“ঝরা পাতা উড়ে যায়”
পর্ব-০৮
শাহাজাদী মাহাপারা
স্টেজে গিয়ে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ উপেক্ষা করে ফারদিনের সামনে গিয়ে ডাকলো,
“শুনছেন।”
মিতার ডাক শুনে সবাই কম বেশি অবাক হলেও ফারদিন বিরক্ত হলো। প্রকাশ না করেই জিজ্ঞেস করলো, ” কোনো সমস্যা?”
মাথা উপর নিচে নেড়ে সে বললো, ” আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? আমাকে ভিতরে আসতে বলার পর থেকেই আপনি গায়েব।”
ফারদিন একটা মুখ ভেঙালো। এতক্ষণ সে খেয়াল করেছে মিতা কি করছিলো৷ এসেই গিলতে বসেছে। একবারো ওকে খোঁজেনি। এখন ইচ্ছে করে সবার সামনে অপদস্ত করতেই তার এইখানে আসা।
ফারদিন বললো, ” এখানেই ছিলাম। তুমি অস্বস্তি বোধ করবে তাই ডাকি নি। এসো পরিচয় করিয়ে দেই। ”
মিতা সবার দিকে হেসে তাকালো। সবাই অবাক হয়ে ওদের কনভার্সেশন শুনছিলো এতক্ষণ।
“আমার বউ রুস্মিতা।”
ফারদিনের সম্বোধনটা অন্য রকম লাগলো মিতার কাছে। ভালো লাগা খারাপ লাগা দুটোর সংমিশ্রণ। এই জায়গাটা অন্য কারো ছিলো। এই জায়গাটার একান্ত মালকিন আমি। ঠিক এইরকমই অনুভূতি। সবাই কেমন বোকা বোকা হাসলো। বাংলাদেশে এমন অসম বয়সের বিয়ে অহরহ দেখা যায়। কিন্তু ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে এমন কিছু একটু অস্বস্তিকর। যেখানে ওরা বন্ধুরা মিলে এতক্ষণ অন্যকিছুরই ইঙ্গিত দিচ্ছিলো। মেয়েটা দেখলে নিশ্চই কষ্ট পেতো।বা মন খারাপ হতো৷ ফারদিনের হতে যাওয়া বিয়ে ভেঙেছে তা সবাই শুনেছিলো কম বেশি। একেক জন একেক জায়গায় থাকায় একসাথে হতে সময় লেগেছে তাই ফারদিনের বিয়ে এটেন্ড করতে পারেনি। তাছাড়া ওর বিয়েটাও ফ্যামিলি রিলেটিভ ছিলো আর কেউ দাওয়াত পায়নি। রিসেপশন দেরিতে হবার কথা ছিলো। অথচ ভেঙে যাওয়া বিয়েতেই যে ফারদিন বিয়ে করে এসেছে তা কেউ জানতো না। মিতা সবার চোখ মুখের এক্সপ্রেশন দেখলো। কিন্তু কি করবে বুঝতে পারলো না৷ মেরুন রঙের শাড়ি পরা মেয়েটার মুখে যেনো কেউ নুন ঢেলে দিয়েছে। বুঝতে পেরেছে মিতা। এটা ফারদিনের কিছুমিছু হলেও হতে পারতো টাইপ বান্ধবী৷ যার পাত্তা অলরেডি কেটে গিয়েছে। অন্যরকম আনন্দ হচ্ছে মিতার পেটের ভিতর। সে মেকি হাসি দিতে চাইলেও এখন তার সত্যিই সুখী সুখী হাসি দিতে মন চাইছে। এবং সে তাই করলো৷ সবাই একটু কনফিউজিড এখন মিতাকে কি ভাবী বলে সম্বোধন করবে? মিতা কম হলেও তাদের বয়সে নয় থেকে দশ বছরের ছোট।
সবার সাথে পরিচয় পর্ব শেষে মিতা আবার গিয়ে বসে নিজের জায়গায় । সব বন্ধুরা মিলে ফারদিনকে অল্প বয়সী মেয়ে বিয়ে করার জন্য টিপ্পনী কাটলো। শুধু তিশা বাদে। তিশা নিচে নেমে মিতার দিকে এগিয়ে যায়।
“কেমন আছো রুস্মিতা?”
কফির ছোট কাপটা হাত থেকে রেখে উপরে তাকায় মিতা।
” ভালো। আপনাকে চিনতে পারলাম না দুঃখিত।
” আমি তিশা, তোমার বরের বান্ধবী।”
বান্ধবী শব্দটা এমন ভাবে বলছে ইংরেজিতে ন্যারেট করলে ওটা গার্লফ্রেন্ড হয়ে যাবে। মিতা মনে মনেই বললো, বান্ধবী হতে যাবেন কেন! বলেন না প্রাক্তন প্রেমিকা ছিলেন। যত্তসব।
” ও আপু বসেন প্লিজ।” হেসেই উত্তর দিলো মিতা।
সামনের চেয়ার টেনে বসতে বসতেই তিশা মিতার দিকে ভালো করে একনজর দেখে নিলো।
” শুনেছি তোমার বড় বোনের জায়গায় নাকি তুমি জোর করে বিয়ে বসেছো। বোনের বর কে এতোই ভালো লেগেছিলো?তোমার বয়সতো খুবই কম। অনুভূতি কেমন?” বলেই সামনে রাখা একটা চিজ বল মুখে নিলো তিশা।
মিতা আর খেতে পারলো না। তখন না ওনার বন্ধুরা বললো তিশা ডাক্তার বিদেশ থেকে হায়ার স্টাডি করে এসেছে। অথচ তার বাক্যের ব্যবহারের যাচ্ছে তাই অবস্থা। খাবারটা গলায় আটকে আছে। মিতার চোখ দুটো জ্বলে যাচ্ছে। তবে দমে যাবার পাত্রী সে না। আর যাই হোক মিথ্যের প্রতিবাদ সে অতি অবশ্যই করে।
” এই বয়সে সিঙ্গেল থাকার চেয়ে আমার মতো বয়সে বিয়ে করে ফেলাই ভালো না আপু? আপনিও আপনার চেয়ে একটু বয়স্ক কাওকে দেখে বিয়ে করে ফেলুন। কনে সাজার এক্সপেরিয়েন্স আপনারও হবে। তখন আর জনে জনে অনুভূতি জানতে চাইতে হবে না আপু।”
তিশা মাথা নিচু করে হাসলো। মিতা সেখান থেকে উঠে চলে গেলো।
” মিতাকে দেখেছো? তোমার সাথেই এই টেবিলে বসে থাকতে দেখেছিলাম।”
” ওয়াশরুমে গিয়েছে হয়তো।”
” আচ্ছা।”
” ফারদিন শোনো।”
ফারদিন পিছনে ফিরে তাকালো।
” তুমি ভালো আছো?”
তিশা ভেবেছিলো ফারদিন মুখ কালো করে থাকবে হয়তো উত্তর দিবে ‘তুমি যেমন রেখে গিয়েছিলে’ টাইপ কিছু।
কিন্তু তিশাকে অবাক করে দিয়ে ফারদিন তার বত্রিশপাটি দাঁত বের করে ম্যাজিক টুথ পাওডারের এডের মতপ দন্ত বিকশিত হাসি দিয়ে গেলো। যার অর্থ এই দাঁড়ায় যে তুই ভাবছিস তুই গেলে আমি দেবদাস হবো? যা ভাগ।
তিশার বদৌলতে ফারদিনের বউ বেশ পরিপক্ক আর ঠোঁট কাঁটা। বন্ধু মহলে সে কথা চাউর হতে সময় লাগলো না। পার্টি সেন্টার থেকে ফেরার পথে ফারদিন তিশাকে তার বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে এলো এক প্রকার অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো। নিজের ঘরে ঢুকে মিতার একটা বিচ্ছিরি অনুভূতি হচ্ছে। দ্রুত এই সঙ পালটে ফেলতে হবে। লাগেজ থেকে একজোড়া সালওয়ার স্যুট নিয়ে মিতা ঢুকলো ওয়াশরুমে।
মিতা যখন নিজের রুমে যাচ্ছিলো ফারদিনের বাবা তখন ফারদিনকে নিজের রুমে ডাকেন।
“মিতার ফুফা কল করেছিলেন।”
” ও। হঠাৎ?না মানে এই পাঁচদিনে তো একবারো কল করে খোঁজ নেন নি। বিয়ে দিয়েতো একটা বোঝা নামিয়েই দিয়েছেন আর খোঁজ না নিলেও চলে তাই না?”
” তুই তো এত কথা বলিস না। হঠাৎ এতো কথা বলছিস কেনো?”
” বাবা বাদ দাও। কি জন্য কল করেছিলো তা বলো।”
” মিতার বাবা তোদের তার বাসায় ডেকেছেন দাওয়াতে।”
” ও বাড়িতে গেলে আবার ওর বোনের মুখোমুখি হতে হবে। এটা কি শোভনীয়?”
” এইটা একটা একসিডেন্ট যা হয়ে গিয়েছে। পাস্ট টেনে লাভ নেই। তাছাড়া আজীবন তো আর তোমরা এমন মুখ না দেখে থাকতে পারবে না। মুখোমুখি একদিন হতেই হবে।”
ফোস করে নিশ্বাস ছাড়লো ফারদিন।
” ঠিকাছে। কবে যেতে হবে?”
” পরশু।”
” মা জানে? ”
” রুম দেখে বুঝতে পারছো নিশ্চই।”
ফারদিন হাসলো৷ তিনিও হাসলেন।
যেদিন ফারদিনের বাবা মায়ের মাঝে কথা কাটাকাটি হয় সেদিন মা তারিনের রুমে ঘুমান। ফারদিন নিজের রুমে এসে দেখলো বিছানার উপর মিতার শাড়িটা পরে আছে। সে কোর্ট খুলে শাড়ির পাশেই রাখলো। মিতা ওয়াশরুমে৷ এতো রাতেও শাওয়ার নিচ্ছে। ফারদিন শাড়িটায় হাত বুলালো। কি অদ্ভুত! মিতাকে গাড় রঙে সত্যিই অপ্সরীর মতো লাগে৷ বিয়ের দিন সে দেখেছিলো যখন সবার সাথে মিতা হাসছিলো তখন। একই বিয়ের শাড়িতে মিলা মিতা দুজনকেই দেখেছে ফারদিন৷ একই সাজে৷ অথচ শাড়িটা মিলার থেকে মিতার গায়ে বেশি মানিয়ে গিয়েছিলো। যেনো শাড়িটা তার জন্যই তৈরি ভুল করে অন্যের অঙ্গে চড়েছিলো। মামীর কিচকিচ আর রাগের জন্যই মিলাকে দেয়া সব শাড়ি গহনা খুলে মিলাকে পরানো হয়েছিলো। অথচ তিনি জেদ না করলে মিতাকে সত্যিই ওভাবে দেখা হতো না৷ মিতার নিশ্চই খুব কষ্ট হয়েছিলো বোনের কথা ভেবে।
আচ্ছা সে এসব কি চিন্তা করছে? মিতা কষ্ট পেলেই বা তাতে তার কি এসে যায়? সে তো এর জন্য দায়ী না। উল্টো তাকেই ঠকানো হচ্ছিলো।
ফারদিন নিজের কাপড় নিয়ে বাহিরের ওয়াশরুমে গেলো ফ্রেশ হতে।
চলবে…!