‘ঝরা পাতা উড়ে যায়’
পর্ব-১২
দুপুরের খাবারে বহু অতিথি এলো। বিশাল বড় ছাদ জুড়ে প্যান্ডেল বেঁধে রাখাছিলো সেখানেই ভোজনের বন্দবস্ত হয়েছে। মিলার বাবা খুব গর্ব করে দুই জামাইয়ের সাথেই সবার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন ক্ষণে ক্ষণে। মিলা, মিতাও সেখানে উপস্থিত৷ ওরা একটুও ভুল ছিলো না৷ সত্যিই মিলা আর মিতার সাজ পোশাক নিয়ে আত্মীয়রা একচোট গসিপ করে নিয়েছে৷ কার বরের পয়সা বেশি আর কার কম তা গহনার পরিমাণ আর ওজনের তারতাম্য দেখেই বুঝে নিয়েছেন। তবে ওদের মাঝে এ নিয়ে কোনো এক্সাইটমেন্ট দেখা গেলো না৷ উলটো দুজন জড়াজড়ি করে বেশ কিছু ছবি তুলে নিলো। বিয়ের দিন এভাবে ছবি তোলা হয়নি। সবাই অবাক হয়ে শুধু দুবোনকে দেখেছে ।
খাবার পর্ব শেষ হতেই কানাঘুষো শুরু হলো। ছোটবোন বড় বোনের বরের দিকে নজর দিয়েছে। নজর খুব খারাপ জিনিস। তাই বিয়েটা হয় নি। আরেকদলের মতে বড় বোন অন্য জায়গায় সম্পর্কে ছিলো তাই নিজের জায়গায় ছোটবোনকে বসিয়েছে। গল্প খুবই রমরমা। শুরুতে মিতা খুব একটা কানে নেয়নি কথা গুলো। কিন্তু ধীরে ধীরে বিষয়টা চাউর হতে লাগলো। মাছের বাজারে ভিনভিন করা মাছির মতো গুঞ্জন উঠে গেলো। সবাই যেনো ওকে জোকার ভাবছে। শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে হাসছে। সবার সেই হাসি মিতা চেয়েও সহ্য করতে পারলো না৷ শরীর খারাপের বাহানা দিয়ে ঘরে চলে গেলো। মিলা মাহতাবকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় খুব একটা খেয়াল করতে পারলো না।
ঘটনা ঘটলো সন্ধ্যায়।
সব ধরনের ঝামেলা শেষ করে ফারদিন যখন ঘরে এলো, এসে দেখলো মিতা ঘুমাচ্ছে বেঘোরে। লম্বা চুল গুলো এলোমেলো হয়ে বালিশে ছড়িয়ে আছে। গায়ের আঁচলের বালাই নেই, শাড়ি হাঁটু অব্দি উঠে আছে। ফারদিন ভাবলো ক্লান্ত হয়ে যাওয়ায় এভাবে ঘুমাচ্ছে মিতা। সন্ধ্যে নেমে এসেছে তাই ডাকতেই হবে এখন। ফারদিন মিতাকে লজ্জা দিতেই তার কাছে গিয়ে ডাকলো।
“মিতা,মিতা…! ”
মিতার কোনো হেলদোল নেই। ফারদিন এবার হাত দিয়েই মিতার কাঁধে ধাক্কা দিলো। তার চোখ মুখ মুহুর্তেই রক্তশূণ্য হয়ে গিয়েছে। মিতা ঠিক ভাবে নিশ্বাস নিচ্ছে না৷ বিছানায় অচেতন দেহ পরে আছে। ফারদিন ভয়ে আরও জোর বেগে ডাকলো মিতার নাম৷
মিতার সারাশব্দ নেই। ফারদিনের চিৎকারে সবাই দরজার সামনে এসে জড় হয়ে ফারদিনকে দরজা খুলতে বলছে। ফারদিন অস্থির পায়ে দরজা খুলে দিয়ে বললো, ”মিতাকে হাসপাতালে নিতে হবে।” মুহিন সেখানেই ছিলো। কথা না বাড়িয়ে সে দ্রুত সিএনজি খুঁজতে নিচে চলে গেলো। ফারদিন মিতাকে কোলে তুলে সিঁড়ি বেয়ে নামলো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
পরিচিত হাসপাতালেই নিলো ফারদিন। এখানে তার বন্ধুরা রয়েছে, দ্রুত সাহায্য পাওয়া যাবে। ঠিক তাই হলো। ডাক্তার নার্সরা দ্রুতই ছুটে এলো পেশেন্ট এটেন্ড করতে। ফারদিনের ভেতরে এক অন্যরকম অস্থিরতা।
মিতার জ্ঞান ফিরলো ২ ঘন্টা পর৷ এ দু ঘন্টা তাকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হলো। প্যানিক এট্যাক হয়েছিলো মিতার৷ একা বদ্ধ ঘরে থাকায় আনকনশাস হয়ে গিয়েছিলো। ফিভারও আছে তাই ডাক্তার ব্লাড টেস্ট দিয়েছে। দ্রুত রিপোর্ট চলে আসবে। মিতার চোখ মুখ কেমন ফ্যাকাশে লাগছে দেখতে৷ ফারদিনের খুব মায়া হলো। মিতা বড় হয়েছে নাবালিকা না তবুও তার ভেতরের কৈশরের উচ্ছ্বাস এখনো বহাল তবিয়তে আছে। এই বনে বাদারে ছুটে বেড়ানো উচ্ছ্বল হরিণীকে বন্দী করে ফেলেছে ফারদিন। অপরাধ বোধ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো। সম্পর্কের দোহাই দিয়েই হোক আর প্রতিশোধ পরায়ণ হয়েই হোক যেভাবেই হোক মিতাকে সম্ভোগ করার যে অপরাধবোধ তা যেনো ভেতরের সবকিছু ভেঙে চূড়ে দিচ্ছে। ফারদিন বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়ালো না।
মিতাকে আপাতত ক্যাবিনে শিফট করা হয়েছে৷
মুহিন ফোন করে মিলাকে জানালো মিতার অবস্থার ব্যাপারে। মিলা এতক্ষণ মাহাতাবকে নিয়ে বসে ছিলো ড্রয়িং রুমে। ফোন রেখে তার মায়ের দিকে তাকালো সে। এক সুরে নাকি কান্না কেঁদেই যাচ্ছে সে। বাকি সবাই তাকে স্বান্তনা দিতে ব্যস্ত। বড় মামী এক গ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে এলো তার জন্য। মিলা রাগে হিতাহিতজ্ঞান ভুলে হাত থেকে থাবা দিয়েই গ্লাসটা ফেলে দিলো। কাচের গ্লাস খান খান হলো ভেঙে সাথে তার মায়ের সুর করে কান্নাও থামলো।
“কেউ মরে যায়নি যে এইভাবে কাঁদছো। তাছাড়া তুমি কাঁদছোই বা কার জন্য? ওকেতো তুমি আগেই মেরে ফেলেছো, মা।”
মিলার মা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন এই মেয়ে দুটোকে তার বিষাক্ত সাপ মনে হচ্ছে৷ কোন কুক্ষণে পেটে ধরেছিলেন।
মিলার ফুফু মিলাকে ধমকে চুপ থাকতে বললেন। মিলা দমলো না।
” আমাকে চুপ করিয়েতো লাভ নেই ফুফু সব তো তুমি নিজেই দেখলে। শুধু মাত্র মায়ের হটকারিতার জন্য আজ মিতার এই অবস্থা। পায়ে পর্যন্ত ধরেছিলাম যেনো মিতার বলি না দেয়া হয়। কেউ শোনোনি আমার কথা তোমরা। মা কি বলেছিলো তোমার মনে নেই?”
রাগে যেনো মিলার চোখ দিয়ে আগুন ঝড়বে৷ মিলার ফুফু সোফায় নিরব হয়ে বসে আছেন। আজ এই বারুদ আর বন্দুকের ভেতরে নেয়ার মতো অবস্থায় নেই। আজ সব ক্ষত বিক্ষত হবেই।
মিলার মা ফের আঁচল মুখে চাপলেন আরেক চোট কান্নার উদ্দেশ্যে। মিলা ধমকে উঠলো –
” খবরদার তুমি কাঁদবে না। তোমার অভিনয় বন্ধ করো। তুমি সেদিন আমায় কি বলেছিলে? আমি নাকি নিজের ছোটবোনের সুখ দেখতে চাই না, নিজের বিয়ে হচ্ছে না অত বড় ঘরে তাই আমি হিংসে করছি মিতা কে? এটাইতো বলছিলা আমাকে? বলেনি মামী আপনি তো উপস্থিত ছিলেন। ”
মিলার মামী শুকনো ঢোক গিললেন।
” আমি যদি তখন বিয়েটা না দিতাম তাহলে সমাজে তোর বাবার সম্মান টা কই থাকতো ভেবে দেখেছিস? তুই অপয়া হয়ে জন্মেছিস সেখানে আমি কেনো দোষী হবো? তোর ভাগের দুঃখ মিতা কেনো ভুগবে? কখনো ভেবে দেখেছিস তখন মিতাকে বিয়ে না দিলে সবাই কত থু থু ছি ছি করতো? এরপর মিতার জন্য কি ভালো কোনো ঘর থেকে পাত্র পেতাম?”
শ্বাস যেনো আটকে আসছে মিলার মায়ের। তবুও তিনি সকল দোষ নিজের কাঁধে নিতে নারাজ।
“তাহলে তোমার বোন, ভাবীরা কেনো সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে যে মিতা বিয়ের আসর থেকে আমার বর কেড়ে নিয়েছে? ও ফারদিনকে সিডিউস করেছে? ছিহ। এরা তো তোমার ফ্যামিলিরই লোক। কই আমার ফুফু, চাচীরা তো কেউ এই বিষয়ে কথা বলেন নি। ”
” মিলা খবরদার মিথ্যা কথা বলবি না। আমরা কেউ এইসব বলি নাই। মিতা ছোট মানুষ। ওর ব্যাপারে এইসব কেন বলবো আমরা?” মিলার খালার প্রতিবাদী কন্ঠ।
” আবার মিথ্যা বলছেন? আমাকে কি ভাবছেন? আমার বর,আমি দুজনে মিলেই শুনেছি আপনারা কি নোংরা কথা বলছিলেন৷ আপনাদের একবারো বাঁধলো না?”
” মিলা ব্যবহার খারাপ করিস না। আম্মু এইসব কিছুই বলেনি। তুই ভুল বুঝতেছিস ব্যাপারটা।” মিলার খালাতো বোন বলে উঠলো।
রাগে, দুঃখ মিলার ইচ্ছে করছে সবাইকে খু*ন করে ফেলতে।
মিলা গর্জে উঠলো,
” সব বের হ আমার বাসা থেকে। এই বাড়িতে আর এক মুহূর্ত থাকবি না কেউ। বের হ। মিতা আসার আগেই বের হবি। ” মিলার ফুফু মিলাকে টেনে ঘরে নিয়ে এলেন। এতোক্ষণের আটকে রাখা কান্না গুলো এবার আর্তনাদে পরিণত হলো। শান্ত হয়ে বসে থাকা মিলার সব বাধ ভাঙলো। বার বার নিজেকে দোষ দিতে থাকলো সে। ফুফু জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন মিলাকে। কিছুক্ষণ পর মুহিন ঘরে প্রবেশ করেই দেখলো মিলা গুঙিয়ে কাঁদছে, যেন মুখ থেকে চিৎকারের আওয়াজ না বের হয় তাই শক্ত করে ফুফুর কাঁধে মুখ গুজে আছে। কান্না না থামলে কষ্টে বুক ফেঁটে যাবে তার। সে যে মিলাকে চেনে তার সাথে সামনে বসে থাকা মেয়েটার যেন কোনো মিল নেই। মুহিন ঘরে আসতেই ফুফু মিলাকে ছেড়ে দিয়ে রুম থেকে বের হলেন। মুহিন কি করবে বুঝতে না পেরে মিলার মাথায় হাত রাখলো। মিলা চোখ তুলে তাকালো। মুহিন অবাক হয়ে দেখলো বড় বড় নেত্রের অধিকারিণীর চোখে এক সমুদ্র জল। মুহিন পাশে বসলো। মিলার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
” মিতা ঠিক আছে। ওকে আগামীকাল সকালে রিলিজ করে দিবে৷ ও বাসায় ফিরলেই আমরা চলে যাবো। আর আসবো না কেমন? ”
মিলা ঘোলা চোখেই দেখলো মুহিনকে। কিভাবে যেনো তার ভিতরটা সে পড়ে নিয়েছে। মিলা কৃতজ্ঞ বোধ করলো যে মুহিনকে কিছু বলতে হয়নি তার।
চলবে…!