ঝরা পাতা উড়ে যায়’
পর্ব-১৩
মিতা বাড়ি ফিরলো পরের দিন সকালে। সকলেই অস্থিরতা নিয়ে তার জন্য অপেক্ষায় ছিলো। মিতাকে তার রুমে নিয়ে ফিরতেই ফারদিন তার শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বললো,
” আন্টি আমি এখানে আর বেশিক্ষণ থাকবো না। মিতা যদি থাকতে চায় থাকতে পারে।”
মিলা মিতার দিকে তাকিয়ে বললো, “মিতাও তোমার সাথে যাবে ফারদিন।” মিলার মা বাধা দিয়ে বললো, ” মিতা এখানেই থাকবে। আমি আমার মেয়েকে কিছুদিন আমার কাছেই রাখবো।”
মিতা শুয়ে থেকেই ফারদিনের দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনি আমাকে একা রেখে যাবেন না প্লিজ। আমিও আপনার সঙ্গেই চলে যাবো।”
” তাহলে শুধু শুধু আসলি কেন আবার৷ হাসপাতাল থেকেই চলে যেতি।” মিলার খালা বললেন।
“সেটার এখন কৈফিয়তও দিতে হবে?” মিলা প্রচন্ড বিরক্তবোধ করলো।
” ভুল হয়ে গিয়েছে। আব্বা ওনাকে আমায় এখানে নিয়ে আসতে বলেছিলো কিন্তু তিনিতো জানতো না আমি এখানে আসতে চাইছিনা। তাই নিয়ে এসেছে।”
মিতা ধীরে ধীরে উঠে যা কিছু বাহিরে ছিলো সুইটকেসের তা আবার গুছিয়ে ভরতে নিলো। মিলা দ্রুত সব প্যাক করে ফেললো। মিতা মিলার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ঘোলাটে চোখ দুটো স্পষ্ট তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছে। মিলাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সে। মিলা আদর করলো তার একমাত্র বোনকে।
ফারদিনের গাড়ি এসে থেমেছে বাড়ির সামনে। মিতা আপাকে ছেড়ে মাকেও জড়িয়ে ধরলো।
” ভালো থেকো আম্মু। নিজের যত্ন নিয়ো।”
মিতা ফারদিনের দিকে তাকালো। ফারদিন তাদের ট্রলিটা নিচে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। মিতা ড্রয়িং রুমে গিয়ে তার বাবাকেও বেশ ক্ষানিকক্ষন জড়িয়ে ধরে রাখলো। তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেলো।
মিলা ফিরে এসে নিজের লাগেজে গুছিয়ে নিলো। মাহতাবের কিছু ডায়পার বাহিরে ছিলো তাও ব্যাগে গুছিয়ে নিলো। তারপর কল করলো মুহিনকে। মুহিন নিচেই দাঁড়িয়ে ছিলো মিলার কলের অপেক্ষায়। মিলার ফুফু গতকাল রাতে চলে গিয়েছিলেন বাসায়। আজ সকালে আবার এসেছিলেন। মিলা তার সাথে দেখা করেই বেরিয়ে এলো বাসা থেকে। মুহিন সিএনজিতে মিলাদের ব্যাগ পত্র তুলে দিয়ে ফুফুর থেকে বিদায় নিয়ে সিএনজিতে উঠে বসলো।
আকাশে মেঘ করেছে।ঝড় নামবে নামবে করছে। মিলার মনটা মেঘের মতোই হয়ে আছে। যদিও সে খুব বেশি কিছু আশা করে আসেনি বাপের বাড়ি কিন্তু এতো কিছু ঘটে যাবে তাও আশা করেনি। মুহিন মিলার দিকে তাকালো মাহতাব তার শাড়ির আঁচল নিয়ে খেলছে। মিলার জন্য আফসোস হলো তার৷ পরিস্থিতি এমন করুণ না হলে নিশ্চই আজ সে তার পাশে থাকতো না। অনাকাঙ্ক্ষিত মাহতাব ও তার কোলে থাকতো না। যত যাই হোক এরকম হঠাৎ করেই সন্তানের মা হয়ে যাওয়াটা কোনো কুমারী মেয়ের কাম্য না৷ তবে মিলার মনোবল খুবই শক্ত তাই এই রকম কঠিন পরিস্থিতি তাকে বিচলিত করতে পারেনি। সে কেঁদেছে, ভেঙেছে কিন্তু গুড়িয়ে যায় নি৷ আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে । দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো মুহিনের বুক থেকে। মিলা এক ধ্যানে বাহিরে তাকিয়েই রয়েছে। খেয়াল করেনি তারা কোথায় যাচ্ছে।
সিএনজি মহাখালী বাস টার্মিনালের কাছে যখন থামলো তখন ভর দুপুর। তবে আকাশে মেঘ জমায় কিছুটা স্বস্তি। মিলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো মুহিনের দিকে।
” আমাদের এক্ষুনি টাঙ্গাইলের বাস ধরতে হবে মিলা।”
” টাঙ্গাইল কেনো? কে থাকে? আপনিতো আগে কিছুই বলেন নি৷ আমিতো কিছুই গুছিয়ে আনি নি।”
” যা আছে তাতেই হবে। আমার তিনদিনের ছুটি রয়েছে৷ আর রয়েছে শুক্র, শনিবার৷ এর মাঝে বেড়িয়ে আসলে আপনার মন ভালো হয়ে যাবে। আপনার এতো সুন্দর বউ বউ চেহারায় এমন মেঘের ঘনঘটা দেখতে একদম ভালো লাগছে না।”
” আমি অতি অবশ্যই নতুন বউ এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ধরনের স্বস্তা স্বান্তনা আমাকে আর দিবেন না প্লিজ।” মুখে বললেও মিলার মনে সত্যিই মুহিনের তার প্রতি কনসার্ণ দেখানোটা অন্যরকম অনুভূতি এনে দিলো।
একদম মহাখালী টার্মিনালে ঢোকার আগের লোকাল বাসেই চড়লো তারা। বাসে যাতায়াতের অভ্যাস রয়েছে মিলার নানাবাড়ি যেতেও তারা বাস বা ট্রেন ব্যবহার করে তবে তা সব সময় সিটিং সার্ভিস বা এসি বাস ছিলো। এমন লোকাল বাসে এন্ড মোমেন্টে বাচ্চা সহ চড়াটা আসলেই ভয়ংকর ব্যাপার আর একটা নতুন এক্সপেরিয়েন্সও বটে। মাঝের সিটটাই নিলো মুহিন। বাসে এখনো কিছু যাত্রী সিট খালি সেগুলো ভরলেই বাস ছেড়ে দিবে। মুহিন মাহতাব আর মিলাকে সিটে বসিয়ে দিয়ে ব্যাগটা উপরের ডিকি সাইডে রেখে নিচে নামলো হালকা কিছু স্ন্যাক্স কিনে নিতে। মুহিনের আসতে আসতে বাস ভর্তি হয়ে গেলো। বাস ছেড়ে দিবে বুঝতেই মিলা উদ্বিগ্ন হলো৷ কন্ট্রাক্টর কে উদ্দেশ্য করে বললো আমার হাজবেন্ড এখনো আসেন নি প্লিজ একটু আপেক্ষা করুন। মিলা ফোন বের করে অস্থির হয়ে মুহিনকে কল দিলো। মুহিন কল ধরতে ধরতেই দৌড়ে বাসের দরজায় দাঁড়ালো। মিলার জানে পানি এলো যেনো। মিলা ফোন নামিয়ে রাখতেই মুহিন সিটে বসলো এসে। কন্ট্র্যাক্টর ড্রাইভারকে “ওস্তাদ চালু, চালু ” বলতে বলতে সামনের দিকে এগুলো।
“ভয় পেয়েছিলেন?” মুহিনের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি।
“তো? ভয় পাবো না? চিনি না জানি না একটা অপরিচিত জায়গায় যাচ্ছি আপনার ভরসায়। আপনি বউ, বাচ্চা রেখে হাওয়া হয়ে গিয়েছেন। আমি একা থাকলেও সমস্যা হতো না। এই বাচ্চা আর ব্যাগপত্র নিয়ে আমি কি করতাম যদি বাস ছেড়ে দিতো? অদ্ভুত।”
মুহিন হেসে মিলাকে নকল করেই বললো, “অদ্ভুত!”
মিলা আর কথা বাড়ালো না। বাস ছাড়লো মুহুর্তেই। বহুদিন পর গ্রামের দিকে যাবে ভাবতেই মিলার মন ভালো হয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে একবার মিতাকে কল করেছিলো কিন্তু কল পিক করেনি। তবে মিলা জানে মিতা ভালো আছে। ফারদিনের সাথে সে ভালো থাকবে। মিলা জানালা দিয়ে সব দেখছে, মাহাতাব তার বাবার কোলে। মিলা জিজ্ঞেস করলো,”টাঙ্গাইল কি আপনার গ্রামের বাড়ি?”
“হ্যাঁ।”
” আপনি যাচ্ছেন তা কি আপনার পরিবার জানে?”
” পরিবারের কেউ জানে না। আমরা দু ভাই বোন আর বাবা মা। এই হলো পরিবার।”
” আমি খুবই দুঃখিত মুহিন। আপনাকে এই দু দিনে আমার পরিবারের ঝামেলা গুলোর মধ্য দিয়ে যেতে হলো। প্লিজ আপনি মনে রাগ বা কষ্ট রাখবেন না।”
মুহিন খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেলো। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়া শুরু করেছে। বাতাস ভেসে আসছে বাসের জানালা দিয়ে। মুহিন দাঁড়িয়ে জানালা আটকে দিলো।
” আপনি আমার পরিবার সম্পর্কে প্রায় সবই জানেন। কিন্তু কখনো আপনার পরিবারের ব্যাপারে কিছু বলেন নি। বিয়েতেও আপনার বাবা- মা, বোন কেউ উপস্থিত ছিলেন না।”
“মিলা গল্প শুনবেন?”
মিলা গভীর দৃষ্টিতে মুহিনের দিকে তাকালো। বাস চলছে আশুলিয়ার কাছাকাছি চলে এসেছে প্রায়।
” আমার প্রথম স্ত্রী অর্থাৎ মাহতাবের মায়ের সাথে আমার বিয়েটা ছিলো প্রেমের বিয়ে৷ লাভ ম্যারেজ। আমার পরিবার খুবই সাধারণ মানসিকতার। তারা আধুনিক না হলেও আমার বিয়েটা তারা মেনে নিয়েছিলেন। আমাদের পরিবারে সবাই কম বেশি শিক্ষিত। আমার মা ম্যাট্রিক হোল্ডার, আব্বা আই.এ হোল্ডার তখনকার সময়ের। আমি তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির আইবিএ তে পড়ি আর মাহতাবের মা স্নেহা আমরা ক্লাসমেইট ছিলাম। ওর বাবা অবশ্য ইউনিভার্সিটির একজন ফ্যাকাল্টি ছিলেন। আর আমি ছিলাম চাষা কাম ব্যবসায়ীর ছেলে। তাও ঢাকাই ব্যবসায়ী না৷ ”
মাহতাব ঠান্ডায় ঘুমিয়ে পরেছে। এই ছেলের ঘুম বেশি যেকোনো যায়গায় সে ঘুমাতে ওস্তাদ। অন্য বাচ্চারা যেমন অতিরিক্ত কাঁদে নখরা করে সে সম্পূর্ণই ভিন্ন। মিলা একটা পাতলা কাথা মাহতাবের গায়ে জড়িয়ে দিলো। গল্প চলছে গল্পের মতোই।
” ওর আব্বা প্রথমে রাজি না হলেও পরবর্তীতে আমার মেধা দেখে আর আপত্তি করেন নি।”
” স্বাভাবিক। শিক্ষা থাকলে কেউই ফ্যালনা নয়।” মুহিন হাসলো মিলার কথায়।
” আসলে তখন স্নেহার মাথায় ভূত ঢুকেছিলো ক্লাসের হ্যান্ডসাম বয়টাকে নিজের করে পাবার যার জন্য মেয়েরা লম্বা লাইন দিয়েছে। ”
মিলা চোখ গোল গোল করে তাকালো মুহিনের কথা শুনে। দুজনেই ফিক করে হেসে ফেললো। যদিও মিলা ভেবেছিলো মুহিন মজা করছে। তবে মুহুর্তেই মুড সিরিয়াস হয়ে গেলো।
” আমি স্নেহাকে শুরুতে খুব একটা গুরুত্ব দিতাম না। ধীরে ধীরে এক সাথে বসা, নোটস নেয়া, ওর ক্লাসের সি আর হওয়া টুকরো ঘটনাকে জুড়ে ভালো লাগা তৈরি হলো। আমি এমবিএ শেষ করে চাকরিতে ঢুকলাম। আর স্নেহা দেশের বাহিরে যাবার জন্য এপ্লাই করল। স্নেহা ডাবল এমবিএ করতে দেশের বাহিরে চলে গেলো৷ এরপর আর যোগাযোগ নেই প্রায় তিন বছর। তিন বছর পর রিইউনিয়নে স্নেহার সাথে আবার দেখা৷ এরপর ধীরে ধীরে ভালোবাসা।
স্নেহার পিএইচডি করার ইচ্ছে ছিলো। এপ্লাই ও করেছিলো। কিন্তু সে তা আমাকে কখনোই জানায়নি। সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলো। বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ আসতে শুরু করলো। আমার খালাতো বোন জুথির সাথে আমার বিয়ের কথা প্রায় পাকাপাকি। জুথি আবার তিতুমীর থেকে এমএসসি করছিলো। আমি বাড়ি গেলাম ছুটিতে৷ মা জানালো জুথির কথা। জুথিকে আমি বোন হিসেবে দেখেছি এমনটা বলবোনা৷ কারণ ওকে আমি বন্ধু হিসেবে ভাবতাম সবসময়। আমি স্টুডেন্ট ভালো হওয়ায় সবাই আমাকে কিছুটা এড়িয়েই চলতো৷ জুথিই একমাত্র আমাকে সঙ্গ দিতো। যদিও আমার চেয়ে বয়সে সে বছর দুয়েক এর ছোট।”
বাসটা থামলো চন্দ্রায়। যাত্রী নামছে আরও কিছু উঠছেন। তবে ভীর কম৷
চলবে…!