ে হলোই না হলো বোনের সাথে৷ সেই রাগের রেশ ধরেই সে চলে যেতে চেয়েছে। যদিও মিতার উপর তার একটা বিশাল রাগ ছিলো। বিষয়টা এমন না যে মিতাকে বিয়ে করতে সে গো ধরেছে। সে চেয়েছিলো তার মাকে জব্দ করতে তাই বিয়ে না করে উঠতে চায়নি৷ সে ভেবেছিলো মিলার সাথেই বিয়ে হয়ে যাবে৷ কিন্তু মা যে মিতাকে চেয়ে বসবেন এবং বোকা মিতাটাও যে রাজি হয়ে যাবে তা ফারদিন নিজেও বুঝতে পারেনি। মিতাকে ফারদিনের কাছে স্বার্থান্বেষীই লেগেছিলো প্রথমে। নিজের রাগ কমে যাওয়ার পর ফারদিন বুঝতে পারে আসলে সবচেয়ে বড় অন্যায়টা হয়েছে মিতার উপর৷ তাই মিতাকে সে সব রকম ফ্যাসিলিটিজ দিতে চেয়েছে। মিতা নিজের পায়ে না দাঁড়ানো অব্দি তার সমস্ত খরচ সে বহন করবে ভেবেছিলো। কিন্তু এখন বিষয়টা ভিন্ন। তার অনুভূতি ভিন্ন। নতুন মিতাকে আবিষ্কার করার নেশায় পেয়েছে তাকে৷ এখন মিতাকে ছাড়া তার চলবে না৷
ফারদিন মিতার দাঁড়িয়ে থাকা, পাড় দিয়ে হেঁটে বেড়ানো কিছু ছবি তুললো৷ তারপর মিতাকে ডাকলো। খোলা চুলের মিতার চুল গুলো সব মুখে এসে পড়লো বাতাসে। ফারদিন আর কথা বললো না। ক্যামেরায় বন্দী করলো সেই মুহূর্ত৷ মিতা ভরকে গেলো। ফারদিনের ইচ্ছে করছে মিতার হাত ধরে সমুদ্রে ডুবে যেতে। বেচারির শরীর ভালো থাকলে আর তাদের পরিস্থিতি অন্যরকম থাকলে অতি অবশ্যই সে তা করতো। কিন্তু এখন সম্ভব না।
মিতা সামনে এগিয়ে গেলো। ফারদিন বুঝলো না কি বলা উচিৎ! সে আমতা আমতা করে বললো, ” চলো কয়েকটা কাপল ফটো তুলি। আসলে আমার আইডির সবাই জেনে গিয়েছে যে আমার বিয়ে হয়েছে। তারিনের কাজ৷ সবাই ছবি চাইছে। তোমার সমস্যা না হলে তুলি? ”
মিতা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
ফারদিন খুশি হলো। মিতাকে জড়িয়ে ধরে ছবি তুললো কয়েকটা৷
মিতা জোর করেই মুখ হাসি হাসি করে রেখেছে। তার মন খুলেই হাসতে ইচ্ছা করছে কিন্তু ফারদিন চলে যাবে কথাটা মনে পড়লেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে৷ এতো ঢংয়ের কি দরকার! দুদিন পর সব ছবি ডিলিট করে বলবে আমারতো ডিভোর্স হয়ে গেছে গাইজ৷
দুপুরে কটাজে ফিরলো তারা। লাঞ্চ সেরে মিতা মিলার সাথে ভিডিও কলে কথা বললো। বাবাকেও ফোন করে কথা বললো। তারিনের সাথেও কথা হলো। তারিন জানালো বাসায় রিসেপশনের জন্য তোরজোর চলছে। বাবা প্রায় জোর করেই অনুষ্ঠান করতে চাইছে৷ তারিনের কন্ঠেও এক্সাইটমেন্ট৷ মিতা মোটামুটি কথা বলে
ফোন রেখে দিলো।
সন্ধ্যায় কটেজের আরও কাপলরা মিলে ডিনার এরেঞ্জমেন্টে গিয়েছিলো। সবাই বেশ আনন্দ করলো। মিতাও পাশের কয়েকজনের সাথে কথা বললো৷ সে সবচেয়ে কম বয়েসী ব্রাইড ছিলো। নরমালি যা কথা হয় তাই হলো। যেমন – বিয়ে লাভ নাকি এরেঞ্জড? ভাইয়া কি গিফট দিয়েছে ফার্স্ট নাইটে? ফ্যামিলির সাথে এডজাস্টমেন্ট কেমন? বিয়ের পরপরই হানিমুনে কি না? মিতা হাসলো। এটা কি হানিমুন তাহলে তাদের? খুবই ফানি ব্যাপারটা। মিতা যতটা না কথা বললো তারচেয়ে বেশি সবার কথাই শুনলো। কাপলরা সামিয়ানার লাইটিং এর নিচে সুন্দর কিছু ছবি তুললো৷ ফারদিন মিতারও তোলা হলো। এক কপি ছবি সেখানের একটা বোর্ড রয়েছে রিসিপশনে সেখানে টাঙানো হবে।
ডিনার সেরে ওরা কটেজে ফিরলো।
চলবে…