#জোনাকিরা জ্বলে নিভে
#পর্বঃ১
#রেহানা_পুতুল
দফায় দফায় মার খেয়েও ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিজের বিয়েকে থামাতে পারলোনা মেয়েটি। অতিরিক্ত কান্নায় চোখ দুটো ফুলে আছে। সারাশরীরে প্রচন্ড ব্যথা নিয়েও ভর দুপুরে বিয়ের আসরে কনে সেজে বসে আছে।
হঠাৎ করে উল্কার মতো চলে এলো অচেনা একটি ছেলে। এদিক সেদিক না চেয়ে বউ সেজে বসে থাকা মেয়েটিকে পাঁজাকোলা করে গাড়িতে তুলে ফেললো। উপস্থিত মানুষেরা চেষ্টা করেও গাড়িটিকে আটকাতে পারিনি।
বুদ্ধি করে একছেলে তড়িতেই গাড়ির পিছনে থাকা নাম্বার প্লেটের ছবি তুলে নিলো। মেয়েটির কিছু আত্মীয় ছেলে গাড়িটির পিছনে পিছনে দৌড়াতে লাগলো । কিছুতেই লাভ হলোনা। চোখের পলকেই গাড়ি মেইন রাস্তায় উঠে সাইঁ সাইঁ করে সবার দৃষ্টির অগোচরে চলে গেলো।
বিয়ে বাড়ির আনন্দঘন পরিবেশ নিরানন্দে পরিনত হলো। উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে গেলো এমন একটা বিশ্রীরকম কাণ্ড ঘটে যাওয়াতে। মেয়েটির চাচা মাথায় হাত চাপড়াতে লাগলো এখন কি হবে এই বলতে বলতে।
মুখরিত পরিবেশে বাজে রকমের গুঞ্জন সৃষ্টি হলো। মুরুব্বি মহিলারা দোয়া দুরুজ পড়তে লাগলো।
একটু পরেই বর যাত্রী চলে এলো। বর তার জন্য সজ্জিত স্টেজে গিয়ে বসলো। বাকি অতিথিরা তাদের জন্য বরাদ্দ করা চেয়ারেগুলোতে আসন পেতে বসলো। বর আসা উপলক্ষে কোন সমাগম নেই বিয়ে বাড়িতে। থমথমে হয়ে আছে একটু আগেও উচ্ছ্বাসে কলরবে মেতে থাকা বাড়িটি। স্টেজে যার যার মতো করে বসে গল্প গুজব করতে লাগলো।
খাওয়ার পর্ব শুরু হতেই ছেলের বাবা, কৌতুহল চোখে বললেন,
কি ব্যাপার বিয়ে পড়ানো না হতে খাওয়ার আয়োজন?
কনে পক্ষের একজন মুরুব্বি এসে বললেন , সমস্যা নেই। খাওয়া দাওয়া শেষ হোক। বিয়ে পরে পড়ানো যাবে।
নাহ। এটা হয়না। আগে বিয়ে পড়ানো হবে পরে খাওয়া। আমরা নিয়ম ভঙ্গ করতে পারিনা। সমাজের একটা প্রচলিত রেওয়াজ আছে।
এভাবে এক দু’ কথায় জানাজানি হয়ে গেলো বউ নেই। কেউ বলছে বউ আগের প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গিয়েছে। কেউ বলছে বউ কিডন্যাপ হয়েছে। কেউ বলছে বেশী সুন্দর বলে বউকে জ্বিনে তুলে নিয়েছে। এই মেয়ের উপরে জ্বিন ভর করছে বহুদিন আগে। এটা জ্বিনের প্রতিশোধ।
বরপক্ষ কনেপক্ষকে কথার অগ্নিবর্ষণ নিক্ষেপ করতে লাগলো।
বরের মামা বললো,
দুলাভাই এ বাড়িতে আর একমুহূর্ত নয়। কিন্তু পাত্র বাধ সাধলো। সে এই মেয়েকেই খুঁজে বের করে বিয়ে করবে। তারা বাবা ছেলে পালটা যুক্তি খন্ডনে লিপ্ত হলো।
বরের কথায় সায় দিয়ে মেয়ে পক্ষের সবাই বলতে লাগলো, জামাই ঠিকই বলছে। দয়া করে আপনারা ধৈর্য ধরে কিছুসময় অপেক্ষা করুন। আমরা খুঁজে বের করে আনছি বউকে। গাড়ির নাম্বার টুকে নিয়েছি আমরা। এটা গ্রাম। শহর নয়। সুতরাং খুঁজে বের করতে দেরী হবেনা থানায় গেলে।
বরের এক মামা তার বাবাকে বললো, দুলাভাই মাথা ঠান্ডা করেন। আমার কথা মন দিয়ে শোনেন। বিয়ে করার উদ্দেশ্য নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যদি বিয়ে না করে ঘরে ফিরে ছেলে। তাহলে এটা বড় অমঙ্গল। অশুভ। যে কোন একটা মেয়েকে খুঁজে বের করতেই হবে । সে পর্যন্ত তামিম বাইরে কোন এক জায়গায় অবস্থান করুক। পাগড়ি পায়জামা পরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে কিভাবে।
মাথা ঝুঁকে ঝিম মেরে বসে রইলো বরের বাবা। কনেপক্ষের অনুরোধে সবাই খেয়ে নিলো।
_______
পড়ন্ত বিকেল। তপ্ত দুপুরের চোখ রাঙানি এখন আর নেই। মৃদু সমীরণে দুলছে গাছের কচিশাখাগুলো।
‘ কুঞ্জলতা ‘ ভবনটির সামনে থামলো একটি গাড়ি। গাড়ির ভিতরে এতক্ষণ বউ সাজা মেয়েটি বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলো। গাড়ি উঠানে থামতেই মেয়েটির হুঁশ এলো। নড়েচড়ে উঠে বসলো। ঘরের ভিতর থেকে বের হয়ে এলো একটি মেয়ে।
উঠানে তাকিয়েই সে স্তব্ধ হয়ে গেলো।
দেখে লাল টুকটুকে শাড়ি পরা একটি বউ। তার বড় ভাই শুভ্র ও গাড়ি থেকে বের হলো ।
ভাইয়া তুই হঠাৎ বিয়ে করে ফেললি চুরি করে? তুই না লুবনা নামের একটি মেয়ের সাথে প্রেম করিস?
শুভ্র পকেট থেকে টিস্যু বের সারা মুখের ঘাম মুছতে মুছতে,
একটা চড় খাবি। বদমাইশ। মেজাজ এমনিতেই তেতে আছে। এ পিচ্চিকে নিয়ে এক থালা ভাত দে। ক্ষুধায় গাড়িতে বেঁহুশ হয়ে পড়েছিলো।
পাশ থেকে তার চাচী এসে,
এটা চুরি নয়রে উরমি। চুরি তো করে মানুষ রাতে। এটা দিনে ঘটছে। এটা ডাকাতি।
শুভ্র রেগে গেলো শুনে। চাচী ও আমার বউ নয়। বুঝলে।
আঃ কি বলিস কি ? তুই কার বউ তুলে আনলি জোর করে? একটু পর না পুলিশ চলে আসে বাড়িতে। রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এলো শুভ্রের মা জেসমিন বেগম। হা- হুতাশ শুরু করলেন ছেলের এমন উদ্ভট কর্মকাণ্ড দেখে। তুই এটা কি করলি বাপ? কোন বাপ মার বুক খালি করলি?
উফফস! মা থামো। এমনভাবে গলা ফাটাচ্ছ কেন? লোকে শুনলে ভাববে বুঝি আমি খুন করেছি।
উরমি মা ও চাচীকে গিয়ে বললো,
আরেহ এসব ভাইয়ার ভুয়া কথা। নিজেই বিয়ে করেছে।
মেয়েটি ড্রয়িংরুমে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। ভয়ে হাত পা ঠকঠক করে কাঁপছে। উরমি তার কাছে গিয়ে এই মেয়ে তোমার নাম কি?
কাজল।
দারুন নামতো। কি কোমল! কি পবিত্র! ভাইয়ার সাথে তোমার কতদিনের পরিচয়?
আমি উনাকে চিনিনা। ক্ষীন কন্ঠে জানাল কাজল নামের মেয়েটি।
বল কি? মা, চাচী এদিকে আস তাড়াতাড়ি।
উরমির ডাকে তারা ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এলো। কি হইছে রে?
এই মেয়ে নাকি ভাইয়াকে চিনেইনা।
জেসমিন বেগম নিজের রুমে গিয়ে বোরকা বের করে পরে নিলো। মেয়েটিকে বললো তোমার ঠিকানা বল। আমিই তোমাকে তোমার বাবা মায়ের কাছে পৌঁছে দিব। মেয়েটি তবু চেপে বসে রইলো।
শুভ্রের চাচী মেয়েটিকে জোর করে দাঁড় করাতে গেলে,
ওমাগো! বলে মেয়েটি যন্ত্রণায় কুঁকিয়ে উঠে। মেয়েটির পিঠ থেকে শাড়ির আঁচল খসে পড়ে। উরমি চিৎকার করে উঠে। হায় খোদা। এর শরীরে দেখি বহু আঘাতের চিহ্ন।
কি বলিস! বলে তার মা ও চাচী মেয়েটির হাত, পা, পিঠ, গলা, পেট, দেখলো। সত্যিইতো। এক্কেবারে মেরে জখম করে ফেলছে।
এই মেয়ে কোন পশুরা তোমাকে এমন নির্দয়ভাবে পেটালো? আর কেনই বা পেটালো? কি কারণে করলো এমন?
একদমে প্রস্নগুলো করলো জেসমিন বেগম।
কাজল কোন উত্তর দিলোনা। শুধু বলল,আমি মারা যাচ্ছি। একটু ভাত দেন না।
উরমি বিদুৎগতিতে রান্নাঘরে ছুটে গেলো। প্লেট ভরে ভাত মাছ সবজি নিয়ে এলো। মেয়েটি আস্তে আস্তে ভাত ও পানি গিলতে লাগলো।
শুভ্র গোসল সেরে তোয়ালে দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে মেয়েটির কাছে আসলো। তার মা জিজ্ঞেস করলো,
কিরে এই মেয়ে নাকি তোকে চিনেইনা। তুই নিশ্চয়ই চিনিস তাকে?
মা আমি এই মেয়েটাকে আজই প্রথম দেখলাম। ওকে আমি একদম চিনিনা। এর নামটাও জানিনা।
সবাই তাজ্জব হয়ে গেলো। একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো।
মেয়েটি ভাত খেয়ে উঠলো। ধীরভাবে বসলো। একটু পরেই পুলিশ চলে এলো বাড়ির উঠানে।
শুভ্রের পরিবারের সবাই ভড়কে গেলো পুলিশ দেখে। তাকে যেতে দিলোনা তার মা। সে উরমি, তার ছোট জা রুবানা দরজার সামনে গেলো। দেখতে পেলো অনেকগুলো মানুষ পুলিশের সাথে। পাগড়ি পরা বর ও আছে।
শুভ্র সাহেব বাসায় আছে? একজন পুলিশ এগিয়ে এসে জানতে চাইলো।
জেসমিন বেগম বললো, কেন?
আপনার কি হয় সে?
আমার ছেলে।
আপনার ছেলে বিয়ের আসর থেকে অন্যের হবু বউকে তুলে নিয়ে আসছে। যেটা আইনগতভাবে দন্ডনীয় অপরাধ। বউটাকে বের করে আনেন।
শুভ্র ভাত খাওয়া শেষ করে নিজেই পুলিশের সামনে এলো।
আপনি আহসানুল হক শুভ্র?
হ্যাঁ। আমিই শুভ্র।
তুলে আনা বউটাকে ডাকুন। আর জোর করে কারো মেয়েকে তুলে আনার অপরাধে আপনাকে এক্ষুনি আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে।
চলবে,,