ঝরা পাতা উড়ে যায়
পর্ব-০৯
শাহাজাদী মাহাপারা
দিনটা শুক্রবার। মুহিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা বানিয়েছে আজ। মিলা এখনো ঘুমাচ্ছে সাথে মাহতাব। গত রাতে মাহতাব খুব জ্বালিয়েছে। ঘুমাতে দেয় নি প্রথমে ২ টা পর্যন্ত সেও মিলার সাথেই জেগেছিল। এরপর কখন ঘুমিয়েছে খেয়াল নেই। ঘুম থেকে উঠে দেখে ৮ টা বাজে। মুহিন ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরের দিকে গেলো।
আজ মিলাদের বাসায় যাবার দিন। মিলার ফুফা কল করেছেন ফের একবার গত পরশু। তাদের দাওয়াত দিয়েছেন মিলার বাবা। মুহিন মাহতাব সমেত। মিলা অভিমান করে আছে তাই সরাসরি তাকে কল করেন নি। এমন কি মুহিনকেও তিনি শিকার করেছেন কিনা তা বোঝা যাচ্ছে না। তবুও ফুফার কথা রাখতে মুহিন যাবে। দুপুরের লাঞ্চে৷ সম্ভবত মিলার বোন কেও দাওয়াত দেয়া হয়েছে। আত্মীয় স্বজনরাও আসবেন। মিলার সম্ভবতঃ অস্বস্তি লাগবে সেখানে যেতে। নতুন জামাই আর আতিথিয়েতা রক্ষার ঝামেলা না থাকলে মুহিন কক্ষনো সে বাড়িতে যেতো না। কিন্তু আজ যেতে হবে মিলার এটা প্রথম দ্বিরাগমন। তাছাড়া সামনের সপ্তাহে সেও ছুটি নিবে অফিস থেকে৷ বাড়ি যাবে বাবা মায়ের কাছে। কতদিন হলো বাবা মা কে দেখে না৷ নিজের গ্রামের সাথে সম্পর্ক ভুলেছে আজ তিন বছর হতে চললো। মাহতাবের মায়ের গ্রামের বাড়ি পছন্দ ছিলো না। তার সেখানকার পিওর আবহাওয়া স্যুট করতো না। তাই শেষবার গ্রামে গিয়েছিলো বিয়ের পর। এরপর আর যাওয়া হয় নি। আম্মা আব্বা এসেছিলেন। কিন্তু বেশিদিন থাকেন নি। আগে এলে বেশ কিছুদিন থাকতেন৷ একদিন অফিস থেকে এসে দেখে ঘর খালি৷ তাকে না জানিয়েই চলে গিয়েছেন তারা৷ এরপর মা নিজেই ফোন করে বলেছেন বাড়িতে জরুরি কাজ ছিলো তাই চলে গিয়েছেন। কত বোকা ছিলো মুহিন, সেটা বিশ্বাস করে নিয়েছে। আচ্ছা মিলাও কি এরকমই হবে? নাহ। এ কদিনে সে মিলাকে যতটা দেখেছে মিলা খুবই মিশুক। সে খুব সহজে সবাইকে কাছে টেনে নেয়। এটা তার একটা বিশেষ গুণ যা সে নিজেও জানে না৷ মুহিন চায়ের কেতলি থেকে চা কাপে ঢেলে মিলাকে ডাকতে গেলো রুমে।
**********
মিলা যখন মুহিনের সাথে বাড়ির গেইটে ঢুকলো তখন বাজে বেলা ১২ টা প্রায়। ভেতরে ঢুকে দেখলো এলাহি কান্ড। বিয়ের দিনের মতোই সাজ সাজ রব। বাড়ির এক সাইডে উঠানের মতো সেখানে রান্নার কাজ হচ্ছে৷ আর ভেতর থেকে বাচ্চাদের হৈচৈ এর আওয়াজ আসছে। মিলাতো জানতো সব মেহমান বিয়ের দিনই চলে গিয়েছে। মিলা ভাবলো ভেতরে যাবে না ফিরে যাবে। একবার সাহস করে মুহিনের দিকে তাকালো৷ মুহিন সম্ভবতঃ মিলার অস্বস্তি বুঝতে পারলো। মিলাকে সাহস দিয়ে সে বললো ভিতরে যেতে কারো অসম্মান যেনো না হয়। অতঃপর মিলা মাহতাবকে কোলে নিয়ে বাড়ির ভেতরে গেলো। ৫ তলা বাড়ির ২ তলা বাদে বাকি সবই ভাড়া দেয়া। দু ইউনিটের বাড়িতে শুধু ২ তলাতেই একটা ইউনিট। মিলা কলিং বেল বাজালো। মিলার মা দরজা খুলেই মিলাকে দেখে জড়িয়ে ধরতে এলেন। মিলার কেনো যেনো মন সায় দিলো না তাকে জড়িয়ে ধরতে। তিনি ধরলেও মিলা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু। মুহিন ততক্ষণে ব্যাগ নিয়ে উপরে চলে এসেছে। শাশুড়ি কে দেখে লম্বা সালাম দিলো সে। তিনি সালামের উত্তর নিয়ে ওদের ভেতরে যেতে বললেন৷ মিলা ভেতরে গিয়ে রুমে ঢুকতে নিলেই মিলার মা বাঁধা দিলেন। মিলা পেছনে তাকালো।
” মিলা তোর জন্য ওইদিকের গেস্ট রুমটা ঠিক করেছি। এই রুমটায় মিতারা আসলে থাকবে।”
মিলা অবাক হলো না। হেসে জিজ্ঞেস করলো শুধু, ” কেনো মা? তোমার ছোট মেয়ের বিদেশি জামাই কষ্ট করে দুটো দিন এসি ছাড়া ঘুমাতে পারতো না? তুমি আমার রুমে আমাকেই যেতে নিষেধ করছো?”
মুহিন পরিস্থিতি বুঝলো।
” সমস্যা নেই মিলা আমরা ওই রুমেই যাই চলো। এমনিতেও মাহতাব এসির বাতাস সহ্য করতে পারে না। আমাদের সমস্যা হবে না।”
মিলা একবার মুহিনের দিকে তাকালো আরেকবার তার মায়ের দিকে। মুহিন ব্যাগ টা নিয়ে গেস্ট রুমের দিকে এগুলো মিলার পেছনে পেছনে।
“আপনাকে লজ্জায় ফেলে দিলাম মুহিন সাহেব। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।” মুহিন হাসলো৷
“আমি জীবনে অনেক কঠিন পরিস্থিতি পার করেছি মিলা এইসব খুবই সাধারণ সেখানে। আপনি মন খারাপ করবেন না প্লিজ। ”
মিলা রুমে ঢুকে ফ্যান ছাড়লো৷ ব্যাগটা কাভার্ডের সাইডে রেখে মাহতাব কে বিছানায় শুয়িয়ে দিলো। গরমে ঘেমে গিয়েছে বেচারা।আজ বৃষ্টি হবার সম্ভবনা রয়েছে তাই বাহিরে বাতাস দিচ্ছে৷ মুহিন রুমের জানালা খুলে দিতেই একটা মিষ্টি সুঘ্রাণে ঘর ভরে গেলো৷ ভেজা মাটির ঘ্রাণ। বাহিরের বাতাসে মুহূর্তেই রুম ঠান্ডা হয়ে এলো। মুহিন সামনে রাখা ডিভানটায় বসে আছে মিলার চাচী রুমের সামনে এসে নক করলেন। মিলাকে দেখলেন মাহতাবকে বুকের কাছে নিয়ে শুয়ে আছে আর মুহিন ডিভানে বসা। তিনি শরবত আর মিষ্টি এনেছিলেন। মুহিন সালাম দিয়ে শরবতের গ্লাসটা হাতে নিলো। কুশল বিনিময় করে তিনি রুম থেকে চলে গেলেন। মিলা হাসলো।
” হাসছেন কেনো?”
” বাচ্চা দেখে সবাই অবাক হয়েছে তাই।”
” কেনো? কেউ জানে না মাহতাবের কথা?”
” না৷” মিলার সহজ স্বীকারোক্তি।
মুহিনের মাথায় যেনো বাজ পড়লো।
“কি বলছেন মিলা?”
” বিয়ের দিন ফুফু শুধু আমার কানে কানে বলেছিলো। আর আব্বা জানতেন। আম্মাও সম্ভবতঃ পরে জেনেছেন। আর কেউ জানেন না।”
” মিলা আপনি কি বলছেন এইসব? আমিতো আগেই সব জানিয়েছিলাম।” অস্বস্তিতে মুহিনের মাথার রগ দপদপ করছে।
” আপনি এতো চিন্তা করছেন কেনো? বিয়ে আমি রাজি খুশিতেই করেছি৷ সংসার ও আমিই করবো এতে অন্য কেউ জেনে কি করবে?”
মুহিন অবাক হয়ে তাকালো মিলার দিকে। কত সহজে মিলা কথা গুলো বলছে। অথচ তার অস্থির লাগছে এটা ভেবে যে সবাই জানার পর কিভাবে নিবে বিষয়টা।
মিলার মায়ের রুমে সব মহিলারা জড় হয়েছে৷ মিলার দুই চাচী, ২ খালা আর মামী। কাজিন বড় বোনেরা আর মিলার ফুফু। মিলার মা আর ফুফুকে এই মুহূর্তে চার্জ করা হচ্ছে কেনো মিলাকে জেনেশুনে একটা বিবাহিত এক সন্তানের পিতা এমন পাত্রের কাছে বিয়ে দেয়া হয়েছে? বংশে এমন কোনো হিস্ট্রি নেই৷ মিলার জন্য তাদের সবার নাম খারাপ হবে কাওকে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবে না ইত্যাদি ইত্যাদি৷ এতক্ষণ মিলার ফুফু ধৈর্য ধরেই সব শুনছিলেন। মিলার মায়ের কান্নার নাটক দেখে এবার বিরক্ত হলেন তিনি। ধমকে উঠলেন।
” বাড়িতে নতুন জামাই আসছে। আপ্যায়ন না করে এইখানে গোল টেবিল মিটিং বসাইছো। মশকরা করো আমার সাথে তোমরা?”
সবাই এবার চুপ হলো। মিলার চাচীরা ভেবেছিলেন এই মকায় তারাও এক হাত দেখে নিবেন একমাত্র ননদ কে। একদম বড়লোক বাড়িতে বিয়ে বসে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। সব কয়টা ভাই কোনো কাজ করার আগে বউদের আগে বোনের পরামর্শ নেয়। মিলার গাঁধে বন্দুক রেখে একে একটা টাইট দেয়া যাবে এবার ভেবেছিলেন। কিন্তু জংগলের হিংস্র প্রাণী হায়না হলেও জঙ্গলের রাজা তো সিংহই থাকে৷ এক ধমকে সব ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গিয়েছে৷
মৃদু চিৎকার করলেন তিনি ভাতিজি,ভাতিজা বউদের উপর। মিলার মা ই মিলার মামাদের মধ্যে বড়। তাই হিসেবে সেই বাড়ির বড় কাজিনদের দিক থেকে বাকি ভাই বোনেরা ছোট হওয়ায় কেউ এই বৈঠকে নেই।
” খুব লায়েক হইছো একেক জন তাই না? মিলার চিন্তায় সবার কলিজা পুরতেছে। নকশা করো? আমার সামনে এইসব নাটক করবা না সব গুলারে হাড়ে মজ্জায় চিনি আমি। তোমাদের সবাইকে কৈফিয়ত দিতে হবে আমার যে ভাতিজিকে গাঙ্গে না ভাসায় বিবাহিত বাচ্চার বাপের সাথে কেন বিয়ে দিছি? মিতারে বিয়ে দিয়া তো সব পালাইছিলা আমার ভাতিজির খবর তখন কেউ নিছো? ”
মিলার চাচী একবার বলতে চাইলেন সব তো লুকিয়ে করেছে তাদের সাথেতো পরামর্শ করেনি। কিন্তু বললেন না। কাসুন্দি যত কম ঘাটা হবে গন্ধ কম ছড়াবে। তাছাড়া এই মেয়ে ডেঞ্জারাস তাদের শাশুড়ির কার্বন কপি। কখন না আবার তাকেই ওয়াশ করে দিবেন ঠিক নাই৷ শেষে ছেলের বউদের সামনে হবে বেইজ্জতি৷
” আমার ভাতিজিকে আমি যেখানে খুশি বিয়ে দিছি। মিলার সমস্যা নাই তার মানে তোমাদের কারোরই মাথা ঘামানির দরকার নাই। আর ছেলের সাথে এখনোতো কেউ দেখাই করো নাই। দেখলে বুঝতা মিতার জামাই সোনা হইলে,মিলার জামাই হীরা। এই বংশের কোনো পুরুষের কেন কোনো জামাইয়ের সাথেই মুহিনের তুলনা হয় না। আমার নিজের বরেরও না।” উত্তেজিত হয়ে বলেই যাচ্ছেন মিলার ফুফু। মিলার মা শেষে আপা বলে ডাকায়। তিনি ফিরে তাকালেন। রাগে তার শিরা উপশিরা জ্বলে যাচ্ছিলো এতোক্ষণ।
” তুমি এতো নাকি কান্না করতেছো কেন ভাবি? যাও আপ্যায়নের ব্যবস্থা করো। তাছাড়া তুমিওতো আমার মুহিনকে দেখতে পারো না। এইসব নাটক বাদ দিয়া যাও এখন।”
মিলার মা ননদের বাক্যবাণে থতমত খেলেন। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে এই বৈঠকের সমাপ্তি টানতে রুম থেকে বের হলেন। তার ছোট কন্যা এলো বলে।
মিলার ফুফু রুম থেকে বের হবার আগে আরেকদফা সবাইকে চোখ রাঙিয়ে চলে গেলেন।
চলবে…!