‘ঝরা পাতা উড়ে যায়’
পর্ব-১৮
শাহাজাদী মাহাপারা
মুহিনের ঘুম ভাঙলো ভোরে। ডান হাতটা অসার হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কয়েকটা ভারী ভারী পাথর দিয়ে চাপা দিয়ে রেখেছে কেউ। নাকের কাছে কিছু খুচিয়ে যাচ্ছে লাগাতার। পা দুটো নাড়াচাড়া করার চেষ্টায় কিছুর সাথে ধাক্কা খেলো। পা! কাথার নিচে পা! ভয়ে সিটিয়ে গেলো সে। নাকের কাছের চুল গুলো বা হাত দিয়ে সরিয়ে উঠে যাওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হতেই সে বুঝলো ওই পা টা মিলার। আস্তে করে ডান হাত টা তার মাথার নিচে থেকে বের করে বিরক্ত হয়ে তাকালো। কিছু দেখা যাচ্ছে না৷ বাহিরে এখনো খানিকটা অন্ধকার। তবে বিরক্ত হতে পারলো না। একটু দূরে সরে গিয়ে স্পেস তৈরি করে মিলার দিকে মুখ করেই শুয়ে রইলো। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। সে এতো কাছে এসে কখন শুয়েছে? শীত করছে বলেই হয়তো শুয়েছে। ঘুমের মাঝেই শুয়েছে নাকি সজাগ ছিলো?
মুহিনের ঘুম আর এলো না। কিছুক্ষণ পর যখন মোরগ ডাকার আওয়াজ এলো মুহিন বুঝতে পারলো মা উঠে মোরগ ছেড়েছে৷ বাহিরেও খানিকটা ফর্সা হয়ে এসেছে। উঠে জানালা খুলে দিলো সে। গ্রিলের ফাঁক গেলে সূর্যের নরম আলো এসে পড়লো মিলার মুখে। সকালের সতেজ বাতাসটাও প্রাণ ভরে ভিতরে নিয়ে নিলো মুহিন। বিগত দু বছরে এই নির্মল বাতাস তার ফুসফুসে প্রবেশ করেনি। সে মিলার দিকে তাকালো। এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে। মুহিনের বিশাল অবাক লাগলো। তার প্রেম পাচ্ছে। মিলার সাথে এখন দুষ্টুমিতে মাততে ইচ্ছে হচ্ছে। তার বয়সের সাথে এটা মানায় না। সে গাম্ভীর্য কে নিজের বাসন বানিয়ে এসেছে আজীবন। এমনকি মাহতাবের মায়ের ক্ষেত্রেও সে কখনো এমন অনুভব করেনি। এর পেছনের কারণ কি? গতকাল রাতের ঘটনা? তাহলে এর মানে কি দাঁড়ায়? মিলা তাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে এমন অনুভব করার জন্য! স্নেহার সাথে তার সম্পর্ক ভালোবাসার ছিলো অবশ্যই৷ তাদের মাঝে শারিরীক টান ও ছিল উদ্দম। তাদের মাঝে আন্ডারস্ট্যান্ডিং ও ছিলো ভালো। সব দিক দিয়েই পারফেক্ট ছিলো। সেইম এইজ হওয়ায় রেস্পেক্ট ও ছিলো দুজনের মাঝে। তাহলে কি ছিলো না? এখন বুঝতে পারছে কি ছিলো না? মানুষের মানসিকতার তারতম্য। সেই একই মুহিন কিন্তু স্নেহা আর মিলার ক্ষেত্রে তার ব্যক্তিত্ব ভিন্ন। কেন? মিলা আর তার মাঝে সম্মান, খুনসুটি আর মতের ভিন্নতা আছে। কিন্তু আন্ডারস্ট্যান্ডিং ও আছে। মিলা আনপ্রেডিক্টেবল। আর স্নেহা ছিলো মিলার অপজিট৷ তার কাছে খুনসুটি করাটা খুবই হাস্যকর মনে হতো। বাচ্চামো মনে হতো। স্বাভাবিক, প্রতিটা মানুষের চিন্তা ধারা ভিন্ন। তবে সে স্নেহার সাথে কখনো আনহ্যাপি ছিলো না। হতে পারে অতিরিক্ত আন্ডারস্ট্যান্ডিংই তাদের মাঝে একটা গ্যাপ ক্রিয়েট করেছে। সে জানেনা আসলে এত সুন্দর সংসার রেখে কেনো স্নেহা চলে গিয়েছে। তবে সে স্নেহাকে কখনো অসম্মান করেনি। মিলার আর তার মাঝে ৬ বছরের গ্যাপ। হয়তো এ জন্যই মিলার মাঝের যে চাইল্ডিশ ভাবটা রয়ে গিয়েছে তা তাকে আকর্ষণ করে। আরও একটা জিনিস হচ্ছে, মিলার ক্ষেত্র বিশেষে গাম্ভীর্য ধারণ করা। জানেনা মুহিন। এখন, এই মুহূর্তে শুধু এতটুকু জানে সে, মিলাকে হারানো যাবে না৷
মিলার ঘুম ভাঙলো তিন্নির ডাকে৷ চোখ খুলে দেখে তিন্নি চা হাতে দাঁড়িয়ে ডাকছে৷ সে উঠে বসে তিন্নির হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে হেসে বললো, ” এইসব বেড টির অভ্যাস আমার নেইগো। তুমি আর কষ্ট করোনা। আমাকে তোমার ভাই ডেকে না দিয়ে পালিয়েছে কই?”
তিন্নি হাসলো। গতকালও ভাবি খানিকটা গম্ভীর ছিলো। সম্ভবত নতুন নতুন অস্বস্তিবোধ করছিলো৷ আজ কি সুন্দর কথা বলছে। অথচ ভাই বললো ভাবিকে বেশি জ্বালাতন না করতে৷
” ভাবি দ্রুত চা খেয়ে রেডি হও। আজ আশেপাশের মহিলারা সহ আমাদের আত্মীয়রাও দেখতে আসবে তোমাকে। নাস্তা করে মায়ের রুমে যেও মা ডেকেছে।”
” আচ্ছা। তোমরা খেয়ে নিয়েছো?”
” না। শুধু ভাই, বাবা খেয়েছে আমি আর মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।”
” আচ্ছা আমি এক্ষুণি আসছি।”
মিলা চা পান করেই বিছানা ছাড়লো দ্রুত।
রান্না ঘরে যেতে যেতেই দেখলো উঠানের এক পাশে বিশাল বড় বড় হাড়ি আনা হয়েছে৷ মিলা রান্না ঘরে গেলো।
” আম্মা, এইগুলো কি করবে?”
মিলার শাশুড়ি হাসলেন। মাহতাব তিন্নির কোলে।
” নাস্তা করো বউমা। ইডি তোমার শশুর আনাইছে। তার নাতি প্রথম আসছে বাড়িতে৷ আর আত্মীয় স্বজন আসবে বাড়িতে নতুন বউ আছে বাড়িতে। ভোজ দিবে, ভোজ।”
” এতো আয়োজন? ”
” ভাবি এটাতো যেই সেই বাড়ি না। তুমিতো গ্রামের পঞ্চায়তের মাথাদের একজনের বাড়ির বউ। আর এই গ্রামে আমাদের মোটামুটি একটা রেপুটেশন আছে।”
” তা গতকালই বুঝতে পেরেছি। ”
মিলা নাস্তা শেষ করে জিজ্ঞেস করলো তাদের কোনো সাহায্য লাগবে কি না?
” তুমি আমার সাথে আমার ঘরে আসো।”
মিলা তার শাশুড়ির পেছন পেছন গেলো। তার শাশুড়ি আলমারি খুলে দুইটা বড় বড় বাক্স বের করলেন। তিন্নিও পেছন পেছন এলো।
” এই খানে দুই জোড়া কানের দুল, গলার হার আর বালা আছে। একটা চেইন আছে তোমার দাদী শাশুড়ির৷ তিনটা আংটি আছে। তুমি শহরে থাকো৷ আর আমাদের জানায় আসো নাই। নাইলে আমি নতুন কইরা কিছু বানায় আনতাম। তুমি দেখো তোমার পছন্দ মতো কোনটা নিতে চাও। আগামীবার আসলে নতুন গয়না গড়ায় দিমানি৷ এইখান থিকা তোমার পছন্দ মতো রাখো। বাকিগুলো তিন্নির জন্য।”
মিতা তার শাশুড়ির বিচক্ষণতা বুঝলো। তিনি দুটো জিনিস খেয়াল করবেন এখানে৷ লোভ এবং ত্যাগ। মিতা এতো ইমপ্রেসড হলো তার শাশুড়ির কান্ডে। তার চোখ দুটো চকচক করে উঠলো।
এইটা হেরেম পলিটিক্স। জোরাজোরি নেই। স্বেচ্ছায় সমার্পণই জিতে যাওয়ার মূলমন্ত্র।
মিলা গয়নাগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখলো৷ হাত দিয়ে ছুয়ে দিলো। তার ঠোঁটের কোনে হাসি৷ সে বড় গলার হারটা নিলো এবং সাথে সাথে তা পরে ফেললো, একটা আংটি পরলো অনামিকায়, ছোট ঝুমকাটা কানে পরলো আর একজোরা বালা নিলো যেটা পাতলা ছিলো। তারপর আয়নার সামনে গিয়ে বললো, “আম্মার এটার সাথে একটা সুন্দর বেনারসি হলে ভালো হতো।আমি যে শাড়ি আনি নি বেশি।”
মিলার শাশুড়ি হাসলেন। তার পুত্রবধূ যে চৌকস তা দেখে তিনি খুশিই হলেন। মিলা বললো, “আর কিছু লাগবে না আম্মা। আমি চেইন পরি না। তাছাড়া এইটাতো দাদীর এটাতে তিন্নির হক বেশি।”
তিন্নি হাসলো, ভাবি ভারি হারটা বাগিয়ে বাকি সব দিয়ে দিয়েছে।
এখন যদি সে নিজে বেশি নিয়ে তাকে কম দিতো তাহলে পরবর্তীতে আম্মার সাথে ভাবির সম্পর্ক ভিন্ন হতো। ভাবির জন্য মনে খুতখুতি থেকে যেতো। নতুন ভাবি তিন্নিকে কতটা যত্ন করবে তার উপর নির্ভর করে আম্মা তাকে কতটা যত্ন করবেন। ঘরপোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘেও ভয়৷ আগের ভাবি যদিও গহনা নিতে চান নি৷ তার কাছে এগুলো ব্যাকডেটেড গহনা আর তিনি ভারি কিছু পরতেন ও না এলার্জি হতো। তবে মিলা ভাবি খুব বুদ্ধিমতি মানতেই হবে৷ এছাড়াও গ্রামের সবাই দেখতে আসলে নতুন বউকে কি দিলো শাশুড়ি তা নিয়েও কথা হবে৷ সবার আগে গলার হারই চোখে পরবে।
“বেনারসি আনতে পাঠিয়েছি মুহিনকে। বাড়ির নতুন বউ লোকে দেখবে শাড়ি না হলে হয়?”
তিনি মিলার হাতে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বললেন, ” বউমা অনেক লোকই আইবো বাড়িতে৷ তুমি কারও কথায় কিছু মনে করবা না৷ সংসারে থাকতে গেলে অনেক কথাই এক কানে হুইন্না আর কান দিয়া বাইর কইরা দিতে হয়।” মিলা তার শাশুড়ির ইংগিত বুঝে তার হাত দুটো শক্ত করে ধরলো। এ যেন পরম ভরসার হাত৷
মাহতাবকে কোলে নিয়ে নিজের রুমে গেলো সে। গালে, কপালে চুমু খেলো। মিতাকে কল করলো তার খোঁজ নিতে। এরপর মাহতাবের কাপড় বের করে তিন্নির কাছে দিয়ে এলো। তিন্নি তাকে গা মুছিয়ে রেডি করে দিবে বলেছে। তিন্নির বড্ড আদরের মাহতাব। রুমকির কথা মনে পড়ে গেলো তার৷ সে দ্রুত ভিডিও কল করলো ফুফুকে।
মিলার কন্ঠে উচ্ছ্বাস শুনে রুমকির মন জুড়িয়ে গেলো। তার চোখের কোণে আনন্দ অশ্রু। বেশ খানিকক্ষণ গল্প করে মিলা তৈরি হতে গেলো।
মুহিন ফিরেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো৷ মিলার জন্য শাড়ি কিনতে গিয়েছিলো। সুন্দর একটা লাল আর মেরুন রঙের মিশেল টাঙ্গাইল পাড়ের শাড়ি আর কয়েকটা সুতি শাড়ি কিনেছে৷ এর মধ্যে আম্মা আর তিন্নির জন্যও আছে৷ আজ বহুদিন পর সে শপিং করেছে বাড়ির সবার জন্য।
মায়ের ঘরে গিয়ে সব দিয়ে মিলার শাড়ি নিয়ে ঘরে চলে এসেছে।
মিলা ছাদ থেকে নেমে ঘরে এসে দেখে মুহিন ব্যাগ খুঁজছে৷ মিলা জিজ্ঞেস করলো,” কি খুজছেন?”
” হ্যাঁ! ব্যাগ।”
” কাপড় সব আলমারিতে রেখে দিয়েছি ব্যাগ থেকে বের করে।”
মিলা গিয়ে আলমারি খুলে ট্রাউজার আর টিশার্ট বের করে দিলো।
“আপনাকে জিজ্ঞেস না করেই আপনার আলমারি ধরেছি। তিন্নি বলেছে সব বের করে গুছিয়ে রাখতে তাহলে বার বার ব্যাগ টানতে হবে না।”
” খুব ভালো করেছেন। আমি নিজেই বলতাম।”
” আমার বেনারসি কোথায়?”
” বেনারসি? ”
” আম্মা নাকি বেনারসি আনতে পাঠিয়েছিলো আপনাকে?”
মুহিন প্যাকেটটা খুলে মিলার হাতে দিলো।
লাল রঙের শাড়ির পাড়টা চোখে লাগছে৷ এইলোক সব ক্যাটক্যাটা রঙ দেখে৷ শাড়ি পুরোটা খুলে মিলা খুশি হলো৷ খুব সুন্দর শাড়ি দুটো রঙ মেশানো টাঙ্গাইল পাড়ের শাড়ি। মোটা চওড়া পাড়। এটার ম্যাচিং ব্লাউজ আছে তার কাছে ভাগ্যিস।
” আমি বেনারসিই আনতে গিয়েছিলাম। তবে আপনি তো আমাদের টাঙ্গাইলের শাড়ি পরেন নি কখনো। বা পরলেও এখন পরাটা ভিন্ন ব্যাপার তাই এনেছি৷ আর আপনাকে এই শাড়িটায় খুব ভালো লাগবে দেখবেন৷”
মিলা হাসলো। সে শাড়ি,গহনা পরে তৈরি হয়ে সামনে বিছানায় বসার জন্য প্যাকেট সরাতেই, প্যাকেটে আরও কিছু আছে বুঝতে পারলো। লাল কাচের চুড়ি, টিপের পাতা। মিলার এতো আনন্দ হচ্ছে কেনো? অদ্ভুত তো! মুহিনকে জড়িয়ে ধরতে মন চাচ্ছে৷ দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখলো মুহিন রান্নার কাজ তদারকি করছে৷ মিলা চুড়ি গুলো পরলো না৷ যে বোকার মতো লুকিয়ে রেখে গিয়েছে, সেই পরাবে।
চলবে…