“ঝরা পাতা উড়ে যায়”
পর্ব-১০
শাহাজাদী মাহাপারা
মিতা বিশাল বড় গাড়ি থেকে নামলো বাড়ির গেটের সামনে। ড্রাইভার নেমে ব্যাগ গুলো গাড়ির ডিক্কি থেকে নামিয়ে সামনে নিয়ে রেখেছে। ফারদিন ড্রাইভারকে ব্যাগটা ভিতরে রেখে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে বললো কারণ মিতাদের গাড়ি পার্কিং এর জায়গা নেই।
মিতা একবার ফারদিনের দিকে তাকিয়ে ভেতরে চলে গেলো।
তার এখানে আসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিলো না। এখানে এলেই বড় আপার মুখোমুখি হতে হবে। চোখের দিকে তাকিয়ে কথাই বলতে পারবে না সে। কি লজ্জার পরিস্থিতি! বড় বোনের হবু বরের সাথে বিয়ে আর বড় বোন এখনো বিয়ে করেনি। এক সপ্তাহ পর তারা এসেছে অনুষ্ঠান করতে। মিতা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ফারদিন বুঝতে পেরেই বললো,” যা হবার তাতো হয়েই গিয়েছে এখন এসব ভেবে নিজেকে ছোট করার কোনো মানে হয় না।”
মিতা ঘাড় উঁচু করে ফারদিনকে দেখলো।
” নিজের দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন ভালো কথা। আমার অপরাধবোধ কম করার প্রয়োজন নেই।”
মিতা কলিং বেল বাজাতেই মিতার চাচী দরজা খুললেন। মিতাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে সবাইকে ডেকে বাড়ি মাথায় তুললেন। সবাই পড়িমরি করে ড্রয়িং রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
মিতা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো। মিলা আসে নি।
“আপা কি এখনো রাগ করে আছে আমার উপর!” নিজেকেই শুধালো সে।
তার খারাপ লাগছে। ফুপিও আসেনি৷ মিতার মা মিতার বর কে আপ্যায়ন করলেন। মিতার বাবা কিছুক্ষণ আগেই ড্রয়িং রুমে এসে বসেছিলেন। তার হাতে এক গ্লাস পানি ছিলো। দ্রুত গ্লাস টেবিলে রেখে মিতার কাছে গেলেন। ফারদিন সালাম করতে নিলেই তিনি তাকে জড়িয়ে ধরে খোশামদিদ জানালেন। ফারদিন ও জড়িয়ে ধরলো। সবাই মিলে মিতাকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসালেন। মামী দ্রুত শরবত মিষ্টি নিয়ে এলেন। মিষ্টি মুখ করিয়ে তিনি জামাইকে স্বর্ণের আংটি পরিয়ে দিয়ে বললেন,” সেদিন হৈ হট্টগোলের মধ্যে তোমার জন্য কিছু করতে পারিনি বাবা। তুমি কিছু মনে করো না। আজকে উপহারটা গ্রহণ করো।”
ফারদিন তাকেও সালাম করলো।
মিতার ফুফু দাঁড়িয়ে সকলকে দেখছিলেন। মিলার বরের ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি। মিলার বর কে এরা এতো সমাদর করেনি উলটো গেস্ট রুমে পাঠিয়েছে। তিনি বলার পর বড় ভাবী মিষ্টি শরবত নিয়ে গিয়েছেন। এদের তিনি এক হাত দেখে নিবেন।
তিনি হেসে সামনে গিয়ে বললেন, “পুরুষদের স্বর্ণ পরা নিষেধ। তাই তোমার জন্য আমি এটা দিলাম।”
তিনি একটা ব্র্যান্ডেড রোলেক্স ওয়াচ আর একটা রূপার উপর হিরে বসানো আংটি দিলেন।
ফারদিন তাকেও সালাম করতে চাইলে তিনি সরে গেলেন। ” মুখে সালাম দিলেই যথেষ্ট।” মিতার মামী খালা মিলে মুখ ভেঙালো।
ফুফু বললেন,” মিলা কে ডাকেন নাই কেন ভাইজান? ও কই ওরে ডাক দেন।” সবাই অস্বস্তি বোধ করলো।
মিলার মামী মিলার মা কে ডেকে বললেন মিলার বরের জন্য তারা কিছুই আনেন নি এখন কি হবে? মিলার মাও লজ্জায় পরলেন৷ কারণ তিনি নিজেই মুহিনের জন্য তেমন বিশেষ কিছু করেন নি। ননদ আরেক দফা ক্ষেপে বোম না হলেই হয়।
মিলার কাজিনরা গিয়ে দরজায় নক করলো। এতক্ষণ মিলা মুহিন কে নিয়ে শুয়ে ছিলো। বাড়িতে হৈচৈ এর খবর তারা পেয়েছে। মুহিন একবার যেতে বলেছিলো। মিলা যায় নি। প্রয়োজন পড়লে তারা নিজেরাই ডাকবে। সে নিজে থেকে আর কোনো কিছুতেই থাকবে না ঠিক করেছে। কারণ এইখানে একটা সার্কাস চলছে। তাকে ডাকা হয়েছে কারণ সমাজে সম্মান রক্ষা করতে হবে তাই।
মিলা দরজা খুলে দিলো। তার খালাতো বোন বললো তাদের ড্রয়িং রুমে ডাক পড়েছে। মিলা আসছি বলে দরজা বন্ধ করে দিলো। মুহিন এর প্রশ্নবোধক চাহনি দেখে সে বললো, “ডেকেছে। চলুন।” মিলা কোলে মাহতাব কে নিয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে গেলো। মুহিন তার পেছন পেছন গেলো।
ফারদিনের অস্বস্তি লাগছিলো। এর আগে দু বার রুদ্মিলাকে দেখেছে সে। প্রথম যেদিন দেখতে এসেছিলো সেদিন। আর দ্বিতীয় বিয়ের দিন। এরপর আজ তৃতীয় দেখা। তবে তা খুবই অস্বস্তি কর কারণ যেখানে সম্পর্ক কাপলের হবার কথা ছিলো সেখানে মিলা এখন তার জেঠশ। বউ এর বড় বোন।
মিতা অস্থির হয়ে বসে আছে। কতদিন পর আপাকে দেখবে৷ এর আগে শেষ আপাকে না দেখে এতোদিন কবে ছিলো তার মনে পরে না। আপা কি তার উপর রেগে আছে?
অতএব সকল অপেক্ষার অবসান ঘটলো মিলার রুমে প্রবেশের মাধ্যমে। মিলার ফুফু নিজে উঠে মিলাকে আর মিলার বর কে বসার জায়গা করে দিলেন। মিলাকে শাড়ি পরা দেখে একটু চমকালো মিতা। ফারদিন ও চমকালো। মিলার কোলে মাহতাব। মুহিন শশুর কে সালাম দিলো। মিলার বাবা এতোক্ষণ কিছুটা বিরক্ত ছিলেন। মুহিন মিলা এসেছে এ কথা তাকে জানানো হয় নি।তাছাড়া তাদেরকে যে আপ্যায়ন করা হয় নি সেটাও আরেকটা কারণ। মুহিন কে দেখেই তার সকল বিরক্তি উবে গেলো। কি সুন্দর মন ভোলানো চেহারা। কি মায়া! তিনি মুহিনকেও জড়িয়ে ধরলেন। কেমন আছো বাবা বলে তার হাল হকিকত জানতে চাইলেন।
মিতা অবাক হলো। আপার বিয়ে হয়ে গেছে? এই লোকটার সাথে?
ফুফার অফিসে জব করে লোকটা। বিয়ের দিন দেখেছিলো তো। আপার বিয়ে এই বিবাহিত লোকটার সাথে হয়েছে। মিতার সব কিছু কেমন দুলছে। সে চোখ নামিয়ে মাটির দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলো।
মিলা জিজ্ঞেস করলো, ” কেমন আছিস মিতা?” মিতা চোখ তুলে তাকালো। আপার চোখ হাসছে। কি চমৎকার সে হাসি।
মিতা তাকিয়েই রইলো।
ফুফু মুহিনকেও মিষ্টিমুখ করালেন। মুহিনের জন্যও তিনি একই রকম দেখতে ঘড়ি, আংটি কিনেছিলেন৷ তা পরালেন।মুহিন প্রথমে মাথা তুলে না করতে চাইলেই তিনি চোখ বড় বড় করে হুমকি দিলেন। মুহিন হাসলো। ফুফুর সাথে তার সম্পর্ক ভিন্ন। নিজের সন্তানের চেয়ে কোনো অংশেই কম ভালো বাসেন না তাকে।
মিলার বাবা মুহিনের সাথে ফারদিনের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
” আমার বড় জামাই মুহিন। ফারদিনকেতো চেনোই আমার ছোট জামাই।”
মুহিন ফারদিনের সাথে করমর্দন করলো।
মিতাকে তাদের রুমে নিয়ে যেতে বললেন মিতার মা। মিতা জিজ্ঞেস করলো, ” আপা তাহলে কোন রুমে থাকবে?”
মিতার মা একবার মিতার দিকে তাকালেন, ” তোর রুমে থাকবি। ওই রুমে এসি আছে। জামাইয়ের গরমে থাকতে কষ্ট লাগবে। তাই তোদের জন্য ওই রুম ঘুছাইতে কইছি।”
মিতা বললো,” তাহলে আপা কি গেস্ট রুমে থাকবে? ওই রুমের ফ্যানের স্পিডও তো কম, এসিও নাই।”
” ফ্যান ঠিক করাইছি। বড় জামাইয়ের গরমে থাইকা অভ্যাস আছে। উনি কিছু মনে করে নাই।”
” মা মিলা আপা কি তোমার আপন মেয়ে না?” মিতা খুবই শান্ত শব্দে কথাগুলো বললো।
চমকে তাকালেন মিতার মা।
মিতা আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নিজের রুমে গেলো। তার পেছন পেছন ফারদিনও গেলো।
মিতা বিছানায় বসতেই ফারদিন রুমের দরজা আটকে দিলো। ফারদিনই আগে জিজ্ঞেস করলো, ” মিলার বিয়ে হয়ে গিয়েছে? কই কিছু বলোনি তো। বিয়ে ভাঙার সাথেই সে বর পেয়ে গেলো?”
মিতা স্মিত হাসলো।
” আমার কাছে আমার ফোন ছিলো না ফারদিন সাহেব। পনেরো দিন আমি আপনার বাসায় আপনার মায়ের অকথ্য কথা শুনে আর রাতে আপনার মনোরঞ্জন করে কাটিয়েছি। সুতরাং এটা আমার জন্যও সারপ্রাইজিং বটে।”
ফারদিন অবাক হয় মিতাকে দেখে। মিলাকে দেখতে আসার দিন গুলোয় সে এক প্রাণোচ্ছলা, চঞ্চলাকে দেখেছিলো। এই নারীর সাথে যার কোনোই সাদৃশ নেই।
অস্থিরতা জাপটে ধরে তাকে। তার সাথেও তো প্রতারণা হচ্ছিলো।
” তোমার পরিবার খুবই স্বার্থপর মিতা। এর দায় তুমি একা আমাকে দিতে পারো না।”
” আপনাকে দায় দেই নি তো। সবাই স্বার্থপর। সে আপনার পরিবার হোক বা আমার।” মিতা সেখানে বসা আর সমীচীন মনে করলো না। উঠে রুমের বাহিরে চলে গেলো। ফারদিন বিছানায় বসে দুহাতে মুখ ঢাকলো। কেমন বিব্রতকর পরিস্থিতি এটা!
চলবে…!