#জোনাকিরা জ্বলে নিভে (পর্ব -৪)
#লেখিকা #রেহানা_পুতুল
শরতের পড়ন্ত বিকেল। আকাশ জুড়ে শুভ্র মেঘের আনোগোনা। তার বুক চিরে দু’ডানা উড়িয়ে নীড়ে ফিরে যাচ্ছে এক ঝাঁক মুক্ত পাখি। ঝিমিয়ে পড়া অবসন্ন প্রকৃতি। কিছু বৃক্ষ পত্র বিবর্ণ রঙ ধারণ করেছে। ঘরের কোনে নিমডালে বসে আছে নাম না জানা অচেনা নিঃসঙ্গ একলা পাখিটি।
আহত স্থির দৃষ্টিতে কাজল পাখিটির দিকে চেয়ে রইলো। যেন বহুযুগ পাড়ি দেয়া এক ঋষি ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে। এক সমুদ্র বিষন্নতা তাকে পেঁচিয়ে ধরেছে সর্পের ন্যায়। কি করবে কোথায় যাবে ভেবে কুল পাচ্ছিনা।
আপা ভাইজান তার রুমে আপনাকে ডাকতাছে।
জরিনার ডাকে সম্বিৎ ফিরে এলো কাজলের। শান্ত অবোধ নিষ্পাপ শিশুরটির মতো শুভ্রের রুমে ঢুকল দরজা ঠেলে।
কাজল বিষাদগ্রস্ত মুখে মুখ নামিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে শুভ্রের সামনে।
তোমার নাম কাজল?
জ্বি।
এত আড়ষ্ট হয়ে থাকতে হবেনা। রিলাক্স হয়ে চেয়ারে বসো।
কাজল বসল কাঁচুমাচু করে। এদিক ওদিক চাইল।
কি দেখছ? কেউ দেখলে কি মনে করবে এটা? কিচ্ছু মনে করবেনা। বসে থাক।
শুনো পৃথিবীতে কার জীবনে কখন কি ঘটবে। তা আগে থেকে কেউই জানেনা। যদি জানতো তাহলে পৃথিবীতে কোন দূর্ঘটনাই ঘটতোনা। সবকিছু ঠিকঠাক ভাবেই চলতো সবার ইচ্ছেনুযায়ী। তোমার সম্পর্কে সব শুনেছি।
সেজন্যই ডেকেছি তোমাকে। তোমার কি কোথাও নিরাপদভাবে থাকার জায়গা আছে?
আম্মুর সাথে থাকা ছাড়া আর কোথাও তেমন জায়গা নেই।
কিন্তু শুনলাম সেখানে নাকি সেই ভদ্রলোকের ছেলে তোমাকে ডিস্ট্রাব করে?
হুম খুউব করে।
তাহলে? তোমার ফুফুর বাড়ি থাকলেওতো বিয়ে দিয়ে দিবে।
হুম ভাইয়া।
আচ্ছা আমি যদি কোথাও তোমার থাকার ব্যবস্থা করি থাকবে?
কোথায়? নেত্রপল্লব উল্টিয়ে জানতে চাইলো কাজল।
ধরো তোমার কলেজের পাশাপাশি কোন ছাত্রী হোস্টেলে।
কাজলের মুখের মলিনতা হালকা হয়ে গেল শুনে। বলল,তাহলে আম্মুর সাথে আলাপ করতে হবে। খরচের বিষয়ে।
তুমি রাজী কিনা আমার প্রস্তাবে। এটা বল আগে?
কাজল ক্ষণ সময় চিন্তা করে দেখল তার জন্য এ মুহুর্তে এর চেয়ে ভালো অপশন আর দ্বিতীয়টি নেই। বলল। আমি রাজী ভাইয়া।
গুড়। এইতো বুদ্ধিমতী মেয়ে। শোন আমাদের বাসায় তুমি এটা বললে সমস্যা নেই। কিন্তু আমি যে ব্যবস্থা করবো। তা একদম বলবেনা। বলবে তোমার আম্মু ঠিক করেছে। এবার আসি তোমার খরচের বিষয়ে। তোমার আম্মু যতটুকু দিতে পারে দিবে। এছাড়া বাকি খরচ আমি বহন করব প্রতি মাসে। ভরসা রাখতে পার আমার উপর।
কাজল বাকরুদ্ধ হলো শুভ্রর মহানুভবতায়। মুখ দিয়ে কিছুই বলতে পারছেনা। বাক্যহারা কাজলের দিকে চেয়ে শুভ্র চওড়া হাসি দিয়ে ফেলল। বলল জানি তোমার মাথায় কি ঘুরপাক খাচ্ছে। এবং এটাই স্বাভাবিক। বিষয়টাকে ইজিভাবে নাও। স্রস্টা কারো না কারো মাধ্যমে মানুষের মনের আশা পূর্ণ করে৷ তুমি বিয়ে বসতে চাওনি। তাই হলো। পড়াশোনা করতে চাচ্ছ। তাই হবে। তোমার এসবের জন্য আমি উছিলা মাত্র। জাস্ট এইই।
কাজলের আঁখিকোন ভিজে উঠল। টলমল দুএক ফোঁটা অস্রু টপটপ করে ঝরে পড়ল বুকে মেলে থাকা ওড়নার উপর।
তুমি এখন যেতে পারো কাজল।
কাজল বসা থেকে উঠে গিয়ে পা বাড়াল বের হওয়ার জন্য।
কাজল শুনো।
কাজল পা থামিয়ে দাঁড়ালো।
মুখটাকে আর ধূসর করে রেখনা। যা ঘটে গিয়েছে তোমার জীবনে। ধরে নাও এটা তোমার ভালোর জন্য। মনে রাখবে,
অনেক সময় খারাপ কিছুর ভিতর দিয়েও ভালো কিছুর সূচনা হয়।
কাজল সজল দুটি চোখে শুভ্রের মুখপানে একপলক তাকালো পলকহীনভাবে।
শুভ্র হাসি হাসি মুখে বলল,
নাম কাজল। কিন্তু তোমার দুচোখ দেখে মনে হয় ভুলেও কোনদিন কাজল পরনি চোখে। মরা মানুষের চোখের আকার ধারণ করে আছে। অবশ্যই কাজল পরবে চোখে।
কাজল নিরবে প্রস্থান করলো শুভ্রের রুম থেকে। শুভ্র অবিকল চেয়ে রইলো কাজলের হেঁটে যাওয়ার দিকে।
তার কেবলই মনে হচ্ছে,
কাজল নামের মেয়েটি যেন অবিরাম বয়ে চলা চপল ঝর্না। আচমকা পাহাড় ধসে তার বয়ে চলা থেমে গিয়েছে। তার গায়ের উপর থেকে সেই পাহাড় কেউ সরিয়ে দিলেই সে খিলখিল করে হাসবে। মেতে উঠবে দুরন্তপনায়। কলকল করে বয়ে যাবে স্রোতস্বিনী নদীর মতই। নুপুর পরে রিনিঝিনি ছন্দে ঘুরে বেড়াবে সারা বাড়ির আঙিনা।
কাজল পুকুর ঘাটে গিয়ে বসল। মায়ের কথা মনে পড়ছে তার। ভীষণ কথা বলতে ইচ্ছে করছে। তার ভাঙাচোরা একটা মোবাইল ছিল। কিন্তু সে মোবাইল ফুফুদের বাড়িতে। বিয়ের দিন বউ সেজে কাচারি ঘরের সামনে স্টেজে গিয়ে বসার আগে ফুফু ফোন নিয়ে নিল।
এক দরিয়া ঘৃণা নিয়ে নিয়ে মনে করলো,
তোমরা তাদের জিনিসগুলো আমার কাছ থেকে নিতে আসলে। কিন্তু আমার মোবাইলটা আনলেনা। তোমরা স্বার্থপর। তোমরা মানুষরূপী অমানুষ। তোমরা পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট। আহ জনম আমার! নিজের বাড়ি বাদ দিয়ে নানার বাড়ি। তার পরে আম্মুর নতুন শশুর বাড়ি। এর পরে ঠাঁই হলো ফুফুর বাড়ি। এখন এদের বাড়ি। এরপরে হোস্টেল। তারপরে আরো কত ঘাটে যে আমার জীবনতরী ভিড়বে তা কেবল নিয়তিই জানে।
শুভ্র উঠে গিয়ে তার চাচী ও মাকে কাজলের বিষয়ে জানাল। তার চাচী রুবানা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বলল,তাহলে ওর মা যেন যত দ্রুত সম্ভব হোস্টেলে উঠার ব্যবস্থা করে মেয়েটির। বর্তমানে নিত্যদব্রের দাম যেভাবে বাডছে একজন মানুষ পুষতেও খবর হয়ে যায়।
হ্যাঁরে শুভ্র? তো মেয়েটি কি তার মাকে বিষয়টি জানিয়েছে?
এমন ত্যানা প্যাঁচায় কেন এই চাচীটা। রুষ্ট কন্ঠে মনে মনে বলল শুভ্র।
চাচী জানাবে বলছে। আর আগেও নাকি এমন কিছু মা মেয়ের মাঝে অল্পস্বল্প আলাপ হয়েছে৷
ও আচ্ছা। হলেতো খুবই ভালো।
পরেরদিন কাজল উরমিকে বলল,
আমার আম্মুর সাথে একটু কথা বলার দরকার। একটা মোবাইল দিতে পারবেন আপু?
হোয়াই নট। আলবৎ পারব। বাট নাম্বার মুখস্থ আছে তোমার আম্মুর?
এই একটি মোবাইল নাম্বারই শুধু আমার মনে থাকে। মুখস্থ থাকে নামতার মতো। বলে আলতো হাসলো কাজল।
আমার মোবাইলে ব্যালেন্স এম্ফটি। ভাইয়ার ফোন আনি। দাঁড়াও এখানে। মোবাইল এনে দিয়ে উরমি অন্যদিকে চলে গেল। কাজল তার মাকে ফোন দিল।
সালাম দিতেই তার মা রেনু কেঁদে উঠল। অনগর্ল বলতে লাগল,
তোর ফুফু আমার সাথে অকথ্য ভাষায় কথা বলেছে। তোর নাম্বারে অনেকবার ফোন দিয়েছি। কেউই রিসিভ করেনি। পরে রিসিভ করে জানাল ফোন তাদের কাছেই আছে। আম্মু তোর মোবাইল চেয়েছি। বলল দিবেনা। এদের বাড়ির ঠিকানা চেয়েছি। তাও দেয়নি। আমাকেও কড়াভাবে নির্দেশ দিল তার শশুর বাড়ি যেন ভুলেও পা না রাখি। তুই আমাকে ঠিকানা দে মা। আমি কালই আসব তোকে দেখতে। তোর কি অবস্থা বল। বিয়ে বন্ধ করলো কে?
জানিনা আম্মু বলে,
কাজল বিস্তারিত সব জানাল তার মাকে । শুনে তার মা স্বস্তির সুরে বললেন, আল্লাহ সেই ছেলেটাকে নেক হায়াত দারাজ করুক। তার মাকেও সুস্থতার সাথে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখুক। যিনি এমন মহৎ সন্তান গর্ভে ধারণ করেছে৷ আমি কালই আসব মা। আচ্ছা আম্মু বলে কাজল ফোন রেখে দিল।
উরমিকে খুঁজে না পেয়ে কাজল নিজেই শুভ্রের রুমে গেল মোবাইল দেওয়ার জন্য। দেখে খালি রুম। বিছানা এলোমেলো। শুভ্র নেই। জরিনা ব্যস্ততার জন্য মনে হয় শুভ্র ভাইয়ার রুম বিছানা গোছাতে পারেনি। কাজল যতটুকু পেরেছে শুভ্রর পুরো রুম গুছিয়ে দিয়েছে। ফুফুর বাড়িতে সবাই ঘুম থেকে উঠলে তার বিছানার চাদর গোছাতে হতো। এটা এখন অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। হাত নিশপিশ করতে থাকে সেই অভ্যাসের কাজটা করতে না পারলে।
শুভ কিছুসময় পরে রুমে এলো। পরিপাটি বিছানার পরিবর্তিত রূপ দেখে আঁচ করতে অসুবিধা হলনা এটা কাজলের কাজ। মোবাইল দিতে এসে গুছিয়ে দিয়ে গেল। নয়তো জরিনা এভাবে চাদর গুছিয়ে রাখেনা। আর উরমিতো নিজের বিছানার চাদর ও ভুলে গোছায়না।
আপন মনেই ঠোঁটের কোনে চওড়া হাসির রেখা ফুটে উঠল শুভ্রর। কাজলের প্রতি ভালোলাগা অনুভব করলো। মোবাইল হাতে নিয়ে কাজল ও তার মায়ের আলপচারিতা শুনল। তার মোবাইলের রেকর্ড অপশন সবসময় অন থাকে। অর্গানাইজেশনের বিভিন্ন কাজের সুবিধার জন্য এটা চালু রাখতেই হয়। শুভ্রকে নিয়ে কাজলের মায়ের হৃদ্যতাপূর্ণ কথাগুলোয় মনটা ভরে উঠল। ভাবল একজন মহৎ হৃদয়ের মানুষই কেবল আরেকজন মহৎ মানুষকে মূল্যায়ন করতে পারে। কাজলের প্রতি ভালোলাগাটা আরেকটু গাঢ় হলো শুভ্রের অন্তরের।
পরেরদিন হন্তদন্ত হয়ে কাজলের মা শুভ্রদের বাড়িতে গেল। সেখানে মেয়ের সাথে সারাদিন কাটাল। একমাত্র মেয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের নিশ্চিত আশা দেখতে পেয়ে তার বুকের ভিতরটা থৈথৈ করে নেচে উঠল। দুপুরে ভরপুর খেল শুভ্রের মায়ের জোরাজোরিতে। তাদের আতিথেয়তায় মন ভরে গেল কাজলের মা রেনুকার। শুভ্র তাকে স্টেশন পর্যন্ত গিয়ে গাড়িতে তুলে দিল।
_____
নির্জন নিশুতি রাত। কাজলের দুচোখ থেকে কেউ যেন ঘুমকে চুরি করে নিয়েছে আজ। কারণ তার মা চলে গেল বলে। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ, প্রিয় আশ্রয়, প্রিয় নির্ভরতার কাঁধ মা। ভাগ্যের করুণ পরিহাসে কাজল সেই মায়ের থেকে কতদূরে। মা থেকেও মায়ের আঁচলতলে ঘুমাবার সৌভাগ্যটুকু নেই তার।
কাজল চুপিচুপি বিছানা থেকে নামল। বিড়াল পায়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। দরজা খুলে নিঃশব্দে পা রাখল ঘরের বাইরে। কাজলের নয়নদুটি জ্বলজ্বল করে উঠলো। আকাশভেঙে থরে থরে চাঁদের আলো মাটির কোলে আছড়ে পড়েছে। কি অপূর্ব! কি মোহনীয়! থইথই করা জোছনার মনোহারিণী রূপের মাঝে কাজল দেখতে পেল অদূরে বেতগাছের ফাঁকে কয়েকটি জোনাকিপোকা। তারা কি অপার্থিব আনন্দে রাতের ঘন আঁধারে মিটমিট করে জ্বলছে আর নিভছে। জোছনা ও জোনাকিপোকা কাজলের অসম্ভব ভালোলাগে! মা রেনুকার সাথে কতরাত জেগে জেগে এই জোনাইপোকার নাচন দেখেছে। ছোট ভাই রাজনকে নিয়ে কত ধরেছে এই জোনাই।
ছোট্ট একটি প্রাণী। অথচ তার কি আশ্চর্য ক্ষমতা। কেমন করে মানুষকে ঘোরে ফেলে দিতে পারে। তাদের চারপাশ ঘেঁষে এক অদ্ভুত মায়াবী আলো তৈরি হয়। কাজল সম্মোহনী চোখে এগিয়ে যায় সেদিকে। বিবশ হয়ে ধরার চেষ্টা করে।
বিদুৎ চলে যাওয়াতে শুভ্রের হাঁসফাঁস লাগে। সে উঠে গেল বাইরে একটু হাঁটার জন্য। দরজা খোলা দেখে সব রুমে উঁকি দিল। দেখল সবাই গভীর ঘুমে বিভোর হয়ে আছে। কিন্তু কাজল নেই। কিঞ্চিৎ ভড়কে যায় শুভ্র। সে উঠানে গিয়ে দেখতে পেল কাজল দুহাত দিয়ে জোনাকিপোকা ধরার চেষ্টা করছে। নিরব পায়ে কাজলের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল শুভ্র।
চলবে,,