“ঝরা পাতা উড়ে যায়”
শাহাজাদী মাহাপারা
পর্ব-০৪
অগ্রহায়ণের শেষ প্রায়৷ চারপাশে মৃদু অন্ধকার। গতকাল সারাদিনের ভ্যাপসা গরমকে ছাপিয়ে বর্ষণের তাড়াহুড়ো পুরো প্রকৃতিজুড়ে। মেঘেরা নিজেদের মাঝেই একটু পরপর গুড়ুম গুড়ুম করে কথা বলে উঠছে। মুহিনের শীত শীত অনুভূত হচ্ছে। ক’টা বাজে? ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলো পাঁচটা। রাতে তার ঘুমটা ঠিক হয়েও হয়নি। ছাড়া ছাড়া ঘুমের কারণ মিলা আর মাহতাব। মিলা একটু পরপরই বিছানা ছেড়ে উঠে বসেছে৷ মাহতাব কে দেখেছে। অথচ এই নারীর সাথে মাহতাবের সৎ নামক সম্পর্ক। মাহতাব ঘুমানোর পরই হয়তো সেও ঘুমিয়েছে। মুহিন উঠেনি ইচ্ছে করেই, আর তার শরীরটাও সায় দিচ্ছিলো না। নয়তো রোজ রাতে সে মাহতাবের জন্য জেগে থাকে। ভোরে ঘুমায় ৯ টায় অফিস যায়। বাসায় আসে রাতের ৮টায়। ততক্ষণ মাহতাব থাকে পাশের ফ্ল্যাটে৷
মুহিন আলমারি থেকে দুটো কাথা হাতে নিয়ে বিছানার সামনে দাঁড়ালো। একটা ফিচলে হাসি দিয়ে ফের একটা কাথা আলমারিতে রেখে বিছানায় উঠে বসলো। মিলা শীতে কাচুমুচু হয়ে ওড়না জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে এক হাত মাহতাবের উপর। মুহিন ফ্যান কমিয়ে জানালা লাগিয়ে কাথা ওদের গায়ে দিতেই মিলা লুফে নিলো। মুহিন মাহতাবকে ঢেকে কিছু অংশ নিজে নিয়ে বিছানায় শুতেই খেয়াল করলো মিলা মাহতাবকে নিয়েই তার দিকে চেপে আসছে। মেয়েটার ঠান্ডা পা দুটো তার পা স্পর্শ করছে। মুহিন ঘাবড়ে গেলো। ধীরে নিজের পা দুটো সংযত করে মিলার দিকে ফিরেই ঘুমালো। উপরে ক্যামেরা সেট করা থাকলে অবশ্যই এটাকে একটা সুখী পরিবার বলা যেতো। সে হিসেবে মাহতাব খুবই ভালো বাচ্চা সে মোটেও কোনো প্রকার নড়াচড়া করেনি। ফ্যান কমিয়ে দেয়ায় এখন আর তেমন ঠান্ডা অনুভত না হওয়ায় মিলা কাথাটা টেনে নামালো কিছুক্ষণের মাঝেই মুহিনের চোখে তন্দ্রা লাগলো।
মিলার যখন ঘুম ভাঙলো তখন আশে পাশে কোথায় হলুদ গাঁদা ফুল গান বাজছে। সে উঠেছে বুকের স্পর্শকাতর স্থানে কারো হাতের ছোঁয়ায়। স্পর্শটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। অভ্যাস বসত ভেবেছে রুশ্মিতা। সে নিচু স্বরে বললো,
” মিতা সরে শো। আম্মু টিভির সাউন্ডটা একটু কমাও।”
কিন্তু সাউন্ড কমলো না। বিরক্তি নিয়ে মিলা আর দিন গুলোর মতোই ঘড়ির দিকে তাকালো। আরে ঘড়ি কই? লাফ দিয়ে উঠে বসে চোখ ডললো। এটা কই? তার মাথা হ্যাং হয়ে আছে। ধাতস্থ হয়ে পাশে হাত দিলো। মাহতাব খেলছে। সিলিং এর দিকে তাকিয়ে অ আ করে মুখ দিয়ে অদ্ভুত সব শব্দ করছে। তার পাশে মুহিন উপুর হয়ে ঘুমাচ্ছে এক হাত মিলার দিকে। মিলার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল ধারা নিচে নামলো। ওটা মুহিনের হাত ছিলো! ভয় পেলেও বুঝলো ঘুমের মাঝে হয়েছে কাজটা। মুহিন তখনও মৃদু নাক ডাকছে। সে বিছানা ছাড়লো শরীরে ওড়না ঠিক করে মুহিনের দিকে তাকালো। একটা কাথায় শুয়ে ছিলো ব্যাপারটায় অস্বস্তি লাগলো মিলার।
বেশ ক্ষানিকক্ষণ ধরে কলিং বেল বাজছে। মিলা বিরক্ত হলো। বাথরুম থেকে বের হয়ে লুকিং গ্লাসে নজর দিলো। কয়েকজন মহিলা দাঁড়ানো। আজ ছুটির দিন হওয়ায় মুহিন অফিস যায় নি। তবে মিলা তাকে কিছু বিশেষ কাজ দিয়েছে যা না করলেই নয়। এটাকে আসলে বাসা না পুরানো স্টোর রুম বলা চলে যা দশ বারো বছরে একবার পরিষ্কার করা হয়। মিলা দরজা খুললো।
“আসসালামু আলাইকুম।”
” ওয়ালাইকুমুস সালাম। তুমি মুহিন সাহেবের বউ?”
” জ্বি। উনিতো বাসায় নেই কিছুক্ষণ আগেই বের হয়েছেন। কিছু বলবেন?”
মহিলা গুলো মিলার কথার গুরুত্বই দিলো না। ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো। মিলা টাল সামলাতে না পেরে দেয়ালে বাড়ি খেলো। হুড়মুড়িয়ে ছ’ সাত জন মধ্য বয়সী নারী ঘরের ভিতর ঢুকলো। সোফার উপর ঝাড়ু দেখে একজন বললো, ” যাক এবার এই ভূতের বাড়িটা মানুষের বসবাসের যোগ্য হবে।”
সবাই একচোট হেসে নিলো।
” আমি এই বাসার বাড়িওয়ালি। তোমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকি।”
মিলা মুচকি হাসলো।
ভদ্রমহিলার নাম রেশমি। বয়স কত হবে ৩৫-৪০ এর মধ্যে। কাপড় চোপড়ে আভিজাত্য ফুটে উঠেছে। চেহারায় জৌলুস। বেশ সুখী সুখী ভাব। মিলা এখন এনাকে কি বলে সম্বোধন করবে? আন্টি? আপু? ভাবি?
তিনি মিলাকে পা থেকে মাথা অব্দি খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যাবেক্ষণ করলেন।
তারা সোফায় বসলেন৷ মিলা বুঝলো না কি করা উচিৎ তার এই মুহূর্তে। সে বাসায় দেখেছে অতিথি আসলে আপ্যায়ন করা খুবই জরুরি। কিন্তু কি দিয়ে করবে? শুধু চা খাওয়াবে এক কাপ?
মিলা একটু হেসে বলল,” আপনারা বসেন৷”
বলেই রান্না ঘরে গেলো। একটা পাতিল মেজে তাতে পানি চড়ালো। আশেপাশে চা পাতির ডিব্বাটা খুঁজলো। সকালেতো মুহিন এখানেই দেখিয়েছিলো৷ চিনি, চায়ের পাতি, দুধের বয়াম চামচ, ছাকনি সব রেডি। কিন্তু দিবে কিসে? ড্রয়িং রুম থেকে এখনো হাসির শব্দ আসছে৷ পানি ফুটতেই চা পাতা দিয়ে চুলার আঁচ একটু কমিয়ে ড্রয়িং রুমে গেলো। সবাই বসে আছে। সে একটা চেয়ার টেনে বসলো।
” চা বসিয়ে এসেছো?”
” জ্বি। একটু অপেক্ষা করুন।”
” শুধু চা খাওয়াবে সেমাই দিবে না?”
” আসলে আমি তো গতকালই এসেছি কোথায় কি রাখা আছে এখনো জানিনা।”
সবাই ফের হাসলো। বোকার মতো চেয়ে আছে মিলা। এতে হাসির কি হলো। একে একে সকলে নিজেদের নাম বললেন কলি, শেফা, মরজিনা, আঁখি, শিখা, লুবা আর রেশমি। এরা হচ্ছে এই বাড়ির ভাবি গ্যাং। চার তলার বাসার সব দুটো করে ফ্ল্যাটের সবাই থাকেন। মুহিনের সাথে তাদের তিন বছরের পরিচয়। মুহিন বিয়ের পর নতুন এ বাসায় শিফট হয়েছিলো এরপর থেকে এখানেই আছে। এর মাঝে জীবনের কিছু উত্থান পতন হলো৷ যার চাক্ষুষ দর্শি এনারা।
মিলা চায়ের কাপের সেট বের করলো৷ ধুয়ে চা ঢেলে এনে পরিবেশন করলো। সাথে চানাচুর। গতকাল রাতে মুহিন খাবারের সাথে চানাচুর আর বিস্কিটের প্যাকেট এনেছিলো। ভাগ্যিস এনেছিলো নইলে এখন কি দিতো? তবে এমন রসানো গল্পের সময় চানাচুর না হলে চলেই না। বহু কিছুই জানা যাবে এনাদের থেকে। জীবনে সংগ্রামের সে এখনো কিছুই দেখেনি। কিন্তু এনারা সিদ্ধহস্ত সকলেই। শিখতে লাজ নেই। তাই হাত বাড়ালেই যে শিখিয়ে দেয়ার লোক পাওয়া গিয়েছে তা ভেবেই স্বস্তি এলো মনে।
চায়ে চুমুক দিয়ে রেশমি বললেন,
” চা ভালো হয়েছে। মিষ্টিও ঠিক আছে। রান্না পারো? ”
” পারি কিছুটা।”
” মুহিন ভাই ভীষণ ভোজন রসিক। একে বাঁধতে হলে আগে নিজের হাত দুটোকে কষ্ট দিতে হবে।” এনাদের পুলক দেখে মনে হচ্ছে এরা অল্পতেই হেসে গড়িয়ে পড়ার মতো অমায়িক। কিন্তু কুটনীতি সব জায়গাতেই রয়েছে। এখানেও আছে।
” মুহিন ভাইকে আভা যাওয়ার পর কত বিয়ে দিতে চাইলাম তিনি তো বিয়ে করতেই রাজি ছিলেন না৷ অথচ দেখো সেই বিয়ে ঠিকি করলেন। ” শিখা বললেন।
ওমনি রেশমি গলাখাকারি দিলেন।
আভা! এটাই তবে মাহতাবের মায়ের নাম। কি আশ্চর্য মিলা কিছুই জানে না৷ নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে নির্বোধ প্রাণী মনে হচ্ছে।
রেশমি বললেন, ” মুহিনকে তো আমার ছোট বোনের সাথে কত বার বিয়ে দিতে চাইলাম। কিন্তু রাজিই হলো না৷ সে নাকি আর বিয়েই করবে না। আর যদি করেও তাহলে নাকি দেখতে ভালো না, অল্পশিক্ষিত আর বাচ্চা নিবে না আর এমন মেয়ে বিয়ে করবে।”
আঁখি রেশমির সাথে তাল দিয়ে বললো,
” কই! এখন দেখছেন ঠিকি সুন্দরী বউ আরেকটা বিয়া করছে। এইটাতো আগেরটার থিকাও সুন্দর। কি সুন্দর ভাসা ভাসা চোখ! ”
মিলা বুঝতে পারছে না সে হাসবে নাকি রাগ করবে? তারা কি দারুণ ভাবে মুহিনের ভালো চায় বলে ক্রিটিসিজাম করে ফেললেন। একেই বলে, মুখে মধু চালে কদু।
মিলাকে রেশমি এতক্ষণ পর মনে পড়ার ভান করে জিজ্ঞেস করলেন, ” আরে তোমার নামইতো জানা হইলো না। মুহিনতো ফট করে বিয়ে কইরা আনছে। কিছুইতো জানায় নাই।”
মিলা হেসে বললো,
” আমি রুদমিলা। ইডেন মহিলা কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছি। ”
” আরে তুমিতো অনেক শিক্ষিত। দেখছেন ভাবি? কতবড় ছুপা রুস্তম?”
” দেখলাম। অথচ আমার বোনটা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। একাউন্টিং এ বিবিএ ফাইনাল ইয়ারে।”
মিলা বুঝতে পারলো রেশমির আক্ষেপ। তার সুন্দরী শিক্ষিতা বোনকে অজুহাত দেখিয়ে মুহিন নাকচ করে ঠিকি সুন্দরী শিক্ষিতা বিয়ে করেছে। অথচ তার বোন মিলার থেকেও যোগ্য। মিলা ঘড়ি দেখলো সাড়ে বারোটা বাজে।আজ আর কাজ সম্ভব না৷ মাহতাব ঘুমাচ্ছে৷ এই ছেলেটা এতো ঘুম কাতুরে৷ মুহিনের আসতে আর কতো দেরি? তরকারি কিনতে গিয়েছে না চাষ করতে বুঝতে পারছে না। এদের বিদায় করাও সম্ভব না। সুতরাং এখানেই বসে এগুলো শুনতে হবে। গসিপ শুনতে তার সমস্যা নেই কিন্তু গসিপের কেন্দ্রবিন্দু সে নিজে, তার স্বামী, প্রাক্তন আর ছোট্ট মাহতাব। তাই অস্বস্তি হচ্ছে।
চলবে…