#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৩৬
তাজরীন ফাতিহা
রাহমিদকে বাসায় আনা হয়েছে গতকাল রাতে। আগের তুলনায় কিছুটা সুস্থ সে। রুদ ছোট ভাইকে কাছ ছাড়া করছে না। রায়হান তো রাহমিদকে পেয়েই চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিয়েছে। তার আর কোনোদিকে মনোযোগ নেই। ভাইয়ের রুগ্ন শরীরে চোখ বুলায় একবার আবার একটুপর কিছু খাবে কিনা, কোনো সমস্যা আছে কিনা ইত্যাদি বলে চলে একমনে। তিনদিন কোচিংয়ে যায়নি সে। এখন রাহমিদকে খুব যত্নসহকারে সুপ খাইয়ে দিচ্ছে রায়হান। নিজের হাতেই বানিয়েছে সুপ। রাহমিদ খেতে না চাইলে বলে উঠলো,
“খাওয়া নিয়ে ঝামেলা কোরো না। তুমি এখনো ছোট নেই যে ধরে, বেঁধে, মেরে খাওয়াতে হবে। চুপচাপ সুপ টুকু শেষ করো।”
ভাইয়ের ঠান্ডা ধমকে রাহমিদ জোর করে খেয়েছে। খেয়েছে বললে ভুল হবে। গিলেছে কেবল। ইফরা সেদিনের পর থেকে আগের থেকে আরও নিশ্চুপ হয়ে গেছে। রায়হান ইফরার সাথে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছে। বেশিরভাগ সময় ছোট ভাইবোনের রুমে থাকে সে। রান্নাবান্নাটাও রায়হানই করে। ইফরা নিশ্চুপ হয়ে তা চেয়ে চেয়ে দেখে।
_____
রাত বাজে তিনটা। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কোনো আওয়াজ নেই চারিপাশে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মানুষ। ইফরার চোখে ঘুম নেই। বিছানায় একা শুয়ে আছে সে। এপাশ ওপাশ করছে। একপর্যায়ে উঠে বসলো। নিজের সম্পর্কে অনেক কিছু ভেবে চললো খানিকক্ষণ। তারপর বিছনা থেকে আস্তে আস্তে উঠে পাশের রুমে গেলো। দেখলো রায়হান চেয়ারে বসে ভাইয়ের মাথায় হাত দিয়ে শুয়ে আছে।
আজকে মোটামুটি ঠান্ডা ঠান্ডা ওয়েদার। রায়হান খানিকটা কাঁপছে। ইফরা রুম থেকে কাঁথা এনে রায়হানের শরীরে জড়িয়ে দিলো। রায়হান , কাঁথার ওম পেয়ে একটু নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে গেলো।
ইফরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওই নিষ্পাপ দায়িত্বশীল মুখটা দেখলো অনেকক্ষণ। রায়হান আবার নড়ে উঠতেই দ্রুত রুমে চলে গেলো। রায়হানের ঘুম হটাৎ করেই ছুটে গেছে। মনে হচ্ছিলো অনেক্ষণ তার দিকে কেউ তাকিয়ে ছিল। কিন্তু আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখলো না। ভাইবোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। একটুও লক্ষ করলো না তার গায়ে কেউ খুব যত্ন করে কাঁথা দিয়ে গিয়েছে। সে তো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন এইমুহুর্তে। তাই কারো যত্নে মোড়ানো ভালোবাসাটুকু দেখার সময় হলো না তার।
এদিকে ইফরা কাঁথা মুড়ি দিয়ে মুখে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলো। উঠে ওযু করে তাহজ্জুদ নামাজ পড়লো। মোনাজাতে কেঁদে কেঁদে কত কিছু যে বললো। সেটা মহান রব আর ইফরা ছাড়া কেউ কোনোদিন জানবে না। ফরজ সালাতের পর সবচেয়ে উত্তম সালাত হলো তাহাজ্জুদ। এই নামাজে আল্লাহর কাছে যা চাওয়া হয় আল্লাহ তায়ালা তা কবুল করে থাকেন। ইফরা সাবরিয়াহ নামের বান্দাটি তার রবের কাছে কি এমন চেয়েছে কেঁদে কেঁদে? আমরা সাধারণ মানুষেরা তা কিভাবে জানবো। এটা তো তার আর তার রবের সিক্রেট লেনাদেনা।
______
—–
রাহমিদ পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার পর এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটে গেলো। ইফরা বাসা থেকে চলে গিয়েছে কাউকে না বলে। রুদ প্রথমে ভেবেছিল ভাবি হয়তবা দরকারি কোনো কাজে গিয়েছে। কিন্তু প্রায় অনেকক্ষণ বাসায় না আসলে তার চিন্তা বাড়ে। ভাইকে কল দিয়ে দ্রুত জানায় কথাটা। রায়হান কোচিং ক্লাসে ছিল তখন। প্রথমে বিশেষ পাত্তা দেয়নি। কোথায় আর যাবে? গেলেও ওই বাবার বাড়ি। তাই সারোয়ার হোসেনকে কল দিলো সে। সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময়ের পর বললো,
” বাবা, ইফরা কি আপনাদের ওখানে গিয়েছে?
তিনি জানালেন,
“না তো বাবা। ইফরা আমাদের এখানে কেন আসবে? ও তো তোমাদের বিয়ের পর থেকেই এই বাড়িতে পা রাখেনি। মেয়েটার অনেক জেদ। সেই যে বলে গেলো কখনোই পা দিবে না, আর কখনোই এই বাড়িতে পা দেয়নি সে।”
রায়হানের বুকে কামড় দিয়ে উঠলো। রায়হান বললো,
“ও আচ্ছা। ঠিক আছে। রাখছি বাবা।”
“কি হয়েছে বললে না তো? হঠাৎ ফোন দিয়ে এটা জিজ্ঞেস করলে কেন যে ইফরা এখানে এসেছে কিনা?”
রায়হান কি বলবে ভেবে পেলো না। ওনাদেরকে কিভাবে বলবে তার মেয়ে যে বাসায় নেই। রায়হান আর কিছু ভাবতে পারলো না। বললো,
“আসলে ও বলেছিল আপনাদের ওখানে যাবে। আমি তো কোচিংয়ে চলে এসেছি তাই রাগ করে আবার চলে গেলো কিনা তাই জানতে ফোন দিয়েছি। রাখি এখন তাহলে। আসসালামু আলাইকুম।”
ফোন দ্রুত কেটে কোচিং থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে আসলো। এসে নিজেদের রুমে ঢুকলো সর্বপ্রথম। রুদ ভাইয়ের পিছনে গেলো। রায়হান আলমারি খুলে দেখলো ইফরার জামাকাপড় কিছু নেই। রায়হানের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো যেন। চারপাশ তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছু পেলো না। বিছানার মাঝ বরাবর একটা সাদা কাগজের মতো দেখলো। রায়হান দ্রুত গিয়ে ওটা খুলে দেখলো ওটা চিঠি। ইফরাই লিখেছে। সে দ্রুত পড়তে শুরু করলো,
রায়হান সাহেব,
এই চিঠিটা যখন আপনার হাতে পৌঁছুবে তখন আমি অনেকটা দূরে। ভাববেন না আবার আত্মহত্যা করেছি। উহু, আত্মহত্যার মতো মহাপাপ আমার দ্বারা হবে না। আল্লাহ নারাজ হবেন যে। কিছু কথা অনেকদিন ধরেই আপনাকে বলতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু বলা হয়ে ওঠে নি। সামনাসামনিই বলতাম কিন্তু আপনার সাথে আমার যথেষ্ট দুরত্ব তৈরি হয়েছে এই কয়দিন। তাই চিঠিতেই লিখলাম। জানেন, ছোট বেলা থেকে আমি ইফরা সাবরিয়াহ অনেকটা নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেছি। আর দশটা ছেলেমেয়েদের মতো আমি বাবা, মায়ের ভালোবাসা উপভোগ করতে পারিনি।
কে বলেছে, বাবা মা না থাকলেই কেবল এতিম হয়? উহু, বাবা মা থাকলেও এতিম হওয়া যায়। আপনার তো বাবা, মা ছিল না তাই তাদের আদর, ভালোবাসা পান নি। কিন্তু আমি যে বাবা, মা থাকতেও তাদের আদর, ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা, আহ্লাদ কিচ্ছু পাইনি। সেই ছোট্ট আমিটার খোঁজ কয়জন রেখেছে বলতে পারবেন? কেউ না।
দিনশেষে কারো কাছে আবদার করতে পারিনি, মন খুলে দশটা কথা বলতে পারিনি, কারো কাছে প্রায়োরিটি পাইনি। পেয়েছি কি জানেন, সবার একবুক লাঞ্ছনা, পাশ কাটিয়ে যাওয়া, অপবাদ আরও কত কি! জানেন, আমার মা বলতো আমার মতো মুখতোড়ের সাথে কেউ থাকতে পারবে না। যার সংসারে যাবো সেই সংসার নাকি ধ্বংস করে ফেলবো। কথাগুলোতে প্রথম প্রথম অনেক কষ্ট পেতাম। তাদের কথার বানে দগ্ধ হয়ে এই আমিটা মরে গিয়েছিলাম বহু আগে।
বলুন তো, আপনার দুঃখ বেশি না আমার দুঃখ বেশি? আপনি বাবা, মা ছাড়া এতিম আর আমি বাবা, মা, আত্মীয় স্বজন সবাইকে নিয়ে এতিম। হা হা।
জানেন, এইজীবনে আমি জীবিত অবস্থায় দুইবার মরে গিয়েছি। একবার বাবামায়ের অবহেলা, কথার বানে। আরেকবার আপনার অবহেলায়, কথার বানে। জি ঠিক শুনেছেন। আপনার কথার বানে। হাসপাতালে সবার সামনে চেঁচিয়ে যখন বললেন, রাহমিদ মরে গেলে আমার কি? আমি ইচ্ছে করেই আপনাকে জানাই নি ওর অসুস্থতার কথা। আল্টিমেটলি পুরো দোষটা আমাকে দিয়েছিলেন। অথচ আমি কখনোই চাইনি রুদ, রাহমিদের কিছু হোক। ওরা আমারও দুর্বলতা হয়ে গিয়েছিল। এই বাচ্চা দুটোর দিকে চাইলে আমার ভীষণ মায়া লাগতো। বিশ্বাস করুন ওদের কিছু হোক সেটা আমি কোনোভাবেই চাইনি।
জানেন, আপনার এই কথাকে আমি ভুলে যেতাম যদি না আপনি আমাকে বিগত কয়েকটা দিন না অবহেলা করতেন। আপনি আমাকে এমন ভাবে এড়িয়ে চলেছেন যেন আমি এক্সিস্টই করিনা। আমাকে দিয়ে রান্না করাননি। যদি আমি কোনোভাবে তরকারিতে কিছু মিশিয়ে দেই সেই ভয়ে বোধহয়। আমাকে এমনভাবে এড়িয়ে চলেছেন, যেন আমি পরিষ্কার পানিতে ভেসে আসা একটুকরো খড়কুটো।
অনেক কথা বলে ফেললাম। আমাকে খোঁজার চেষ্টা করবেন না। জানি আমাকে খুঁজবেন না। আমি এমন কেউ না যে আমাকে খুঁজতে হবে। আপনার জীবনে যে কয়টা দিন ছিলাম, আপনাদের সবাইকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছি। পারলে মাফ করে দিয়েন। রুদ, রাহমিদকে দেখে রাখবেন। ওদের দেখাশোনার জন্য আপনি নামক মহৎ মানুষটি আছে। বিশ্বাস করুন আমার জন্য সেই ছোট্ট থেকে এরকম একটা বস্তুও ছিল না।
আমার চারপাশে আমার বাবা, মা, স্বামী, দেবর, ননদ সব আছে কিন্তু সত্যি বলতে আমার আসলে কেউ নেই। আমি একা। ভীষণ একলা। জীবনের ২২টি বছর যেহেতু একাই ছিলাম বাকি জীবন টুকুও একাই পাড়ি দিতে পারবো। ভালো থাকবেন। আপনার জন্য অফুরন্ত দোয়া।
ইতি
আপনার ঘাড় থেকে নামানো এক বোঝা।
চিঠি টুকু পড়ে রায়হান ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। তার চোখ ছলছল করছে। বুকটা কেমন ফেটে যাচ্ছে যেন। তার দায়িত্বে থেকেও মেয়েটা কতটা অবহেলার শিকার হয়েছে। সে নিজেই করেছে। কিভাবে পারলো। ভাইকে ভেঙে পড়তে দেখে রুদ ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো। রায়হান বোনকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। তার খুব খারাপ লাগছে।
ইফরাকে বিয়ে করার পিছনে তার জীবনের করুন কাহিনী অনেকাংশে দায়ী। ইফরার বাবা যখন তার হাত ধরে বলেছিল,
“বাবা, মেয়েটাকে দেখে রেখো। ও ছোট থেকে ভীষণ একা। আমরা আমাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারিনি। তোমার দায়িত্বে দিচ্ছি। মেয়েটাকে ভালো রেখো। ও ভীষণ রাগী, গম্ভীর। ওর কথায় রেগে যেও না বাবা। মেয়েটা আমার ছোট থেকে আমাদের ভালোবাসার অভাবে এমন হয়ে গিয়েছে। তুমি একটু সামলে নিও। তোমার ধৈর্যের সুনাম শুনেই আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিয়েছি বাবা। দেখে রেখো।”
রায়হান সেদিন সারোয়ার হোসেনকে কথা দিয়েছিল সে দেখে রাখবে। কোনো দায়িত্বের হেরফের হবে না। অথচ আজ সে কি করলো? তার মাথা ভীষণ ব্যথা করছে। সে আর কিছু ভাবতে পারছে না।
কি হবে রায়হান জাইম আর ইফরা সাবরিয়াহর পরবর্তী জীবনে? সুখ কি ধরা দিবে তাদের জীবনে নাকি অধরাই থেকে যাবে?
চলবে…..
#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৩৭
তাজরীন ফাতিহা
“দেয়ালের দিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করো না। সেখানে একা একা দরজা জন্মাবে না। ওপাশে যেতে চাইলে দরজা বানাতে চেষ্টা করো।”
~কোকো শ্যানেল
“পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী যোদ্ধা হলো ধৈর্য এবং সময়।”
~লিও টলস্টয়
সময় নিয়ে এই দুটি উক্তি রায়হানের ভীষণ পছন্দের। সে যখন বিদেশী নভেল বা বিখ্যাত উক্তি পড়ে তখন বিখ্যাত লাইন বা উক্তিগুলো আন্ডারলাইন করে রাখে। অবশ্যই শিক্ষণীয় নভেল বা উক্তির প্রতি তার ঝোঁক প্রবল। সে নিজেকে ধৈর্যবান আর সময়নিষ্ঠবান ভাবতো এতদিন তবে আজ মনে হচ্ছে সে ভুল।
ধৈর্যশীল আর সময়নিষ্ঠবান হওয়ার জন্য জীবনে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিকে ফলো করার চেষ্টা করেছে সে। তার মধ্যে নবীজী (সাঃ) সবার উপরে। এখন মনে হচ্ছে তার আদর্শকে সে ঠিকমতো ধারণ করতে পারেনি। নাহলে তার বউ হারিয়ে যায়।
রায়হান এখন ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে চুপচাপ বসে আছে। কত জায়গায় খুঁজেছে কিন্তু কোথাও পায়নি ইফরাকে। যেন মানুষটা হারিয়ে গেছে চোখের পলকে। রায়হানের এখন পাগল পাগল লাগে। দুইদিন ধরে নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে সারাক্ষণ খুঁজে বেড়িয়েছে সে। তবে ইফরা তো ভালো ইফরার কোনো চিহ্নই কোথাও পায়নি সে।
ইফরার বাবাকে প্রথমে ইনফর্ম না করতে চাইলেও পরে রায়হান জানিয়ে দেয়। ইফরার বাবার মাথায় তো আকাশ ভেঙে পড়ে যেন। তার মেয়েটা কোথায় হারিয়ে গেলো সবাইকে কাঁদিয়ে। ইফরার মা ইয়াসমিন আহমেদ থেকে থেকে কান্না করছেন। ওনারা এখন রায়হানের বাসায়। ইফরার দাদি চোখ, মুখ শক্ত করে রেখেছেন। ইয়াসমিন আহমেদকে কান্না করতে দেখে বলে উঠলেন,
“তোমার ন্যাকা কান্না থামাও তো। জীবনে মাইয়াডার সাথে দুইডা ভালা কথা কইছো? এহন মরা কান্না জুইড়া দিছো কেন? আমার নাতিনের জীবনডা তামা তামা বানাই দিছো তোমরা সবাই। ভালাই করছে ভাগছে। তোমাগো লগে থাকলে আমার নাতিনডা মইরা যাইতো।”
উনি রাগ রাগ কণ্ঠে কথাগুলো বলে থামলেন। শাশুড়ির ধমকে ইয়াসমিন আহমেদ কান্না চাপা দিতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না। কান্নার আওয়াজ শোনা যেতেই লাগলো। সালমা হোসেন বিরক্ত ভঙ্গিতে উঠে রায়হানের রুমে চলে গেলেন। তারা এতক্ষণ রাহমিদ আর রুদের ঘরে বসে ছিলেন।
সালমা হোসেন রায়হানকে চুপচাপ মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে তার পাশে গিয়ে বসলো। রায়হান চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো ইফরার দাদিকে। সালমা হোসেন দেখলেন রায়হানের চোখের নিচে কালি, চোখ ডেবে গেছে। তার মায়া লাগলো। পরক্ষণেই নাতনির চলে যাওয়ার কথা মনে পড়লে চোখ, মুখ শক্ত করে ফেললো। বললো,
“ওই চ্যাংরা, তোর বউ পালাইলো কেন? তোরে না হাত ধইরা কইছিলাম নাতিনডারে দেইখা রাখিস। এই তোর দেইখা রাখা?”
রায়হান কোনো জবাব দিলো না। দাদি আবারও কথা বলে উঠলেন। বললেন,
“কিরে থোতা বন্ধ কেন? এহন আর মুখ চলে না বুঝি? দেইখা রাখতে না পারলে বিয়া করছিলি কেন? তোরে কঠিন বাটনা বাটমু আমার নাতিনরে খুঁইজা না পাইলে।”
রুদ, রাহমিদ ভাইয়ের পাশে বসে আছে। রুদের চোখে মুখে উদ্বেগ, মন খারাপ থাকলেও রাহমিদের চোখেমুখে তার ছিটেফোঁটাও নেই। সে আরামছে বসে বসে পা দোলাচ্ছে। ইফরার দাদি বিষয়টা খেয়াল করে বললেন,
“ওই ছোট্ট চ্যাংরা, তুই অভদ্রের মতো ঠ্যাং লড়াস কেন? দেহিস না সামনে মুরুব্বী বসা। দেইখা তো মনে হয়না ভাবি হারানোর দুঃখে কোনো কষ্ট পাইছিস। মনের সুখে ঠ্যাং লড়াইয়া যাইতাছিস কহন থেকে।”
এতক্ষণ রাহমিদ ভাইকে ধমক খেতে দেখেও কিছু বলেনি। কিন্তু এখন তাকে সরাসরি ধমক দিয়ে কথা বলাতে তার ইগো হার্ট হয়েছে। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বলে উঠলো,
“ঠ্যাং তো আমার। আমার ঠ্যাং আমি লাড়ামু তাতে আপনার কি? ভাইয়ুকে কথা শুনাচ্ছেন শুনান। সে আপনার নাত জামাই কথা শুনাতেই পারেন। কিন্তু আমি আপনার কোন নাতিনের জামাই যে ধমক মেরে কথা বলছেন। আমি কি আপনার কোনো নাতিনকে ভাগিয়েছি?”
ইফরার দাদি চোখ বড় বড় করে বললেন,
“তোগো কাছে আমি আমার আর কোনো নাতিন থাকলেও দিতাম না। নাক টিপলে দুধ বেড়োয় সেদিনের চ্যাংরা আসছে তেলেছমতি দেখাতে।”
“নাক টিপে দুধ বের করে দেখান। এক্ষুণি দেখাবেন।”
রাহমিদ আয়েশ করে বসে নাক বাড়িয়ে দিলো। সালমা হোসেন বিব্রত ভঙ্গিতে রাহমিদের দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলেন।
রুদ ছোট ভাইয়ের কথা শুনে ওর পিঠে মারলো। ইফরার দাদি বড় বড় চোখ করে রাহমিদের দিকে এখনো তাকিয়ে আছেন। বেচারি বোধহয় বুঝে গেছে, বড়টার সাথে পারলেও ছোটটার সাথে পারবেন না তিনি। ভীষণ বজ্জাত আর বুদ্ধিমান ছোট টা। রায়হান ছোট ভাইকে ধমকে উঠলো,
“রাহমিদ, এটা কেমন বেয়াদবি? সে তোমার গুরুজন। এভাবে কথা বলছো কেন? এটা কেমন বিহেভ তোমার?”
রাহমিদ ভাইয়ের ধমকে মাথা নিচু করে বসে রইলো। সালমা হোসেন বললেন,
“থাক থাক। আর ঢং করা লাগবো না। আমার নাতিনরে ভাগাইয়া এহন সাধু সাজোন লাগতো না। সব কটা জাহেল। আমার নাতিনডা আছিলো কেমনে এই সংসারে?”
রায়হান এতক্ষণ পর মুখ খুলে বললো,
“দাদি আমাকে একটু ঘুমোতে দিবেন। আজকে দুইদিন ধরে আমি দু চোখের পাতা এক করতে পারছিনা। এখন প্রচুর ঘুম আসছে। বিশ্বাস করুন আমার জীবনে আমি একটু শান্তিতে ঘুমোতে পারিনি মা, বাবা ইন্তেকালের পর। কোনোদিন পারবো কিনা জানি না। তবে এখন আমার প্রচুর ঘুম আসছে। আমি কি একটু ঘুমোতে পারি? কথা দিচ্ছি ঘুম থেকে উঠে আপনার নাতনিকে আবার খুঁজবো।”
সালমা হোসেনের এই কথাটা শুনে কি হলো জানা নেই। তবে তার চোখের কোন ভিজে গেছে। তার সামনে বসা ছেলেটার অনেক দুঃখ। তার নাতনিও ছেলেটাকে সুখে রাখেনি সেটা তিনি জানেন। ইফরা যে রাগী। রাগ নিয়েই কথা বলতো সারাক্ষণ। নিশ্চয়ই এই ছেলেটার সাথেও রাগী, রূঢ় আচরণ করতো। তিনি আর কোনো কথা না বলে বেড়িয়ে গেলেন রুম থেকে।
ইফরার দাদিকে চলে যেতে দেখে রায়হান চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়লো। নিমিষের মধ্যে সে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল।
________
—–
“তুই কি আর ফিরে যাবি না?”
ইফরার বান্ধবী ফিহা কথাটি বলে থামলো। ইফরা মুখ গম্ভীর করে বললো,
“সেটা সময় বলে দিবে। ফিরে গেলে তো দেখতেই পাবি। কেন আমি থাকায় তোর সমস্যা হচ্ছে নাকি?”
ফিহা বালিশে হেলান দিয়ে বললো,
“সমস্যা আমার না আমার পরিবারের। তারা তো ভাবছে তুই কয়েকদিন থেকে চলে যাবি। কিন্তু তুই তো একেবারেই চলে এসেছিস বললি। মা তো বলেই বসেছে, তোর বান্ধবী না বিবাহিত? তাহলে জামাই রেখে তোর কাছে কি? আবার জামাই ছেড়ে চলে এসেছে নাকি? বলা তো যায়না, যে রাগী ও। চলেও আসতে পারে।”
ইফরার কথাটি শুনে খুব খারাপ লাগলো। বিষন্নতায় মন ছেয়ে গেলো। ফিহা ব্যাপারটা লক্ষ করে বললো,
“শোন, জীবনটা নাটক সিনেমা না? তুই বললি আর সব কিছু হয়ে গেলো। আমরা একটা সমাজে বাস করি। এখানে কিছু নিয়ম কানুন আছে। এসব মেনেই আমাদের এই পৃথিবীতে টিকে থাকতে হয়। রাগারাগি প্রত্যেকটা সংসারেই হয়। আমাদের উচিত রাগারাগি হলে মাথা ঠান্ডা করে তার মীমাংসা করা। কারণ রাগ হলো শয়তানের অস্ত্র। জানিস শয়তান সবচেয়ে খুশি হয় কখন?”
ইফরা কথা বললো না। চুপটি করে ফিহার কথা শুনতে লাগলো। ফিহা আবার বলতে লাগলো,
“শয়তান সবচেয়ে খুশি হয় স্বামী স্ত্রীর তালাক হলে। তাই স্বামী স্ত্রীর বেশিক্ষণ রাগারাগি করে থাকা উচিত না। এতে করে শয়তান তার অস্ত্র ব্যবহার করে স্বামী স্ত্রীর ছাড়াছাড়ি করিয়ে ফেলে। স্বামী স্ত্রীর তালাক হয়ে গেলে সে তার অনুসারীদের নিয়ে উল্লাসে মেতে ওঠে। শয়তানের যে অনুসারী স্বামী, স্ত্রীর বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে সারাদিনের কুকর্মের ফলাফল দেয়ার সময় ঐ অনুসারীর মাথায় সেরা মুকুট পড়িয়ে দেয় স্বয়ং শয়তান। অর্থাৎ সেরা অপকর্মের মুকুট পায় যে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে তালাক করাতে পারে সে। ভাবতে পারছিস কি ভয়ংকর কথা?
ফিহা একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলো,
“তোর স্বামী যদি তোকে ভুল বুঝে তুই পারবি তাকে সঠিকটা বুঝাতে। এতদিন আমার কাছে ছিলিস তুই। কিন্তু সে যদি ভাবে আল্লাহ না করুক তুই কোনো পরপুরুষের সাথে ছিলিস। পারবি তার মনে সত্য উদ্রেক করতে। শয়তান তো এটাই চায়।”
ইফরার মনে ভয় ঢুকে গেলো। সে ভাবতে লাগলো কিভাবে কি করবে। তবে একটা বিষয়ে নিশ্চিত সে। সামনে কি করবে সব তার আগেই ভাবা শেষ। দেখা যাক তার কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারে। শয়তানকে সে কিছুতেই জয়ী হতে দিবে না। এটাই তার নিজের সাথে নিজের অঙ্গীকার।
চলবে….