“ঝরা পাতা উড়ে যায়”
পর্ব-১১
শাহাজাদী মাহাপারা
জুম্মার নামাজে গিয়েছে মিলার বাবা সাথে দুই মেয়ের জামাই, মিলার চাচা, ফুফা, মামা আর চাচাতো ভাই।
খাবারের আয়োজন প্রায় শেষের দিকে অতিথিরা আসতে শুরু করবে কিচ্ছুক্ষণ পর। ফুফু বলে গিয়েছেন নতুন বউদের মতো সেজে থাকতে৷ মিতা একটা সবুজ রঙের জামদানী পরলো। লম্বা চুল গুলো হাত খোপা করে ফুল গুজে দিলো তার ভাবীরা। মিতাকে তার শশুর বাড়ি থেকে এক সেট স্বর্ণের গহণা দিয়ে পাঠিয়েছিলো তার শাশুড়ি। গলার হার, ঝুমকা, দু গাছি চিকন চুড়ি গোল্ডের আর বালা। হাতে আগের দুটো আংটিই ছিলো। মিতাকে স্বর্ণের গহনায় এতো মানিয়েছে যে সবাই চেয়েও চোখ ফেরাতে পারছে না। মিতার একটুও ভালো লাগছে না। সে শুধু দুটো বালা আর ঝুমকা পরতে চেয়েছিলো। কিন্তু তার শাশুড়ি ফোন করে তার মাকে বলেছেন গহনা গুলো যেনো দেখে নেয় ঠিক ঠাক ভাবে আছে কিনা। তাকে একা বললেও চলতো কিন্তু তিনি তা করেননি। লাউডস্পিকারে দিতে বলে ঘর ভর্তি লোকের সামনে কি কি দিয়ে পাঠিয়েছেন তা জাহির করলেন।
মিলা মাহতাব কে খায়িয়ে নিজে সাজতে বসলো। তার রঙ মিতার মতো গোলাপি না। সে হলদেটে। উপটানের মতো রঙ তার৷ মিলার জন্মের পর তার দাদী নাকি তাকে উপটান দিয়ে গোসল করাতেন তাই নাকি তার গায়ের রঙ এমন। মিলার শশুর বাড়ির এখানে কেউ নেই। তাই তার ফুফু তাকে একটা গাড়ো গোলাপি রঙের জামদানী দিয়ে গিয়েছেন। মিলা হাসলো শাড়িটা দেখে। ফুফুর সবসময়ই ব্রাইট কালার পছন্দ। তিনি নিজেও সবসময় ব্রাইট কালার পরে থাকেন। ফুফাও তাকে এমন রঙে পছন্দ করেন।
শাড়ির নিচে গোলাপি ব্লাউজ পেটিকোট সবই আছে। এছাড়া আছে একটা গয়নার বাক্স। লাল বাক্স। মিলা বিরক্ত হলো এসবের কি দরকার ছিলো! তার এমনিতেই গহনা পরতে ভালো লাগে না।
মিলা বাক্সটা খুললো তাতে চিরকুট।
“রুদ্মিলা,
এই গহনা গুলো আমার তরফ থেকে আপনাকে বিয়ের উপহার। আমি কিপটে নই। আসলে হুট করে বিয়ে করায় আপনাকে কিছুই দিতে পারিনি। ফুফুর গহনা দিয়েই আপনাকে ঘরে তুলেছিলাম।কিন্তু সেগুলোতো আপনার নিজের নয়। ফেরত দিতে হবে অতি অবশ্যই। তাই এই অধমের সামর্থ্য অনুযায়ী এইগুলো যদি গ্রহণ করতেন তবে খুশি হতাম।
মুহিন।”
ব্যস। এইটুকুই লেখা চিরকুটে। মিলার মনে মিশ্র অনুভূতি। একটা পাতলা স্বর্ণের হার, ঝুমকা, বালা আর একটা বড় চেইন। মিলার মন ভালো হয়ে গেলো। গহনা দেখে না গহনার পেছনে মুহিনের এফার্ট দেখে। সবকিছু কি স্বাভাবিক হচ্ছে ধীরে ধীরে?
মিলা দরজা আটকে নিজের মন মতো সাজলো। লম্বা বেনি করে তাতে কিছু গোলাপ গুজলো। নিজের কাছেই নিজেকে অন্য রকম লাগছে। বিয়ের দিনের জবরজং সাজের মতো না,স্নিগ্ধ।
মিলা ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে মাথায় শাড়ির আঁচলের ঘোমটা দিয়ে বের হলো রুম থেকে, কোলে মাহতাব।
মিলার ফুফু মিলাকে দেখে সূরা পড়ে ফু দিলেন। তার সব ভাইদের সন্তানের মধ্যে মিলা তার খুব আদরের। মিলাকে দেখলেই তার মায়ের কথা মনে পরে। কি সুন্দর সেই হাসি, চোখ, রঙ, কথা বলার ভঙ্গি। তার মা এত শুদ্ধ করে কথা বলতে পারতেন না কিন্তু তার বচন ভঙ্গি ছিলো অতি অমায়িক৷
তিনি মিলাকে ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসতে বললেন৷
মিতা কিছুক্ষণ পরই বের হলো। অপসরীর মতো দেখতে তার এই ভাতিজি। মিলা যতটা শান্ত, নম্র আর ধৈর্যশীল, মিতা ততটাই চঞ্চল, প্রাণোবন্ত আর উচ্ছল। অথচ আজ যেন দুবোন নিজেদের মাঝে বদলাবদলি করে নিয়েছে।
মিতা ফুফুর সামনে গিয়ে বললো,
” ফুফু, তুমিও কি আমার উপর রেগে আছো এখনো?”
তিনি হাসলেন। যা হয়েছে তার জন্য মিতার উপর রাগ করা যায় না৷ এটা সত্য সে এখন আর নাবালক না। তবে যে পরিবেশে সে বড় হয়েছে এবং সবার ছোট হওয়াতে তাকে কখনো বড় সিদ্ধান্ত নিতে হয় নি। তাই তাকে যা বলা হয়েছে সে তাই করেছে। আজীবন তাদের সন্তানদের তারা মধ্যবিত্তের মিথ্যে সম্মান রক্ষার গল্প শুনিয়ে এসেছে।” প্রাণ যাবে কিন্তু মান নাহি” এই দীক্ষায় দীক্ষিত সন্তান আর কিই বা সিদ্ধান্ত নিতো?
তিনি মিতার কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
” তুই তো সবার ছোট,বড্ড আদুরে। তোর উপর কেউ রেগে থেকেছে কখনো?”
” আপা আমার সাথে কথা বলছে না ফুফু।”
” মিতা, তোর এখন বিয়ে হয়েছে। পারিপার্শ্বিক অনেক কিছুই তোকে এলম করে নিতে হবে মামনি।”
ফুফু মিতার দুহাত শক্ত করে ধরলেন,
” তোর বিয়ে যে পরিস্থিতি তে হয়েছে আর তোর বাবা মায়ের এমন প্রতারণা মিলাকে গুড়িয়ে দিয়েছে। তোর আপা কখনোই তোর উপর রাগ করতে পারে না৷ তাকে একটু সামলে ওঠার মতো সময় আর স্পেস দুটোই দিতে হবে। তাছাড়া মিলাকে দেখ সে মাহতাবকে নিয়ে কতটা ব্যস্ত। ওকে দেখলে কেউ বলবেই না এই সন্তান ওর গর্ভজাত না৷ কতটা মমত্ববোধ থাকলে মুহূর্তেই অন্য কারো সন্তানকে নিজের বলে পরিচয় দেয়া যায়!”
মিতা বুঝলো।
” ফুফু তোমরা কেনো আপাকে মুহিন স্যারের সাথে বিয়ে দিলে?”
” স্যার! দুলাভাই হয়৷” তিনি হাসলেন।
” উনি তো ফুফার অফিসে জব করতেন। ফুফা তাকে স্যার ডাকতেন তাই আমিও ডাকি।”
” আরে বোকা, উনিতো মজা করে ডাকতেন। মুহিনের সন্তানের জন্য মায়ের প্রয়োজন ছিলো আর মিলাকে ট্রমা থেকে বের করার জন্য তাকে এমন কারো হাতে সোপে দেয়া যে মিলাকে সর্বোচ্চ সম্মান করবে৷ তাই মিলার জন্য মুহিনের থেকে বেস্ট তোর বরও হতো না। ঠিক বলেছি?”
মিতা হাসলো। সত্যিই তো৷ মিতা পনেরো দিনে যতটা ফারদিনকে চিনেছে অবশ্যই আপা এই পরিবারে সার্ভাইব করতে পারতো না। তার শান্ত ভদ্র আপা এমন একটা খবিশ শাশুড়ি পেতো এটা মানা যায় না৷ যতই পরিস্থিতি অনুকূল থাকুক এক না একদিন তো খোলস থেকে বের হতেনই। পর্দার আড়ালে আর কতদিন। তার শাশুড়ির জন্য তার মতো ছেলের বউই পারফেক্ট। আজ বহুদিন পর মিতার হাসি পেলো। মন খোলা হাসি। সে হাসলো। ফুফুও হাসলেন। মিতার মনে হলো ফুফু ম্যাজিক জানেন। শী ক্যান মেক এভ্রি ইম্পসিবল পসিবল। মিলাও যোগ দিলো।
” দুজনে একা একা কি খি খি করছো আমাকে রেখেই৷”
মিতা আর অস্বস্তি বোধ করছে না। এইতো তার বাসা, তার ফুফু, তার সেই আপা। সাথে তার ভাগ্নে ছোট্ট মাহতাব। সব আগের মতো না থাকলেও সময়ের সাথে সবটাই সয়ে আসবে। মিতা মিলার কোল থেকে মাহতাবকে নিলো। মিলাও ডাইনিং এর চেয়ারে বসলো ফুফুর পাশে। মিতা জিজ্ঞেস করলো, ” নাম কি ওর?”
” মাহতাব।” ফুফু বললেন।
মিতা মাহতাবের গালে চুমু খেলো। মাহতাব মিতার কানের ঝুমকো নিয়ে খেলছে। মিলা বললো, “তোকে তো খুব সুন্দর লাগছে। এতো বড় কবে হলি ময়না?”
মিতার চোখে পানি টলটল করছে সে খুব কষ্টে ধরে রেখেছে৷ আপাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে৷ মিলা বুঝলো। সে উঠে এসে মিলাকে কাছে টানলো।
” আপা তুই ভালো আছিস?”
” আমি খুব ভালো আছি। দেখে বুঝতে পারছিস না? এবার বল এই শাড়িতে কেমন লাগছে?”
” সবাই একটু পর এলেই তামাশা দেখতে পারবি কিভাবে শাড়ি গহনা নিয়ে তুলনা শুরু করবে।”
দু বোন বাকি সবাইকে নিয়ে কথা বলা শুরু করতেই ফুফু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আশ্চর্য হবার কিছু নেই৷ কিছু অভ্যেস কখনোই যাবার নয়৷ ভালোবাসার মতো অভ্যেস তো কখনোই না৷ বোনেদের মাঝের গসিপ সেগমেন্ট দুনিয়া উল্টে গেলেও কখনো বদলাবে না। মেহমান এসে পড়েছে। ভাইরাও চলে আসবে একটু পর। তার এখন ওঠা দরকার সব বোঝা তো তার মাথায়ই। তার নিকাম্মি অলস ভাবীরা কি করছে তা একটু দেখা দরকার৷ বউয়ের চেয়ে এরা বেশি সেজে ফেললে আবার সমস্যা। অতঃপর তিনি সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।
চলবে…!