‘ঝরা পাতা উড়ে যায়’
পর্ব-১৪
শাহাজাদী মাহাপারা
” আমি জুথিকে বিয়ে করতে রাজি হই না। স্নেহার কথা বাড়িতে জানাই৷ বাবা বেদম রাগ করেন। তারপর মায়ের অনেক বোঝানোর পর বোঝেন। স্নেহার সাথে কথা বলি। স্নেহার বাবাও রাজি হন৷ এরপর বিয়ে। স্নেহাদের আত্মীয় বলতে কেউ ছিলো না। ব্রোকেন ফ্যামিলিতে বড় হওয়া স্নেহা মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের পর মা লন্ডনে সেটেল হন। আর বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর বাবা বাকি সন্তানদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যান। হাস্যকর হলেও সত্যি জানো স্নেহা কিন্তু তার বাচ্চার সাথেও তাই করেছে যার ভিক্টিম ও নিজে। ”
মিলার মুহিনের জন্য খারাপ লাগলো।
” আপনার তাহলে এখন বয়স কত?”
” কত হতে পারে আন্দাজ করোতো?”
” চৌত্রিশ,পয়ত্রিশ?”
” ডেং৷ আমার এখন ৩১ বছর রানিং৷ তুমি হিসেবে অনেক কাঁচা।”
” জি না। আপনি নিজের হুলিয়া আর ভূড়ির এমন অবস্থা করেছেন যে আপনাকে বয়সের চেয়ে বেশি বয়স্ক মনে হয়।” মুহিন নিজের পেটের দিকে তাকালো।
” আগে ছিলো না এটা। অনিয়মের জন্য এই অবস্থা। এখন থেকে ঠিক হয়ে যাবে দেখো।” মিলা মুহিনের কথার অর্থ উদ্ধার করে মুখ ভেঙালো।
” তারপর কি হলো?”
“বিয়েতে খুব একটা লোক জানাজানি হলো না। খুব সাদামাটা বিয়েই হলো। এরপর স্নেহাকে নিয়ে আমরা গ্রামে চলে এলাম। স্নেহা তো গ্রামের বাড়ি জীবনে প্রথম দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলো। উচ্ছ্বল কিশোরীর মতো দাপিয়ে বেড়ালো। মা হারা মেয়ে ভেবে আব্বা আম্মাও স্নেহা কে খুব স্নেহ করতেন। তবে যতদিন গেলো স্নেহা এসবে ক্লান্ত হতে লাগলো৷ নেটওয়ার্ক কাজ করেনা, বিদ্যুৎ থাকে না ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর আমরা আবার ঢাকায় ফিরে এলাম। আমার চাকরিতে তখনও প্রমোশন পাইনি তাই কিছুটা খরচ বাঁচাতেই এখন যে বাসায় থাকি তাতে উঠলাম। যদিও কিছুটা সমস্যা হতো তবে আমরা এতে অসুখী ছিলাম না। বাসায় ওঠার তিন মাস পর স্নেহা জানালো সে জার্মানের এক ইউনিভার্সিটি তে এপ্লাই করেছিলো৷ সেখানে তাকে রিসার্চের জন্য এপ্রুভ করেছে। এবং সে সেখানেই সেটেল করতে চায়। কিন্তু আমি তখনো এই বিষয়ে কিছু ভাবি নি। আব্বা আম্মাকে ছাড়া অলরেডি শহরে পরে থাকি এখন আবার বিদেশবিভুঁইয়ে যেতে হবে ভেবেই আমার কষ্ট হলো। আমি খুব আদরে বড় হওয়া ছেলে মিলা। আমিতো শহরে পড়তেই আসতে চাইনি৷ তবুও এসেছি। তবে নিয়তির কি পরিহাস স্নেহা প্রেগন্যান্ট এটাও ধরা পরে এর পরের সপ্তাহেই। আর্লি প্র্যাগন্যান্সি হওয়ায় স্নেহা আমাকে না জানিয়েই এবর্শন করতে চায়। কিন্তু এতে কমপ্লিকেশন থাকায় ডাক্তার এবর্শনের অনুমতি দেয় না৷ মাহতাব খুব যুদ্ধ করেই এই পৃথিবীতে এসেছে৷ এরপর শুরু হয় রোজ রোজ অকারণে ঝগড়া, রাগারাগি, ভাঙচুর তো রয়েছেই৷ স্নেহা উন্মাদ হতে থাকে। নিজের যত্ন নেয় না,ঠিক মতো মেডিসিন নিতে চায় না৷ আর আমাকে দোষারোপ করে। এতে যদিও আমি কষ্ট পেতাম না৷ আমার এক কলিগ আসিফ যে কিনা ইউনিভার্সিটিতে থাকতে আমাদের কমন ফ্রেন্ডও ছিলো সে একদিন আমাদের বাসায় আসে। স্নেহার সাথে দেখা করে৷ পুরনো বন্ধু আমাদের। তার পর স্নেহা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে যায়। এক সপ্তাহের জন্য বাবার বাড়ি থেকেও ঘুরে আসে। সব কিছুই আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যায়। তখন স্নেহার সাত মাস চলে৷ আমি আসিফকে ধন্যবাদ জানাই। আম্মা সাধ করবেন তাই আমাদের গ্রামে যেতে বলেন। গাড়ি ভাড়া করে তিনজনেই যাই গ্রামে। সবাই খুশি হয়৷ স্নেহা রাত জেগে আসিফের সাথে গল্প করে তা দেখে আম্মা সন্দেহ করেন৷ আমাকে সাবধানও করেন৷ আমি রেগে স্নেহাকে নিয়ে পরদিন ঢাকায় ফিরি। স্নেহার এই কথা বলার বিষয়টা আমি বুঝেও বুঝতে চাইনি৷ আট মাসের সময় আম্মা এসে থাকতে চান স্নেহার সাথে৷ স্নেহা আম্মাকে ফোন করে রাগারাগি করে। এরপর আর আম্মার সাথে আমার কথা হয়নি। তখন আমি বাচ্চা আর স্ত্রীর চিন্তায় এতোটাই মগ্ন ছিলাম যে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি আমলে নেই নি। আট মাসের শেষের দিকেই মাহতাবের জন্ম হয়। স্নেহা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের অজুহাত দিয়ে মাহতাবের থেকে দূরত্ব তৈরি করে৷ আমার আব্বা আম্মা নাতিকে দেখতে আসে। কোলে নিতেই বাবার সাথে স্নেহা চরম খারাপ ব্যবহার করে৷ কারণ খুবই সামান্য, বাবার হাত ধোয়া ছিলো না। বেবির গায়ে জার্ম লেগে যাবে। এরপর বাবা অপমান সহ্য করে চলে যান বাড়িতে। আমার সাথে আর তাদের যোগাযোগ নেই। সেবারই তারা মাহতাবকে প্রথম দেখেছিলেন সেইবারই শেষ। ”
গলা শুকিয়ে গিয়েছে মুহিনের। মিলা পানির বোতল টা এগিয়ে দিতেই মুহিন অর্ধেকটা বোতল খালি করে ফেলে।
****
গাড়িতে গুমোট পরিবেশ। এ কয়দিনের খরতাপের পর অবশেষে বাদল ধারার দেখা মিলবে হয়তো । মিতা জানালার কাঁচ থেকে বাহিরে দিকে তাকিয়ে রইলো৷ গাড়ি কুড়িল ফ্লাইওভার ক্রস করছে। নিকুঞ্জ ক্রস করার সময় বাড়ি গুলোর দিকে বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলো সে।গাড়ি এয়ার্পোরটে এসে থামলো। মিতাকে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে বললো ফারদিন। বিনা বাক্য ব্যয়ে মিতা ফারদিনের পিছু পিছু চললো। টিকিট দেখিয়ে ভিতরে ঢুকলো তারা। মিতা একবার জিজ্ঞেস করলো শুধু, “আমরা কোথায় যাচ্ছি?” অপর ব্যক্তির উত্তর ছিলো কক্সবাজার।
*****
মিলা তন্ময় হয়েই যেনো গল্প শুনছে।
” এরপর স্নেহা মাহতাবকে কোলে নিতে চাইতো না, খাওয়াতে চাইতো না উদাসীন হয়ে থাকতো। তার বাবাকে জানানোর পর তিনি একজন মেইড ঠিক করে দেন মাহতাবকে দেখে রাখতে। তখন আমাদের কোম্পানিতেও ঝামেলা৷ তোমার ফুফা সেটা টেক ওভার করতে নিয়েছিলেন। তিনি অবশ্য আমার বাবার পূর্ব পরিচিত ছিলেন। তারা একই স্কুলে পড়েছিলেন। ”
” এক মিনিট৷ হ্যাঁ তাইতো। ফুফুর শশুর বাড়িতো টাঙ্গাইলে যদিও তারা এখন আর যান না৷ আমার তো বোঝা উচিৎ ছিলো। ইশ!”
মুহিন হাসলো।
” আমদের বিয়েতে ফুফাই আমার অভিভাবক ছিলেন। তিনি সম্ভবতঃ বাবার সাথে আগেই কথা বলে নিয়েছিলেন। আর ফুফার উপর বাবার একটা উপকার থাকায় ফুফু আমার প্রতি এতটা যত্নশীল। সে গল্প অন্য একদিন বলবো।”
” আচ্ছা।”
“আমার প্রমোশন তখনও ঝুলে আছে নতুন এমডির উপর। তিনি চাইলে প্রমোশন হবে নইলে না। এমন কঠিন একটা পরিস্থিতি ছিলো যে আমি কোনো ভাবেই কোথাও মানসিক শান্তি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এমন কি বাসায় ফিরে মাহতাবকে নিয়ে আমার ব্যস্ত থাকতে হতো।
স্নেহার সাথেতো রোজকার ঝগড়া অশান্তি লেগেই থাকে। একদিন আসিফ জানালো সে, চাকরি ছেড়ে জার্মান চলে যাচ্ছে। আমি অবাক হলাম, মনে সন্দেহও হলো । বাসায় ফিরে স্নেহাকেও জিজ্ঞেস করলাম। স্নেহা কিছু জানেনা বললো। এরপরের ঘটনা খুবই আনপ্রেডিক্টেবল ছিল আমার জন্য। স্নেহা নিরুদ্দেশ হবার একদিন আগে আমার প্রমোশন কনফার্ম হলো। সেদিন রাতে আমরা ডিনারে গেলাম দুজন। সবকিছুই স্বাভাবিক ছিলো। স্নেহার মাঝেও পরিবর্তন দেখলাম। পরের দিন স্নেহা মাহতাবকে মেইডের কাছে রেখে নিরুদ্দেশ হলো। ডিভোর্সের পেপার পাঠিয়ে দিলো। তার বাবা জানালো সে জার্মান চলে গিয়েছে। আর আমার কাছে ক্ষমা চাইলেন। আমিও রাগে, দুঃখে ডিভোর্স কনফার্ম করলাম। এরপর থেকে মাহতাব আমার কাছেই। মেইড চলে গেলো একসময়। আর আমি আর মাহতাব রয়ে গেলাম। ”
মিলা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মানুষের জীবন কত বিচিত্র মনে হলো কোনো ছবি বা উপন্যাসের অংশ পড়লো। অথচ এমনটা সত্যিই তার পাশে বসা ভদ্রলোকের সাথে ঘটেছে। মিলা কাঁদতে চাইলো। কিন্তু পারলো না৷ বুক ভার হয়ে গেলো। সেও পানির বোতলে চুমুক দিলো।
বাস মির্জাপুরে চলে এসেছে। পাকা রাস্তা, ফ্লাইওভার একটার পর একটা দারুণ লাগছে মিলার। সাথে থেমে থেমে বৃষ্টি।
” আমরা আর কিছুক্ষণের মাঝে নামবো। ”
বাহিরে এখন বৃষ্টি নেই। মাহতাব ঘুম থেকে উঠেছে কিছুক্ষণ আগেই। বাস থেমেছে পাম্প স্টেশনের কাছে। মিলারা নামলো বাস থেকে। সামনে রাস্তা কাঁদা হয়েছে কিছুটা।
“মিলা আপনি কি ঘোমটা টেনে নিবেন মাথায়। বাধ্যতামূলক কিছু না তবে এখান থেকে সামনে এগুলেই মুরুব্বিরা চায়ের দোকানে বসে আছে দেখবেন।”
” এই বৃষ্টির মাঝেও?”
” হ্যাঁ। তারা বয়ঃবৃদ্ধ মানুষ, চায়ের দোকানেই তাদের আড্ডা জমে। ভাগ্য করে আপনি আজ লাল শাড়িই পরেছেন।”
হা হা করে হাসলো মুহিন।
মিলা মাথায় শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘোমটা টেনে নিলো। সামনের দিকে এগুতেই দেখলো ভ্যান পাওয়া যাচ্ছে। মুহিন স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো৷ দুবছর পর বাড়ি ফিরেছে সে। এই দু বছরে মোটামুটি রাস্তাঘাট অনেকটাই চেইঞ্জ হয়েছে। ভালো লাগছে তার। রাস্তা পাকাও হয়ে যাবে নিশ্চই আর কিছুদিন পর। এবার তার সত্যিই গাড়ি কিনে ফেলা উচিৎ। মিলা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সত্যিই চায়ের দোকানে ভীড়। টিভিতে নায়ক মান্নার ছবি চলছে৷ সে ডায়ালগ দিচ্ছে কেঁদে কেঁদে আর ভীড় করা দর্শক সবাই তার সাথে গলা মিলিয়ে হ, হ করছে, আহা, উঁহু করছে। মিলা মৃদু হাসলো।
মুহিনকে দেখে চায়ের দোকানের ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ” ছাত্তারের পোলা নি?”
” আসসালামু আলাইকুম কাক্কা। ভাল আছেন?”
” আছি আলহামদুলিল্লাহ। কয় বছর পর আইলা বাজান? নগে ক্যারা?”
” এই বছর দুয়েক হলো। আমার স্ত্রী মিলা। আর এইটা আপনাদের নাতী মাহতাব।”
” মাশাল্লাহ। ভ্যানের জন্য দাঁড়ায় আছো?”
” জ্বি।”
” চা খাইবানি?”
” না। ভ্যান পেলেই বাড়ি যাবো।”
” দাড়াও।ওই ইদ্রিস ওগোরে বাড়িতে পৌঁছায় দিয়ায়। বৃষ্টির মধ্যে খাড়ায় থাকবো নাইলে।”
ইদ্রিস নামের লোকটা তার ভ্যানে মিলাদের ব্যাগ উঠিয়ে মিলাকে বসতে বললো।
মুহিন মাহতাবকে ভ্যানের উপর রেখে মিলাকে সাহায্য করলো উঠে বসতে৷ মুহিন নিজেও চড়ে বসলো। স্কুল ঘরের সামনে যেতেই ব্রিজ পরে৷ মুহিন নেমে ভ্যানের পিছনে ধাক্কা দিলো উপরে তুলতে। মিলা আড় চোখে বেশ ক বার মুহিনকে দেখলো। মুহিন খেয়াল করলেও কিছু বললো না৷ মিলা আশে পাশের ক্ষেত দেখছে। বাতাসের ছন্দে ধানী জমি কিভাবে দুলছে৷ মনোরম এক দৃশ্য। আকাশে মেঘ। দূর দূরান্তে কেউ নেই৷ বাড়ি বাড়ি থেকে খিচুড়ির বাসনা যেন বাতাসে ভেসে আসছে। মিলার খুব মন চাইলো কোনো একটা বাড়িতে ঢুকে চট করে খেয়ে আসতে। মিলার ঠোঁটের হাসি যেনো সরছেই না। চোখে মুখে আনন্দ তার।
” অনেক দিন পর গ্রামের বাতাসে শ্বাস নিচ্ছি।”
” সুন্দর না? ”
” হ্যাঁ। দারুন লাগছে।”
” কয়েকদিনের মাঝে বন্যা হবে। তখন চারপাশে শুধু পানি আর পানি। নৌকা ছাড়া বের হবার উপায় নেই। নৌকায় করে ঘুরতে বের হওয়া যেতো। আবার শীতের সময় যতদূর চোখ যাবে শুধু হলুদ সরিষা। সেই দৃশ্য যেনো আরও মনোরম। আমরা বন্যার সময় আবার আসবো কেমন?”
” ঠিকাছে। আপনার অফিস ছুটি দিলেই আসবো।”
” বহু ছুটি জমে আছে। তাছাড়া আসতে যেতে এখন আর খুব একটা সমস্যা হয় না৷ দেড়, দু ঘন্টায় পৌঁছে যাওয়া যায়। ”
” বন্যায় গ্রাম ডুবে যায় না? ”
মুহিন হাসলো।
” না। একটু পরেই বুঝতে পারবেন।”
একটা বড় পুকুরের সামনে গিয়ে থামলো ভ্যান। মুহিন ভাড়া কিছুটা বাড়তিই দিলো, মোড়লের বাড়ি। মুহিন ভ্যান চালকের ফোন নম্বর নিয়ে তাকে বিদায় দিলো।
মিলার কোলে মাহতাব মিলা দাঁড়িয়ে আছে। বললো, “আসুন।”
চলবে…!