ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-০১

0
187

“ঝরা পাতা উড়ে যায়”

শাহাজাদী মাহাপারা
সূচনাপর্ব

কাঁচা বাজেরর সামনে দিয়েই বাঁক নিলো রিকশাটা। রুদমিলা বিরক্ত চোখে চেয়ে দেখছে সব। মাছের বাজারের সামনে থেকে যাওয়ার সময় তীব্র বিশ্রী গন্ধে নাক মুখ আঁচল দিয়ে ঢাকলো যেনো তার নাড়িভুড়ি সব উল্টে আসতে চাইছে। কি বিশ্রী গন্ধ! পাশে বসা লোকটার গা থেকেও ঘামের সোদা গন্ধ ভেসে আসছে বাতাসের সাথে। মিলা আর সহ্য করতে পারলো না বমি করার জন্য ওয়াক করে উঠলো। মুহিন চট করে তাকালো বাঁ পাশে। সহসা জিজ্ঞেস করলো,
” তুমি ঠিক আছো?”
মুখের ভিতর তেতো ভাব নিয়ে মিলা তার দিকে তাকালো। এই লোকের সাহস তো কম বড় না তাকে তুমি করে ডাকছে? ১ ঘন্টা হয়েছে মাত্র এই লোকের সাথে তার পরিচয়। আর এখনি সে তাকে তুমি বলে সম্বোধন করছে? ম্যানারলেস লোক। স্বামী হয়েছে তাই মাথা কিনে নিয়েছে? অসহ্য। মিলা কোনো উত্তর করলো না। বেগুনী রঙের শাড়িটা শক্ত করে আঁচল দিয়ে মুখটা ঢেকে রাখলো।
মুহিন কয়েক লহমা ওর দিকেই তাকিয়ে থেকে নজর ফিরিয়ে নিলো।

৩৪ বছর বয়েসি মুহিন একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরে। বয়সের সাথে দেহেরও একটা ভারিক্কি নজরে পরে। পুরোপুরি না হলেও পেটের দিকে মেদ জমতে শুরু করেছে। লম্বায় ৫ফিট ৬ কি ৭ হবে। জীবনের নানা বাঁক দেখে অভ্যস্ত লোক হঠাৎ করে একটা নতুন বাঁকের সাথেই ধাক্কা খেয়েছে। জীবন নামক তরীটা একা একা বইবার ভার থেকে মুক্তি নিতেই আজ রুদমিলা নামের তরুণী, আচ্ছা, ওর বয়স তো ২৬ এখনো কি তরুণী বলা চলে তাকে? হ্যাঁ তরুণীই তো সে। সেই নারীকে সে বিয়ে করেছে। আড়ম্বরহীন এই বিয়েতে রুদমিলার মত কতটা আছে সে সঠিক জানে না তবে এতক্ষণে কিছুটা ঠাওড় করে নিয়েছে। ভেতরে ভেতরে সে শান্ত। সময়ের সাথে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে কথাটা রুদমিলার ফুফু তাকে বলেছে। আসলেই কি ঠিক হয়ে যায় সব? হয় না। সত্যি কথা বলতে সময়ের সাথে কিছুই ঠিক হয় না। তবে সময় কাঁচা ঘায়ে মলমের প্রলেপ লাগিয়ে দেয় এতে ঘাঁ শুকিয়ে যায় ঠিক কিন্তু দাগ রয়েই যায়৷ তবে সময় আবার নতুন করে ঘায়ের সৃষ্টি করে এটা ঠিক। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মুহিন।

একটা চার তলা বাড়ির সামনে এসে থামলো রিকশা। মুহিন আগে নেমে ভাড়া দিলো। রুদমিলার কাছে গিয়ে হুড নামিয়ে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো রিকশা থেকে নামার জন্য। রুদমিলা হাতের দিকে তাকিয়েও বিরক্ত হলো। আরে কি আশ্চর্য সে কি অথর্ব নাকি? এমন হাত বাড়িয়ে দেয়ার কি আছে? সে কি জীবনে রিকশা চড়ে নাই? আজব! মিলা হাত ধরার ধারে কাছেও গেলো না। উল্টো পাশে নামলো। নিজের ব্যাগ নিজেই নামালো। এরপর চুপ চাপ দাঁড়িয়ে রইলো। মাথায় ঘোমটা দেয়া ছিলো সেটা সরিয়ে ফেললো। ভ্যাপসা গরমের দিনে এমন নতুন শাড়িতে শরীর চুলকাচ্ছে। একটা নরমাল সুতি শাড়িই নাহয় দিতো। বেগুনী রঙের কটকটা কাতান শাড়ি। এইগুলা কি দিছে আজাইরা। রাগে তার ইচ্ছে করছে লোকটার মাথায় একটা থাবড়া দিতে কিন্তু পারছে না। মুহিন গেইট খুলে ভিতরে গিয়ে বললো, “এসো।” মিলাও পেছন পেছন গেলো। সিঁড়ি বেয়ে তিন তলার ৩-বি লেখা বাসাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মুহিন একটি অস্বস্তি বোধ করছিলো। তবুও চাবি দিয়ে দরজাটা খুলে ভেতরে গেলো। মিলা তার পেছন পেছন ঢুকলো। অন্ধকারের জন্য কিছু দেখা যাচ্ছে না। সে আরেকটু ভেতরে যেতেই পায়ে কিছু বিঁধলো। মাগো বলেই আর্তনাদ করে উঠলো সে। মুহিন দ্রুত লাইট জ্বালালো। মিলা ঘরের দিকে চট করে তাকালো আলো জ্বালায়। হতভম্ব হয়ে গিয়েছে সে তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মুহিনের বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। মন খারাপও হলো। এই সুন্দর পুতুলের মতো মেয়েটাকে সে কিভাবে নিজের সাথে রাখবে? অনুশোচনা হচ্ছে এখন বিয়ে করে।

মিলা প্রায় চিৎকার করে উঠলো ,
” আল্লাহ মাবুদ এইসব কি? এই বাসায় মানুষ বসবাস করে?”
চোখ থেকে পানি আসার উপক্রম তার। ইচ্ছে করছে হাত পা ছড়িয়ে কাঁদুক। মিলা মুহিনের দিকে তাকিয়ে বললো,” ওয়াশরুম কোথায়?” মুহিন হাত দিয়ে ইশারা করতে দেরি মিলা প্রায় শাড়ি হাটুর উপর উঠিয়ে দৌড়ে গেলো ওয়াশরুমে। বেসিনে হরহর করে বমি উগড়ে দিলো। শরীর ছেড়ে দিয়েছে তার। বুক হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে। বেসিনের কল ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। আয়নায় সাদা সাদা আস্তরণ পড়েছে, বাথরুমটাও পিছলা, শাওয়ারের নবটা নেই। বালতিতে কিছু কাপড় ভিজিয়ে রাখা আছে। কান্না উপচে পড়ছে তার চোখ থেকে। কাঁপা হাতেই চোখমুখে পানি দিলো সে। বাথরুম থেকে বের হয়ে ঘরের দিকে নজর গেলো। ছোট ছোট বাচ্চাদের খেলনা সারা ঘরময় ছড়ানো। ডাইনিং রুমে সিক্স সিটার টেবিল কাঠের। তার উপরে বাচ্চাদের দুধের কৌটা, ফিডার নিচে দুধ প্রায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে৷ পানির কাচের জগ, গ্লাস, চামচের সেট এলোমেলো হয়ে আছে। পাশে কলা আর পাউরুটির প্যাকেট।

সামনে একটা বেডরুম আর এই ড্রয়িংরুম কাম বেডরুমের বাসা। ড্রয়িং রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দা তা থেকে রাস্তাটা দেখা যায়। রুদমিলা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সামনে এগোতেই মুহিনকে দেখলো খেলনা গুলো একটা একটা করে সেন্টার টেবিলের উপর উঠাচ্ছে। মিলাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলো, ” তুমি ঠিক আছোতো মিলা?”

” আপনি আমাকে আপনি বলে ডাকুন। এটা একটা ভদ্রতা অপরিচিত কাউকে সম্বোধন করার।” মুহিনের মনে হলো তার থেকে বয়সে ৭-৮ বছরের ছোট মেয়েটা তার গালে কষে একটা চড় বসিয়েছে। আচ্ছা নিজের স্ত্রীকে কেউ আপনি বলে ডাকে? কি কুক্ষণে এমন অভদ্র মেয়েকে বিয়ের জন্য সে রাজি হয়েছিলো কে জানে! রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।

” দুঃখিত। আর ভুল হবে না মিসেস রুদমিলা আজহার।”

মিলা বিরক্তিতে ভ্রু কুচকালো। মুহিন ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা এক বোতল পানি বের করে তা গ্লাসে ঢেলে মিলার হাতে দিলো। পানি দেখেই যেন তেষ্টা আরও জেঁকে বসেছে। ঢক ঢক করে গ্লাসের পানি গিললো সে। উফ বুক পেট ঠান্ডা হয়েছে এতক্ষণে।

মিলা বললো, ” আমি কোন ঘরে থাকবো?”
হাত দিয়ে ইশারায় রুমের দিকে দেখালো মুহিন। মিলা ফের বললো, ” এই বাসায়তো একটা বেডরুম আপনি কোথায় থাকবেন?” হতবুদ্ধি হয়ে গেলো মুহিন। আরে কি আশ্চর্য! স্বামী স্ত্রী যে এক রুমে থাকে এই মহিলা জানে না? একে এখন মেয়ে বলতে বাঁধছে তার। ২৬ এর বুড়ি অথচ কথার ঢং শোনো। হাসি পেলো মুহিনের। এবার আর সে হাসি চাপলো না।
হেসেই বললো, “স্বামী স্ত্রী এক রুমে, এক বিছানায় পাশাপাশি শোয়, এক প্লেটে খাবার খায়, এক গ্লাসে পানি খায়, এক বাথরুম উইজ করে, এক তাওয়াল ইউজ করে এমন কি এক কাথা – কম্বলের নিচে ঘুমায়।”

মিলার মুখটা একদম দেখার মতো হলো মনে হচ্ছিলো এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে সে। কিছু বলতে যাবে তার আগেই মুহিন বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। মিলা অবাক হয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলো। কিছুক্ষণ পরেই আবার বাসায় ঢুকলো। হাতে একটা ছোট্ট বাচ্চা৷ দেড় বছর হবে বয়েস। তাইতো মনে হচ্ছে দেখে৷ মিলা মুহিনের হাতে বাচ্চা দেখে এবার হেঁচকি তুলে কাঁদতে লাগলো। ওর কান্না দেখে এবার আর মুহিন বিরক্ত হলো না৷ ওর সত্যিই মিলার জন্য খারাপ লাগছে। পরিস্থিতি তাদের দুজনকে জুড়ে দিয়েছে নইলে মিলার মতো মেয়ে এমন জায়গায় কখনোই থাকতো না আর না মুহিনের ছেলেটার এতো কষ্ট হতো। সবই কপাল। মিলার কান্নার আওয়াজে বাচ্চাটার ঘুম ভেঙে গিয়েছে। সেও কান্না শুরু করেছে। মিলা, মাহতাব একসাথে কাঁদছে। মুহিন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে টিভি ক্যাবিনেটের পাশে। কার কান্না আগে থামাবে বুঝতে পারছে না। মিলাকে ধমক দিয়ে কান্না থামাতে বলার আগেই সে উঠে এসে মাহতাবকে কোলে নিয়ে সোফায় বসে শান্ত করতে লাগলো। এখনো সে হেঁচকি তুলছে। কান্নার দমকে তার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠছে। পিঠের পিছনে সোফায় হেলান দিতেই পেঁপু শব্দ করে উঠলো একটা খেলনা টিয়া। মিলা টিয়াটা হাতে নিয়ে ছুড়ে মারলো মুহিনের পায়ের কাছে। কিছু বললো না সে।অপর পাশের সোফায় বসে একটু পর পর নিজের মাথার চুল নিজেই টানতে লাগলো।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে