ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-০২

0
147

“ঝরা পাতা উড়ে যায়”

শাহাজাদী মাহাপারা
পর্ব-০২

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। মাহতাব বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সোফার উপর৷ কিছুক্ষণ আগেই সুজি খাইয়েছে মিলা। সারা বিকাল কান্না করে করে এখন মাথা চোখ বুক সব ব্যথা করছে। বিকেলে মাহতাবের কান্না থামার পরই মুহিন বাসা থেকে বের হয়েছে। যাওয়ার আগে “একটু বাহিরে যাচ্ছি” বলেই দরজা লাগিয়ে চলে যায়। মিলার মা বাবার কথা খুব মনে পড়ছে।
এইরকম একটা অসুস্থ পরিবেশে তাকে প্রায় জোর করেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছে তার।বারবার কান্না ডুকরে উঠছে বুকের ভিতর।কিন্তু আসলেই কি তাকে জোর করে পাঠানো হয়েছে? ব্যাপারটা ঠিক তা না। সে এক বুক অভিমান আর আত্মসম্মানবোধ থেকেই এখানে। পরে পরে পঁচে বা শরীরে জং ধরে যাচ্ছে এইসব কথা শোনার চেয়ে এইখানে বিয়ে বসাটা তার কাছে বেশ সহজ মনে হয়েছিলো তখন। কিন্তু এখন অস্থির লাগছে। কি করে সব সামলাবে? নিজের ভেতর ভয় আর চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। মিলা মাহতাবকে কোলে নিয়েই আশেপাশে দেখতে লাগলো। এই বাসায় যে মহিলা মানুষ দূরে থাক বুয়াও আসে না তা বুঝতে বাকি নেই তার। পুরো বাসায় কোণায় কোণায় ঝুল, মাকড়সার বাসা। এত ছোট বাচ্চা নিয়ে এই লোক এমন নোংরার মধ্যে থাকে, কি করে সম্ভব! আচ্ছা এই লোক যে বেতন পায় একটা বুয়াতো রাখতে পারে৷ বাচ্চাটা সারাদিন থাকে কোথায়? নিজের মনে হাজারটা প্রশ্ন কিলবিল করছে মিলার। রান্না ঘরের দিকে গেলো সে। সিংকে দুটো প্লেট, গ্লাস, বাবুর একটা ফিডার আর বাটি পরে আছে।

হেঁটে হেঁটে অবশেষে বেডরুমের দরজা খুললো। প্রথমেই যেটা তার মন ভালো করে দিলো তা হলো নির্মল বাতাস। এতো সুন্দর বাতাস রুমের জানালা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকছে। তার সাথে বেবি পাওডারের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। প্রাণ ভরে শ্বাস নিলো মিলা। মন খারাপিটা অনেকটাই কেটে গেলো। একটা বড় একটা খাট, কিং সাইজ বেড। সুন্দর একটা চাদর বিছানো। বাচ্চাদের মশারি, বালিশ, কোলবালিশ সবই আছে। একটা বড় তিন স্টোরের আলমারি একপাশে, আরেকপাশে ড্রেসিং টেবিল, বিছানার এক পাশে বেড সাইড টেবিল, একটা ওয়াড্রোব, একটা ছোট টেবিল-চেয়ার। ময়লা কাপড় রাখার ঝুড়ি আর একটা ময়লার ঝুড়ি রাখা রুমে।

এই হলো বাসার হাল হকিকত। মিলা মাহতাবের দিকে তাকালো। প্রথমে সে ভেবেছিলো মাহতাবের বয়স দেড় বছর তবে এখন বুঝতে পারছে তার বয়স ১ বছরের বেশি না। এই ছোট্ট বাচ্চাটাকে একা পালা সত্যিই মুশকিল। মাহতাব হাত দিয়ে মিলার খোপা করা চুলে একটু পর পর হাত দেয়ার চেষ্টা করছে। ছোট ছোট হাত। মিলা হাতটা সামনে এনে চোখ রাঙিয়ে তাকালো। কি কপাল! নিজের বাচ্চা পালার বয়সে আরেকজনের বাচ্চা পালতে হচ্ছে। নিজেকে ন্যানি ছাড়া আর কিচ্ছু মনে হলো না তার। হ্যাঁ ন্যানিই তো। আর আমেরিকান ভাষায় বেবি সিটার বলে। সে তো এই বিয়ে বসেছে বাচ্চা পালার দায়িত্ব নিতেই। সে যে অথর্ব না তা সে দেখিয়ে দিতেইতো এত বড় গুরু দায়িত্ব নিয়েছে।

মিলা রান্না ঘরে গেলো আবার এটা সেটা ধরে ধরে দেখলো।মাহতাবকে খেলনা দিয়ে বসিয়ে দিলো রান্না ঘরের মেঝেতেই। তারপর হাতের কাছে সুজি দেখে একটু সুজি বানালো। রান্নাটা এখনো পুরোপুরি করায়ত্ব করতে পারেনি সে। এইভাবে আরেক জনের কিচেনে ঢোকাটা তার কাছে চরম অস্বস্তির কাজ। কিন্তু আজ সে আরেকজনের ত্যাগ করা সব কিছুই নিজের করে নিচ্ছে একটু একটু করে৷ সুজি বানানো শুরু করলো সে। ফোনের ডাটা অন করে বাচ্চাদের সুজির রেসিপি বের করে তাই বানালো। নিজের জন্যও বানালো একটু চিনি বেশি করে দিলো। চিনি দুধ সামনেই ছিলো সব। এই শাড়িতে আরও খারাপ লাগছে রান্না ঘরে আগুণের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। মাহতাব টিয়া পাখিটাতে একটু পরপর চাপ প্রয়োগ করতেই সেটা আওয়াজ করছে আর মাহতাবের মুখের মৃদু হাসে দেখা যাচ্ছে।

মিলা সুজি বানিয়ে মাহতাবকে চামচ দিয়েই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খাওয়ালো। মাহতাবও বেশি নখড়া না করে খেয়ে নিলো। মিলার মনে হলো মাহতাব অভুক্ত ছিলো অনেক। খাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই সে ঘুমিয়ে গেলো। মিলা ওকে সোফায় শুয়িয়ে দিয়ে নিজেও পাশে বসে দম ফেললো। সুজিটা গিলে তারও পেটের জ্বালা কমেছে। ক্ষুধা সহ্য হয় না মিলার। বাবার বাড়িতে কখনো রাগ করে না খেয়ে থাকতে হয় নি। বাবা জোর করে হলেও খাইয়েছে। মা একশো বকা দিলেও খাবারের সময় একশোবার ডেকেছেন। চোখে টলটলে অশ্রু কিন্তু আর কাঁদতে ইচ্ছে করছে না মিলার। মিলার মনে হলো মাহতাব আসলে মিশুক বাচ্চা। নাহলে এতো ছোট বাচ্চা মা ছাড়া কারো কোলে যেতে চায় না। আর তার যেহেতু শুধু বাবাই আছে সুতরাং বাবা ছাড়া কাওকে ধরতে অনুমতি দিচ্ছে এমন কি মিলাকে দেখেছে কয়েক ঘন্টা মাত্র তাতেই সে মিলার সাথে মিশে গিয়েছে। মিরাকেল টাইপ ব্যাপার স্যাপার।

মেইন ডোরের দিকে নজর যেতেই উঠেই চাবিটা লাগিয়ে দিলো ভেতর থেকে। ভদ্রলোক আসলে নিশ্চই কলিংবেল দিবে। মিলা বেডরুমে গিয়ে বিছানা ঝারার ঝাড়ু খুঁজে আগে বিছানা পরিষ্কার করে মাহতাবকে এনে শুয়িয়ে দিয়েছে। এরপর নিজের এই ক্যাটক্যাটা বিয়ের শাড়ি দেখলো আয়নায়। আসলে শাড়িটা খুব খারাপ যে তা না। শুধু ওরই বিরক্তবোধ হচ্ছে। গা চুলকাচ্ছে। এই শাড়ি পাল্টাতে হবে। কিন্তু শাড়ি পালটে কি পরবে? আবার শাড়ি পরবে? নাকি সালওয়ার স্যুট? অসহ্য লাগছে আগে শাড়ি পালটে গোসল নেয়া দরকার বমির পর থেকেই শরীর আর চলতে চাইছে না। সারা দিনের না খাওয়া তাই যা বমি হয়েছে তা শুধু সকালে সাবিনা ভাবির জোর করে খাইয়ে দেয়া একটা পাউরুটিই ছিলো। দ্রুত ব্যাগের চেইন খুলে এক সেট সালওয়ার কামিজ আর গামছা বের করলো। শাড়ির জায়গায় জায়গায় সেফটি পিনের লক। মনে হচ্ছে সেফটি পিন দিয়ে তাকেই শাড়ির সাথে আটকে ফেলা হয়েছে। এই সেফটিপিন খুলতেই খানিকটা সময় নিলো। শাড়ি খুলে পেটিকোট আর ব্লাউজ পরেই হাতে কাপড় নিয়ে পিছলা বাথরুমের সামনে গেলো সে। হঠাৎ মনে পড়লো শাওয়ারের নব নেই, বালতিতে ময়লা কাপড় ভেজানো গোসল করবে কি দিয়ে? আরেকটা বালতি খুঁজতে লাগলো। এই বাড়িতে আগেও মহিলা ছিলো তার মানে বালতিও আছে এক্সট্রা। এমনকি জীবন যাপনের জন্য যা যা লাগে সবই আছে। শুধু অযত্নে আছে। বাবু ঘুমাচ্ছে ও ঘুমে থাকতেই গোসল সারতে হবে। বাচ্চার মায়েরা এভাবেই গোসল করে। কিন্তু আফসোস এটা ওর বাচ্চা না। রান্না ঘরে ঢুকবার আগে সে আরেকটা বালতি পেলো। ওটা নিয়েই বাথরুমে ঢুকতে যাবে দেখলো দরজার নব কেউ বাহির থেকে খুলছে। কি আশ্চর্য!সে তো লক করেই রেখেছিলো। ভয়ে শিটিয়ে গেলো মিলা। চোর নাকি? উপরের ছিটকিনি না লাগিয়ে বিশাল ভুল হয়েছে। হায় আল্লাহ!

দরজার নব খুলে মুহিন ভিতরে এলো। হাত ভরতি কিছু জিনিস। দরজা লাগিয়ে পেছনে তাকাতেই বেক্কল হয়ে গেলো।
মিলা মুহিনকে দেখে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। হঠাৎ নিজের অবস্থা সম্পর্কে অবগত হতেই “আ” জাতীয় মৃদু চিৎকার করে দু হাতে মুখ চেপে ধরলো। মুহিন এখনো হাবলার মতো তাকিয়ে আছে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে। মিলা ‘পা*রভার্ট’ বলে গালি দিয়েই বালতি সহ দৌড়ে বাথরুমে ঢুকলো একটুর জন্য পিছলা খেয়ে পড়ে নি। নইলে মান সম্মানের আর কিছুই থাকতো না। ও ধরণী তুমি দ্বিধা হও আমি লুকাই।
মুহিন মিলার দৌড়ে যাওয়ার স্টাইল দেখে বোকা বোকা হাসলো। এরপর চেপে না রেখে জোরেই হাসলো। বাথরুমে কল ছাড়া থাকায় মিলা টের পেলো না। মাথায় মগ দিয়ে পানি ঢালতে ঢালতে ভাবছে সবার আগে এই বাথরুমের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর বাদবাকিটা ভেবে দেখা যাবে। নতুন কাপড় গুলো পানি পেয়ে রঙ ছেড়েছে আর মিলার দেহ ঠান্ডা পানির সংস্পর্শে এসে স্বস্তির শ্বাস।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে