#জোনাকিরা জ্বলে নিভে (পর্ব -৬)+ (পর্ব_৭)
#লেখিকা #রেহানা_পুতুল
অভ্র ফোন রেখে দিলে উরমি নিজেকেই প্রশ্ন করলো। কিসের চ্যালেঞ্জ নিল ভাইয়া কাজল আপুকে নিয়ে ? চিনেই বা কিভাবে?
জেসমিন বেগম বলি বলি করেও শুভ্র’র কাছে কাজলের বিষয়ে আশানুরূপ প্রসঙ্গটি তুলতে পারছেন না। এভাবে প্রায় পনেরদিন অতিক্রম হয়ে গেল।
তিনি এই ভিতরে একদিন সবার অলক্ষ্যে শহরে অবস্থিত স্বামীর সাথে আলাপ করলেন। শুভ্রের বাবা বিস্তারিত শুনে কোন আপত্তি করলেন না। আবার খুব যে পছন্দ হয়েছে তাও বললেন না।
শুধু জানালেন, শুভ্রের পছন্দ হলেই চলবে। জীবন তার। সুতরাং সিদ্ধান্ত ও তার। চাপিয়ে দেওয়ার মতো বিষয় নয় এটা।
জেসমিন বেগম শুনে আস্বস্ত হলেন অনেকটাই। উরমির সাথেও বিষয়টা নিয়ে আলাপ করলেন।
উরমি শান্তভাবে টেনে টেনে মাকে বলল,
আম্মু কিছুদিন পর ছোট ভাইয়াও লন্ডন থেকে আসবে। তখন অবধি অপেক্ষা করি আমরা। ভাইয়া আসুক। তখন বড় ভাইয়ার মত জেনে আমরা কাজল আপুর আম্মুর কাছে বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে যাব। এখন চুপ থাক। ছোট ভাইয়ার অনুপস্থিতিতে বড় ভাইয়া বিয়ে করবেনা। এটাতো নিশ্চিত।
তুই মন্দ বলিসনি। তবে শুভ্রের কেমন লাগে কাজলকে। এটাতো জানতে সমস্যা নেই। কি বলিস?
সেটার দায়িত্ব আমার উপর অপর্ণ করো জননী। এক সপ্তাহ সময় নিচ্ছি।
শুভ্রের মুঠোফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটি দেখতে পেয়ে নিজের অজান্তেই মনের গহীনে পুলক জেগে উঠলো। আকুল করা ব্যকুলতা থাকা সত্ত্বেও শুভ্র কখনোই কাজলকে অহেতুক ফোন করেনি একটি বারও। কোন না উপলক্ষ তৈরি করেই ফোন দিত। অতিরিক্ত আলাপ ও করেনি যেচে। যতই ভালোলাগুক কাজলকে। নিজের ব্যক্তিত্ববোধকে বির্সজন দিতে সে নিতান্তই অপারগ। কেটে দিল কাজলের ফোন। খানিক পরেই ব্যাক করলো।
হ্যালো শুভ্র ভাইয়া কেমন আছেন?
কাজলের নেশা জাগানিয়া কন্ঠ শুনে শুভ্রের ইচ্ছে করছে বলতে,
ভাইয়া বাদ দিয়ে শুভ বলবে জাস্ট। কিন্তু তা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। শুভর চরিত্রের সাথে এসব হ্যাংলামো একদম অশোভনীয়।
হ্যাঁ কাজল আছি। হঠাৎ তলব?
কেন আমি কি ফোন দিতে পারিনা আপনাকে?
অজস্রবার পারো। বাট তুমিতো খুব দরকার না হলে ফোন দাওনা। তাই বললাম। হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে বলল শুভ্র।
ভাইয়া আপনি কি ঢাকার জিন্দাপার্ক চিনেন?
না চেনার কি আছে? আমাদের ব্যবসার কাজে প্রায়ই আমার ঢাকায় যাওয়া হয়। বন্ধুরা সহ গিয়েছি কয়েকবার। কেন কাজল?
না আমার কয়েকজন ক্লাসমেট বন্ধু বলল খুউব সুন্দর নাকি এই লোকেশনটা। তাই জেনে নিলাম সত্যি নাকি ওদের বলাটা। তাহলে কখনো ঢাকায় গেলে এখানে যাব৷
আমার সাথে যাবে কাজল?
জানিনা।
আচ্ছা ঠিকাছে৷ যেদিন জানবে। সেদিন জানাবে। দেখি কি করতে পারি। রাখি বাই।
এই কয়দিনে কাজল টের পেয়েছে শুভ্রের অনুভূতি অনুরাগ। কিন্তু সে যে উপলব্ধি করতে পেরেছে, এটা শুভ্রকে বুঝতে দিচ্ছেনা। এদিকে শুভ্র ও জানেনা কাজল ও তাকে গোপনে চায়। হারাতে চায় গোপন অভিসারে। করতে চায় জোছনাবিলাস। কারণ কাজল তাকে বোঝার সুযোগটুকু দিচ্ছেইনা। কাজল আরো নিশ্চিত হতে চায় শুভ্রের বিষয়ে। কেননা ধনীর ছেলেদের ভালোলাগার রূপ বদল হওয়াটাই নরমাল গিরগিটির মতন।
উরমি ইনিয়ে বিনিয়ে নানাভাবে নানাকৌশলে শুভ্রের কাছ থেকে কাজলের বিষয়ে নিশ্চিত হলো।
মাকে জানাল গিয়ে,
ভাইয়াতো কাজল আপুকে খুওব পছন্দ করে।
কাজল করে কিনা এটা জানিস? বলল জেসমিন বেগম।
ওহ হো! ঠিক বলছ। এটাও জানা জরুরী। নয়তো এক পাক্ষিক প্রেম হয়ে যাবে এটা।
যা এটা জানার চেষ্টা কর।
এক বিকেলের অবসরে শুভ্রের চাচীর মত জানতে চাইলো তার মা। সে তিনহাত নাক সিঁটকে বলল,
পথ থেকে কুড়িয়ে আনা ধুতুরা ফুলকে যদি গোলাপ ভেবে ফুলদানিতে রাখতে রূচিতে না বাঁধে আপনাদের। তাহলে আমার আর কিইবা বলার থাকে ভাবি। আমার শুনতেই চিত্ত রি রি উঠলো। রুবানা গ্যাল বাঁকিয়ে চলে গেল অন্যদিকে।
জেসমিন বেগল মোটিভেটেড হয়ে গেলেন কিছুটা। রুবানা মনে হয় ঠিকই বলছেন। একবার ভেবে উঠলেন।
কাজলের সাথে সপ্তাহে একদিন দেখা হয় শুভ্রের। এটা নিয়মের মত হয়ে গিয়েছে। রোজ দেখতে ইচ্ছে করলেও সেটা কাজলের সামনে মুখ ফুটে প্রকাশ করেনা। কিন্তু আকার ইঙ্গিতে বুঝাতে চায় শুভ্র কাজলের প্রতি টান অনুভব করে। শক্ত করে হাত দুটো ধরে রাখতে চায় জনমভর।
এক অলস দুপুরে শুভ্র কাজলের কলেজের সামনের পথ ধরে অন্যদিকে যাচ্ছে কোন কাজের তাগিদে। মাঠের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল আনমনেই। দেখতে পেল কাজল ফুচকার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। একটি ছেলের সাথে হেসে হেসে ফুচকা খাচ্ছে।
পা চালিয়ে শুভ্র সেখানে গেল। ছেলেটা এখন নেই। অন্যদিকে চলে গিয়েছে।
ভাইয়া আপনি এই অসময়ে এখানে?
ভর দুপুরে কলেজের মাঠের একপাশে শুভ্রকে আকস্মিক দেখে জিজ্ঞেস করলো কাজল।
তোমাকে দেখেই এগিয়ে এলাম।বিল দিয়েছ?
না দিব।
আমি দিয়ে দিচ্ছি বলে শুভ্র দুই প্লেট ফুচকার দাম মিটিয়ে দিল।
কাজল বাধা দিয়েও পারলোনা।
তোমাকে না বললাম চোখে কাজল দিবেনা আমি না বললে। দিলে কেন?
আংশিক রাগত স্বরে জানতে চাইলো শুভ্র।
মন চেয়েছে। তাই দিয়েছি। আপনি দিয়েছেন বলেই শুধু আপনাকে দেখানোর জন্যই পরব। অন্য সময়ে পরতে পারবোনা। এটা কেমন কথা?
এটাই কথার কথা। একদম পরবেনা। পানিতে ভেসে উঠা মরা মাছের মতো করে রাখবে তোমার চোখ দুটোকে।
মেন্টালের মত বলছেন কেন আপনি। লাগবেনা আপনার কাজল। দিয়ে দিবে ফেরত। বিরক্ত গলায় বলল কাজল।
শুভ্রর খুউব ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে একটা চড় মারতে কাজলের বাম গালে। চুপিচুপি বাম হাতের পাঁচ আঙ্গুলকে মুঠোবন্দি করে ফেলল তৎক্ষনাৎ। মুহুর্তেই আবার ছেড়ে দিল আঙ্গুলগুলো।
কাজলের হাত ধরে কলেজের মাঠের পিছনে নিয়ে গেল শুভ্র। জিন্সের প্যান্টের পকেট থেকে দুটো টিস্যু বের করে নিল। নলকূপ থেকে ভাঁজ করা টিস্যুটি ভিজিয়ে নিল। নিজ হাতে কাজলের দুচোখের কাজল ঢলে মুছে দিল টিস্যু দিয়ে।
কাজল নিজের ভিতর ঘাপটি মেরে থাকা অদম্য কৌতুহলকে আর দমন করতে পারলোনা। হড়হড় করে জিজ্ঞেস করলো,
সমস্যা কি শুভ্র ভাইয়া? ক্লিয়ার করেন প্লিজ। সাইকো নাকি আপনি?
শুভ্র শিকারী চোখে কলেজের পিছনের চারপাশে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। দেখল বেশ ফাঁকা। সবাই ক্লাসের ভিতরে। কাজলের দুহাত ধরে শক্ত চোয়ালে বলল,
আমি তোমাকে ভালোবাসি। তাই কেউ তোমার কাজলটানা চোখের প্রেমে পড়ে যাক তা চাইনা। তুমি চাইলেই আমার হয়ে যেতে পার। তপ্ত মরুর বুকে এক পশলা বৃষ্টির মতো পড়তে পারো অবিরাম ধারায়।
কাজল ভাবলেশহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নরম গলায় বলল। আমিতো আপনাকে লাইক করিনা ওভাবে। আস্তে করে বলল কাজল।
আমিতো চোর, ডাকাত বা গুন্ডা নই কাজল। যে জোর করে ছিনিয়ে বিয়ে করব। তোমার চাওয়া পাওয়ার মর্যাদা অবশ্যই আমি দিব। তুমি না চাইলে কিছুই হবেনা। তবে জেনে রেখ। আমি কেবল তোমাকেই চাই। ক্লাসে যাও। লেট হয়ে যাচ্ছে।
শুভ্র উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলে হেঁটে চলে যাচ্ছে কলেজ প্রাঙ্গণের সবুজ চত্বর ছেড়ে৷
কাজল দাঁড়িয়ে থাকা থেকে জোর পায়ে শুভ্রের কাছে আসল৷ গা ঘেঁষে দাঁড়ালো ছোট্ট হাঁসের ছানার মতো।
আমি সারাজনম শুধু আপনার জন্যই দুচোখে কাজল পরতে চাই। আর কারো জন্যইনা। বলে এক দৌড়ে কলেজের ভিতরে চলে গেল।
শুভ্র আচমকা শুকনো মাটিতে আছাড় খাওয়ার মতো দাঁড়িয়ে গেল। যেন টাল সামলাতে পারছেনা। বারবার মনে করলো কাজলের বলা বাক্য দুটি। ভীষণ মন চাচ্ছে সেতারের বীণার মতো কাজলের এ কথাটি তার বুকের অতলে প্রতিধ্বনিত হতে থাকুক মুহুর্তের পর মুহুর্ত।
আমার কাজল বউ৷ পারলে তোমাকে এখন কোলে নিয়ে এভারেস্টের চূড়ায় উঠে যেতাম মনের আনন্দে।
কাজলের ক্লাসে একদম মন বসছেনা। কেমন যেন উদাস উদাস লাগছে। বিবাগী হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে তার। তসবিহর ন্যায় মনে মনে গোপনে জপতে লাগল,
আমার শুভ্র বর টা। আমার চির অসুখ টা। আমার সাইকোটা।
আজ অভ্র বাড়িতে এসেছে। সারাঘরজুড়ে উল্লাস আর উচ্ছ্বাস। যেন উৎসবমুখর কোন পরিবেশ। দুইদিন পর উরমি থেকে কাজলের বিষয়ে খোঁজ খবর নিল অভ্র।
উরমি বলল, আমার আইফোন কই ঘুষ হিসেবে?
তুই ঘুষ খাবি আমার বোন হয়ে ?
এই ভাইয়া ভালো হবেনা বলছি। অনেক সংগ্রাম করে করে তুমি আসা অবধি ভাইয়ার আর কাজল আপুর বিয়ে আটকে রেখেছি। এখন নয়ছয় করলে হবেনা।
আগে সফল হই। তারপর দিব বনু।
কিসের সফল?
আমি কাজলকে বিয়ে করবো।
উরমির মাথা চরকির মতো ঘুরতে লাগল। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,এ দেখি একটি ফুলে দুটি ভ্রমর। ত্রিভুজ প্রণয়।
উরমির ঝুঁটি করা চুলের মাথা ধরে টান মেরে বলল অভ্র ,
কোন প্রেমটেম না। কিছুই না। মুখ বন্ধ রাখ এখন। এটা অন্যরকম প্রতিশোধ।
চলবেঃ ৬
#জোনাকিরা_জ্বলে_নিভে
(পর্ব -৭ ও শেষ )
#লেখিকা #রেহানা_পুতুল
আমার কৌতুহলের মাত্রা লাগামহীন হয়ে যাচ্ছে ভাইয়া। নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছে। পুরো কাহিনী না বললে মুখ বন্ধ রাখা অসাধ্য। বমির মতো গড়গড় করে উগরে যাবে সব।
কাউকে বলবিনাতো? আমি আমার মতো করে সবার সামনে উপস্থাপন করবো কাজলকে বিয়ে করার বিষয়টা।
একদম না ভাইয়া। চামড়ার মুখে লোহার তালা দিয়ে দিব। টেল মি প্লিজ।
শুন প্রায় একবছর আগের কথা। অর্থাৎ আমি দেশের বাইরে যাওয়ার একমাস আগের ঘটনা। আমিনুল নামের পরিচিত এক ছোট ভাইয়ের সাথে একদিন দুপুরে তাদের বাড়িতে যাই। তার কিছুক্ষণ পরে কাজল তাদের ঘরে ঢোকে।
আমি আমিনুলকে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই জিজ্ঞেস করি মেয়েটা কেরে?
সে জানাল। নাম কাজল। তাদের লাগোয়া পাশের বাড়ির মেয়ে। তার ছোট বোনের ক্লাসমেট। এসএসসি দিবে একসাথে। পড়াশুনার কোন কারণেই গিয়েছে তাদের ঘরে। সব সময় যায়। কথা প্রসঙ্গে আমাকে আমিনুল আরও জানাল কাজলকে সে ভালোবাসে। কিন্তু কাজলের কাছে সেই প্রশ্রয়টুকু পাচ্ছেনা। কাজল যত তাকে ইগনোর করছে। ততই নাকি তার আকাঙ্খা বেড়ে দিগুণ হয়ে যাচ্ছে কাজলের প্রতি।
তার একটু পরেই আমিনুল বলল,
ভাই আপনি বসেন। আমি গোসল সেরে আসি। একবারে লাঞ্চ সেরে বের হয়ে যাব। আম্মু রান্না করছে।
এই বলে সে চলে গেল।
আমি একা একা বোর হচ্ছি। তাই তাদের বাড়ির পিছনের দিকে একটু হাঁটার জন্য বের হলাম। কয়েক পা এগোতেই চোখে পড়লো আমিনুল একটা আম গাছের আড়ালে কাজলের হাত ধরে কি যেন বলছে। আর কাজল হাত ছাড়াবার জন্য চেষ্টা করছে৷ এক সময়ে তা জবরদস্তি পর্যায়ে চলে যায়। আমি কাজলকে তার থেকে সেভ করার জন্য তাদের সামনে গেলাম। কাজল আমাকে খেয়াল করেনি। সে পায়ের স্যান্ডেল খুলে তাকে বাড়ি মারতেই সেটা আমার গায়ে এসে লাগে৷ আমিনুল আমাকে দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। এবং খুব নারভাস হয়ে ক্ষেপে যায় কাজলের উপর। আমিনুল ছিল স্বভাবে কিছুটা উগ্র মেজাজের। আমি তাকে সরিয়ে দিই।
কাজল আমাকে সর্যি বলার পরিবর্তে আমার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। আমি কিছু বলতে গেলাম। কিন্তু সেই শুনলইনা। খুব ভয়ানকভাবে আমাকে ইনসাল্ট করেছে ছেলে মানুষের জাত তুলে।
আমি বিমূঢ় হয়ে গেলাম ঘটনার আকস্মিকতায়। আবার মেয়েটার কথার দৃঢ়তা আর চরিত্রের সততা দেখে ভালো ও লেগে গেল।
তখন তাদের ঘরে এসে আমিনুলকে সব বলে বললাম,
এই মেয়ে জীবনেও তোমাকে বিয়ে করবেনা। মনে রেখ।
শুনে ও বলল,
শপথ করে বলছি ভাই। কাজলকে আমি কারোই হতে দিবনা। যদি আমি না পাই।
চিন্তা করলাম এ ছেলে যে ঘাড়ত্যাড়া। সত্যি সত্যিই এ মেয়ের বিয়ে সারাজীবন আটকে রাখবে। আর আমার সাথে মেয়েটি ভুল আচরণগুলো ভুল করেই করেছে। মাথা ঠিক রাখতে পারেনি আমিনুল তাকে ফোর্স করে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করাতে। ওর স্থানে আমি হলেও হয়তো এমনটাই করতাম।
হঠাৎ মাথা খেলে গেল। একটু হেয়ালি করে বললাম,
যদি আমি বিয়ে করি মেয়েটাকে?
শুনেই বলল,
বড় ভাই আপনি করলে সাত খুন মাফ। আমার প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে যাবে৷
এর অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে। কেন আমিনুল আমাকে এত বেশী সমীহ করে। সেটা আজ থাক। অন্য সময় বলল তোকে।
তখন তাকে বললাম। আমিতো বাইরে চলে যাচ্ছি। তাহলে তুই ওর বিষয়ে সব খবর রাখবি। আর নিজেও তার পথ থেকে সরে যাবি। একবাক্যে রাজী হয়ে গেল আমিনুল ।
কাজলের লাস্ট বিয়ে ভাঙা ও ভাইয়াকে ফোন করা এগুলো সব আমিই করিয়েছি আমিনুলকে দিয়ে। বুঝলি। আর কাজলের ও সেই বিয়েতে অমত ছিল। আমি না বললেও এমনিতেও তার বিয়ে হতে দিতনা আমিনুল।
চিন্তা করলাম ভাইয়া এসব নিয়ে কাজ করে। আর যেহেতু আমিই বিয়ে করবো। তাই আমাদের ঘরেই যাওয়া হোক কাজলের। কারণ আমার বিশ্বাসই ছিল ভাইয়া বাড়ি ছাড়া আর কোথাও নিবেনা কাজলকে। কিন্তু চাচীর জন্যতো তার হোস্টেলে উঠতে হলো।
উরমি থম মেরে রইলো কিয়ৎক্ষণ। অভ্রর মুখপানে চেয়ে,
আমার মনে হয় কাজল তোমাকেও বিয়ে করতে রাজী হবেনা। আর মধুর প্রতিশোধ ও নেওয়া হবেনা। রাজী হলে ভাইয়ার সাথে হবে। সিচুয়েশন তাই নির্দেশ করে কিন্তু।
আরেহ নাহ। বিনা অপরাধে তার জুতার বাড়ি খাব আমি। আর ভালোবাসা পাবে ভাইয়া। তা হয়না। আমি কাজলের সাথে দেখা করবো। আমি ছাড়া অন্য কেউ কাজলকে বিয়ে করলে আমিনুল তাকে শান্তিতে থাকতে দিবেনা।
এটা হলো খোঁড়া লজিক। বললেই হলো নাকি৷ আচ্ছা শুনো। বিনা ভিজিটে বুদ্ধি নিয়ে নাও। তুমি একা বাইরে তার সাথে মিট করতে যেওনা। নয়তো তোমার গায়ে স্যান্ডেল আবার উড়ে আসার সম্ভাবনা প্রবল। তোমার প্রতি তার কোন ফিলিংস নেই। তাই বলছি কি। আমাদের বাড়িতে তাকে ডেকে আনুক ভাইয়া। সবার সামনে তোমাকে দেখলে কিছুই করবেনা। বিষয়টা সহজ ও হতে পারে। হয়তো ভালো ও লাগতে পারে৷
গুড় আইডিয়া। যাই আম্মুকে বলি।
ইয়েস বস। তাই করেন যান। আমার কোন সমস্যা নেই। কাজল আপুকে ভাবি হিসেবে পেলেই আমি হ্যাপি।
অভ্র জেসমিন বেগমের নিকট প্রসংগক্রমে কাজলকে দেখার আবদার করল। শুভ্র’র কানে কথাটা যেতে দেরী মাত্র। উৎফুল্ল হয়ে বের হয়ে গেল কাজলকে আনার জন্য হোস্টেল থেকে । হবু ভাবিকে দেখার অধিকার অভ্রর রয়েছে। এই ভেবেই কাজলকে হোস্টেল থেকে তার সাথে বাড়িতে নিয়ে আসল। কাজল ও শুনে বুঝতে বাকি রইলোনা শুভ্র আমাকে দেখাতেই নিয়ে যাচ্ছে ছোট ভাইকে।
কাজল জেসমিন বেগম ও রুবানাকে সালাম দিল। নাস্তা করলো সবার সাথে। উরমি একটা দামী পারফিউম দিল কাজলের হাতে। ধরো ছোট ভাইয়ার পক্ষ থেকে ছোট্ট একটা প্রীতি উপহার তোমার জন্য।
ধন্যবাদ বলে লাজুক হাসি দিয়ে পারফিউমটি হাতে নিল কাজল।
শুভ্র কাজলকে ঘরে দিয়েই বের হয়ে গেল। হবু বউ আর পরিবারের সামনে থাকতে কেমন যেন সংকোচ হচ্ছে শুভ্রের মনে।
অভ্র কইরে বাবা। কাজল মেয়েটাকে দেখবি আয়।
মায়ের ডাকে অভ্র তার রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে এলো। কাজল সালাম দিয়ে অভ্রর মুখের দিকে চেয়েই তব্দা খেয়ে গেল।
আপনি এখানে? বাকরুদ্ধ কন্ঠে প্রশ্ন করলো কাজল।
আমি কোথায় থাকলে তুমি খুশি হতে? বলল অভ্র।
কাজল আমতা আমতা করতে লাগল। ভীষণ লজ্জিত ও অনুশোচিত হচ্ছে। সারামুখ কৃতজ্ঞতার আবরণে ছেয়ে গিয়েছে। ভাবছে এই বুঝি নিয়তি। বিনা দোষেই ভুল বুঝে যে ছেলেটাকে এক দুপুরে আচ্ছামতে অপমানিত করলাম। আমিনুলকে জুতা মারতে গিয়ে তার গায়ে গিয়ে পড়ল। ভ্যাগ্য আমাকে তাদের ঘরেই নিয়ে আসল। আশ্রয় দিল। কি আশ্চর্য! কি কাকতালীয়!
কাজল হাত থেকে সেন্টার টেবিলের উপরে পারফিউমের শিশিটা রেখে দিল। সোফায় বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। উরমি চোরাচোখে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে গোয়েন্দার মতো।
জেসমিন বেগম বললেন,
এটা আমার ছোট ছেলে অভ্র৷ তুমি তাকে আগে থেকে চেন নাকি?
জ্বি আন্টি। আচ্ছা আমি এখন আসি। পড়া আছে আমার। পরে আবার আসব।
কেউই আর কিছু বলতে পারলোনা। কাজল হনহন পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল মাথায় পুনরায় ওড়না টেনে দিয়ে৷
শুভ্র এসে কাজলকে না দেখে জানতে চাইল চলে গেল কেন।
জেসমিন বেগম যতটুকু দেখেছেন। জানিয়েছেন শুভ্রকে।
ওহ। চিনতেই পারে। কার কখন কার সাথে কিভাবে চেনাজানা হয় তা কেউই জানেনা। বলেই হেসে উড়িয়ে দিল শুভ্র।
আচ্ছা কাজলের সাথে শুভ্রের বিয়ে হলে কেমন হবে অভ্র? উৎসুক গলায় হুট করেই জানতে চাইলো জেসমিন বেগম।
দারুণ মানাবে আম্মু। বলল উরমি।
অভ্র কঠিন দৃষ্টিতে চাইলো বোনের দিকে৷ চট করেই বলল,
আম্মু আমি কাজলকে বিয়ে করতে চাই।
হঠাৎ তুই করতে চাস কেন? বলতো। জেসমিন বেগম অবাক চোখে জিজ্ঞেস করলে।
শুভ্র ভার মনে গালে হাত দিয়ে বসে আছে সোফায়। দৃষ্টি মোবাইলের স্ক্রিনে হলেও পূর্ণ মনোযোগ মা ও অভ্রর কথোপকথনের দিকে।
আম্মু আমি কাজলকে পছন্দ করি বাইরে যাওয়ার আগে থেকেই। কাজল ও আমাকে চিনে। তাতো দেখতেই পেলে।
কিন্তু তুই এক তরফা ভালোবাসলে হবে নাকি? আদেশের সুরে বলল শুভ্র৷
জেসমিন বেগম বললেন, তোরা দুজনেই কাজলকে পছন্দ করিস। কিন্তু কাজল যাকে পছন্দ করবে তার সাথেই বিয়ে হবে। এটার ফায়সালা আজ এক্ষুনি হবে। এই উরমি ফোন দে কাজলকে। লাউড স্পিকার চালু রাখবি। যেন সবাই শুনতে পাই ওর কথা।
উরমি কাজলকে ফোন দিল। লাউড স্পিকার অন রয়েছে।
কাজলকে আয়েশা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,
শুনো মা। তোমাকে আমার দুই ছেলেই পছন্দ করে। বিয়ে করতে চায়। এবার তুমিই বল তুমি কাকে পছন্দ কর।
কাজল থতমত খেয়ে গেল। মরা কন্ঠে বলল,
আন্টি এখুনি বলতে হবে? পরে বললে হয়না?
নাহ হয়না। কোন পরে টরে নেই। এখুনি সাফ সাফ জানিয়ে আমাকে ঝামেলা মুক্ত করো।
কাজলের গলা ধরে আসছে। তবুও কাঁপানো অসহায়ের সুরে বলল,
আন্টি আমি আপনার মতো মায়ের সেবা করার সুযোগ পাব। এটাই আমার কাছে বড় পাওয়া। তবুও যেহেতু একজনকে বাছাই করতেই হবে। তবে বলছি। আমি আপনার সংসারের বড় পুত্রবধূ হয়েই বাঁচতে চাই।
আলহামদুলিল্লাহ মা। আলহামদুলিল্লাহ। বেঁচে থাকো। যোগ্য উত্তর দিলে তুমি। আমার কলিজাটা মাটির কলসির পানির মতো ঠান্ডা হয়ে গেল। এবার রাখ তুমি।
অভ্র রক্তবর্ণ চোখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাকি সবাই বেশ উচ্ছ্বসিত। শুভ্র মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,মা দোয়া করো আমার জন্য।
সন্ধ্যার পরেই জেসমিন বেগম শুভ্রের থেকে কাজলের মায়ের নাম্বার নিল। ফোন দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিল। তিনি এক পায়ে রাজী হয়ে গেলেন।
অভ্রর অসন্তুষ্টি দিয়ে জেসমিন বেগম ও বাকিদের কিছুই যায় আসেনা৷ কারণ তার চাওয়াটা ছিল অনুচিত ও অযৌক্তিক।
অভ্র আগেই শুনেছে উরমির কাছে, কাজল কোন হোস্টেলে উঠেছে। সেখানে চলে গেল। কাজলকে ডেকে এনে অনেক আকুতি মিনতি করলো তাকে বিয়ে করার জন্য। কিন্তু কোন সুফল হলনা। জোর করে এ পৃথিবীতে সব কেড়ে নেওয়া গেলেও কারো মন নেওয়া যায়না স্বেচ্ছায় না দিলে।
অভ্র কত স্বপ্ন দেখেছে গত এক বছর ধরে কাজল নামের মেয়েটিকে নিয়ে। কত কষ্ট করে ফন্দি এঁটে নিজের ঘর পর্যন্ত কাজলকে আনল। তবুও পাচ্ছেনা। শুভ্র পেয়ে যাচ্ছে৷ ভেবেই ক্ষোভে ফুঁসে উঠছে অভ্র। একদিকে প্রিয় বড় ভাই। তাই চাইলেও ভাইয়ের কোন ক্ষতি করার কথা ভাবতে পারছেনা।
কাজলের বিয়ের দিন ধার্য করা হয়েছে। সব কেনাকাটা শেষ বর পক্ষের। কাজলের মাও তার মতো করে প্রস্তুতি নিল স্বামীর সাহায্য নিয়ে। কাজল মায়ের কাছে থাকবে বিয়ের সময়। সেখান থেকেই তাকে বধুবেশে নিয়ে আসবে বর শুভ্র।
কাজল ও আনন্দে দিশেহারা। বিয়ে ও হয়ে যাবে৷ পড়াশোনা সম্পন্ন করে ভালো কোন একটা চাকরি করবে। নিজেকে আত্মনির্ভরশীল করে তুলবে। সুখের ফল্গুধারায় ভেসে যাচ্ছে কাজলের তিরতির করে দুলতে থাকা অনুভূতিগুলো।
শুভ্র কাজলের সাথে রোজ কথা বলে৷ রোজ দেখা করে। অপেক্ষার প্রহর যেন না ফুরিয়ে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে তার জন্য।
আজ বিকেলে কাজলের মেহেদী সন্ধ্যা ও গায়ে হলুদ। দুটো অনুষ্ঠান একদিনেই হবে। সকালেই সে হোস্টেল থেকে কাপড়চোপড় গুছিয়ে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়েছে। চোখেমুখে রাজ্যের অস্থিরতা। পিচঢালা পথ পার হবে। ঠিক এমন সময় একটা দ্রুতগামী লোকাল বাস কাজলকে ধাক্কা মেরে চলে যায়।
কাজলের উঠার শক্তিটুকু নেই। গলগল করে মাথা ফেটে রক্ত যাচ্ছে। পথ দিয়ে যাওয়া মানুষ কাজলকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। তার মোবাইলের ডায়াল নাম্বার চেক করে ফোন দেয় তার মাকে । তার মা রেনুকা ছুটে আসে উম্মাদের ন্যায়। সে কাজলের ফোন থেকে শুভ্রের নাম্বার বের করে শুভ্রকে ফোন দেয়। শুভ্র ঘোড়ার বেগে ছুটে আসে।
মাথায় অতিরিক্ত আঘাত ও রক্তক্ষরণের জন্য কাজল ঘন্টা না পেরোতেই বিদায় নেয় এই নশ্বর ভুবনের মায়াজাল থেকে৷
তার আগে নিবুনিবু চোখে শুভ্রের দিকে চাইল একপলক। শুভ্র কাজলের হাত ধরে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিল ছোট বাচ্চার মতন।
কাজল দোহাই তোমার। আমাকে ছেড়ে যেওনা। সত্যি মরে যাব তোমাকে ছাড়া। একদম বাঁচবোনা। আমাকে একা করে এভাবে যেওনা কাজল বউ আমার।
কাজল অস্পষ্ট ভাঙা গলায় বলল,
আমার জীবনে সবকিছুই কাছে এসেই দূরে চলে যায়। এই পাই এই হারাই। জোনাকির মতো। এই জ্বলে এই নিভে। আম্মুর কাছে থাকতে গিয়েও থাকা হলনা। আপনার কাছে থাকতে গিয়েও থাকা হলনা আমার। আপনি নিজের দিকে লক্ষ্য রাখবেন।
কাজলের মা দুইহাত তুলে আর্তনাদ করতে লাগলো। স্রস্টার কাছের ফরিয়াদ করল মেয়ের জীবন ভিক্ষা চেয়ে।
একমাত্র ছোট ভাই আপারে… আমার কাজলবুরে…ওরে আমার কাজলা দিদিরে…আল্লারে বলে মেঝেতে লুটিয়ে সারা দুনিয়া এক করে ফেলছে।
তার আত্মচিৎকারে গোটা হাসপাতালের আঙিনা ভারি হয়ে উঠেছে৷
আম্মু… বলে কাজল মায়ের কোলের উপর হাত রাখল। ধীরে ধীরে তার দুচোখ বুঁজে আসছে ক্ষয়ে আসা মোমের মতো। শুধু মনে পড়ছে, কিছুদিন আগে কোথায় যেন তার প্রিয় এক ঝাঁক জোনাকিপোকা জ্বলছে আর নিভছে। সেগুলো ধরার তার কি চেষ্টা। এরপর কে এসে যেন তাকে সেগুলো ধরে দিল৷ পলকেই তার মনটা রঙিন প্রজাপতির ন্যায় রঙিন হয়ে গেল।
( সমাপ্ত )