“ঝরা পাতা উড়ে যায়”
পর্ব-০৭
শাহাজাদী মাহাপারা
সকাল সকাল মিতার ঘুম ভাঙলো পর্দা ভেদ করে আসা সূর্যের আলোয়। মাথাটা ভার হয়ে আছে। এই সময়ে সে সকালের চা পান করতো। বিগত কয়েকদিন যাবৎ সেই নিয়মের বাহিরে সে। অস্থির জীবন পার করছে। আদৌ জীবনে আছে না ছিটকে গিয়েছে বলা যাচ্ছে না। তার তো আর এক মাস পর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিলো। এই সময়ে সে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসে। আজ এই মুহূর্তে সে আরেকজন পুরুষের বিছানায় শুয়ে আছে। অস্বস্তিতে আবার গাঁ গুলিয়ে উঠতে চাইলো। রুস্মিতা আজহার। দাদী খুব শখ করে তাদের দুবোন এক ভাইয়ের নাম রেখেছেন। রওনক, রুদমিলা, রুস্মিতা। সেই দাদীই ওদের তিন ভাইবোনের জীবনের তেরটা বাজিয়ে এখন ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাং তুলে পান চিবোয়৷ এই জন্যই রুদমিলা দাদীকে অপছন্দ করে। এতদিনে বুঝলো সে। হায়! আর কিছুদিন আগে যদি বুঝতো তাহলে কি তার জীবনটা আগের মতো হতো? হতো না। বাবা চরম মা ভক্ত মানুষ। অসম্ভব।
মিতা বহু কষ্টে নিজেকে হিঁচড়ে দাড় করালো। সে এই সুন্দর সাদা রঙের দেয়ালের ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখলো। জলপাই রঙের পর্দা। কন্ট্রাস্ট করা বিছানার চাদর, ডিভান, আলমারি, ড্রেসিং। মিতার মনে হলো সে একটা খাঁচায় বন্দী। বাঘের সাথে তার রোজ এক পাতে খেতে হবে। আচ্ছা এই যে সবাই সংসার সংসার করে এই ঘরটা কি কখনো তার সেই সত্যিকারের সংসার হবে?
মিতার হঠাৎ সাদিকের কথা মনে পড়লো। চোখ দুটো ঝাপসা লাগছে মুহুর্তেই। আচ্ছা সাদিক এখন তাকে ছাড়া কি করবে? সে কেমন আছে? তারপর হঠাৎই সম্বিত ফিরল। এইখানেও ট্র্যাজেডি। শালার জীবন তার থেকে শুধু নিয়েই গেলো কিছুই দিলো না। এই যে এতো রূপসী রুস্মিতা। কেউ তার দিকে কখনো নজর ভরে তাকিয়ে দেখেছে? সাদিক ভাইয়ের মতো মানুষ। সেও নাকি শেষ পর্যন্ত আপাকেই পছন্দ করে। আপাতো আজীবনই প্রেম ভালোবাসা অগ্রাহ্য করে এসেছে। অথচ সে বিগত চার বছর ধরে সাদিককে পছন্দ করে। কই সাদিকতো একবারও তার ইঙ্গিতে সারা দেয় নি। অথচ সে ভাবতো সাদিক ভাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার কথায় হেসে লুটিয়ে পড়ছে। তাকে স্নেহ করছে। ভালোবাসছে৷
মিতার বুক ফেঁটে কান্না আসছে। জীবনটা কেমন মুহুর্তেই একটা অদ্ভুত বাঁক নিলো৷ তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। চিৎকার করে কাঁদতে না পারলে যেন মারা যাবে সে। দৌড়ে বিছানার বালিশে মুখ চেপে হাউমাউ করে উঠলো। মিতার মনে হচ্ছে এক্ষুণি দমবন্ধ হয়ে যাবে। কান্নার দমকে পুরো দেহ তার কেঁপে কেঁপে উঠছে। সে এখানে আর থাকতে চায় না। এক মিনিটও না, এক মুহুর্তও না।
মুখ থেকে তার চি করে একটা মুদু গোঙানি ভেসে এলো।
খট করে দরজা খুললো। রুস্মিতাকে এমন অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় দেখে ঘাবড়ে গেলো ফারদিন। চট করে দরজা লক করে মিতাকে জাপটে ধরলো৷
“মিতা তুমি ঠিক আছো? সরাও বালিশ। সরাও।”
মিতা বালিশ সরালো না মুখ থেকে উল্টে কান্না থামিয়ে দিয়েছে। একদম পাথরের মতো। এই প্রথম ফারদিন তার নাম নিয়েছে। কথা বলেছে। কিন্তু মিতার তাকে বিন্দুমাত্র সহ্য হচ্ছে না৷ থর থর করে কাঁপতে থাকা ছোট্ট কায়ায় ফারদিন অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে৷ ফারদিন কি তাকে ভালোবাসে? চারদিনে ভালোবাসা হয়? তার ইচ্ছে করছে না ফারদিনের সংস্পর্শে থাকতে। কিন্তু তার দেহ তার সাথে হঠাৎই প্রতারণা করছে। এইসব কি হচ্ছে মস্তিষ্ক আর দেহের যুদ্ধে তার নিজেকে বিষাক্ত মনে হচ্ছে। ফারদিন মিতাকে শান্ত করতেই চুমু খাচ্ছে অথচ মিতার মনে হচ্ছে সে আবার বাঘের শিকারে পরিণত হতে যাচ্ছে।কিন্তু তার দেহ আরেকটু এই উষ্ণ আলিঙ্গনে থাকতে চাইছে। মিতার হঠাৎ মনে হলো বিগত চার দিনে তার বাসার কেউই তার খোঁজ নেয় নি কোনো। ফারদিনদের তরফ থেকেও বৌভাতের অনুষ্ঠান করা হয় নি৷ এক মাস পর হবে। মিলা আপু। মিলা আপুও কি একবারও তার খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেনি? অবশ্য করবেই বা কি করে। তার জীবনের ঝড়টাওতো কম বড় না। মিতা চোখ তুলে চাইলো ফারদিনের দিকে। ফারদিনের সিম্প্যাথি হোক আর যাই হোক এই মুহূর্তে মিতার ফারদিনকে নিজের কাছের মানুষ মনে হলো। যে তার কান্না শুনলে বিরক্ত বোধ করবে না । বিয়ের রাতেও তো কত কেঁদেছিলো কই ফারদিন তো রাগ করেনি৷ মিতা বালিশ সরিয়ে ফারদিনের উপর ঝাপিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো এবারে।
ফারদিন তার বিশাল বাহুর মধ্যে বন্দী করলো মিতা কে৷ মিতার মনে হলো সে ইচ্ছে করে বাঘের থাবার শিকার হচ্ছে। ফারদিনের মনে হলো ছোট্ট একটা বিড়াল ছানা তার বুকে চলে এসেছে প্রোটেকশনের উদ্দেশ্যে। একটাইতো সেই জড়িয়ে ধরা অথচ ভিন্ন ভিন্ন অর্থে।
****
বাফেট খাবার বিষয়টা মিতার একদমই পছন্দ ছিলো না৷ তবুও সে প্লেটে একটু একটু করে খাবার নিয়ে কোণার দিকের একটা টেবিলে বসে খাচ্ছে। শাড়ি পরা তার কাছে মহাবিরক্তি লাগে। তবুও আজ সে একটা মেরুন কাতান শাড়ি পরে এসেছে ফারদিনের ছোট বেলার বন্ধু বান্ধবীর রিসেপশনের দাওয়াতে। ফারদিনের সব বন্ধু বান্ধবীরাই ডাক্তার। শুধু সে বাদে। এর মধ্যে দু জোড়া কাপল ও আছে। ফারদিন দূরে গ্রে টাক্সিডো পরে দাঁড়িয়ে আছে। কি যে সুন্দর লাগছে ওকে দেখতে অথচ এত সুন্দর বেশভূষা আসলে একটা কুৎসিত চেহারা ঢেকে রাখার মাধ্যম যা শুধু রাতের আঁধারেই প্রকাশ পায়।
মিতা কাওকে চেনে না৷ ফারদিন নিজেও আগ্রহ করে ওর সাথে কারও পরিচয় করায় নি। মিতাকে ভিতরে আসতে বলে ফারদিন গাড়ি পার্ক করতে গিয়েছিল এরপর ভিতরে এসে একবারও মিতার খোঁজ নেয় নি। মিতাও বিশেষ একটা গাঁ করলো না। সে নিজের মতো বসে বাকি সবার সাজ দেখায় ব্যস্ত হলো।
আশেপাশের সবাই কি সুন্দর ঝাঁ চকচকে। এই শাড়িটা আপার মানে মিলার। বিয়েতে মিলার জন্য যত লাগেজ দেয়া হয়েছিলো একটা বাদে বাকি সবই তার বাসা থেকে দিয়ে দেয়া হয়েছে।গহনা গুলোও সে নিয়ে এসেছে। এইগুলোতে মিলার আর কোনো অধিকার নেই। এই সব শপিংই মিতার পছন্দের ছিলো। মিলার চয়েজ ভালো না ভেবে মিতার মা মিতাকে মিলার সাথে পাঠিয়েছিলেন সব কিনতে। ভাগ্যের ফেরে ঘুরেফিরে তা মিতার গাঁয়েই চড়লো। মিতার এইসব ভাবতে ভালো লাগে না। কিন্তু একলা থাকলে এইসবই মাথায় ঘুরে৷ তার ছোট মস্তিষ্কটা আরও সংকীর্ণ হয়ে যায়। মন খারাপ হয়। তাই মিতা খাবার নিয়ে বসেছে। ধীরে ধীরে খাচ্ছে। বর বউ কে দেখা যাচ্ছে স্টেজে। পাশে বাকি সব বন্ধুরা। সবাই মিলে ছবি তুলবে তাই দাঁড়িয়ে আছে। কারো অপেক্ষা করছে সম্ভবতঃ৷ ক্ষনিক বাদেই সবাই হই হই করে উঠলো৷ স্টেজে একটা লম্বা চুলের মেয়ে উঠে যাচ্ছে। খুবই সিম্পল সেজেছে। অথচ কি অন্যরকম সুন্দর লাগছে। অবাক কান্ড সেও মেরুন রঙের শাড়ি পরেছে।
সবার সাথে হাত মিলিয়ে ফারদিনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো তিশা। ফারদিন মুচকি হাসলো। সবাই আরেকদফা হই হই করে উঠলো। মিতার ভালো লাগছে না৷ এটা অদ্ভুত একটা অনুভূতি। সে বেজায় বিরক্তবোধ করছে। আচ্ছা তার কি উপরে যাওয়াটা ঠিক হবে? তার কি ফারদিনের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো উচিৎ? সবাইতো কাপলরা ছবি তুলছে। তারাও তো কাপল।যেভাবেই হোক বিয়ে হয়েছেতো। হাবিজাবি ভাবতে ভাবতেই মিতার চোখ পড়লো স্টেজে সব কাপলরা বসে ছবি তুলছে বর বউয়ের সাথে। ফারদিনের সাথে মেয়েটা দাঁড়ানো। আর বেশিক্ষণ বসে থাকা গেলো না। মিতা উঠলো স্টেজে যাবার উদ্দেশ্যে ।
চলবে…