#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৪০(অন্তিম পর্বের প্রথম অংশ)
তাজরীন ফাতিহা
শীতের আমেজ চারপাশে ভালোই বিরাজ করছে। প্রকৃতিতে কেমন শীত শীত গন্ধ লেগে আছে। যখন যে ঋতু শুরু হয় তখন সে ঋতুর ঘ্রাণ নাসারন্ধ্রে বারি খায় যেন। গ্রীষ্মকালে ঘেমে জবজবে অবস্থা, বর্ষাকালে বৃষ্টির রিনিঝিনি শব্দ, শরৎকালে কাশফুল ও মেঘের পেঁজা তুলোর মতো উড়াউড়ি, হেমন্তে ধান উঠানোর ধুম, শীতকালে হাড় কাঁপানো শীত। সর্বশেষে বসন্তে পাখপাখালির কলরব, নতুন পাতা গজানোর আমেজ। প্রত্যেকটি ঋতুই যেন আল্লাহ প্রদত্ত এক অপূর্ব সমাহারের সৃষ্টি। সুবহানাল্লাহ!
ইফরা আজকে ফজর পড়ে আর ঘুমায়নি। ফজরের নামাজ পড়ে নাস্তা খেয়ে সাধারণত একটু ঘুমায় সে। তবে আজকে ঘুমাচ্ছে না। ভার্সিটির শেষ বর্ষে এবার সে। পড়াশোনা রায়হান শেষ করতে বলেছে। ইফরা রাজি ছিল না পড়াশোনা করায় কিন্তু রায়হান বলেছে শুধু পরীক্ষা দিতে। তবুও যেন পড়ালেখাটা শেষ করে। ইফরা আর না করেনি। দেখতে দেখতে তার দাম্পত্য জীবনের প্রায় তিন বছর। আল্লাহ তাকে খুব উত্তম এক নিয়ামত দিয়েছেন। যে নিয়ামতের নাম রায়হান জাইম।
গতকাল রাতে হঠাৎ করেই রায়হান ইফরাকে বলছিল,
“এই পৃথিবীতে আমি সবচেয়ে ঋণী কার কাছে জানো?”
ইফরা সরল মনে উত্তর দিয়েছিল,
“আপনার মা, বাবার কাছে।”
রায়হান মুচকি হেঁসে বলেছিল,
“উহু, মা বাবার ঋণ তো কখনোই শোধ করা যাবে না। তাদের নিজ সন্তান আমি। আমার চামড়া কেটেও তাদের ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব নয়। ওনাদের অস্তিত্ব আমি। কিন্তু আমার আপন না এমন দুইজন মানুষের কাছে আমি চিরঋণী। তুমি তাদের দেখতে চাও?”
ইফরার খুব আগ্রহ জাগলো। সে বিনাবাক্যে রাজি হয়ে গেলো। রায়হান সকাল সকাল রেডি হয়ে থাকতে বলেছিল তখন। রুদ, রাহমিদকেও রেডি হয়ে থাকার জন্য বলে এসেছিল।
রাতের কথা ভাবতে ভাবতে ইফরা রেডি হয়ে গেলো। রুদও এরমধ্যে তৈরি হয়ে ভাবির কাছে চলে এসেছে। ইফরা রুদকে দেখে বললো,
“রাহমিদ রেডি হয়েছে?”
“জ্বী ভাবি।”
“ভাইয়ু কোথায় ভাবি?”
“তোমার ভাইয়ু কোথায় যেন গেলো। বলেছে তৈরি হয়ে থাকতে। আমাদের এসে নিয়ে যাবে।”
“আচ্ছা।”
______
—-
“আপনারে না কইলাম ওষুধটা লইয়া ঘরে আসতে। একটা কতাও হুনেন না কেন?”
জয়নয় বেগম আফজাল হোসেনকে শাসিয়ে কথাটা বললেন। আফজাল হোসেন কাশতে কাশতে ঘরে ঢুকে স্ত্রীর পাশে বসলেন। বললেন,
“হাতে টাকা নাই অহন। টাকা হইলে কিনোন যাইবো।”
“কতদিন ধইরা আপনের কাশি অথচ একখান ওষুধ কিন্না খাওয়ার টেকা আপনের কহনই থাহে না।”
“আরে কইতরী চেইতা যাইয়ো না তো। তোমার এমনিতেই হাঁপানির সমস্যা। বুড়া হইতেছি তো দুইজনই। এহন আর আগের মতো বল পাইনা শরীরে। আস্তে আস্তে রত বল সব চইলা যাইতেছে।”
জয়নব বেগম নিজেদের ছিড়া কাঁথাটা সেলাই করতে করতে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। আগামী দিন কিভাবে জানে মাবুদ ছাড়া কেউ জানে না। আফজাল হোসেনের শরীরে রোগ বাসা বেঁধে আছে। কবিরাজি চিকিৎসা করিয়ে ওষুধ খেয়েছে। এমনিতে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাওয়ার সামর্থ্য তার নেই। মেলা দাম ওষুধের। এখন হোটেলে কেনা বেচাও অতো হয়না। কত নতুন নতুন হোটেল হয়েছে। আফজাল হোসেনের সেই পুরোনো ভাতের হোটেলের কদরও কমেছে।
আফজাল হোসেনের দিকে তাকালে জয়নব বেগমের ভারী মায়া হয়। বেচারা জীবনে বহুত ভালো কাজ করেছে কিন্তু কারো কাছে কোনো মূল্য পায়নি। সারাজীবন বিনে পয়সায় মানুষের সেবাই করে গেছে কিন্তু নিজের সেবার দরকার হলে কাউকে পাননি। যাক আল্লাহ যেমনই রেখেছেন তাদের কোনো অভিযোগ নেই ওই মহান রবের প্রতি। কথাগুলো মনে মনে বলে জয়নব বেগম কাঁথা সেলাইয়ে মনোনিবেশ করলেন।
আফজাল হোসেন স্ত্রীকে চুপ মেরে যেতে দেখে বিছনায় শুয়ে পড়লেন। গলায় মাফলার পেঁচিয়ে খাটের এক কোণে শুয়ে রইলেন। ইদানীং শরীরটা বেশিই খারাপ লাগছে। জয়নব বেগমকে ভয়ে বলেন না। তাহলে চিৎকার চেঁচামেচি করে হাঁপানি উঠিয়ে ফেলবে। তাদের দুই বুড়া বুড়িরই হাঁপানির সমস্যা। কোনদিন যেন দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে আল্লাহর ডাকে চলে যেতে হয়। জয়নব বেগমের জন্য তার ভীষণ চিন্তা হয়। সে না থাকলে তার স্ত্রীর কি হবে? এসব চিন্তা ইদানীং মাথায় জোঁকের মতো জেঁকে বসে থাকে।
দরজায় ঠকঠক আওয়াজ আসছে। এইমাত্র বিছানায় পিঠ ঠেকালেন এখনই আবার কার আসতে হলো? আফজাল হোসেন জোরে বলে উঠলেন,
“কে?”
“চাচা আমি দিলদার। দরজাডা একটু খুলেন?”
“তোর এইসময় কি কাজ?”
বলেই আফজাল হোসেন কেশে উঠলেন। দিলদার কোনো কথা না বলে আবারও দরজা ধাক্কালো। জয়নব বেগম বললেন,
“উইঠা দেহেন। জরুরী কিছুও তো হইতে পারে।”
“হ কিছুর দরকার হইলে এই আফজাল হোসেনরে দরকার। এমনিতে খোঁজও পাওন যায়না।”
আফজাল হোসেন কাশতে কাশতে উঠে দরজা খুললেন। খুলেই বলতে নিলেন,
“তোর আসার আর সময় ছিল না?”
বাকি কথা শেষ করতে পারলেন না দরজার সামনে অপরিচিত কয়েকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হতভম্ব হলেন। এরা কারা?
রায়হান মুচকি হেঁসে বলে উঠলো,
“আসসালামু আলাইকুম আংকেল। কেমন আছেন?”
আফজাল হোসেন এখনো ঠাহর করতে পারছেন না কিছু। রায়হান আফজাল হোসেনকে তব্দা খেয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আবারও বলে উঠলো,
“আংকেল চিনতে পারেন নি? আমি রায়হান।”
আফজাল হোসেন অস্ফুট স্বরে বললেন,
“রায়হান!”
“আংকেল আপনার শরীর এমন ভেঙে গিয়েছে কেন? খাওয়াদাওয়া করেন না?”
আফজাল হোসেনের হুঁশ ফিরলো যেন। চেহারায় কেমন অবিশ্বাস ভাব। রুস্তম পিছন থেকে বলে উঠলো,
“চাচা কি অহনো চিনবার পারেন নাই?”
“না পেরেছি। তবে সেই রায়হানের সাথে চেহারার ভীষণ তফাৎ। ভিতরে আসো বাবা।”
রায়হান হেঁসে বললো,
“রুদ, রাহমিদকে মনে আছে আংকেল?”
আফজাল হোসেন হেঁসে বললেন,
“মনে থাকবে না কেন? খুব মনে আছে। তোমার ছোট ভাইয়ের খামচির কথা কি ভুলা যায়। সব ভুললেও সেটা ভুলা সম্ভব না। ওরা কত ছোট ছিল। ওদের দেখলে এখন আর চিনবো না।”
ভাইয়ের পাশ থেকে বারো বছর বয়সী রাহমিদ বলে উঠলো,
“তাহলে চিনানোর জন্য কি আবার খামচি দিতে হবে?”
রুস্তম আর দিলদার হেঁসে উঠলো। আফজাল হোসেন বারো বছরের রাহমিদের দিকে মায়াভরা নজরে তাকালেন। সেই ছোট্ট রাহমিদ কি এইটা? গুলুমুলু গালের এই বালকটাই কি সেই এক বছর বয়সী গুলুমুলু বাচ্চাটা? কতকিছু ভেবে চলেছেন তিনি। রায়হান বললো,
“আংকেল কি ভাবছেন? সেই এক বছর বয়সী বাচ্চাটাই কিন্তু ইনি।”
আফজাল হোসেনের চোখ ছলছল করলো যেন। আগের রায়হান, রুদ, রাহমিদের সাথে বিস্তর ফারাক বর্তমানে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজনের। উনি স্বাভাবিক হয়ে রায়হানদের ঘরে ঢোকালো। জয়নব বেগম সেলাইরত অবস্থায় দরজার দিকে তাকিয়ে ছিলেন এতক্ষণ। স্বামীকে অনেকক্ষণ কথা বলতে দেখে ভাবছিলেন, “কে এলো এই অসময়ে?” অপরিচিত কতগুলো মুখকে ঘরে ঢুকতে দেখে মাথায় শাড়ির আঁচল ভালোভাবে টেনে দিলেন। ছিঁড়ে কাঁথাটা লুকিয়ে রাখলেন ভালো কাঁথার ভাঁজে। আফজাল হোসেন বললেন,
“চিনতে পারো কিনা দেহো তো?”
জয়নব বেগম কিছুই বুঝতে পারলেন না। তিনি কিভাবে চিনতে পারবে এদের? এদের কি চিনার কথা তার? এসব ভাবছেন তিনি। রায়হান মুখ খুললো,
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন?”
“আন্টি” ডাকটা এর আগেও শুনেছেন তিনি। কিন্তু ওই মুখ আর এই মুখের মধ্যে বিস্তর ফারাক। চেহারা, পোশাকে আভিজাত্যে ভরপুর। রায়হান জয়নব বেগম আর আফজাল হোসেনকে পাশাপাশি বসিয়ে নিজে নিচে বসলো। দুইজনের প্রৌঢ় হাতের ভাঁজে হাত গলিয়ে দুইজনের দিকে তাকালো। অনেক মায়াময় দৃষ্টি ফেলে ধীরে ধীরে বলতে লাগলো,
“যখন আমাদের জন্য দুনিয়ার স্বার্থপর মানুষগুলো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল ঠিক তখনই মহান রবের অনুগ্রহে দুইজন ফেরেশতারূপী মানুষের আগমন ঘটে আমাদের জীবনে। স্বার্থপর এই দুনিয়ায় আপন মানুষেরাই যখন দু মুঠো অন্ন দিতে কার্পণ্য করেছে তখন তারা একজন নয় দুজন নয় তিন তিনটি মুখের অন্নের ব্যবস্থা করেছিলেন। এইযে আমি রায়হান আজকে এখানে পৌঁছেছি তার পিছনে এই দুইজন মনুষের অনেক অবদান।”
কথাটুকু বলে রায়হানের গলা আটকে গেলো। আগের কিছু স্মৃতি তীব্রভাবে বারি খাচ্ছে মাথায়। থেমে থেমে আবারও বলতে লাগলো,
“যখন আমি তিনটি মুখের খাবারের যোগানই দিতে পারছিলাম না ঠিক তখন আফজাল হোসেন নামক এই মানুষটা আমাকে পড়াশোনা ছাড়তে বাধা দিলো। পড়াশোনা জানা থাকলে একটা না একটা কিছু করে এই পৃথিবীতে টিকতে পারবো অন্যথায় সারাজীবন পস্তাতে হবে এরকম নানা উপদেশ এই মানুষটা দিয়েছিল। আমার এখনো মনে আছে যেদিন ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাই সেদিন রাহমিদকে ছেড়ে কিছুতেই যেতে পারছিলাম না। আমার এক বছর বয়সী দুধের ভাই আমাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না। ও আমাকে ছাড়তেই চাচ্ছিলো না। এদিকে আমার পরীক্ষার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। তখন এই মানুষটা রাহমিদকে কোলে নিয়ে ওর খামচি খেয়ে হাত থেকে রক্ত বের হলেও পর্বতের মতো অটল ছিল শুধুমাত্র আমি পরীক্ষা যেন ভালোভাবে দিয়ে আসতে পারি সেজন্য।”
রায়হানের চোখ থেকে পানি টপ টপ করে ঝরছে। মাথা নিচু করে আবারও ভাঙা গলায় বলতে লাগলো,
“যেদিন ভর্তিপরীক্ষার রেজাল্ট দিলো সেদিন এই মানুষটার চোখে আমি সত্যিকারের খুশি দেখতে পেয়েছিলাম। আমার কাঁপা শরীর ধরে এই মানুষটা আমাকে ভরসা দিয়েছিল।”
রায়হান কিছুক্ষণ থেমে জয়নব বেগমের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,
“এই মানুষটা সম্পর্কে কি বলবো? যখন টিউশনি করাতাম রুদকে তার কাছে রেখে যেতাম। এই মানুষটা নিঃস্বার্থভাবে রুদকে আগলে রাখতো। ঘরে খাওয়ার কিছু না থাকলে নিজে খাবার দিয়ে আসতো। প্রতিবেশীদের খোঁচা মারা কথার জবাব দিতো। কখনো এই দুই চোখে বিরক্তি দেখিনি। তখন ভাবতাম আল্লাহর দুনিয়ায় এখনো এতো ভালো মানুষ আছে? যাদের আমাদের থেকে পাওয়ার কিছু ছিল না, বিনিময় ছিল না তবুও দিল খুলে এই দুটো মানুষ আমাদের জন্য করেছেন। আপনাদের দুজনের চোখে এতো অবিশ্বাস কেন আন্টি, আংকেল? কেন আপনাদের চোখ দুটো বলছে আপনাদের ভুলে গেছি? আপনাদের কি কখনো ভুলতে পারি আমি?”
কথাগুলো বলে রায়হান আরও ভেঙে পড়লো। ষোড়শী রুদ, বারো বছরের রাহমিদও কাদঁছে। তাদের অতীত মোটেও সুখকর ছিল না। ভাইয়ের মুখে কথাগুলো শুনে স্থির থাকতে পারেনি তারা। ইফরা, দিলদার, রুস্তম ওদেরও চোখে পানি জমেছে।
আফজাল হোসেন আর জয়নব বেগমের চোখ থেকেও পানি পড়ছে। রায়হান ওনাদের হাত ধরে আবারও বলে উঠলো,
“আপনাদের এই এগারো বছরে অসংখ্যবার মনে পড়েছে কিন্তু আপনাদের সামনে আসতে পারিনি অপরাধবোধে। আপনার মেয়ে আমাদের জন্য শশুরবাড়ি যেতে পারছিল না কথাটি আমাকে আজও ভীষণ পীড়া দেয়। এগারো বছরে কোনো নামাজ নেই যে আপনাদের জন্য দোয়া ছিল না। এই অধমের মাথায় কি একটু হাত বুলিয়ে দিবেন আংকেল, আন্টি?”
রায়হান মাথা বাড়িয়ে বললো। আফজাল হোসেন এবং জয়নব বেগম ইতস্তত করতে করতে হাত বুলিয়ে দিলেন। রুদ, রাহমিদও ভাইয়ের দেখাদেখি মাথা বাড়িয়ে দিলো। তারা ওদের মাথায়ও হাত বুলালেন। রায়হান আফজাল হোসেনের দিকে তাকিয়ে বললো,
“একটা আবদার করবো, রাখবেন?”
“বলো।”
“আমাদের সাথে যাবেন। আপনার এই ছেলের কাছে থাকতে আপনাদের সমস্যা আছে?”
“তা হয়না বাবা। তোমাদের দেখেছি এতেই শান্তি। নিজের ভিটে মাটি ছেড়ে কোথাও যাবো না। এখানেই শেষ নিঃশ্বাসটা ফেলতে চাই। তুমি আমায় এই অনুরোধ করো না বাবা।”
আফজাল হোসেন আকুল কণ্ঠে বললেন। রায়হান আর কিছু বলতে পারলো না। রায়হান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“ঠিক আছে। আপনার ইচ্ছে। তবে আপনাদের সাথে প্রতি সপ্তাহে সপ্তাহে নাহয় মাসে মাসে দেখা করার অনুমতি দিতে হবে।”
“আচ্ছা দিলাম।”
রায়হান খুশি হলো। বললো,
“আপনার মেয়ে কেমন আছে আংকেল?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালোই বাবা। ওর শাশুড়ি তো প্যারালাইজড হয়ে আছে গত পাঁচ বছর হয়। এখন নাকি খালি কাঁদে। তোমাদের কথা অনেকবার বলেছিল। তোমাদের কাছে নাকি মাফ চাইবে। আল্লাহ এতিমদের সাথে খারাপ ব্যবহারের শাস্তি তাকে এই দুনিয়াতেই দেখিয়ে দিয়েছে। আমাদের ক্ষমা করো বাবা। কিছু করার ছিল না তখন। তোমরা মনে অনেক কষ্ট নিয়ে এই বাসা ছেড়েছিলে ভাবলে এখনো আমার খারাপ লাগে।”
আফজাল হোসেন হাত জোর করে মাফ চাইলেন। রায়হান তৎক্ষণাৎ হাত ধরে নিলো। বললো,
“আপনার কোনো দোষ নেই আংকেল। সবই আমাদের ভাগ্যে ছিল। আমি ওসব মনে রাখিনি। আপনাদের বৌমাকে দেখছেন?”
“কোথায়?”
জয়নব বেগম তাড়াহুড়ো করে বললেন। রায়হান ইফরাকে দেখিয়ে দিলো। জয়নব বেগম দেখলেন বোরকা পরিহিত নিকাবে মুখ ঢাকা একজন অদূরে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি কাছে ডাকলেন। ইফরা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো। রায়হানের পাশে বসলো। জয়নব বেগম ইফরাকে উঠিয়ে তার পাশে বসালেন। বললেন,
“মাশাআল্লাহ। আল্লাহ তোমাগো সংসারে বরকত দিক। তুমি কি সন্তান সম্ভবা?”
ইফরা উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। জয়নব বেগম মাথায় হাত দিয়ে অনেক দোয়া করে দিলেন। বললেন,
“এই অধম মানুষ গুলারে সময় কইরা দেইখা যাইয়ো। এই বুড়ির কাছে কয়দিন থাইকা যাও তোমরা।”
রায়হান বললো,
“আমার বন্ধ নেই আন্টি। আপনাদের দুজনকে কয়েকদিন আমাদের সাথে থাকতে হবে। তাই আজকে এসেছি আপনাদের নিতে। এটা মানা করবেন না। তাহলে ভীষণ কষ্ট পাবো।”
আফজাল হোসেন মানা করতেই যাচ্ছিলেন কিন্তু জয়নব বেগম বাধা দিলেন। বললেন,
“আইচ্ছা যামু।”
সবাই খুশি হয়ে গেলো। দিলদার রায়হান যে জিনিসপত্র এনেছে সব মাটিতে নামিয়ে রেখেছে। কয়েকপদের ফলমূল, বিস্কুট, কয়েকদিনের বাজার সব কিছু করে এনেছে রায়হান। সবকিছু নামিয়ে দিলদার চলে যেতে নিলে রায়হান থামলো তাকে। বাইরে নিয়ে এসে কোলাকোলি করলো। রসিকতার স্বরে বললো,
“দিলদার ভাই, আমি কিন্তু এখন বাজার সদাই ভালোই করতে পারি।”
দিলদার লজ্জা পেলো। রুস্তম পিছন থেকে এসে দিলদারের মাথায় টোকা দিয়ে বললো,
“কিরে দিল। আমারে ভুইলা গেছস নাকি।”
দিলদার মুখ গোমড়া করে বললো,
“ভাই আমি বিবাহিত। বউয়ের সামনে প্রেস্টিজ নষ্ট কইরেন না। যেখানে সেখানে টুকা দিয়েন না। পাশের ঘরে বউ আছে।”
রায়হান, রুস্তম একসাথে হেঁসে দিলো।
চলবে…
#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৪১(অন্তিম পর্বের শেষাংশ)
তাজরীন ফাতিহা
দিনগুলো যেন পলকের মধ্যে হারিয়ে যায়। সপ্তাহ, মাস, বছর শেষে আরেকটি বছরের আগমন ঘটে। আফজাল হোসেন আর জয়নব বেগম আজ সকালেই চলে গেছেন রায়হানদের বাসা থেকে। একমাস তাদের ভীষণ যত্ন নিয়েছে রায়হান। ইফরা, রুদ, রাহমিদের সাথেও তাদের ভালো রকমের একটা বন্ডিং তৈরি হয়ে গেছে। রুদ, রাহমিদের ভীষণ মন খারাপ। ইফরারও খারাপ লাগছে। মানুষের জীবন এক প্রবাহিত চক্র। কেউ থামাতে পারবে না এই জীবনচক্রকে।
রায়হান দুইদিনের জন্য কোথাও যেন যাবে। ইফরা তাই কাপড় চোপড় গুছিয়ে দিচ্ছে। তার নিজের শরীরটাও ভীষণ দুর্বল ইদানীং। রাতে ঘুমোতে পারেনা। বাচ্চা পেটে আসার পর থেকে শরীর একেবারে ভেঙে গেছে। পড়াশোনাও করতে পারেনা ঠিক করে অথচ দুই দিন পর এগ্রোনোমি অ্যান্ড হর্টিকালচারের উপর পরীক্ষা। বাবু পেটে আসার পর পড়াশোনায় একেবারই মনোযোগ দিতে পারছে না সে।
রায়হান অবশ্য প্রতিদিন সবাইকে পড়িয়ে নিজের বউকে পড়ানোর মিশনে নামে। রাত হলেই পেটে তেল ম্যাসাজ করে দিয়ে বউকে পড়াতে বসায়। ইফরাকে পড়ানো যেন একটা যুদ্ধের সমান। বেচারা সারাদিন খেটে এসে বউ আর ভাইবোনের আবদার রাখতে গিয়ে আরও কুপোকাত হয়ে যায়।
কলিংবেলের শব্দে ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলো ইফরা। রাহমিদ দরজা খুলেই ভাইয়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বে এখন। ইফরা তার খানিক উঁচু পেট নিয়ে আস্তে করে হেঁটে রুমের দরজার সামনে আসলো। যা ভেবেছিল তাই। রাহমিদ বড় ভাইয়ের গলা ধরে ঝুলছে। রুদও ভাইকে সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। তারপর ব্যাগ নিয়ে সোফায় রাখলো।
রায়হান রাহমিদকে জড়িয়ে দরজা বন্ধ করলো। দুই ভাইবোনের মাথায়, কপালে চুমু খেলো। ইফরার দৃশ্যটি দারুন লাগলো। কিছুক্ষণ ভাইবোনের সাথে কথা বলে ব্যাগ নিয়ে রুমে আসলো। ইফরাকে দরজায় দাঁড়ানো দেখে বললো,
“কিগো, আমার আওলাদ দেখি দাঁড়িয়ে আছে।”
ইফরা আস্তে আস্তে রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
“আপনার আওলাদ সারাক্ষণ জ্বালায়। আপনার মতো হয়েছে।”
রায়হান ইফরাকে পিছন থেকে জড়িয়ে বললো,
“আমি কি করলাম। কিছু না করেও সবসময় আমাকে দোষী বানাতে ভালো লাগে বিবি সাহেবা?”
ইফরা রায়হানের চুল আউলিয়ে বললো,
“ইয়েস জাইম সাহেব।”
রায়হান ইফরার নাকে নাক স্পর্শ করলো। বসে পেটে চুমু দিয়ে বললো,
“হেই বাচ্চা, মাকে বেশি জ্বালাবে না কিন্তু। বাবা দুইদিন থাকবো না। ভালো বাচ্চা হয়ে থাকবে দুই দিন। ঠিক আছে।”
তারপর বউকে ছেড়ে হাত মুখ ধুতে গেলো। ইফরার খুব সুখ সুখ অনুভূত হয় হয় ইদানীং। তার যে এতো সুন্দর একটা সংসার হবে সেটা জানতোই না কখনো। আল্লাহ তায়ালা উত্তম পরিকল্পনাকারী। মহান রবের প্রতি সীমাহীন শুকরিয়া এতো সুন্দর একটা পরিবার উপহার দেয়ার জন্য।
_____
বাসায় ডাইনিং টেবিল থাকলেও রায়হানরা খাওয়াদাওয়া সবসময় নিচে বসে করে। কারণ নিচে বসে খাওয়া সুন্নত। আধুনিক সময়ে টেবলের বেশ কদর থাকলেও রায়হানের বাসায় টেবিল একটি অবহেলিত বস্তু। পাটিতে গোল হয়ে বসে আছে ইফরা, রুদ, রাহমিদ। সামনে বোলে ভাত আর তরকারি রাখা। রায়হানের জায়গা ফাঁকা। এখনো মুখ ধুয়ে আসেনি সে। রাতের খাবারের জন্য তারা গোল হয়ে বসে আছে। মাঝে মাঝে টুকটাক আলাপ করছে।
রায়হান হাত, মুখ মুছে বসলো তার বরাদ্দকৃত জায়গায়। এখন তার কাজ হলো তিনজনকে খাইয়ে দেয়া। তিন বাচ্চাকে পালতে পালতে তার জীবন শেষ। ইফরা প্রেগনেন্ট হওয়ার পর রান্না মূলত রুদ আর ইফরা মিলেই করে। এতে ইফরার স্বস্তি হয়। আজকে খাবারের মেন্যুতে আছে লইট্যা শুটকি ভুনা, চুই ঝাল দিয়ে হাঁসের গোশত ভুনা, পাতলা ডাল আর গরম গরম সাদা ভাত। শীতকালে এসব দিয়ে ভাত খাওয়ার মজাই আলাদা। যদিও শীত খানিকটা কমেছে। বসন্ত দরজায় উঁকি দিচ্ছে তবুও শীতের আমেজ কিন্তু এখনো রয়ে গেছে।
রায়হান বোলে ভাত মাখিয়ে প্রথমে রাহমিদকে খাওয়ালো। রুদ আর ইফরা অধির আগ্রহে বসে আছে। রাহমিদের পর রুদকে খাইয়ে শেষে ইফরাকে খাওয়ালো। টুকটাক কথা বলে খাবারের সমাপ্তি ঘটালো তারা।
______
—-
নিজ জন্মস্থান ছেড়ে থাকাটা কলিজায় সূচ নিয়ে হাঁটার মতো। তাও যদি জন্মস্থানে নিজের মা, বাবার খুন হয় এবং কবর থাকে তাহলে তো সেটা আরও কষ্টকর। প্রায় এগারো বছর, ঠিক এগারো বছর পর নিজের শহরে পা রেখেছে রায়হান। এই শহরে অসংখ্য সুখময় স্মৃতি যেমন জড়িয়ে আছে তেমনই বিদঘুটে ভয়ংকর স্মৃতিও জড়িয়ে আছে। যা তাকে প্রতি রাতে ঘুমোতে দেয়না।
গত পরশু হঠাৎ করেই মা, বাবাকে স্বপ্নে দেখলো সে। তারা দুইজন বলছে,
“বাবা জাইম, মা বাবাকে মনে পড়েনা বুঝি?
তারপর দু হাত মেলে তাকে ডাকছিল। তখনই তার ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্নটি দেখে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গিয়েছিল সে। সেদিনই ঠিক করেছিল নিজ শহরে, নিজ জন্মস্থানে একবার হলেও যাবে। কেমন আছে তার বাবা, মায়ের স্মৃতি জড়ানো সেই বাড়িটি? ভাবলেই বুকটা হুহু করে ওঠে।
রুস্তমের ডাকে ভাবনা থেকে বের হলো রায়হান। তারপর দুজন রায়হানের বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলো। এখানের সবকিছুই পরিবর্তিত হয়েছে। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর বেড়েছে। এগারো বছরে এতো পরিবর্তন রায়হানকে অবাক করছে।
“সন্ধ্যা ছায়া” বাড়িটার বিশাল গেটের সামনে দাড়িয়ে আছে রায়হান আর রুস্তম। রায়হান মন ভরে বাড়িটাকে দেখে নিলো। তারপর কি মনে করে মা, বাবার কবরের নিকট গেলো। দেখলো কবরের উপর ঘাস জমে কবর একেবারে সোজা হয়ে গেছে। রায়হান হাঁটু গেড়ে শরীর ছেড়ে বসে পড়লো। কবর দুটি খুব যত্ন নিয়ে ছুঁয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম আব্বু ও আম্মু। ভালো আছেন আপনারা?”
কবর দুটি থেকে কোনো প্রতিত্তর আসলো না। রুস্তমের এতো কান্না পেলো দৃশ্যটি দেখে। সে চোখের পানি আড়াল করতে চাইলো। রায়হান এবার ধীরে ধীরে বলতে লাগলো,
“জানেন আব্বু, আম্মু আমি আপনার আদরের রত্নের কোনো অবহেলা করিনি। ওদেরকে কষ্ট ছুঁতে দেইনি। ওরা না আপনাদের প্রচুর মিস করতো। আমিও করতাম কিন্তু আপনাদের এনে দেয়ার সাধ্য কি আমার আছে বলুন? যে সম্পত্তির জন্য আপনারা আমাদের ছেড়ে আজ এতো দূরে ঐ সম্পত্তির একটা কানা কড়িও আমি এবং আমার ভাইবোন ভোগ করিনি। যেদিন জানলাম আপনাদের হত্যা পূর্বপরিকল্পিত সেদিনই আমি মরে গিয়েছিলাম। যেদিন আপনাদের লাশ বহন করতে হলো সেদিন আরও মরে গিয়েছিলাম। একটা সন্তানের জন্য পিতামাতা উভয়ের লাশ বহন করা কি পরিমাণে কষ্টের তা কি আপনারা জানেন?”
রায়হানের চোখ থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। রুস্তম রায়হানের কাঁধে হাত রাখলো। রায়হান আবারও বললো,
“আপনাদের জাইম অনেক বড় হয়েছে আব্বু, আম্মু। আপনারা তো তা দেখতে পারলেন না।”
রায়হান আর বলতে পারলো না। বাধ ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়লো। হঠাৎ পিছন থেকে একজন বলে উঠলো,
“কে? কে ওখানে?”
রায়হান চোখে পানি নিয়েই ঘুরে তাকালো। তার চোখ দুটি ভীষণ লাল। এগারো বছর আগে যে মানুষটির জন্য রায়হান এবং তার ভাইবোন বেঁচে গিয়েছিল আর তার বাবা, মায়ের খুনিদের চিনেছিল সেই বেলায়েত চাচা তার সামনে দাঁড়িয়ে। চাচার শরীর আগের থেকে ভেঙে গিয়েছে। চুল দাড়িতে পাক ধরেছে। বেলায়েত চাচা রায়হানকে চিনলো না। রায়হান চোখের পানি মুছে তার নিকট গেলো। গিয়ে সালাম দিয়ে বললো,
“চাচা আমি জাইম। খন্দকার রাতিব ইকবালের বড় ছেলে খন্দকার রায়হান জাইম।”
বেলায়েত ইসলাম হতভম্ব হয়ে গেলেন। মুখে কোনো রা নেই। যেন পাথর বনে গেছেন। অস্ফুট স্বরে বললেন,
“জাইম!!”
পরক্ষণেই আবার হুঁশ ফিরলে বলতে লাগলো,
“তুমি সত্যই জাইম?”
“জি বেলায়েত চাচা।”
বেলায়েত ইসলামের এবার সত্যিই মনে হলো এটা জাইম। কারণ জাইমই একমাত্র তারে নাম ধরে চাচা ডাকতো। তিনি চোখের পানি ছেড়ে রায়হানকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো,
“এতদিন কই আছিলা বাপ? তোমগো অনেক খুঁজছি। পাই নাই। তোমগো বাড়িডা কতদিন ধইরা খালি পইড়া আছে। আমি সপ্তাহে সপ্তাহে বাড়িডা পরিষ্কার করায় রাখি। জানি তোমরা আইলে বাড়িঘর অপরিষ্কার না দেহো। কই আছিলা এতদিন? কত বড় হইয়া গেছো!”
“ছিলাম চাচা। আল্লাহ রেখেছেন। বাড়ি খালি পড়ে আছে কেন? ঐ লোভী কুলাঙ্গারের দল থাকে না আমাদের বাড়িতে?”
“না। দুই বছর আগ পইযন্ত আছিলো। তারপর তোমার মেঝ চাচা অ্যাক্সিডেন্টে মইরা গেলো। পোলার শোকে তোমার মেঝ চাচীরে অপয়া কইয়া বুড়িডা বাইর কইরা দিলো। হেরপর তোমার বড় চাচার অবস্থা আরও করুণ। পায়ে ফোড়া হয়ে পুঁজ জমে গেছিলো। হেই পুঁজ থেইকা সারা শরীরে বিষাক্ত পুঁজের দেখা দিছে। ডান হাত তো কাইটা ফেলাইতে হইছে। এতো পরিমাণে হইছিলো হাতে তাই। হাটা, চলা করতে পারতো না। হাগা, মুতা সব বিছানাতেই করতো। এসব দেইখা তোমার বড় চাচী তার মাইয়াগো নিয়া বাপের বাড়ি চইলা গেছে। এসব শুইনা তোমার ফুপির জামাই তারে মারধর কইরা বাপের বাড়ি পাঠায় দিছে ডিভোর্স দিয়া। নিজ সন্তানগো এমন করুণ পরিণতি শুইনা বুড়িডা গেছে মইরা। এহন তোমার ফুপি খালি তোমাগো মা, বাবার কবরের সামনে আইসা কান্দে, মাফ চায়।”
রায়হান স্তব্ধ হয়ে এতক্ষণ কথা শুনছিল। এতো কিছু ঘটে গেছে! বেলায়েত চাচা আবারও বললেন,
“বুঝলা এসবই হইলো হেগো পাপের ফল। পাপ বাপরেও ছাড়ে না একটা কতা আছে না? আল্লাহ হেগো দুনিয়াতেই বুঝাই দিছে দুইটা নিষ্পাপ মানুষরে বিনা অপরাধে মারার শাস্তি কতডা ভয়ানক হইতে পারে। আমি খুব খুশি হইছি শয়তান গুলার শাস্তি হইছে দেইখা। আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম যারা তিনডা পোলাপানরে এতিম করছে তাগো বিচার যেন নিজ চোক্ষে দেইখা যাইতে পারি। আল্লাহ কবুল করছেন আমার দোয়া। তোমাগো বাড়ি তো এহন খালি। হুনো, বাড়িতে চইলা আসো। আর কোনো ঝামেলা নাই।”
“না চাচা, আমি ওখানে শিক্ষকতা করি। আমার সব কিছু ফেলে আসা সম্ভব না। তবে আমি মাসে মাসে আসার চেষ্টা করবো।”
“ও আইচ্ছা। তোমার ভাইবোনরে আনো নাই?”
“না। ওদের নিয়ে আসবো এখন থেকে। ভেবেছিলাম বাড়িতে ঢুকতে পারি কিনা? তাই ওদের আনি নি।”
“তুমি আইজকা থাকবা?”
“এসেছিলাম তো বাড়ি বুঝে নিতে কিন্তু মহান রব তো আগেই আমার বাড়ি সুরক্ষিত রেখে দিয়েছেন তাই থাকবো না। ওদের নিয়ে এসে একেবারে থাকবো।”
“আইচ্ছা। তয় মুখে কিছু দিয়া যাইতে হইবো কিন্তু।”
_______
—-
“সন্ধ্যা ছায়া” নামক বাড়িটা কেমন ঝলমল করছে। ঠিক এগারো বছর আগে যেমন পাঁচজনের হাসিখুশিতে বাড়িটি হেঁসে উঠতো ঠিক তেমনই আজকেও বাড়িটি প্রাণ ফিরে পেয়েছে যেন। রাহমিদ তো ঘরের ভিতর এই প্রথম সিঁড়ি দেখেছে। এটা নাকি ডুপ্লেক্স বাড়ি। উপরে কতগুলো রুম। আবার নিচেও রুম। তার কাছে এগুলো নতুন। তার কেমন শান্তি শান্তি লাগছে বাড়িটাতে। ভাইয়ু বলেছে এটা নাকি তার নিজের বাড়ি। এখানে যা খুশি তাই করা যাবে।
রুদের মনে হচ্ছে, এই বাড়িটি তার খুবই পরিচিত। এই বাড়িতে সে আগেও থেকেছে। কেমন ঝাপসা ঝাপসা কিছু স্মৃতি মনে পড়ছে যেন। সে বাড়িটির সব কিছু ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে।
ইফরা জার্নি করাতে উপরের ঘরে শুয়ে ছিল। তারপর রাহমিদ, রুদের উৎফুল্লতায় নিচে নেমে এসেছে। উপরে একা একা বোরিং লাগছিল তার। এখন রুদের সাথে গল্প করছে।
রায়হান কোথা থেকে এসে যেন বললো,
“চলো সবাই। আমার মা, বাবার কবর জিয়ারত করে আসি। ইফরা আর রুদ দূরে দাঁড়িয়ে দোয়া করবে আর আমি ও রাহমিদ কবরে ফুল গাছ লাগিয়ে দোয়া করবো।”
রায়হান অনেকগুলো ফুল গাছের চারা এনেছে। সবাই মিলে কবর জিয়ারত করলো। রাহমিদ, রুদ তো কেঁদেই দিলো। তাদের মা, বাবার কবর এই দুটো। রাহমিদ কবর ছুঁয়ে অনেকক্ষণ কবরের উপর শুয়ে ছিল। বাচ্চা মানুষ। রায়হান জোর করেও উঠাতে পারেনি। যেহেতু মহিলাদের কবর জিয়ারত উচিত না তাই রুদ আর ইফরা দূরে দাড়িয়েই দোয়া পড়েছে। যতক্ষণ তারা কবরের কাছে ছিল ততক্ষণ ইফরা, রুদ, রাহমিদ, রায়হান সবারই মন খারাপ ছিল। বাসায় এসেও মন আর ঠিক হয়নি। মা, বাবা তো সবার কাছেই ইমোশন।
_____
—
“সন্ধ্যা ছায়ায়” আজ গরীব, এতিম, মিসকিনদের চাঁদের হাট। রায়হান মা, বাবার জন্য দোয়া, কুরআন তিলাওয়াত করে তাদেরকে খাওয়ানোর নিয়ত করেছিল। বিরাট ডেকচিতে পোলাও, কোরমা, খাসির রেজালা, গরু ভুনা হচ্ছে।
রাহমিদ এতিম বাচ্চাগুলোর সাথে খেলছে। সে আর রায়হান সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মা, বাবার কবরের পাশে কুরআন পড়ে দোয়া করেছে। এখন সে একবার বাবুর্চিদের রান্না দেখে আবার বাচ্চাগুলোর সাথে খেলাধুলো করে। খুব আনন্দিত আজকে সে।
ইফরা আর রুদ কুরআন পড়া শেষ করে নিচে নামলো। পুরুষ লোকের আনাগোনা দেখে আবারও উপরে চলে গেলো। রায়হান বাবুর্চিদের হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিচ্ছে।
আজকে আরও অনেকে জড়ো হয়েছে “সন্ধ্যা ছায়া” বাড়িটায়। আফজাল হোসেন, জয়নব বেগম, তাদের মেয়ে আয়শা ও তার পুত্র এবং স্বামী, দিলদার, রুস্তম, তাদের বউ সবাই এসেছে। মূলত রায়হানই কাল রাতে তাদের এনেছে
রুস্তম, দিলদার, রায়হান, আফজাল হোসেন আর তার মেয়ের জামাই সবাই টুকটাক আলাপ করতে করতে কাজ করছে।
__
বাড়ির সামনে খোলা উঠোনে পাটি, চাদর বিছিয়ে পুরুষ সবাইকে নিয়ে খাওয়া শেষ করলো রায়হান।
মহিলারা সবাই বাড়ির মধ্যে। রায়হান তার চাচা আর ফুপুকে খাবার দিয়ে এসেছে। সে আর যাই হোক জালিম তো আর না। শুনেছে তারা খুব দুঃখে দিন পার করছে। এছাড়াও তার ফুপি সেদিন তার পায়ে ধরে মাফ চাচ্ছিলো। সে তৎক্ষণাৎ তাকে উঠিয়ে দিয়েছিল। সে তাদের ক্ষমা করলেও মহান রবের কাছে তারা আজীবন অপরাধীই থেকে যাবে। তাই নিজের হাতেই খাবার দিয়ে এসেছে।
খুব আনন্দে, আয়োজনে দিনটি শেষ হলো সবার।
_____
—–
রায়হান বিরাট এক পেন্ডুলাম ঘড়ি নিয়ে এসেছে আজ। ঘড়িটায় ঘণ্টার কাটা পড়লেই ঢং ঢং করে বাজতে শুরু করে। ঘড়িটার আওয়াজ বাহির পর্যন্ত যায়। তাই নিজেদের হলরুমে ঘড়িটা লাগিয়ে দিয়েছে রায়হান। যাতে তারা চলে গেলেও বাসাটা ফাঁকা ফাঁকা মনে না হয়।
রায়হান আজকে রাতে সবাইকে নিয়ে বাড়ির উঠোনে বসবে বলে পরিকল্পনা করেছিল কিন্তু ইফরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। ইফরার সারা শরীর ফুলে গেছে। প্রেগন্যান্সির সময়ে এরকম হয়। রায়হান প্রতিদিন সকালে ও রাতে ইফরার হাত, পায়ে তেল ম্যাসাজ করে দেয়।
রাত বাজে এখন একটা। রাহমিদ আর রুদকে উঠিয়ে নিচে নামলো রায়হান। ইফরার শরীর অসুস্থ থাকায় আর সিঁড়ি ভেঙে তাকে নিচে আনেনি রায়হান। দশটা বাজলেই ইফরা ঘুমে কুপোকাত হয়ে পড়ে।
রাতের আধারে “সন্ধ্যা ছায়া” নামক বাড়ি থেকে বের হলো তিনজন। বাড়ির বিশাল উঠোনের মাঝখানে চাদর বিছিয়ে বসে পড়লো রায়হান, রুদ আর রাহমিদ। রায়হান মাঝখানে। রাহমিদ ও রুদ তার দুই পাশে। রাতে হালকা শীত পড়ে দেখে চাদর নিয়ে এসেছে রায়হান। এখন সেই চাদরের নিচে রায়হান তার দুই ভাইবোনকে জড়িয়ে গল্প করছে। হঠাৎ রুদ জিজ্ঞেস করে উঠলো,
“ভাইয়ু জানো, আল্লাহ রাসূলের পর আমরা সবচেয়ে বেশি কাকে ভালবাসি?
রায়হান বললো,
“কাকে?”
দুইজন একসাথে বলে উঠলো,
“তোমাকে।”
রায়হান জিজ্ঞেস করলো,
“কেন?”
রুদ ভাইয়ের ঘাড়ে মাথা দিয়ে বলতে লাগলো,
“এর কোনো ব্যাখ্যা নেই ভাইয়ু। আমার কিংবা রাহমিদ উভয়ের কাছে তুমি অনেক স্পেশাল। আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া তোমার মতো ভাই আমাদের উপহার দেয়ার জন্য। মানুষ নাকি বাবা, মায়ের ঋণ শোধ করতে পারেনা কখনো। কিন্তু আমরা বাবা, মায়ের পাশাপাশি তোমার ঋণও কখনো পরিশোধ করতে পারবো না। তোমাকে আমরা কারণ ছাড়াই ভীষণ ভালবাসি ভাইয়ু।”
রাহমিদও তাল মিলিয়ে বললো,
“অনেক বেশিই ভালবাসি।”
তারপর দুজনেই রায়হানের গালে কপালে চুমু দিলো। রায়হানও দুজনের কপালে, মাথায় চুমু খেয়ে বললো,
“তোমাদেরও ভাইয়ু ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি জেনে রেখো কলিজা।”
দুজনকে শক্ত করে জড়িয়ে রেখে আকাশের দিকে তাকালো রায়হান। মহান রবের কাছে সকল কিছুর জন্য শুকরিয়া জ্ঞাপন করলো সে। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রায়হানের মনে হলো আসমান থেকে আল্লাহ বলছেন,
“সব কিছুর হিসেব ঠিকঠাক মতো হয়েছে তো? অতএব তোমরা (জ্বীন ও মানবজাতি) তোমাদের রবের কোন নিয়ামত ও অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে?”
দূর থেকে পেন্ডুলামের আওয়াজ ভেসে আসছে। রায়হান দু’চোখ মুদে ফেললো। তার চোখের কার্নিশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মুখ থেকে আপনাআপনি বেরিয়ে আসলো,
“আলহামদুলিল্লাহ।”
সমাপ্ত