‘ঝরা পাতা উড়ে যায়’
পর্ব-১৫
শাহাজাদী মাহাপারা
একটা লোহার গেটের ভেতরে ঢুকলো তারা। বিশাল বড় উঠান। ভিজে গিয়েছে বৃষ্টিতে। মুহিন তিন্নি বলে দুবার ডাকতেই ঘর থেকে একটা মেয়ে দৌঁড়ে বারান্দায় এসে দাড়ালো।
মা, মা বলে ডাকতে লাগলো তিন্নি। তিন্নি কাদার মাঝেই হেঁটে এসে মাহতাবকে জাপটে ধরলো মিলার কোল থেকে। মিলা তিন্নির দিকে তাকিয়ে হাসলো। মিলাকে দেখে তিন্নি কিছু বললো না৷ ভিতর থেকে তিন্নির মা বের হয়ে দেখলেন বাহিরে মুহিন দাঁড়ানো। তিনি তিন্নিকে সবাইকে নিয়ে ভিতরে আসতে বললেন৷ মিলা বুঝতে পারলো। সবাই মুহিনের উপর কিছুটা অভিমান করে আছে। খুব স্বাভাবিক। মুহিন এত কিছুর পরেও তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেনি৷ স্নেহার সাথে ডিভোর্সের পরেও না। সে অনুতপ্ত ছিলো৷ কিভাবে তাদের সামনে এসে দাঁড়াবে বুঝতে পারেনি। তবে তারা তো পরিবারই ছিলেন। তাদের মুহিনের সমব্যথী হবার কথা ছিলো। হয়তো ইচ্ছেও ছিলো৷ তবে দূরত্ব মুহিন নিজেই তৈরি করেছে। এবার সম্ভবতঃ সব ঠিক হয়ে যাবে।
ভিতরে গিয়ে মিলা তার শশুর কে দেখলো সাদা পাঞ্জাবী পরা একজন বৃদ্ধ লোক৷ মেহেদি দেয়ায় লাল রঙের দাড়ী। মিলা ঘোমটা আরেকটু টেনে তাকে সালাম করতে নিলো। তিনি গমগমে কন্ঠে বললেন, পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে হবে না৷
মিলা, মুখে হাসি নিয়েই আসসালামু আলাইকুম আংকেল বললো। তিন্নি ফিক করে হাসলো।
” আংকেল আবার কি কথা তুমি আমার ছেলের বউ। আব্বা ডাকবা।” মিলা মুহিনের দিকে তাকালো। মুহিন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মিলা ঘাড় কাত করে, “জ্বি আব্বা” বললো।
মিলা মাহতাব কে তিন্নির কোল থেকে নিয়ে তার শশুরের কোলে দিলো। তিনি বললেন, ” আমি হাত ধুইয়া আইসা ধরি। ”
মিলা হাসলো, ” হাত ধুতে হবে না৷ কিচ্ছু হবে না৷ বাচ্চাদের ইমিউনিটি অনেক শক্তিশালী থাকে৷”
মাহতাব তার দাদার দাড়ী দেখে অবাক হলো৷ খুশিও হলো। সে তা টেনে ধরে খেলছে। মুহিন তার বাবাকে সালাম দিলো।
” রেস্ট নাও আসতে বহু কষ্ট হইছে তোমার৷ বহুদূর থিকা আসছো৷ কয়দিনের জন্য আসছো?”
” পাঁচদিনের ছুটিতে আসছি।”
” ভালো। মুহিনের মা বউরে ঘরে নিয়া যাও।”
মুহিন লাগেজ নিয়ে তার ঘরের দিকে গেলো৷ সব আগের মতোই আছে৷ তিন্নি নতুন চাদর বের করে বিছানা ঝেড়ে বিছিয়ে দিলো৷ মুহিন উত্তরের জানালা খুলে দিতেই ঘরে হুরমুরিয়ে বাতাস ঢুকলো। পাকা বাড়ি৷ বেশ বড় সর। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাতেই মিলা বুঝতে পারলো মুহিন কেনো বন্যার কথায় হাসছিলো। বাড়ি ধানী জমি থেকে অনেকটা উঁচুতে৷ তিন্নি পানির গ্লাস আর মিষ্টি নিয়ে ঘরে এলো তাদের মা ও এলেন পিছনে। বিছানায় বসে দেখলেন মিলাকে। মিষ্টির বাটি থেকে মিষ্টি মুখ করালেন দুজনকেই। তিন্নি খানিকটা সরিষা তেল নিয়ে মাহতাবের চাঁদিতে দিয়ে দিলো। একটু মিষ্টি নিয়ে তার মুখেও দিলো। যদিও মাহতাব তা খেলো না মাড়ি দিয়ে চিবিয়ে ছিবড়ে করলো৷ ওর কান্ড দেখে সবাই হাসলো।
” তোমার নাম কি?”
মিলা তাকালো তার শাশুড়ির দিকে।মুহিনের এত রূপ এই মহিলার থেকেই পাওয়া তাহলে।
মিলার হাতে একজোড়া স্বর্ণের বালা পরিয়ে দিলেন মুহিনের মা। সাইজে কিছুটা বড় হলো।
” মুহিন যখন হইছিলো তখন আমার শাশুড়ী এই বালা গুলা দিছিলো। তোমার শরীর ভরলে তখন পইরো। তখন হাতে লাগবে।” মিলার মন খারাপ হয়ে গেলো। মুহিন লক্ষ্য করলো।
” ওকে তোমার কাছে রেখেই যাবো কিছুদিন মা৷ তুমি খাওয়ায় দাওয়ায় মোটা বানায় ফেলবা৷ ঢাকায় তো খায়ই না৷ চড়ুইয়ের মতো খায়৷ ” মুহিনের মা কথা বলতে নিলেই মুহিন ইশারায় মাথা নাড়ে। তিনি বুঝতে পেরে বলেন,আচ্ছা।
মিতারা কক্সবাজার যখন পৌঁছালো তখন সেখানে তিন নম্বর বিপদ সংকেত জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ফারদিনের বন্ধুর বাবার এখানে টুরিস্ট এন্ড লজের বিজনেস রয়েছে৷ সমুদ্র সৈকত থেকে কিছুটা দূরত্বে একটা কটেজে তারা উঠলো। আগামী দুদিন তারা এখানেই থাকবে। মিতা, ফারদিন যদিও বিয়ের পর হানিমুনে যায়নি কোথাও। তবে এটাকেও মধুচন্দ্রিমা বলা যায় না। মিতার সাথে দুজোড়া ঘরে পরার সালওয়ার কামিজ আর তিনটা শাড়িই রয়েছে। চেক ইন করে ভিতরে গেলো তারা। মিতার প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে। গতকাল রাত থেকে শুধু সুপ্যের উপর বেঁচে আছে। এখন সলিড খাবার পেটে না পড়লে সত্যিই শরীর খারাপ করবে। মিতা ঘড়ি দেখলো ১:৪৫ বাজে। শাওয়ার নেয়া উচিৎ। রুমে গেলো তারা৷ দরজা খুলতেই একটু অবাক হলো মিতা। রুমটা আসলে হানিমুন কাপলদের জন্য। ফারদিন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অফ সিজন বলে ভেবেছিলো ঝামেলা কম হবে। স্বস্তির শ্বাস নিতেই বন্ধুর কাছে হেল্প চেয়েছিলো। কখনো কারো থেকে কিছু ফরমায়েশ করে না ফারদিন৷ এই প্রথম। বন্ধুও বিটকেল। যেই শুনেছে বউ নিয়ে যাবে হানিমুন সুইফট বুক করেছে।
মিতা রুমে ঢুকলো সুন্দর সেন্টেড ক্যান্ডেলের স্মেলে মন ভালো হয়ে গেলো তার। বারান্দা থেকে সোজা তাকালেই সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ দেখা যাচ্ছে। সমুদ্রের লবণাক্ত স্মেলটা যদিও তার ভালো লাগছে না। তবুও ঢেউ গুলো যেনো তার মন কে অন্যরকম অনুভূতি দিয়ে যাচ্ছে। মিতাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফারদিন বললো, তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। ওরা কিছুক্ষণের মধ্যে লাঞ্চ রুমেই দিয়ে যাবে।”
মিতা লাগেজ থেকে ড্রেস বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো। ওয়াশরুম থেকেও সাগর দেখা যাচ্ছে। বাহির থেকে ভিতরে যদিও দেখা যায় না তবে ভেতর থেকে বাহিরে দেখা যাচ্ছে। একটা ছোট্ট জাকুজিও রয়েছে। মিতার খুব ইচ্ছে হলো জাকুজিতে নেমে দেখতে। কিন্তু ফারদিনও ক্লান্ত তারও ফ্রেশ হতে হবে ভেবে সে দ্রুত শাওয়ার নিয়ে বের হলো। মিতা বের হতেই ফারদিন ওয়াশরুমে গেলো। সেও চমকে গেলো৷ কটেজটা যে বেশ আধুনিক এতে সন্দেহ নেই। ভাগ্যিস পে করতে হচ্ছে না। বিয়ের গিফট। নইলে দারুণ ভাবে পকেট খসতো। ব্যাপারটা ভেবেই হাসি পেলো তার।
দুপুরের লাঞ্চ রুমেই দিয়ে গেলো। লাঞ্চ সেরে মিতা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। এত কিছুর মাঝে সে ঠিক মতো কিছু খেতে পারলো না। ফারদিন খেলো সব৷ ওর সম্ভবত খুব ক্ষুধা ছিলো পেটে।
মিতা মিলার ফোনে কন্টেক্টের চেষ্টা করলো তবে বৃষ্টি আর নেটওয়ার্ক দূর্বল হওয়ায় আর কথা হলো না।
ফারদিনের আর ১৩ দিন পর ফ্লাইট। যদিও ফারদিন কাওকে কিছু জানায় নি। আরেক মাস পরই যেতে চেয়েছিলো তবে এমন মন পরিবর্তন হবার কারণ ওর জানা নেই। ও ব্যাপারটা জেনেছে ফারদিন যখন কলে কারও সাথে কথা বলছিলো এই বিষয়ে তখন।
তবে এখন তার একটাই চিন্তা ফারদিন চলে গেলে তার কি হবে?
সে তো ওই বাড়িতে থাকতে পারবেনা। তাহলে কোথায় যাবে? বাবার বাড়িতেও যাবে না। তবে? ফুফুর বাড়িতে? হ্যাঁ সেটাই একমাত্র সেইফ প্লেস তার জন্য। তারপর সে কোনো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে কয়েকটা টিউশন যোগার করে নিজের খরচ নিজে চালিয়ে নিতে পারবে৷ কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির টাকা এই মুহূর্তে তার নেই আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেয়ার প্রিপারেশন ও তার নেই৷ তাহলে? টাকা? এই মুহুর্তে তার কাছে কাবিনের আট লাখ টাকাই রয়েছে। কি মনে করে এতো টাকা কাবিন করেছিলেন ফুফা তার জানা নেই। তবে এইগুলোই তার শেষ সম্বল এখন। প্রাইভেটেই ঢুকতে হবে৷ ওয়েভারের এপ্লিকেশন করতে হবে৷ এতে কিছু খরচ বেচে যাবে আশা করা যায়। তারপর বাকিটা দেখা যাবে৷ জীবন খুবই নিষ্ঠুর৷ এতো দ্রুত এইসব সহ্য করতে হতো না হয়তো। সারাজীবন আপা আর বাবা মায়ের ছত্রছায়ায় কাটিয়ে দেয়া মিতা আজ কিভাবে একাকী জীবন পার করা যায় তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।
আচ্ছা এই যে মানুষটা, ফারদিন৷ মিতার কি একবারের জন্য তার প্রতি কোনো অনুভূতি আসে নি? জোর করেই হোক আর যেভাবেই ফারদিনের স্পর্শ কি একবারো মিতার মন কে আন্দোলিত করেনি? একবারো ভালো লাগায় ভাসতে ইচ্ছে করেনি তার?
ফারদিন! তার মনে কি চলছে? সে কি কখনো ব্যাকুল হয়েছে মিতার জন্য? তার সকল স্পর্শই কি শারিরীক আকর্ষণ ছিলো শুধু? কখনো কি ভালোবাসা ছিলো না তাতে? ফারদিন কি চলে যাবে তাহলে মিতাকে ছাড়া? দূরে, বহুদূরে যেখানে মিতার কোনো স্মৃতিই ফারদিনের আর মনে পরবে না? এভাবেই কি ফারদিনের জীবন থেকে মিতার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে? মিতাই কি ফারদিনকে আর মনে রাখবে?
মাথায় আবল তাবল কত কিছু ঘুরছে তার এই মুহূর্তে।
চলবে…