ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-১৬

0
131

‘ঝরা পাতা উড়ে যায়’
পর্ব-১৬
শাহাজাদী মাহাপারা

বৃষ্টি বাড়ছে। সমুদ্রে উত্তাল বড় বড় ঢেউ৷ ভিজে যাচ্ছে মিতা। ফারদিন বারান্দায় তাকিয়ে দেখলো মিতা বৃষ্টির ছাটে ভিজছে। ঘরের আলো কমিয়ে ফারদিন বারান্দায় এলো নিঃশব্দে। মিতার কাঁধে হাত রাখতেই মিতা চমকে গেলো। ফারদিন অবাক হলো মিতা তাকে ভয় পায়? এতটা?

” ভিজছো কেনো? তোমার এমনিতেই শরীর ভালো নেই।” ফারদিনের কন্ঠে উৎকন্ঠা কি মিতা টের পেলো?

” এই শরীর নিয়ে প্লেনে করে কক্সবাজার চলে আসতে পেরেছি তাই ভিজলেও সমস্যা নেই।” মিতার কন্ঠ গম্ভীর। মিতার চোখে মুখে বৃষ্টির ছাট। পড়নের শাড়ি ভেজা। এইখানে এসেও তাকে শাড়ি কেনো পরতে হবে? রিল্যাক্স হবার জন্য এনেছে তাকে। সুন্দর। ফারদিনের মাথায় হঠাৎ সুন্দর শব্দটা বেজে উঠলো। মিতাকে সত্যিই সুন্দর লাগছে। মিতা অনেক সুন্দর। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আশ্চর্য! মিতাকে নিয়ে ভাবছে ফারদিন? মিতাকেতো কখনো ওই চোখে দেখেনি সে? দেখে নি? কিসব আবল তাবল ভাবছে সে? মিতা! তার স্ত্রী, অর্ধাঙ্গিনী। মিতার দেহের এমন কোনো বাঁক নেই যেখানে তার ঠোঁটের স্পর্শ নেই। মিতার কায়ার রহস্যের আদি অন্ত ফারদিন কবেই উন্মোচন করেছে। অথচ তবুও কেনো মনে হচ্ছে তখন কিছু একটা ছিলো না। মিসিং ছিলো কোনো একটা পার্ট। মিতার মন! মিতার মনের অলিগলিতেতো ফারদিন ছিলো না। সেটাই মিতাই কি ফারদিনের মনে ছিলো? এখন দিন রাত মাথায় শুধু মিতা ঘোরে। মিতার প্রতি সে কনসার্ণ এটা তো অসত্যি না। সে কি মিতাকে ভালোবাসে? যাহ! এতো দ্রুত? এত দ্রুত প্রেমে পরা যায়! ভালোবাসা যায়? কই ফারদিনের তো প্রেম আগেও ছিলো তখন তো এত দ্রুত সব ঘটে নি। শারিরীক টানের জন্যই কি মিতাকে তার এতো কাছের মনে হচ্ছে? নাতো। কিন্তু এই সুন্দর মুহূর্তে তো ফারদিন মিতার দেহের প্রতি কোনো মোহ পাচ্ছে না৷ তার চিন্তা হচ্ছে মিতাকে নিয়ে, তার সুস্থতাকে নিয়ে, শারিরীক, মানসিক দুটোই৷ মিতার মনে কি চলছে? এতো গম্ভীর হয়ে কথা বলাটাও ফারদিনের মনে আঘাত করছে৷ মনে হচ্ছে কেউ একশোটা সুই বিধিয়ে দিয়েছে তার মনে৷ কি ভাবছে সে এগুলো! পাগল হয়ে যাচ্ছে নাতো!
ফারদিন নিজের মাথার চুল টেনে ধরে বারান্দার বাহিরে চলে গেলো। মিতা আবার সামনে ফিরে সমুদ্রের দিকে মনোযোগ দিতে চাইলো। কিন্তু পারলো না। ফারদিন সাথে সাথেই ফিরে এসে মিতাকে কাছে টেনে অধর বন্দী করলো। এই তৃষ্ণা মিটবে কিভাবে? মিতার নিজের কোনো বোধই রইলো না৷ ফারদিনের ডাকে তার দেহ সাড়া দিতে শুরু করেছে। আগে যেমন লাশের ন্যায় পরে থাকতে পারতো। এখন পারছে না। পারে না। তবে তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। মিতাকে ছেড়ে হঠাৎ ফারদিন আঙুল উঁচিয়ে চিৎকার করে বললো দ্রুত চেইঞ্জ করো৷ আর শাড়ি পরবে না৷ বলেই রুম থেকেই বের হয়ে গেলো। মিতা বোকার মতো চেয়ে রইলো।

ফারদিন ফিরলো ঘন্টা খানেক পর। এতক্ষণ সে বাহিরে বসে ছিলো। বাসার সবার সাথে কথা বলেছে। মুহিনকেও ফোন করে তাদের গন্তব্যের কথা জানিয়েছে। মিলার প্রতি এখন আর তার কোনো কিছুই নেই। রুমে এসে সে দেখলো মিতা ঘুমাচ্ছে বিছানায়। সালওয়ার কামিজ পরা। ফারদিন নিজেও চেইঞ্জ করে নিলো। বিছানায় গিয়ে শুয়ে রইলো কিছুক্ষণ। মিতা এতো দূরে শুয়ে আছে যে আরেকটু নরলেই পরে যাবে মেঝেতে। ফারদিন মিতাকে টেনে আনলো না। সে নিজেই এগিয়ে গেলো মিতার কাছে৷ কম্ফোর্টারের নিচে৷ এক হাত মিতার উপরে দিয়েই বিছানায় আটকে বেড়িকেট বানালো৷ এখন মিতা পরবে না৷ মিতার ঘুমের দীর্ঘশ্বাস টের পাচ্ছে সে। পেটের উঠা নামাও টের পাচ্ছে। এখানে নিশ্চই কিছুদিন পর আরও একজন থাকবে৷ আরে কিসব ভাবছে সে! নিজের কপাল চাপড়ে মিতার কানে চুমু খেলো। এরপর ডুব দিলো ঘুমের দেশে। বাহিরে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। ভেতরেও থেমে থেমে ভালোবাসারা উড়ে বেড়াচ্ছে।
*****

শরীরে আর এক ফোঁটাও বল নেই। এতো ক্লান্ত আগে কখনো লাগে নি রুমকি বেগমের। হাসানাত সাহেব এতোক্ষণ পাশেই ছিলেন। জানালা দিয়ে কন্যা সুন্দরী আলো এসে পড়েছিলো রুমকি বেগমের মুখে। সমস্ত মুখে চুমু খেয়েছেন হাসানাত সাহেব বেশ কয়েকবার। এতো সুন্দর পুরুষ রুমকি বেগম আগে কখনোই দেখেন নি। তার একান্ত ব্যক্তিগত এই মানুষটাকে নিয়ে তার অহংকার করতে ইচ্ছে হয়। একটু আগেই হাসানাত সাহেব উঠে গিয়েছেন তার কাছ থেকে। তিনি ভেবেছেন রুমকি বেগম ঘুমিয়ে গিয়েছেন সম্ভবতঃ। কিন্তু তিনি জেগেই ছিলেন। বিগত কয়েকদিনের কথাই তিনি ভাবছিলেন৷ ভাবতে ভাবতে পেছনে ফেলা আসা বহু স্মৃতিই তার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে।

মিতার ফুফু রুমকি বেগম। তিন ভাইয়ের এক মাত্র অতি আদরের ছোট বোন। আদরেই বড় হয়েছেন সবার৷ প্রথমে বড় ভাবি, তার পর ছোট ভাবি, শেষে মেঝো ভাবি এলেন। জীবন পরিবর্তন হলো৷ ভাইয়েরা আলাদা হতে শুরু করলো। রুমকি কলেজে ভর্তি হলো বাবা মাও গত হলেন। রুমকির দায়িত্ব এখন কে নিবে? বাবার গ্রামে তেমন জমি জমা ছিলো না৷ শুধু ভিটে মাটি টাই ছিলো। আর ঢাকায় এক তলা বাড়ি আর একটা বিপণী বিতান। শাড়ির দোকান।
ছোট ভাই সারাদিন টই টই করে ঘুরে বেড়াতেন৷ তেমন একটা কাজ করতেন না। তার শখ হলো গরুর ফার্ম দেয়ার। তাই যখন সব কিছু ভাগ হলো তখন দেখা গেলো গ্রামের জায়গা টুকু ছোট ভাই পেলেন। এখনের বাড়িটা গেলো মেঝো ভাই এর হাতে। আর বড় ভাই ইন্টারের পরেই বাবার সাথে দোকানে বসায় বাজারের বড় দোকানটা তার আন্ডারে গেলো। আর রুমকি বেগমের জন্য কিছু রইলো না। এটা নিয়ে তিনি অবশ্য তেমন ভাবেনও নি। আদরে বড় হওয়া রুমকি তখন এতো সব কিছু বুঝতেন না। তারপর ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করলেন যখন তার ভাবিরা তাকে বোঝা ভাবতে শুরু করলেন। রুমকির দায় ভার অবশেষে গিয়ে পড়লো মেঝো ভাইয়ের কাঁধে। রুমকির মেঝো ভাবির বয়স বাকি দুই ভাবির থেকে কম ছিলো। মেঝো ভাই বিয়ে করেছিলেন একটু দেরিতে অল্প বয়সী মেয়ের সাথেই। রুমকির থেকে ভাবি দু তিন বছরের বড় হওয়ায় ভাবির সখ্যতাও একটু বেশি ছিলো বাকি ভাবিদের তুলনায়। এরপর মেঝো ভাইয়ের ঘরে এলো মিলা। রুদ্মিলাকে ভাবির চেয়ে বেশি রুমকিই পেলেছেন। রুদ্মিলা নামিটাও তার দেয়া। অন্য কোনো ভাইয়ের সন্তানদের প্রতি তার এতো টান নেই যতটা রুদ্মিলার জন্য আছে। ভাবি হঠাৎ একদিন স্ট্রোক করেন। এরপর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যান। মিলার বয়স তখন চার , ভাবিকেও সামলানোর কেউ নেই। তাই ভাবির বাবা মা ঠিক করেন ভাবির ছোট বোনের সাথে আবার মেঝো ভাইয়ের বিয়ে দিবেন। প্রথমে রাজি না হলেও যখন রুমকির জন্য বিয়ের ঘর আসতে শুরু করে তখন তাকে সব দিক বিবেচনা করে রাজি হতেই হয়৷ ভাবি কথা বলতে পারতেন না৷ ইশারায় বোঝাতেন৷ নতুন দম্পতি হোক ভাইয়ের দ্বিতীয় বিয়ে তবুও তো নতুন৷ তাদের কথা বার্তা, খুনশুটি আর ভাবির বোনের ভাবির প্রতি কিছুটা অবহেলা৷ সব মিলিয়ে ভাবিও হয়তো বেশিদিন সহ্য করতে পারেন নি৷ জীবনের মায়া ত্যাগ করে মিলাকে ফেলে চলে যান৷ তারপরের বছরই রুস্মিতা আসে। সময় সময়ের মতো পার হয়ে যায় আর রুদ্মিলাও রুমকির কাছেই বড় হতে থাকে৷ তখন রুমকি বেগম বড় ভাইয়ের দোকানে যান একদিন। একটা নতুন শাড়ি নিতে যেনো ইউনিভার্সিটির ফাল্গুণের অনুষ্ঠানে পরতে পারেন। শেষ বর্ষ চলছে তার। বড় ভাই অবশ্য শাড়ি দিতে চান নি। রাগ করে যখন রুমকি বেগম চলে আসছিলেন তখন তাকে কেউ একজন পিছু ডাকে৷ রুমকি বেগমকে ভদ্রলোক তার হাতে থাকা ব্যাগটা দিয়ে বলেন আপনি এটা কিছুক্ষণ রাখতে পারবেন? আমি সামনের দোকানে যাবো কাজটা সেরেই চলে আসবো। আপনিতো ওই শাড়ির দোকানেরই লোক তাই না? রুমকিও বোকার মতো মাথা নাড়ে৷ এত সুদর্শন পুরুষ কি সে আগে দেখেছে? ছোট ভাই ও সুন্দর কিন্তু এতোটাও না। বোকা রুমকি ব্যাগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঘন্টা খানেক। তারপর বিরক্ত হয়ে তা দিয়ে আসতে যায় দোকানে। যার নেয়ার সেখান থেকেই নিয়ে যাবে। কি মনে করে যেনো রুমকি ব্যাগের ভেতর উঁকি দেয়৷ একটা বাসন্তি রঙের সিল্ক শাড়ি। তাতে একটা ছোট চিরকুটও রয়েছে৷ তাতে লেখা এই চিরকুট যে প্রথম খুলে পড়বে শাড়িটা তার। বোকা রুমকি আরও বোকা হয়ে রইলো। তারপর এদিক সেদিক তাকিয়ে শাড়িটা নিয়ে দোনামোনায় ভুগলো৷ অবশেষে শাড়িটা পরার চিন্তা করলো। তার নিজেস্ব শাড়ি নেই। আগের অনুষ্ঠান গুলোতে মেঝো ভাবির শাড়ি পরতো। এখন তো সেগুলোও জবর দখল হয়েছে৷ রুমকি শাড়ি নিয়েই বাড়ি ফিরলো। এরপর ফাগুণ গেলো, চৈত্র গেলো, বোশেখ, জৈষ্ঠ্য, আষাঢ় গেলো, শ্রাবণ এলো সাথে শাড়ি কিনে দেয়া ভদ্রলোকও এলেন৷ হাসানাত সাহেব এক সন্ধ্যায় সবাই কে অবাক করে দিয়ে রুমকির মেঝো ভাইয়ের বাড়িতে এলেন তার মাকে নিয়ে। রুমকি বেগমের খেলছিলেন তখন রুদ্মিলার সাথে কোলে রুস্মিতা। ভাই এসেছে ভেবে দরজা খোলে রুমকি। চমকে যান দরজার ও পাশের দুজনও। রুমকি তাদের ঘরে বসতে দেন। আপ্যায়ন করেন। রুমকির মেঝো ভাই বাড়ি ফিরে খানিকটা অবাকই হন। সিমেন্ট, রডের বিজনেস আছে হাসানাতদের ছেলে শিক্ষিত সুদর্শন৷ আর রুস্মিতা রুমকির মেয়ে না এটাও জানতে পারে হাসনাত। তারপর একদিন সব ভাইয়েরা মিলে অতি আদরের এবং অতি বোঝার বোন কে বিদায় করেন বাড়ি থেকে। রুদ্মিলা দেখতে দেখতে ছয় বছরের হয়ে যায়৷ স্কুলে ভর্তি হয়। তারপরের বছর রুমকিও বিদেশ যান বরের সাথে ফিরেও আসেন। ব্যবসা বৃদ্ধি হয় হাসানাত সাহেবের। খবর আসে রুমকি বেগম অন্তসত্তা। তারপর মিসক্যারেজ, রুমকি বেগমের আর মা না হতে পারার সংবাদ, রুমকির মিলাকে দত্তক নিতে চাওয়া। মিলাকে নিলে রুস্মিতাকে কে পালবে সেই চিন্তায় মেঝো ভাবির ঘুম হারাম হওয়া এবং অবশেষে মেঝো ভাবির গো এর কাছে মেঝো ভাই হার মেনে মিলাকে রুমকি বেগমকে দিতে না চাওয়া। সবটাই তার চোখে ভাসে এখনো। তবুও হাসানাত সাহেব একজন আদর্শ পুরুষ ছিলেন। তিনি এক ফাল্গুণে দেখা রুমকির হাত এতো বছরেও ছাড়েন নি। বিবাহিত জীবনের সপ্তম বছরে এসে শূন্য কোল ভরাট হয় রুমকি বেগমের। এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন তিনি। তারপর সব জায়গায় তার কদর বাড়তে থাকে। শ্বশুর বাড়ি, বাপের বাড়ি সব জায়গায়। রুদ্মিলাও খানিকটা অবহেলায় আর অনেকটা ভালোবাসায় বড় হতে থাকে।ছোট রুস্মিতা এবং তার পরে আসা সকলে ছাড়া বাকি সবাই জানে মিলার মা আসলে তার মা নয়। এ কথা মিলা নিজেও জানে৷

চলবে…!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে