ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-০৩

0
95

“ঝরা পাতা উড়ে যায়”
শাহাজাদী মাহাপারা

পর্ব-০৩

এই মুহূর্তে এই ছোট রুমটাকেও মিলার কাছে বিশাল মনে হচ্ছে। সিলিংফ্যানের ঘটঘট আওয়াজ আর তিনজন মানুষের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। রাত ৩টা বাজে। চোখে ঘুম থাকলেও নতুন জায়গা বা বিছানা বদল যেকোনো একটা কারণে তার তন্দ্রাটা ঠিক ঠাক ভাবে আসছে না। নাকি পাশে পুরুষ রয়েছে বলেই এমন হচ্ছে!

খুব স্বাভাবিক। ছাব্বিশ বছরের মধ্যে মাত্র পাঁচ বছর সে বাবার সাথে ঘুমিয়েছেলো। এরপর থেকে অন্য কোনো পুরুষের সাথে ঘুমায়নি। সেখানে এতো রীতিমতো স্বামী। পরপুরুষ না হোক পুরুষ তো। ধর্ম, আইন, সমাজ এমন কি নিজের শরীর সব কিছুর কাছেই সে বৈধ।আর মনের কাছে? উত্তর নেই।

মুহিন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে৷ আজ সারাদিনের দৌড় ঝাপের পর তার মাঝে রোম্যান্টিসিজম আসলেও তা ফলানো সম্ভব নয়৷ এমন কি চিন্তা করাও মহাপাপ। তাই রাতের খাবার গলা দিয়ে নামতেই সে বিছানাকেই নিজের প্রেয়সী বানিয়ে ভোস-ভোস করে নাক ডাকছে। নাক ডাকা তার ধাতে নেই তবে ক্লান্ত লাগলে এমন টা হয়। মাঝখানে মাহতাব ঘুমাচ্ছে তার পাশে ওই সুন্দর রমণী যার জন্য হঠাৎ করেই তার বরফ হয়ে যাওয়া মনটা একটু একটু করে গলতে শুরু করেছে। সে অবশ্যই কোনো মহা পুরুষ না, মানসিক রোগীও না৷ তাই নারী দেহ পাশে থাকতে অভুক্ত থাকবে এটা রীতিমতো হাস্যকর। তবুও নিজের লিপ্সাকে প্রাধান্য দেয়নি সে। জানে এই বিয়ে, সংসারটা স্বাভাবিক না। এখানে বৈধতা থাকলেও ভালোবাসা নেই, প্রেম নেই। তার বিয়ে করার উদ্দেশ্য মাহতাবকে মা দেয়া। আর মিলার কি উদ্দেশ্য তা সে এখনো সঠিক জানে না। আর তার নিজের আত্মসম্মান বোধ প্রবল। তাই মিলার কাছে নিজের চরিত্রে দাগ পরতে দিতে নারাজ।
মিলা উঠে বসলো। কিছুক্ষণ পায়চারি করে আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।

গোসল করে বের হতেই দেখলো মুহিন বসে আছে ডাইনিং টেবিলে। এখনো সারাদিনের কাপড় ছাড়ে নি। মিলা বারান্দায় গিয়ে কাপড় নেড়ে টেবিলের অপর প্রান্তে এসে বসলো। মুহিন এবং সে দুজনেই এখন মুখোমুখি। মিলা খেয়াল করলো মুহিনের চোখ মুখে ক্লান্তি। চুলগুলো উষ্কখুষ্ক অথচ ঘন চুলে মাথা ভর্তি। একটু যত্নের অভাব। এ বাসায় সব কিছুতেই যেন যত্নের অভাব টের পায় সে। সে যে খুব যত্নশীলা তেমনটা না। সে অলস। কিন্তু টুকটাক কাজ সে অবশ্যই করে। তবে আজ মনে হচ্ছে কাজের মাত্রা বেশি হয়ে গিয়েছে। পুরো ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো সে। মাইক্রোওয়েভ ওভেনের সিগনালটা তখনই বিপ বিপ করে আওয়াজ করেলো। ঘাবড়ে গেলো মিলা। দ্রুত বেডরুমের দিকে তাকালো, আওয়াজে মাহতাব উঠে না যায়। ওর দৃষ্টি লক্ষ্য করে মুহিনও তাকালো। স্মিত হেসে বললো,
” দুঃখিত।” মিলা ফের মুহিনের দিকে তাকালো।
” ওভেনে খাবার গরম দিয়েছিলাম। আপনার ক্ষুধা লেগেছে নিশ্চই।”
” জ্বি।” মিলার মুখটা শুকিয়ে গিয়েছে ক্ষুধায়। ক্ষুধা পেটে তার ঘুমও আসে না।
মুহিন একে একে প্লেটে খাবার সাজিয়ে মিলার সামনে রাখলো।
” আসলে আজ রান্না হয় নি। আর আমার রান্না হয়তো আপনি খেতে পারবেন না৷ আমি বাসায় খাই না বাহিরে রাতের খাবার সেরে ফিরি। সামনে একটা হোটেল দেখেছেন না? সেখানেই। আর সকালের নাস্তা আর লাঞ্চ অফিসেই করি।”
এজ এক্সপেক্টেড। মিলার মনে হলো সবকিছু স্বাভাবিক করতে বেশ সময় লাগবে৷ বিয়েটা হুট করে হওয়ায় সে মুহিন সম্পর্কে কিছুই জানে না। আজকালকার যুগে এমন পাত্রী দেখতে এসে বউ নিয়ে বাড়ি ফেরা বিষয়টা তার কাছে অদ্ভুৎ আর হাস্যকর মনে হতো। অথচ কি কপাল তার ক্ষেত্রেই এমনটা হয়েছে। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে – ‘ যে যারে নিন্দে, সে তারে পিন্দে’। অর্থাৎ যাকে বা যে জিনিসকে অপছন্দ করবা বেশি ওটাই তোমার সাথে ঘটবে। প্রবাদটা যেনো স্বশব্দে তার গালে চড় বসিয়েছে অথচ সে চড়ের শব্দ তার কর্ণকুহর ছাড়া আর কোথাও প্রতিধ্বনিত হয় নি।
মিলা ফোস করে শ্বাস ছাড়লো। গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, ডিম, মুরগীর তরকারি, লেবু,শসা এক গ্লাস পানি সবই সামনে আছে। মিলা মুহিনকে ভদ্রতা থেকেই জিজ্ঞেস করলো,
” আপনি খাবেন না?”
” খাবো। আপনি খেয়ে নিন। আমি ফ্রেশ হয়ে খাবো। বাথরুমে বাবুর কাপড় ভেজানো ধুঁয়ে দিতে হবে।”

মিলা চুপ করে রইলো। মুহিন মাথা নিচু করে বসে আছে।

” আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি বসছি।”
কথাটা মিলা বলতেই পারতো কিন্তু তার ধারে কাছ দিয়েও গেলো না। ক্ষুধার্ত মিলার মাথা ধরার বাতিক রয়েছে। সে দ্রুত প্লেটে খাবার বেড়ে নিয়ে মুখে তুলে চিবানো শুরু করলো। মুহিন বোকার মত চেয়ে রইলো। এই মেয়ের মধ্যে সামান্য সহমর্মিতা, সৌজন্যতাবোধ নেই। সেও যে সারাদিনের না খাওয়া এইটুকু এই মেয়ে জানার চেষ্টাও করলো না। মুহিন এক গ্লাস পানি গিলে চেয়ার ছেড়ে উঠে বললো, “আরাম করে খান।” মিলা ওর কথা শুনলো কিনা বোধগম্য হলো না। সে কচ কচ করে শসা গুলোতে কামড় বসাতে ব্যস্ত।

মুহিন রুমে গিয়ে দেখলো মিলার বিয়ের শাড়িটা অবহেলায় মেঝেতে পড়ে আছে। চুড়িগুলো ড্রেসিং টেবিলের উপর যেনো কেউ ছুড়ে ফেলেছে। সবকিছুই কেমন এলোমেলো। মুহিন শাড়িটা মেঝে থেকে তুলে ভাজ করে রাখলো। এটা আগামীকাল লন্ড্রিতে দিতে হবে। মিলা বমি করেছে এই শাড়ি পরা অবস্থায়। যদিও বমি কাপড়ে লাগে নি তবুও। মুহিন তাওয়াল নিয়ে বাথরুমে গেলো ফ্রেশ হতে। ঢুকেই ধাক্কা খেলো বালতিতে কাপড় নেই। ভেজানো কাপড়গুলোতো এইখানেই ছিলো৷ দৌড়ে বারান্দায় গেলো। মিলা খাবার খেতে খেতেই মুহিনকে দেখছিলো। মুহিন বারান্দা থেকে এসে আবার বাথরুমে ঢুকলো। কৃতজ্ঞতাবোধ করলো। যতটা ভেবেছিলো ততটাও খারাপ না মেয়েটা৷ এই একদিনে কত উদ্ভট সব কান্ড ঘটে গেলো অথচ খুবই সাধারণ সব বিষয়াদি। গোসল করে বের হয়ে দেখলো খাবার টেবিলে সব ঢাকা। মিলা নেই। সে বারান্দায় গিয়ে নিজের কাপড় নেড়ে খাবার খেয়ে ঘরে এসে দেখলো মিলা বসে আছে।

” আপনার ফেসবুক আইডি নেই?”
চট করে তাকালো মুহিন।
” হ্যাঁ, আছে।”
” নাম বলুন।”
মুহিন ঘাবড়ালো। সে কি বিয়ের বিষয়টা পাবলিক করবে? নাম বলতে সমস্যা নেই। কিন্তু তার আইডিতে গেলে এই মেয়েটা কষ্ট পাবে। নাও পেতে পারে কারণ ওদের মধ্যে কোনো মানসিক টান এখনো তৈরি হয় নি। আইডি জুড়ে তার প্রথম প্রেমের ছাপ। যা সে এখনো মুছে ফেলতে পারেনি। আইডির ছাপতো কিছুই না এই যে বিছানায় ঘুমাচ্ছে এই বাচ্চাটা এটাতো তার প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা, প্রথম স্ত্রীর একটা অংশ। সে তাকেও মুছতে পারেনি নিজের জীবন থেকে। বিছানায় তাকিয়ে সে ভাবছে আইডি দিবে কি না?

মিলা বুঝতে পারলো৷
“থাক লাগবে না। ফোন নাম্বারটা দিন অন্তত।”
মুহিন ফোন নাম্বার বললে মিলা নাম্বার হাজবেন্ড লিখে সেভ করলো। তার প্রথমে অস্বস্তি হলেও এটাই ঠিক মনে হচ্ছে। এমন কি ইমার্জেন্সি ডায়ালে সে বাবা মায়ের নাম্বারের সাথে মুহিনেরটাও এটে দিলো।

মুহিন জিজ্ঞেস করলো, ” আপনার নাম্বারটা?”
” মিসড কল দিয়েছি সেভ করে রাখুন।”
মুহিন মিলার নাম্বার ওয়াইফ লিখে দুটো লাভ ইমোজি দিয়ে সেভ করলো। হাস্যকর হলেও তার মজা লাগলো।কি অদ্ভুৎ প্রহসন চলছে। সে তার প্রথম স্ত্রীর নাম্বার এইভাবে সেভ করেনি। সেটা তার নামেই সেভ করা ছিলো।
মুহিনের ফোন থেকে ওয়াইফাই স্ক্যান করে মিলা ফেসবুকে ঢুকলো।

এই বাসায় তার প্রথম স্ত্রীর কোনো ছবি নেই। যেদিন ডিভোর্স পেপারটা পেয়েছিলো সেদিনই সব ছবি সে নিজে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলেছিলো। সে রাতের কথা সে আর ভাবতে চায় না। জানালার কাছে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালো।

মুহিন সিগারেট খাচ্ছে দেখে মিলা বললো,”আপনি বাসায় থাকলে এইসব খাবেন না প্লিজ। আমি এইগুলোর ধোঁয়া সহ্য করতে পারিনা। আর এইগুলোতে আপনার নিজের ফুসফুসতো যাচ্ছেই সাথে বাবু আর আমার ফুসফুসও যাবে।” মুহিন দুটো টান দিয়ে ফেলে দিলো। সিগারেট শুরু করে কলেজে থাকা সময়৷ এরপরও খেয়েছে। কিন্তু মাহতাব আসার খবর পেয়ে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলো। ডিভোর্সের পর থেকে আবার শুরু করেছে।বেশি না রোজ একটা খায়। কোনো কোনো দিন দুটো। এমনও রাত গিয়েছে যখন সারা রাত ঘর সিগারেটের ধোঁয়ায় ধোয়াসা হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু মাহতাবের কথা ভেবে কমিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে আবার বন্ধ করতে হবে।

মুহিন রুমে এসে শুয়ে পড়লো। আগামীকাল ফেসবুকের সব ছবি ডিলিট করে দিতে হবে। তার চেয়ে ভালো ডিএক্টিভ করে নতুন একাউন্ট খোলা। সে তাই করবে৷ কিছুক্ষণের মধ্যে মুহিন ঘুমিয়ে গেলো। এর মধ্যে মাহাতাব পটি করলো, রাতে ক্ষুধার জন্য উঠে কান্না করলো মিলা খুব সুন্দর মাহতাবকে ভাত খাওয়ালো অল্প অল্প করে। সেই সন্ধ্যার পর ঘুমিয়েছিলো বেচারা।খেয়ে দেয়ে কিছুক্ষণ খেলার পর সে আবার ঘুমিয়ে গেলো। মিলার পাশেই। মিলা হাসলো। মুহিনের ছেলেকে নিয়ে একটুও হুশ নেই। আজব তো! সে বুঝতে পারলো মুহিন ইচ্ছে করেই উঠেনি। সে জানে মিলা সামলে নিবে। কি করে জানলো? আচ্ছা, মাদার ইন্সটিংক্টের মতো কি ফাদার ইন্সটিংক্ট ও কাজ করে? কাল সকালে একবার জিজ্ঞেস করতে হবে।

এটা সেটা চিন্তা করে মিলার আর ঘুম হলো না। সারা রাত সে এপিঠ ওপিঠ করেই কাটালো। আচ্ছা এই বিয়েটা স্বাভাবিক হলে এখন তারা কেমন অবস্থায় থাকতো? ওরা নিশ্চই বাকি দম্পতিদের মতো নফল নামাজ পড়তো। মুহিন কি প্রথমেই তার অধিকার আদায় করতো? নাকি সারা রাত একে অপরকে জানার জন্য প্রশ্নে প্রশ্নে সুখ খুঁজতো। নানাবিধ প্রশ্ন সে নিজেই নিজেকে করলো উত্তরও সে নিজেই বের করলো।

ফজরের আযানের পর তার চোখটা একটু লেগে এলো।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে