ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-১৭

0
64

‘ঝরা পাতা উড়ে যায় ‘
পর্ব-১৭
শাহাজাদী মাহাপারা

রুদ্মিলার অনার্স শেষ করে মাস্টার্সের জন্য ভর্তি হয়। সকলেই এবার তাকে বিয়ে দিতে উঠে পরে লাগে। মিলা নিজেও আর মানা করে না। রুদ্মিলার বাবার ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে ফারদিন।ফুফুর বড় ঘরে বিয়ে হয় এবং তারা ইন্ডিয়া চলে যান সেখান থেকে লন্ডন। এবং তাদের সাথে যোগাযোগও কমতে থাকে যুদ্ধের পর আর যোগাযোগ থাকে না৷ রুদ্মিলার বাবা তখন অনেক ছোট৷ এবং ছোট চাচার জন্ম হয় তার দু বছর পর। সে ফুফাতো ভাইয়ের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো রুমকি বেগমের শশুরের। লতায় পাতায় আত্মীয় বলা চলে। সেই সুবাদেই রুদ্মিলার সাথে ফারদিনের বিয়ে ঠিক হয়৷ এরপর রুদ্মিলার শরীর দিন দিন ভেঙে পরতে থাকে। রুমকি বেগম জোর করেই রুদ্মিলাকে ডাক্তারের কাছে নেন। চিকিৎসার পর জানতে পারেন রুদ্মিলার জরায়ু বাচ্চা বহনে অক্ষম৷ তার জরায়ু একটা সুস্থ জরায়ুর তুলনায় আকারে ছোট। রুদ্মিলা বিয়ে করতে চায় নি। রুমকি বেগমও বিয়ে দিতে চান নি সবাইকে না জানিয়ে। রুদ্মিলার এহেন অবস্হার কথা জেনে রুমকি বেগম ভেঙে পরেন৷ তার এত আদরের ভাতিজির কপাল যে তার মতন হবে ভেবেই তার দেহ শিউরে ওঠে। তিনিই জানেন সে রাতে তিনি হাসানাত সাহেবের বুকে পরে কেমন হাউমাউ করে কেঁদেছেন আর জানেন রুদ্মিলার ফুফা। এরপর রুস্মিতার মা রুদ্মিলাকে আত্মহত্যার হুমকি দেয় এবং রুমকি বেগমকেও তিনি রুদ্মিলার মাথার কসম খাওয়ান। এক বিশাল নাটকের পর রুদ্মিলা নিজেই রুস্মিতার শাশুড়ি মায়ের কাছে চিঠি পাঠায়। এবং বিয়েতে বর যাত্রী আসার পরই সে এই চিঠি পাঠানোর ব্যবস্থা করে৷ তারপর এই কথা জানবার পর যা হওয়ার তাই হয়৷ রুদ্মিলা জানতো ভদ্রমহিলা এই বিয়ে হতে দিবেন না। কিন্তু মাঝখানে বলির বকরা যে রুস্মিতা হবে এটা সে ভাবতে পারে নি। এবং ফারদিনও যে বিয়ে না করে আসর ছেড়ে উঠবে না এটাও সে ভাবতে পারেনি।
তারপরের ঘটনা খুব সহজ। মিতাকেও নিজে সহ বাবা এবং মিলাকে বিষ খাওয়ানোর মতো ব্ল্যাকমেইল করে তাদের মা। এবং মিতাকে বিয়েতে বাধ্য করে৷ বোকা মিতাটাও রাজি হয়ে যায়৷ এরপরের দিন সকালেই ফুফু কোথা থেকে যেনো মুহিনকে ধরে নিয়ে আসেন এবং মিলার সাথে গাটছাড়া বেঁধে দেন। মিলা শুধু জিজ্ঞেস করেছিলো ফুফুকে মুহিন তার বিষয়ে কতটা জানে? ফুফু বলেছিলেন, গতকাল মুহিন তার বিয়েতে এসেছিলো। এবং পুরো বিষয়টাই তার কাছে পরিষ্কার। এরপর আর মিলা কিছুই বলতে পারেনি। তাকে যতক্ষণ সাজিয়েছে সে হয়তো সজ্ঞানেই ছিলো না। কবুল বলার পর তার হুশ ফিরেছে। এরপর সই স্বাক্ষর করে সে বিকেলের মধ্যে মুহিনের স্ত্রী হয়ে গিয়েছে, মাহতাবের মা হয়ে গিয়েছে।

বৃষ্টি থেমেছে অনেকক্ষণ হলো। মাহতাব তার ফুফুর সাথে খেলছে। মিলা বারান্দায় চেয়ারে বসে সামনের বন্যার পানি আর সুন্দর সূর্য ডোবা সন্ধ্যা দেখার আনন্দ উপভোগ করছে। আর ফেলে আসা সময় গুলো নিয়ে ভাবছিলো। দুপুরের খাবার খেয়ে মুহিন বের হয় আশেপাশে ঘুরতে। মিলাকেও বলেছিলো তার সাথে যেতে। কিন্তু তার মা বারণ করেছে৷ নতুন বউ বাড়ির বাহিরে প্রথম দিন এসেই টই টই করলে ভালো দেখায় না৷ আগামীকাল সকালে সবাই এসে দেখে যাবে বউ এরপর ঘুরে বেড়াক যত খুশি৷ তাই মিলাকে ছাড়াই সে বের হয়েছে৷ মিলাকে এক কাপ চা পাঠিয়েছে তার শাশুড়ি। এই বাড়িতে দুজন কর্মী আছে স্বামী স্ত্রী সন্তান সহই পেছনের ঘরে থাকে। আর মুহিনের বাবার গরুর ফার্ম আছে। ধানি জমি, পুকুরে মাছ চাষ হয়। মুরগিরও ফার্ম আছে। তার শাশুড়ির হাত ভালো। তিনি যা বুনেন তাই ফলে। এই যে ছাদে গিয়েছিলো বিকালে গোসল সেরে কাপড় নাড়তে। ছাদে ডালিম, পেয়ারা গাছ। লেবু, বেগুন, মরিচ, ঢেড়শ,লাউ, চিচিঙ্গা আরও কিছু সবজির গাছ দেখে সে অবাক হয়েছে। তিন্নি মিলাকে দেখে বলল, “ভাবি এইগুলা সব আম্মার লাগানো। আম্মার হাতে সব হয়। ভাইয়ার হাতও এমন।
আম্মার এই গুণটা ভাইয়া পেয়েছে৷”

মিলা হাসে তিন্নির কথায়৷ তিন্নিও মিতার মতো ছটফটে। তিন্নিকে বেশ ভালো লেগেছে মিলার৷ নরম চেহারার দূরন্ত মেয়ে। মিতার চেহারায় একটা নরম ভাব আছে কিন্তু তিন্নির চেহারায় মায়া আছে। মিতার চেহারায় নমনীয়তা আছে।

রাতের খাবারের পর মুহিন রুমে এসে দরজা দেয়। মিলা আজ ঘরে একাই। মুহিন একটু অস্বস্তি বোধ করলো।
” মাহতাব কোথায়?”
” আব্বা আম্মার কাছে।”
” নিয়ে আসি। ”
” দিবে না। আমি চেয়েছিলাম। তারা আজ রাত এবং আগামী কয়েকদিন তাদের নাতির সাথেই থাকবেন বলেছেন। ”
“ও। কিন্তু মাহতাব তো আমাকে ছাড়া ঘুমায় না।”
মিলা একটু হাসলো।
” আপনার পুত্রকে কেউ কিডন্যাপ করতে চাইলে জোরও করা লাগবে না। সে এমনিতেই চলে যাবে। ঘুমন্ত রাজকুমার৷ তার দাদীর সাথে ঘুমাইতে কোনো সমস্যা নেই৷ সে ঘুমিয়ে কাঁদা।”
“ওহ৷ ঠিকাছে।”
মিলার মাথায় দুষ্টামির ভূত চাপলো। সে চুল খুলে চিরুনি করলো। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পাশ ফিরে তাকালো মুহিন তখনো দরজার সামনে দাঁড়ানো। সে হাতের উপর ভর দিয়ে কাত হয়ে শুয়ে মুহিনকে বিছানায় চাপড় দিয়ে ইশারা করলো। মুহিন ঢোক গিললো মিলার আচরণে। তার কাছে এই মিলা অপরিচিত, খুবই। মুহিন মিলার দিকে তাকিয়ে ধীরে বিছানায় গিয়ে বসলো। মিলা উঠে তার খুব কাছে গিয়ে বসলো৷ মুহিন মিলার চোখের দিকেই তাকিয়ে আছে এক ধ্যানে। তার চোখ হাসছে৷ অদ্ভুত সে হাসি। মিলার চিকন ঠোঁটে সে হাসি এতো মহোনীয় লাগছে যে মুহিনের ভেতরের সব বেসামাল হতে চাইছে। মিলা উঠে মুহিনের কাঁধে হাত রেখে উঁচু হয়ে তার চুলে হাত বুলালো।
তারপর আচমকা প্রায় চিৎকার করেই বললো, ” একি আপনার দেখি চুল পাকতে শুরু করেছে৷ ওহ নো! এতো দ্রুত? ” বলে সে দূরে সরে গেলো। মুহিন ভ্যাবাচেকা খেয়ে মিলার দিকে তাকালো।
” আপনি এখন থেকে স্ট্রেস কম নিবেন৷ খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করে ঘুমিয়ে যাবেন যলদি৷ তারপর দ্রুত ঘুম থেকে উঠে হাটতে যাবেন রোজ। আপনার তো চুল পেকে গিয়েছে, সর্বনাশ!”
” যলদি ঘুমাতে হবে৷ হ্যাঁ! হ্যাঁ! তাই তো দ্রুত ঘুমাতে হবে৷ মুহিন বিছানা থেকে নেমে টেবিলের উপর রাখা গ্লাসের পানি ঢক ঢক করে গিলে আবার বিছানায় এসে কোনো দিকেই তাকালো না। দ্রুত বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লো।” নিজের চুল তার নিজের ছিড়তে ইচ্ছে হচ্ছে৷ ইশ!

মিলাও আর কিছু না বলে চুপ করে পাশ ফিরে শুয়ে পরলো।
তার পেট ফেটে যাচ্ছে। হাসি চাপতে কষ্ট হচ্ছে৷

রাতে আরেকদফা বৃষ্টি হলো৷ পাশের ঘরের টিনের চালে বৃষ্টির ঝম ঝম শব্দটাও এঘরে শোনা যাচ্ছে। মিলার ঘুম ভেঙে গেলো৷ মিতার কথা মনে পড়ছে। কক্সবাজারে এখন মিতা,ভালো আছে। ফারদিনের সাথে দুপুরে কথা হয়েছে। মিতার জন্য এই মুহূর্তে এই রিফ্রেশমেন্টটার দরকার ছিলো। তার নিজের জন্যেও দরকার ছিলো।

মুহিনের কাছে সে কৃতজ্ঞ। তার উচিৎ এই সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তাকে একটা সুযোগ দেয়া। মাত্র তো কয়েকদিন কিন্তু মাহতাবের সাথে সে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গিয়েছে৷ হয়তো মা না হতে পারার দুঃখ থেকেই সে মাহতাবের প্রতি কনসার্ণ। মুহিন না থাকলেও তার চলবে কিন্তু মাহতাবকে ছাড়া কি করে থাকবে? ওই টুকু বাচ্চাকে বুকে নিয়ে নিয়ে ঘুম পাড়ায় সে। অসম্ভব! তাই মাহতাবের প্রতি টান থেকেই হোক আর মুহিনের প্রতি ভালো লাগা থেকেই হোক মুহিন আর তার এই সম্পর্ক কে তার নতুন করে সাজাতে হবে। সংসারটা এবার গুছিয়ে নিজের করে নিতে হবে৷

মিলার শীত শীত অনুভূত হচ্ছে। সে পাশে তাকিয়ে দেখলো মুহিন কাথা গায়ে শুয়ে আছে। এ ঘরে তিন্নি দুষ্টু একটাই কাথা দিয়েছে৷ মিলা নিজের পা দুটো ধীরে ধীরে মুহিনের কাথার নিচে আশ্রয় দিলো। মুহিন পাশ ঘুরে তাকে কাছে টেনে কাথার নিচে নিয়ে এলো। শক্ত করে জড়িয়ে রইলো। মিলার দম বন্ধ হবার জোগাড়। কিছুক্ষণ পর সে মুহিনের হাত তার হাতের উপর থেকে সরিয়ে কোমড়ে রাখলো। নিঃশ্বাস আটকে আসছিলো এতোক্ষণ। পরীক্ষা করে দেখলো মুহিন জেগে আছে কিনা৷ মুহিনের শ্বাস প্রশ্বাসের ওঠা নামা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে গভীর ঘুমে তলানো৷ সেও ঘুমিয়ে গেলো কিছুক্ষণের মাঝেই।

চলবে…!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে