#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৩৩.১
তাজরীন_ফাতিহা
“তুমি এখন থেকে আমাদের বাসায় থাকবে বড় মেয়ে মানুষ?”
রাহমিদ বিজ্ঞের মতো কথাগুলো বলে থামলো। ইফরা মুখ গম্ভীর করে বললো,
“তো বাসা থেকে বের হয়ে যাবো? বড় মেয়ে মানুষ আবার কি?”
রাহমিদ থতমত খেলো। তারপর সেও মুখ গম্ভীর করে বললো,
“তুমি বিরক্ত হচ্ছো কথায়?”
“যদি বলি হ্যাঁ তাহলে কি কথা বলা বন্ধ করবে?”
রাহমিদ মুখ কুঁচকে ইফরার দিকে তাকিয়ে রইলো। রুদ এক গ্লাস পানি নিয়ে ইফরাকে দিলো। ইফরা চুপচাপ বিসমিল্লাহ বলে পানি পান করলো। ওর মুখ এখনো গম্ভীর।
আজকের মতো একটা দিনে তাদের বাসা খালি। মাত্র তিনজন মানুষ তারা। আজকে আরেকজন যোগ হয়েছে। তাদের ভাইয়ুর বউ। রুদ মনে মনে কথাগুলো ভেবে ইফরাকে উদ্দেশ্য করে খুশিমনে বললো,
“ভাবি তোমার এখানে কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবে। তুমি আমাকে রুদ বলে ডেকো। রুদ বলে ডাক দিলেই আমি দৌঁড় দিয়ে তোমার কাছে চলে আসবো।”
হাসিমুখে কথাটা বলে ইফরার দিকে তাকালো। ইফরা মুখ অন্ধকার করে বললো,
“অপরিচিত কাউকে আপনি সম্বোধন করতে হয় সেটা জানো না? এভাবে হুট করে বড় কাউকে তুমি বলবে না। দুইজনের কেউই না। এটা ব্যাড ম্যানার্স।”
রুদের হাসিখুশি মুখ নিমিষেই চুপসে গেলো। রাহমিদ বোনের কালো মুখ দেখে বললো,
“আপুনি চলো এখান থেকে। উনি বোধহয় আমাদের উপর বিরক্ত হচ্ছেন।”
রাহমিদের কণ্ঠে রাগ প্রকাশ পাচ্ছিলো। নিজের অপমান সহ্য করলেও বোনের অপমান কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না সে। তাই কিছুটা রাগ প্রকাশ পেলো তার কথায়। বোনকে টেনে হিঁচড়ে রুম থেকে নিয়ে তাদের বরাদ্দকৃত রুমে চলে গেলো।
ইফরা চুপচাপ রোবটের মতো উঠে মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়লো। তার মন মেজাজ কোনোটাই ভালো নেই। বেশিরভাগ সময় সে চুপচাপ থাকে কারণ মুখ খুললেই তো রোবোটিক আওয়াজ ছাড়া আর কিছু বের হয়না। এই গুরুগম্ভীর স্বভাব নিয়ে আগামী দিনগুলো ইফরার কেমন কাটবে একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কেউই তা জানে না।
______
রায়হান রুমে ঢুকে রুম অন্ধকার পেলো। বুঝে নিলো মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। সে বাথরুমে গিয়ে মুখ, হাত, পা ধুয়ে বের হলো। ভাইবোনকে দেখার উদ্দেশ্যে পাশের রুমে গেলো। দেখলো তার ভাইবোন একে অন্যকে জড়িয়ে শুয়ে আছে। রাহমিদটা ছোট বেলা থেকেই হাত, পা ছড়িয়ে ঘুমায়। এখনো হাত, পা ছড়িয়ে বোনের কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। আর রুদ ভাইকে জড়িয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। রায়হানের চোখ জুড়িয়ে গেলো। পরক্ষণেই মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো। এতদিন সে এই ভাইবোনকে আগলে ঘুমাতো আর আজ থেকে তারা আলাদা থাকবে। তার সাথে ঘুমানোর মানুষ এসে গেছে।
রায়হান অবশ্য ওদের ঘুম পাড়িয়েই ওই রুমে চলে যেতো। বোনকে কমফোর্ট জোন দেয়ার জন্য রুদ বড় হওয়ার পর পরই অন্য রুমে ঘুমাতো সে। রাহমিদ শুধু বোনের সাথে ঘুমায়। যেহেতু বড় ভাই বোনের মাঝখানে ঘুমিয়ে অভ্যাস রাহমিদের তাই শুধুমাত্র ছোট ভাইয়ের জন্য তারা তিনজন একসাথে ঘুমাতো। এখন চাইলেও আর ভাইবোনের সাথে ঘুমাতে পারবে না।
রায়হান দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাইবোনকে চুমু দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। ভাইবোনগুলো আজকে তার সাথে কথা না বলেই ঘুমিয়ে গেলো। ভাইয়ের বউ আসার খুশিতে এতদিনের অভ্যাস ভুলে গেলো। রায়হান চেহারায় অসন্তুষ্টির রেখা ফুটে উঠলো কিছুটা।
_____
রায়হান রুমে এসেই বিছনায় শুয়ে পড়লো আস্তে করে। ইফরা আস্তে করে উঠে বসলো। বললো,
“আপনি কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?”
রায়হান তড়াক করে উঠে বসলো। বললো,
“জি না। আমি ভেবেছি আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাই আর ডিস্টার্ব করিনি।”
ইফরা হাঁটু ভাঁজ করে বসলো। চোখ মুখ শক্ত করে বললো,
“না ঘুমাই নি। জেগেই ছিলাম। শুনুন কিছু কথা খোলাশা করা জরুরি বলে আমি মনে করি।”
ইফরার স্বভাবজাত কাঠখোট্টা কথা। রায়হান কিছুক্ষণের জন্য থতমত খেলো। তার জানা মতে মেয়েরা বিয়ের রাতে লাজুক থাকে। কথা থাকে ছোট কিন্তু এই মেয়ের কথা দেখি বুলেটের মতো খড়খড়ে। তার নিজেরই তো একটা মেয়ের সাথে বেড শেয়ার করতে লজ্জা লাগছে। সেখানে মেয়েটা কি অবলীলায় কথাগুলো বলছে। ইফরা রায়হানের চোখের সামনে তুড়ি বাজাতেই রায়হানের হুঁশ ফিরলো। রায়হান কোনমতে বললো,
“জি বলুন।”
ইফরা রোবোটিক গলায় বললো,
“আমার এখানে এডজাস্ট করতে সময় লাগবে। আমার উপরে খবরদারি করা যাবে না। আমাকে আমার মতো থাকতে দিতে হবে। কোনো কিছুর জন্য জোরজবরদস্তি করা যাবে না। যেহেতু আমার বাবা মা তাদের ঘাড় থেকে নামিয়ে আপনার ঘাড়ে ট্রান্সফার করেছেন সেহেতু আমাকে না পড়ালেও চলবে। আপনার টাকাও বেঁচে যাবে। বুঝেছেন?”
রায়হানের মনে হলো বাজারের কোনো ফর্দ শুনানো হচ্ছে। যেহেতু ইফরার রগচটে স্বভাব সম্পর্কে সারোয়ার হোসেন আগেই কিছুটা অবগত করেছেন তাই রায়হান আর রাগ করলো না। অন্য কেউ হলে ওর কথার বিপরীতে প্রচণ্ড রাগ করতো। বিয়ের রাতেই বরের সাথে বেয়াদবি করার জন্য তার জন্য সালিশ বসানো হতো। তবে রায়হান কিছুই করবে না। এর থেকেও কত কঠিন কঠিন পরিস্থিতি রায়হান মোকাবেলা করেছে সেখানে এতটুকু রোবোটিক খিটখিটে কথা হজম করাই যায়। সে মুচকি হেঁসে কৌতুক গলায় বললো,
“বিছানাটা কি আলাদা করতে হবে সাহেবা?”
ইফরা চোখ মুখ আগের চেয়েও শক্ত করে রায়হানের দিকে তাকালো। তারপর শক্ত গলায় বললো,
“না।”
রায়হান আড়মোড়া ভেঙে বললো,
“যাক বাবা বাঁচলাম। বিছনা আলাদা করতে বললে অবশ্য সমস্যা ছিল না। নাটক সিনেমার মতো আমার সোফা না থাকলেও বিকল্প পন্থা একটা ছিল। ভাইবোনের খাটে গিয়ে আরামছে শুয়ে পড়া যেতো।”
ইফরা আগের মতোই বসে আছে। রায়হান বুঝলো প্রথম দিনেই মজা করা ঠিক হয়নি। চেনা জানা হয়নি এতেই মশকরা করা উচিত হয়নি। তাই তাড়াতাড়ি করে বললো,
“আরে রেগে যাচ্ছেন কেন? নরমাল হয়ে বসুন। আপনি কি সব কোথায় এরকম রেগে থাকেন নাকি?”
ইফরা কোনো কথা বললো না। রায়হান কথা ঘুরাতে আবার বললো,
“আরে আমরা তো পরিচিতই হলাম না। তখন থেকে অহেতুক কথা বলেই যাচ্ছি।”
ইফরা এবার মুখ খুললো,
“আমার পরিচয় দেয়ার মতো কিছুই নেই। আমি একজন মেয়ে। এটা ছাড়া আমার কোনো পরিচয় নেই।”
“এটা কেমন পরিচিতি। এরকম বললে তো আমার কোনো অস্তিত্বই পৃথিবীতে নেই। বাবা, মা থেকেও যদি আপনার কোনো পরিচয় না থাকে তাহলে আমি তো পৃথিবীতে এক্সিস্টই করি না। এবার সুন্দর করে আমার পরিচয় বলি। তারপর আপনি বলেবেন। ঠিক আছে?”
ইফরা কিছুটা নরম হয়ে বসলো। কোনো কথাই বললো না। রায়হান বলতে শুরু করলো,
“আমার নাম রায়হান জাইম। খন্দকার রায়হান জাইম। বাবার নাম মৃত খন্দকার রাতিব ইকবাল। মায়ের নাম মৃত জাইয়ানা আনজুম। আমরা তিনজন ভাইবোন। বোনের নাম খন্দকার রুদাইফা জিনাত আর ভাইয়ের নাম খন্দকার রাহমিদ জাইফ। আমার পরিবার এই দুইজন। আমার সব কিছু এই দুজনকে ঘিরে। সংক্ষেপে আমাদের তিনজনেরই পরিচয় আমরা এতিম। আমি একটা কোচিং সেন্টারে জব করি। এবার আপনার পালা ম্যাডাম।”
“সংক্ষেপে আমারদের তিনজনেরই পরিচয় আমরা এতিম” কথাটা বার বার ইফরার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। হাসিমুখের আড়ালে কথাটায় কি পরিমাণ কষ্ট লুকায়িত ছিল ইফরা একটু হলেও উপলব্ধি করতে পারছে। ইফরার মন কিছুটা নরম হলো। রায়হানের ডাকে এবার কল্পনা থেকে বের হয়ে বললো,
“আমার নাম ইফরা সাবরিয়াহ। আমার কোনো ভাইবোন নেই। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বোটানি নিয়ে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছি। আমার অভিবাবক আমার দাদি। এতোটুকুই আমার পরিচয়।”
“আপনার বাবা, মায়ের নাম তো বললেন না?”
ইফরা কথা ঘুরিয়ে বললো,
“আমার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়ুন তাহলে।”
“হ্যাঁ ঘুমাতে হবে। কালকে সকালে আবার উঠতে হবে। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি একটু আসছি।”
রায়হান ঘড়ি দেখে তাড়াহুড়া করে দাঁড়িয়ে গেলো। তারপর ভাইবোনের রুমে গিয়ে ওদের গা থেকে চাদর সরিয়ে দিলো। বাচ্চা দুটো ঘেমে গেছে। রায়হান তাদের শিয়রে বসে কিছুক্ষণ মাথা হাতিয়ে দিলো। তারপর ঘাম মুছে দিলো। ভাই বোন তার প্রচুর ঘামে। এটা বর্ষাকাল তবুও ভ্যাপসা গরম পড়ে এই সময়টায়। কারেন্ট চলে গেলে তো আরও সমস্যা হয়। সারা রাত সে হাত পাখা চালিয়ে বাতাস দেয়। যাতে ভাইবোনের ঘুম কোনোভাবেই না ভাঙে।
সবকিছু ঠিকঠাক করে বেশ রাতে নিজের রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। পাশে ঘুমে বেহুঁশ হয়ে ঘুমাচ্ছে তার নববিবাহিত স্ত্রী। দুইজন দুই দিকে ফিরে শুয়ে আছে। নববিবাহিতের কোনো ছায়াও এদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে কতকালের তাদের সংসার। সারাদিনের সংসার শেষে দুইজন বেহুঁশ হয়ে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।
আগামী দিনের সূর্যোদয় কেমন কাটবে এই নব দম্পত্তির?
চলবে…
#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৩৩.২(বর্ধিতাংশ)
তাজরীন ফাতিহা
ফজরের আজান কানে যাওয়ার সাথে সাথেই রায়হানের ঘুম ভেঙে যাওয়া নতুন কিছু নয়। যত রাত করেই ঘুমাক সে ফজরের আজান তার কানে পৌঁছুবেই। আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আজান শুনেই আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় গড়াগড়ি খেতে গিয়ে কোনো কিছুর সাথে বাধা পেলো। চট করে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো তার নববিবাহিত স্ত্রীর গায়ে হাত, পা মেলে দিয়েছে সে। তাড়াহুড়া করে হাত, পা সরিয়ে ফেললো। একজন মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছে তার অনুমতি ছাড়া ব্যাপারটা ভেবেই কেমন যেন লাগছে তার। হোক সে স্ত্রী। তবুও তার ভীষণ অকোয়ার্ড লাগছে।
ইফরার ঘুম ভেঙে গেছে কোনো কিছুর ধাক্কায়। রায়হান হাত, পা সরানোর সময় ইফরার ঘুম ছুটে গেছে। তাকে ধাক্কা দিলো কে? দাদু মণি নাকি? চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো রায়হান বসে বসে কি যেন বিড়বিড় করছে। হঠাৎ চোখের সামনে অপরিচিত জায়গা আর পুরুষ মানুষ দেখে খানিকক্ষণের জন্য তব্দা খেয়ে গেলো। এমনিতেই ঘুম থেকে উঠলে সাময়িক সময়ের জন্য মানুষের স্মৃতি ঘোলাটে থাকে। ইফরারও তাই। আচানক চিল্লিয়ে উঠলো সে। রায়হান চিল্লানোতে হতভম্ব হয়ে গেলো। বললো,
“আরে ভাই আপনি চিল্লাচ্ছেন কেন?”
ইফরা উঠে বসে রায়হানকে ভালোভাবে দেখে বললো,
“দুঃখিত। আমি কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম সব। নতুন জায়গা তো মানিয়ে নেয়া হয়নি এখনো।”
রায়হান আর কিছু বললো না। ওযু করার উদ্দেশ্যে বাথরুমে যাওয়ার পথে ইফরার কথা শুনে থেমে গেলো।
“আপনাদের এখানে জ্বীন, ভূত আছে নাকি?”
রায়হান ঘুরে অবাক স্বরে বললো,
“জ্বীন, ভূত আসবে কোথা থেকে?”
“না রাতে ঘুমের ঘোরে শরীর ভার ভার লাগছিল। এরপর একটু আগে কে যেন ধাক্কা দিলো মনে হলো। নাকি স্বপ্ন দেখলাম বুঝতে পারলাম না।”
রায়হানের এখন সত্যি লজ্জা লাগছে। একটা মেয়েকে রাতে জড়িয়ে শুয়ে ছিল। সে বোধহয় ভাইবোন ভেবে জড়িয়ে ধরেছিল। ভাইবোনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে ঘুমাতে বদ অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। কালকে রাতে অন্য কাউকে জড়িয়ে ধরেছে। একজন পুরুষ হয়ে যে পরিমাণ লজ্জা সে পাচ্ছে মেয়ে হলে গাল লাল হয়ে যেতো এতক্ষণে। ছেলে মানুষের লজ্জা দেখা যায়না। তাদের লজ্জা হয় সুপ্ত।
ইফরা রায়হানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“দাঁড়িয়ে আছেন কেন? যেখানে যাচ্ছিলেন যান। আমি কিছুক্ষণ ঘুমাবো।”
“কেন নামাজ পড়বেন না?”
“কিসের নামাজ? তাহাজ্জুদের?”
“না ফজরের।”
“ওমা আজান দিয়ে দিয়েছে। তো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? দ্রুত যান। আপনার ওযু শেষে আমি ঢুকবো। আজকে মাথা ভার ভার লাগছে। এতো তাড়াতাড়ি আজান দিয়ে দিলো।”
“আজান ঠিক টাইমেই দিয়েছে। আপনি আর আমি রাত পর্যন্ত গল্প করলাম না এতেই সময় চলে গিয়েছিল।”
“ওহ। হবে হয়তো। আপনি ওযু করে আসুন।আপনার পর আমি যাবো।”
“আচ্ছা।”
কথাটুকু বলেই রায়হান ওযু করতে চলে গেলো। ওযু করে বের হয়ে দেখলো ইফরা নামাজের খিমার বের করছে। রায়হান তাকে পাশ কাটিয়ে ভাইবোনের রুমে চলে গেলো। ইফরা গুরুগম্ভীর চোখে সেইদিকে তাকিয়ে রইলো। এই পৃথিবীতে তাকে প্রায়োরিটি দেয়ার মানুষের খুবই অভাব। ছোট বেলা থেকে আজ পর্যন্ত কেউই আগ বাড়িয়ে তার খোঁজ নেয়নি। কেউ নিজের ঘাড় থেকে নামিয়ে অন্যের ঘাড়ে দেয়। অন্যজন আবার খুব যত্ন করে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। এসব আর এখন গায়ে লাগে না তার।
ইফরা কিছু হয়নি এমন ভাব করে বাথরুমে ঢুকে গেলো।
______
—-
“রাহমিদ, রুদ উঠে পড়ুন কলিজা। ফজরের সময় হয়ে গেছে।”
রায়হান ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো। রুদ এক ডাকে উঠলেও রাহমিদ বিছনায় গড়াগড়ি খেতে লাগলো। রায়হান তা দেখে বললো,
“নামাজের ব্যাপারে গড়িমসি একেবারেই অপছন্দ আমার। দ্রুত উঠে পড়ুন। আল্লাহকে সিজদাহ দিন। আল্লাহ্ আপনার সারাদিন বরকতময় করে দিবেন।”
রাহমিদ ভাইয়ের কঠোর কথার বিপরীতে তাড়াহুড়া করে উঠে বসলো। উঠে চোখ কচলালো। এর মধ্যে রুদ ওযু করে এসেছে। রাহমিদ ঘুম ঘুম চোখে বাথরুমে গেলো। রায়হান অপেক্ষা করলো ভাইয়ের জন্য। সারাদিনের মধ্যে এই ফজরের নামাজটাই দুই ভাই একসাথে পড়তে পারে। অন্যসময় রায়হান থাকে কোচিংয়ে আর রাহমিদ স্কুলে। রুদ নামাজে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। রাহমিদ বের হলে রায়হান ওকে নিয়ে মসজিদে চলে গেলো।
_____
“ভাবি আসবো?”
রুদ নামাজ পড়ে ইফরার সাথে দেখা করতে চলে এসেছে। ইফরা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। রুদের ডাকে ওর দিকে ফিরলো। ঘাড় কাত করে অনুমতি দিলো। রুদ ঢুকে বললো,
“কি করছেন?”
ইফরা ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কি করতে দেখছো?”
রুদ থতমত খেলো। ইফরা আবারও জিজ্ঞাসা করায় রুদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“দাঁড়িয়ে আছেন।”
ইফরা হাত ভাঁজ করে বললো,
“তো জিজ্ঞাসা করলে কেন? এই প্রশ্নটা বিরক্তকর। অন্তত আমার কাছে খুবই বিরক্তকর। যখন একটা মানুষকে দেখো কোনো কাজ করছে বা বসে আছে অথবা দাঁড়িয়ে আছে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করবে কেন? কি করছেন? এটা কি কোনো প্রশ্ন হলো? দেখছোই তো দাঁড়িয়ে আছি তাহলে এই প্রশ্নের মানে কি? কোনো কাজ নেই আজাইরা কোয়েশ্চেন করা ছাড়া কিছু মানুষের।”
রুদ মুখ নামিয়ে চোখ মুখ আধার করে দাঁড়ালো। তারপর বললো,
“দুঃখিত ভাবি।
“তোমাকে আমি বকেছি?”
রুদ বুঝলো না কি বলবে এই কথার বিপরীতে। চুপ করে মাথা নিচু করেই থাকলো। ইফরা একটু নরম হয়ে বললো,
“মন খারাপ করো না। তুমি কি প্রতিদিনই এতো তাড়াতাড়ি ওঠো?”
“জ্বি ভাবি।”
“গুড। এভাবেই উঠবে। আর কিছু বলবে?”
“না আর কিছু বলবো না। আপনি সকালে কি খাবেন ভাবি?”
“এই মাত্র না বললে কিছু বলবে না। তাহলে শেষে একটা প্রশ্ন করলে কেন?”
ইফরা ভ্রু নাচিয়ে বললো। রুদ আবারও থতমত খেলাম। ইফরা রুদের থতমত ভাব দেখে বললো,
“তুমি রাঁধবে নাকি?”
“ভাইয়ু রাঁধবে আর আমি সাহায্য করবো।”
“আচ্ছা। কখন রাঁধবে?”
“এইতো মসজিদ থেকে এসে।”
“ও ভালোই তো। তোমার ভাই রান্নাবান্না জানে?”
এই প্রশ্নে রুদকে ভীষণ উৎফুল্ল দেখালো। উৎফুল্ল হয়ে বললো,
“জানেন ভাবি, ভাইয়ু না দারুন রাঁধতে পারে। ভীষণ মজার হয় ভাইয়ুর হাতের রান্না। একবার খেলেই ফ্যান হয়ে যাবেন রান্নার।”
ইফরা আগের মতোই মুখ গম্ভীর করে রাখলো। তারপর বললো,
“ভালো। তোমার ভাইকে শেফ হতে বলতে। বাইরের দেশ গুলোতে শেফের অনেক মূল্য। বাংলাদেশে অবশ্য নেই। বাইরের দেশে থাকলে অনেক টাকা কামাতে পারতো।”
“টাকা দিয়ে কি হবে? টাকা থাকলে শুনেছি সুখ থাকে না। অনেকে টাকার পিছনে ছুটতে ছুটতে পরিবারকে সময় দিতে পারে না। এমন টাকা দিয়ে আদৌ কোনো লাভ হবে, যা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়?”
রায়হানের প্রশ্নে ইফরা ঘুরে তাকালো। দেখলো রায়হান দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। সাদা পাঞ্জাবি, সাদা টুপি আর কালো প্যান্ট পড়ে আছে যা টাখনুর উপরে গুটিয়ে রাখা। রায়হানকে ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে। রাতে ঠিক করে খেয়াল করা হয়নি। রায়হান মসজিদ থেকে কখন এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করিনি কেউ। রুদ উৎফুল্ল হয়ে ভাইকে সালাম দিলো তারপর হাতের জায়নামাজ ভাঁজ করে রাখলো। তারপর ভাইকে বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। রায়হান টুপি রাখতে রাখতে বললো,
“আপনার কোনো বিষয়ে ইন্টারফেয়ার করবো না তবে আপনাকেও আমার একটা অনুরোধ রাখতে হবে।”
ইফরা রায়হানের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কোনো কথা বললো না। রায়হান আবারও বললো,
“আমার ভাইবোনকে কষ্ট দিয়ে কোনো কথা দয়া করে বলবেন না। ওদের আমি এতটুকুন থেকে মানুষ করেছি। ওরা খুব ছোট থাকতে এতিম হয়েছে। মা, বাবার ভালোবাসা কি তা তারা বলতে পারবে না। যখন মা, বাবার কথা জিজ্ঞাসা করতো ওদেরকে অন্য কথা বলে ভুলিয়ে রেখেছি। রাহমিদ মায়ের বুকের দুধের জন্য কাঁদলে ফিডার দিয়েছি, সুজি খাইয়েছি, খেতে না চাইলে জোর করে মেরে হলেও খাইয়েছি, টয়লেট করলে পরিষ্কার করেছি, রুদ বমি করলে নিজ হাতে পরিষ্কার করেছি, তাদের গোসল করিয়েছি, রুদের যখন মাকে দরকার তখন নিজে মায়ের মতো দায়িত্ব পালন করেছি। সেই আদরের ভাইবোনের সাথে কেউ উচুঁ স্বরে, তাচ্ছিল্য করে কথা বললে আমার বুক জ্বলে। বুকের মধ্যের হৃদপিণ্ডে ব্যথা অনুভূত হয়। দয়া করে ওদের সাথে একটু নমনীয় হবেন। বিশ্বাস করুন একটু আদর দিলে ওরা ভীষণ খুশি হয়।”
কথাগুলো বলেই উল্টো ঘুরে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। চোখে পানি জমেছিল কিনা ইফরা তা দেখতে পেলো না। তবে লোকটার গলা ভার ভার লাগছিল। তার কথা কি সব শুনেছে লোকটা? তার কন্ঠ বেশি রূঢ় শুনিয়েছে কি? নাহলে লোকটা এতগুলো কথা বললো কেন? ইফরার এই প্রথম অপরাধবোধ জাগ্রত হলো। মা, বাবার রাগটা অতটুকু ছেলেমেয়ের উপরে না দেখালেই কি নয়? ওরা তো ছোট থেকেই এতিম। ওদের ভালবাসলে আল্লাহ্ তায়ালাও ভালবাসবেন কিন্তু সে তো ওদের সাথে খারাপ কোনো ব্যবহার করেনি। একটু গম্ভীর হয়ে কথা বলেছে দেখে মনে হয়েছে ধমকাচ্ছে।
ইফরা কি করবে বুঝতে পারছে না। তার কথাই এমন মনে হয় কাউকে মারবে বা ধমকাবে। এরপর থেকে একটু নরম হয়ে কথা বলতে হবে। পরক্ষণেই ভাবলো সে কি লোকটার কথা শোনা শুরু করেছে নাকি? অথচ সে-ই একদিন প্রতিজ্ঞা করেছিল লোকটার জীবন তামা তামা করে ফেলবে। অল্পক্ষণের মধ্যেই লোকটা বশ করে ফেললো নাকি তাকে?
_____
“রায়হান কাম তো একটা সাইড়া ফালাইছি।”
অনেকদিন পর রুস্তম ভাইয়ের সাথে দেখা। রায়হানকে দেখেই খুশি হয়ে চা খেতে নিয়ে এসেছে। নানারকম গল্প গুজব করেছে। হঠাৎ করেই উপরোক্ত কথাটি বলে বসলো রুস্তম। রায়হান কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“কি করেছেন ভাই?”
রুস্তম চা খেতে খেতে বললো,
“তোমার বিয়ার পরই বিয়া কইরা হালাইছি। তয় আমি বিয়া করতে চাই নাই। তুমিই কও এই বুড়া বয়সে বিয়া করাডা বেমানান না? আত্মীয় স্বজন জোর কইরা বিয়া দিয়া দিছে। মাইয়াডা অবশ্য ভালা। তোমার ভাবিরে দেখতে একদিন আইসো বাড়িত।”
“না ভাই। উনি আমার জন্য গায়রে মাহরাম নারী। ওনাকে দেখার ইচ্ছা আমার নেই। তবে আমাদেরকে না জানিয়েই বিয়ে করে ফেললেন দেখে কষ্ট পেলাম।”
“ছরি। তুমি তো আবার ইসলাম মাইনা চলো। ভুইলাই গেছিলাম। আল্লাহ্ মাফ করুক। কিছু মনে কইরো না ভাই। বয়স হইছে তো। সব কিছু ভুইলা যাই। আরে হুট কইরা বিয়া দিছে কইলাম না। রাগ কইরো না। বড় কইরা অনুষ্ঠান করলে তোমারে দাওয়াত দিমুনি।”
এরকম আরও কথা চলতে থাকলো তাদের মাঝে। দুইজন অনেকক্ষণ নানা বিষয়ে আলাপ আলোচনা করলো। রুস্তম ভাই রায়হানকে পেলে আর ছাড়তে চাননা। রায়হানকে যতদিন দেখা হয়নি ততদিনের কাহিনী বলে তারপর থামবে। নামাজের আজান হলে দুজনেই একসাথে মসজিদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
সেই বখাটে রুস্তমের সাথে এতিম রায়হানের কি দারুন সখ্যতা! যে এখন রায়হানের সাথে থেকে ইসলামকে লালন করে গভীরভাবে। সুন্দর না দৃশ্যটি।
চলবে…