#জীবন_পেন্ডুলাম(আবর্তিত জীবনচক্র)
#পর্ব_৩১
তাজরীন ফাতিহা
মানুষের জীবন এক অদ্ভুত পেন্ডুলামে আবৃত। দিন যায়, মাস আসে। আবার মাস যায় বছর শেষ হয়। এক অদ্ভুত রহস্যময় পেন্ডুলামের নামই জীবন। ঘুরছে তো ঘুরছেই। কতগুলো দিন কেটে গেলো এভাবে করেই।
সেই ছোট্ট রায়হান এখন আর ছোট্ট নেই। উনিশ বছরের অবুঝ রায়হান এখন যথেষ্ট বুঝদার। লিকলিকে গড়নের শ্যামবর্ণের ছেলেটা এখন পরিপূর্ণ যুবক। বেড়েছে দেহের গড়ন, বয়সের পার্থক্য। হয়েছে আরও পরিপক্ব। সাতাশ বছরের সুঠাম দেহি এক পুরুষ যুবা। মুখে ঘন চাপ দাড়ি। মাঝারি আকারের বেশ অনেকটাই দাড়ি। মুখে গম্ভীর আভিজাত্য। বেশ উঁচু তার গড়ন। দূর থেকে তাকালে মনে হয় যেন আভিজাত্যে মোড়ানো এক পুরুষ হেঁটে আসছে।
শিক্ষক হিসেবে রায়হানের বেশ নামডাক। একটি কোচিং সেন্টার খুলেছে বন্ধুদের নিয়ে। পঞ্চম থেকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়ায় সে এবং তার বন্ধুরা মিলে। ইনকাম ভালোই। ঢাকা শহরের মতো জায়গায় খেয়ে পড়ে ভালোই আছে রায়হান। একটা ছোট্ট দুই রুমের ভাড়া বাসায় দুই ভাইবোনকে নিয়ে থাকে সে।
রুদ, রাহমিদ ভালোই বড় হয়েছে। রাহমিদটা আগের থেকে আরও দুষ্টু হয়েছে। কিছুদিন আগে রায়হান একটা সাইকেল কিনে দিয়েছিল। সেটা নিয়েই বর্তমানে তার মাতব্বরি চলছে।
রুদ বাচ্চাটা আগের থেকে বড় হয়ে গেছে। এবার এইটে পড়ে সে। বেশ বুঝদার বাচ্চাটা। বড় ভাইয়ের রান্নার সময় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে এটা সেটা এগিয়ে দেয়া, থালাবাসন ধোয়া, ঘর ঝাড়ু দেয়া, ঘর মোছা, নিজের ও ছোট্ট ভাইয়ের কাপড় ধুইয়ে দেয়া সবই বাচ্চাটা করে। এই বয়সে দারুণভাবে কাজে পটু হয়ে গিয়েছে সে। রান্নার কাটাকুটিও মোটামুটি করতে পারে তবে রায়হান কখনোই বোনকে দিয়ে কিছু কাটায় না। কখন হাত, পা কেটে যায় বলা তো যায়না। বিপদের তো আবার হাত, পা নেই। বিশেষ করে তার ভাইবোনের বিপদের অভাব নেই। সেই চিন্তা করে রায়হান বোনকে বটি বা ধারালো কিছু দিয়ে কাজ করতে দেয়না।
_____
“বলেছিলাম এই মেয়ের বিয়ে দিতে বহুত কসরত করতে হবে শুনো নি তো। এখন দেখো এই মেয়ের কপালে কি পরিমাণ দুঃখ আছে। এক ছেলেকে নাকি কয়েক বছর আগে সামসুল ভাই দেখেছে ওই ছেলে নাকি সাথে সাথে নাকচ করে দিয়েছে। পরে এই বিষয়ে ভেবে জানাবে বলে যে ভেগেছে আর কোনো খবর নেই ছেলেটার। বুঝে গেছে এই মুখতোড়ের সাথে থাকতে পারবে না।”
ইফরা এই এক কথা গত চার বছর ধরে শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছে। এখন আর মা নামক এই নারীর কথা শুনতে আর তার কথার উত্তর দিতে ইচ্ছে হয়না। তবে রাগে শরীর জ্বলতে থাকে। ইয়াসমিন আহমেদের সাথে কথা বলে রাগটাকে আর প্রশ্রয় দিতে চায়না সে। মেজাজ গরম নিয়েই চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেলো সে। সারোয়ার হোসেন “চিহ” শব্দ করে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। বললেন,
“এই এক ডায়ালগ দিতে দিতে তুমি বিরক্ত হও না? মেয়েটাকে সবসময় এসব বলে কি লাভ পাও তুমি?”
“এখন আমার কথা তো খারাপ লাগবেই। এই পর্যন্ত মেয়ের কয়টা সম্বন্ধ ভেঙেছো? এই মেয়েকে আদৌ কেউ বিয়ে করবে? তোমার এতো ছুকছুকে স্বভাব কেন বলো তো? মেয়েকে পড়াশোনা তো বিয়ের পরও করানো যেতো। আমরা করাতাম। এখন বয়স বেশি হয়ে গেলো না? পাত্র পাবে আর?”
“উফফ তুমি একটু থামো তো। আল্লাহ্ যখন ভাগ্যে বিয়ে রাখবে তখনই বিয়ে হবে। আমাদের এসব নিয়ে মাথা ফাটালে কোনো লাভ হবে?”
“তোমার এসব কথার জন্য মেয়ে প্রশ্রয় বেশি পেয়েছে। পাত্রের সামনে রোবটের মতো রাগী ভাষায় কথা বলেছে দেখে দুইটা সম্বন্ধ ভেঙে গেছে। মুখ খুললেই যেন বুলেট বের হয়। মেয়ে মানুষ হবে নরম। কথা হবে ছোট ছোট আর এই মেয়ের মুখ না যেন পারমাণবিক বোমা।”
“তুমি একজন শিক্ষিকা হয়ে মেয়ের সম্পর্কে এতো খারাপ ধারণা রাখো এটা কি মানুষ জানে?”
“সেটাই তো দুঃখ। মেয়েকে মানুষ করতে পারলাম না। আর কিছু থাকুক আর না থাকুক মুখটা আছে।”
“সেটা তোমার ব্যর্থতা নয় কি?”
“আমার ব্যর্থতা? কি বলতে চাও?”
“সেটা তুমি ভালোভাবেই বুঝতে পারছো। মেয়েকে শাসনের নামে দুঃশাসন বেশি করেছো। কথায় কথায় মেয়েকে সব কিছুতে নিচু করেছো। এগুলো মেয়েকে আরও বেপরোয়া বানিয়েছে।”
“আচ্ছা তাই। তা মেয়ে তোমাকে কেন এড়িয়ে চলে?”
“সেটাও আমার ব্যর্থতা। শিক্ষকতা করতে করতে নিজের মেয়েকেই শিক্ষা ও সময় কোনোটাই দিতে পারিনি। মেয়েটা ছোট বেলায় “বাব্বা বাব্বা ” বলে দৌঁড়ে আসতো। ছোট্ট আদুরে হাত ধরার বয়সে তখন স্টুডেন্ট পড়াতে পড়াতে মেয়েকে অবহেলা করেছি। এখন আফসোস হয় বুঝলে। ভীষণ আফসোস। মেয়েটা আমাদের থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। এখন চাইলেও মেয়ের সাথে সহজ হতে পারবো না। নিজের অপারগতা কুড়ে কুড়ে খায় আমাকে।”
কথাগুলো বলার সময় সারোয়ার হোসেনের চোখ ভিজে উঠেছিল। খুব সন্তপর্নে তা মুছে ফেললেন তিনি। চশমা খুলে গ্লাস পরিষ্কার করলেন। ইয়াসমিন আহমেদ থম মেরে বসে আছেন। তার নিজেরও কেমন যেন লাগছে আজকে।
_____
ইফরা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বোটানি নিয়ে পড়াশুনা করছে। ছোটবেলা থেকেই তার গাছপালার প্রতি ভীষণ দুর্বলতা। বোটানি সাবজেক্টটা নেয়ার পিছনে এই গাছ প্রিয়তা ভূমিকা রেখেছে শতভাগ। এছাড়াও তার গুরুগম্ভীর স্বভাবের সাথে বোটানি সাবজেক্টটা ভালোই মিলে যায়।
আজকে ভার্সিটি থেকে এসেই তার মেজাজ গরম। বাসায় এখন রীতিমত বিরক্ত লাগে তার। মায়ের ঘ্যানঘ্যানিতে অতিষ্ঠ হয়ে বাসা থেকেই বের হয়ে যেতে ইচ্ছা হয় মাঝেমধ্যে। শুধুমাত্র দাদুমণির কারণে এখানে থাকে সে। নাহলে কবে হোস্টেলে উঠে যেতো। দাদুমণির জন্য তার ভীষণ টান। এই মানুষটা তার রন্ধ্রে মিশে আছে যেন। তার যত্নআত্তি তো সেই এইটুকুন থেকে এখন পর্যন্ত এই মানুষটাই করছে। এই মানুষটার কিচ্ছু হলে ইফরা বোধহয় মরেই যাবে।
“দাদু মণি কি করছো?”
“হাদীস পড়ছি রে ইফরা মনি। তুই আইসা পড়ছিস? আয় ভিতরে আয়?”
ইফরা ভিতরে ঢুকে দাদীর পাশে বসলো। সালমা হোসেন কিছুক্ষণ বিভিন্ন হাদিস আদরের নাতনিকে পড়ে শুনালেন। তারপর ইফরা দাদীকে কয়েকটা হাদিস পড়ে শুনালো। এভাবেই দুই দাদি নাতনির হাদিস বলার প্রতিযোগিতায় বিকেলটা পার হলো।
____
—-
রায়হান বাসায় ঢুকলো চিপস, চকলেট আর বোনের জন্য ফুসকা নিয়ে। ইদানীং রুদ ফুসকা খাওয়া শুরু করেছে। স্কুলে গিয়ে ফুসকা খাওয়া শিখছে প্লেট ভরে ভরে। রায়হান সেদিন ওকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে এই দৃশ্য দেখে বোনের জন্য ফুচকা আনার চেষ্টা করে। তবে প্রতিদিন আনার সাধ্য তার নেই। যা আয় করে সংসারের পিছনে তা ব্যয় হয়ে যায়। বাড়তি খরচ করার সামর্থ্য তার নেই তবুও মাঝে মধ্যে ভাইবোনের আবদার পূরণ করার চেষ্টা করে সে।
আজকে বাসার সবকিছু কেমন নিস্তব্ধ লাগছে। দরজাটাও খোলা। আবার কি হয়েছে? রায়হানের বুক দুরু দুরু করে কাঁপছে। এই ভাইবোনের চিন্তায় কোনদিন যেন সে স্ট্রোক করে বসে। ঘরে ঢুকেই ওদের আওয়াজ না পেলেই বুকের মধ্যে কামড় দিয়ে উঠে তার। সেই ছোট্ট থেকে এই দুইজনকে একা হাতে মানুষ করেছে সে। তাদের গায়ে একটা ফুলের টোকা পড়লেও তার শরীর, কলিজা পুড়ে যায় যেন। সে জোরে ডেকে উঠলো,
“রুদ, রাহমিদ কোথায় তোমরা? দ্রুত সামনে আসো?”
কোনো সাড়াশব্দ নেই। রায়হান পুরো ঘর খুঁজলো কিন্তু কোনো অস্তিত্ব পেলো না। কোথায় গেছে দুজন এই সন্ধেবেলা। রায়হানের চিন্তা হচ্ছে ভীষণ। ভাই বোনকে খোঁজার উদ্দেশ্যে বাইরে বের হতে গিয়ে দরজার কড়া নাড়ায় দ্রুত দরজা খুললো। দেখলো রুদ কাচুমাচু ভঙ্গিতে ছোট ভাইকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ গম্ভীর করে কপাল ভাঁজ করে রায়হান জিজ্ঞাসা করলো,
“কোথায় গিয়েছিলে?
রাহমিদ, রুদ দুইজনের একজনও কথা বলছে না। রায়হান ধমকে উঠে বললো,
“কথা বলছো না কেন? আমাকে না জানিয়ে কোথায় গিয়েছিলে দুইজন? পিটিয়ে তোমাদের পিঠের ছাল তুলে ফেলবো একদম। বেশি মাতব্বরি করো তাইনা। বলেছি না কিছু দরকার হলে সোজা আমায় বলবে। কই গিয়েছিলে?”
“রিমা আন্টির কাছে।”
রুদ ভয়ে ভয়ে বললো। রায়হান ভ্রু কুঁচকে বললো,
“রিমা আন্টির কাছে তোমাদের কি কাজ এই সন্ধেবেলা?”
“একটু দরকার ছিল ভাইয়ু।”
“সেটাই জানতে চাচ্ছি। সেদিন তোমাদের নামে যা তা বলে যাওয়ার পরও তার কাছে তোমাদের কি কাজ তাই জানতে চাচ্ছি।”
রুদ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েই থাকলো। এক পর্যায়ে কেঁদে দিলো। রাহমিদ ভয় ভয় চোখে তাকিয়ে আছে বড় ভাইয়ের দিকে। বড় ভাইয়ের রাগ উঠলে তারা খুবই ভয় পায়। বড় ভাই তাদের কখনোই মারে নি তবে তার শাসনের সময় দুই ভাইবোনই মাথা নিচু করে ভয়ে কাঁপতে থাকে। হঠাৎ ছোট বোনের কান্নায় রায়হান তাল হারিয়ে ফেললো যেন। দ্রুত রুদ আর রাহমিদকে ঘরে ঢুকিয়ে রুদের সামনে হাঁটু মুড়ে বসলো সে। নরম গলায় বললো,
“কি হয়েছে কলিজা? ভাইয়ুকে বলবেন না? ভাইয়ুকে বলুন। ভাইয়ু সব ঠিক করে দিবো।”
রুদ তারপরও চুপ। নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে যাচ্ছে। রায়হানের অস্থির লাগছে। কোচিং থেকে এসে শার্টটা পর্যন্ত খুলেনি সে। ঘামে জবজবে হয়ে আছে। এসেই বোনের কান্নার হেতু খুঁজে পাচ্ছে না সে। রায়হান রাহমিদকে কাছে টেনে বললো,
“আপুনির কি হয়েছে কলিজা? আপুনি কাঁদে কেন?”
“ভাইয়ু আপুনির না রোগ হয়েছে। রক্তে জামা ভরে গেছে আপুর।”
রায়হানের মনে হলো পুরো দুনিয়া ঘুরছে। রুদকে ধরে পাগলের মতো জিজ্ঞাসা করতে লাগলো,
“কি হয়েছে কলিজা? বল না কি হয়েছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে? রাহমিদ এসব কি বলছে? রক্ত কোথা থেকে এলো। আল্লাহ্! বল না বোন।”
রুদের ভীষণ সংকোচ হচ্ছে। যেহেতু এইটে পড়ে সেহেতু সে একটু হলেও বুঝে মেয়েদের একটা নির্দিষ্ট সময় রক্তক্ষরণ হয়। তার এইবার প্রথম হলো। এই সম্পর্কে একটু জানাশোনা থাকলেও আজকে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। ঘরে সে আর রাহমিদ ছাড়া কেউ নেই। হঠাৎ জামায় রক্ত দেখে জোরে চিৎকার দেয়ায় রাহমিদ ছুটে এসে দেখে বোনের জামায় রক্ত। সেও সাথে সাথে চিৎকার, কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিলো। এতটুকু ছেলে বোনকে কত কথা বলে ভরসা দিয়েছে হিসেব নেই। বোনের জামার রক্ত পরিষ্কার করেছে আর বলেছে,
“এসব কিচ্ছু না আপুনি। তুমি কাঁদো কেন? রক্ত ভরালে কি করে? কোথায় পড়ে গিয়েছিলে? কথা বলছো না কেন? তাড়াতাড়ি বলো। চলো ডাক্তারের কাছে যাই।”
এরকম আরও নানা কথা। রুদের যেহেতু একটু হলেও জানা ছিল তাই ছোট ভাইয়ের কাছে খুলে কিছু বলেনি সে। মাগরিবের আজান দিয়ে দিয়েছে দেখে ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে রিমা আন্টির বাসায় গিয়েছে। রিমা আন্টিদের বাসায় গিয়ে দেখে তাদের বাসা তালা মারা। তারা কেউ বাসায় নেই। রুদের দুনিয়া যেন ঘুরে উঠলো। তারপর আস্তে আস্তে নিজেদের বাসায় এসে দেখে দরজা লাগানো। তারপর তো এই কাহিনী।
বড় ভাইয়ের অস্থিরতা দেখে রুদ আর না লুকিয়ে ভাইকে সব জানালো। রায়হানের মনে হলো বুকের উপর থেকে পাথর নেমে গেছে। রায়হান উঠে গিয়ে রুদের প্রয়োজনীয় সব কিছু কিনে আনলো। এগুলো বোনের হাতে দেয়ার সময় বললো,
“ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এগুলো স্বাভাবিক। এটা বলতে এতো দ্বিধা কেন? এটি প্রত্যেক নারীর জন্য আল্লাহ্ প্রদত্ত এক নেয়ামত। এটা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগার কিছু নেই। কোনো কিছুর দরকার হলে ভাইয়ুকে বলবে। ভাইয়ু সব সময় তোমার সাথে আছি কলিজা। ভয় পেও না আমার ব্রাভো গার্ল।”
চলবে….
#জীবন_পেন্ডুলাম(ধামাকা: বিবাহ স্পেশাল)
#পর্ব_৩২
তাজরীন ফাতিহা
“আরে রায়হান যে। তোমাকে তো এখন পাওয়াই যায়না। পালিয়ে বেড়াচ্ছো মনে হচ্ছে। তা এতদিন পর আজ কি মনে করে আমার সাথে দেখা করতে এলে।”
ইমাম হুজুর কিছুটা রসিকতার সুরেই কথাগুলো বলে থামলেন। রায়হান থতমত মুখ করে কিছুটা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো। ইমাম হুজুর বললেন,
“দাঁড়িয়ে কেন? বোসো না।
রায়হান মুখ নামিয়ে বসলো। অনেকদিন ইমাম হুজুরের সাথে তেমন সাক্ষাৎ করা হয়না। মূলত রায়হানই এড়িয়ে চলতো। আজ হঠাৎ করেই দেখা করতে মন চাইলো তাই দেখা করতে চলে এসেছে। এমনিতেই কোচিংয়ে পড়াতে পড়াতে সময় হয়না এদিকটায় আসার।
এখন রায়হান এই এলাকায় থাকে না। এখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে আমতলী রোডের পাশে একটি বাড়ির দুই তলায় ছোট্ট দুই রুমের বাসায় সে আর তার ভাইবোনেরা থাকে। ছোটখাটো ছিমছাম সংসার তার। অভাব অনটন থাকলেও ছোট্ট ঘরটায় সুখের কমতি নেই। তবে ইদানীং সুখে কিছুটা ভাটা পড়েছে। রুদটার জন্য রায়হানের ভীষণ চিন্তা হয়। রুদ কেমন মনমরা হয়ে থাকে। তাকে খুলে কিছু বলতে অনেক দ্বিধাবোধ করে।
রায়হানের চিন্তায় চিন্তায় মাথায় ভীষণ ব্যথা হয় ইদানীং। ঠিক করেছে বিয়ে করবে। যথেষ্ট বয়স হয়েছে তার। অনেক আগেই করতো কিন্তু ভাইবোনের যত্নের ঘাটতি হবে ভেবে আর এগোয় নি সেদিকে। তবে রুদের ভাবমূর্তি দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিয়ে করবে। রুদের একটা সঙ্গী তো হবে। এতে তার বোনটা নিশ্চয় আর কোনো দ্বিধাবোধ করবে না কথা বলায়।
ইমাম হুজুর অনেকদিন ধরে বিয়ের বিষয়ে বলছেন। তাই রায়হান ভেবেছে ওনার সাথেই কথা বলে দেখা যাক। ইমাম হুজুর নিশ্চয়ই খারাপ মেয়ের সন্ধান দিবেন না। রায়হান দেখেশুনেই বিয়ে করতে চায়। ভাইবোনের অযত্ন রায়হান কোনোভাবেই মেনে নিতে পারবে না। আবার যে মেয়েটা সবকিছু ছেড়ে তার মতো অনাথের কাছে আসবে তাকেও তার পরিপূর্ণ প্রাপ্যটা দিতে হবে। নাহলে রায়হানের আদর্শের বিঘ্ন ঘটবে। রায়হান তা কোনো মতেই চায়না।
“কি হলো রায়হান চুপ মেরে গেলে কেন? বিয়ে শাদী করেছো? তোমার দেখাই তো পাইনা।”
“জি না আংকেল বিয়ে শাদী করেনি। ওই ব্যাপারেই আপনার সাথে আলাপ করতে এলাম।”
ইমাম হুজুর কিছুটা নড়েচড়ে বসলেন। বিস্ময় নিয়ে বললেন,
“বিয়ের ব্যাপারে আলাপ!
“জি। আপনি অবাক হলেন মনে হয়।”
“তা তো অবশ্যই। তুমি তো বিয়ের ব্যাপারে কোনো কথাই শুনতে চাও না। বিয়ের কথা উঠলেই পালিয়ে বেড়াতে সেই তুমি বিয়ের ব্যাপারে আলাপ করতে এসেছো বিষয়টা অবাক হওয়ার মতো নয় কি?”
ইমাম হুজুর কিছুটা কৌতুক করে বললেন। রায়হানের ভীষণ লজ্জা লাগছে। ছেলে দেখে লজ্জাটা ফুটিয়ে তুলতে পারছে না। মেয়ে হলে এতক্ষণ ব্লাসিং করতো নির্ঘাত। রায়হান চোয়াল নামিয়ে লাজুক স্বরে বললো,
“এখন ভাবছি ওই বিষয়ে তাই আরকি।”
“আরে বেটা তুমি লজ্জা পাচ্ছো মনে হচ্ছে।”
রায়হানের এই কথাটায় আরও লজ্জা লাগলো। সে মুখ নামিয়েই রাখলো। নিজের বিয়ের কথা নিজে কেউ বলেছে কিনা সে জানে না। তার মতো অনাথদের তো নিজের বিয়ের ঘটকালি নিজেকেই করতে হয়। তাদের হয়ে কেই বা বলবে। তাই শরম করলেও নিজ মুখে এসে কথাটা বলেছে সে। ইমাম হুজুর রায়হান কে লজ্জা পেতে দেখে মুচকি হেঁসে বললো,
“মেয়ে একটা আছে বৎস। তোমাকে তার কথা বহু আগেই বলেছিলাম। তোমার মনে আছে কি বৎস? যার কথা প্রায়ই তোমাকে বলতাম।”
রায়হানের এবার মনে হচ্ছে উঠে কোথাও চলে যেতে। এতো লজ্জা সে কখনোই পায়নি। ছেলে মানুষ হয়েও তার এতো লজ্জা ইমাম হুজুর কি ভাববে? ইমাম হুজুর রায়হানের সাথে আর রসিকতা না করে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,
“রায়হান তুমি কি সিরিয়াস এই বিষয়ে?”
“জি ভেবেছি এই বিষয়ে কয়েকদিন।”
“তোমার ভাইবোন কি বলে এতে?”
“সরাসরি ওরা কিছুই বলেনি তবে ওদের বিশেষ করে রুদের জীবনে একজন নারীর খুবই প্রয়োজন আমি বুঝতে পারছি।”
“শুধু রুদের প্রয়োজন? তোমার?
“আপাতত ভাইবোনের কথাই বেশি চিন্তা করছি আমি। বিয়ে যেহেতু আমার সাথেই হবে ইংশাআল্লাহ্ কোনো কমতি আমি রাখবো না। আমার সাধ্যমতো আমি সবই দিবো তাকে। তবে মেয়ে যেন নামাজী আর আমার ভাইবোনকে কখনোই অবহেলা না করে এমন হয়। এতটুকু হলেই আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি।
ইমাম হুজুর মুচকি হাসলেন আড়ালে। মেয়ের চাচা হিসেবে ছেলেকে তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। রায়হান কে ইফরার জন্য অনেক আগেই মনে ধরেছে তার। শুধুমাত্র ইফরা আর রায়হানের অমত ছিল বিধায় এই বিয়ে কত বছর পিছিয়ে গেলো। এবার যেহেতু ছেলে রাজি এই বিয়ে হওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারবে না। সারোয়ারের সাথে আজই কথা বলতে হবে এই বিষয়ে। কথাগুলো ইমাম হুজুর নিজ মনে ভাবলেন রায়হানের দিকে তাকিয়ে।
দেখা যাক সামনে কি হয়?
_____
—-
“ছেলে একটা কোচিংয়ে পড়ায়। ভীষন ভদ্র আর বিনয়ী সে। তুই একবার ছেলের সাথে কথা বলে দেখতে পারিস। তোর অপছন্দ হবে না।”
ইমাম সামসুল হোসেন কথাগুলো বলে থামলেন। ফোনের ওপাশে সারোয়ার হোসেন চুপটি করে বড় ভাইয়ের কথা শুনছিলেন। এবার মুখ খুললেন। বললেন,
“আপনার উপর আমার বিশ্বাস আছে ভাইজান। আপনি নিশ্চয়ই আমার ইফরার জন্য খারাপ ছেলে আনবেন না। তাছাড়া এই ছেলের কথা বিগত চার বছর ধরে আপনি বলে আসছেন। নিশ্চয়ই ছেলের মাঝে আলাদা কিছু দেখেছেন যা আমার ইফরার জন্য কল্যাণকর। আপনার উপর আমার এতটুকু বিশ্বাস আছে।”
“বিশ্বাস আছে ঠিক আছে। তবে মেয়ের বাবা হিসেবে ছেলেকে একবার হলেও তোর দেখা উচিত। শুক্রবারে দেখা করতে পারিস। ছেলে জুম্মার নামাজ পড়তে আসে এখানে ছোট্ট ভাইকে নিয়ে। তুই চলে আসিস নামাজ পড়তে। দেখে যাবি ছেলেকে।”
“আচ্ছা ভাইজান। তবে শুক্রবারেই আপনার ঐখানে যাবো।”
“আচ্ছা।”
_____
—-
“রাহমিদ তুমি নাকি নামাজ পড়ায় ফাঁকিবাজি করো?”
ভাইয়ের হাত ধরে জুম্মার নামাজ পড়তে যাচ্ছে রাহমিদ। পথিমধ্যেই ভাইয়ের কথা শুনে কাচুমাচু করা শুরু করলো। একটু আধটু ফাঁকিবাজি করে সে মসজিদে আসায়। এটা আবার ভাইয়ুকে কে বললো? নিশ্চয়ই জিহান বলেছে। ওর খবর আছে। ভাইয়ুকে নালিশ করে কত্তবড় সাহস! রায়হান বললো,
“বদ বুদ্ধি মাথা থেকে বের করে ফেলো। তোমার মাথায় যে বদ বুদ্ধি ঘুরছে আমি জানি না ভেবেছো?”
রাহমিদ চোরের মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। রায়হান বললো,
“আরেকদিন শুনি, তোমায় কি করবো দেখো। এগুলো কিন্তু খুবই খারাপ কাজ। গুনাহ হবে। এমন আর করবে না। আল্লাহ্ নারাজ হবেন তাহলে।”
রাহমিদ মাথা নুইয়ে অনুতপ্ত স্বরে বললো,
“আর হবে না ভাইয়ু।”
“মনে থাকে যেন।”
_____
জুম্মা পড়ে মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় ইমাম হুজুর ডেকে উঠলেন। রায়হান রাহমিদকে নিয়ে সেখানে গেলো। গিয়ে সালাম দিলো। ইমাম হুজুর সালামের উত্তর দিলেন। বললেন,
“বসো। আমার ভাইয়ের সাথে পরিচিত হও।”
রায়হান সারোয়ার হোসেনকে সালাম দিলো। সারোয়ার হোসেন সালাম নিয়ে নানা কথা জিজ্ঞাসা করলেন। রায়হান ইমাম হুজুরের ভাই হিসেবেই প্রত্যেকটা কথার উত্তর দিলো। সে তখনও জানে না মেয়ের বাবা সারোয়ার হোসেন। কথাবার্তা বলে ছোট ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। সারোয়ার হোসেনের ছেলেকে ভীষণ পছন্দ হলো। যেমন সুন্দর, বলিষ্ঠ দেখতে তেমনই সুন্দর আর মার্জিত কথাবার্তা। ছেলেটা এতিম হলেও ইফরার জন্য পারফেক্ট। ইফরার রাগ এই ছেলেটাই কন্ট্রোল করতে পারবে বলে তার ধারণা। আল্লাহ্ তায়ালা কবুল করুন।
_____
—-
তারপরের সময় খুব দ্রুতই গেলো। কিভাবে কি হলো এক আষাঢ়ে রায়হান জাইমের সাথে ইফরা সাবরিয়াহর বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়েতে দেনমোহর ছিল মাত্র দশ হাজার টাকা। এর বেশি দেয়ার সামর্থ্য রায়হানের ছিল না। তাই ফাতেমী মোহরে খুব অল্প পরিসরেই অনাড়ম্বরহীন ভাবে রায়হানের বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়েতে রুদ, রাহমিদ উভয়ই খুশি ছিল। তাদের খুশির সীমানা ছিল না ভাইয়ের বউ অর্থাৎ তাদের ভাবি আসার আনন্দে।
বিয়েতে একমাত্র ইফারার মুখ ছিল কালো। এই বিয়েতে সে সন্তুষ্ট না। মা, বাবার বাধ্য মেয়ের মতো বিয়ে করেছে একমাত্র দাদুমণির জন্য। এই মানুষটা তাকে বুঝিয়ে অনেক কিছু বলেছে। তাই ইফরা বিয়েতে মত দিয়েছে।
কনে বিদায়ের সময় ইফরার চোখে এক ফোঁটা পানিও দেখা যায়নি। শুধু দাদীর রুমে গিয়ে আধাঘণ্টা কেঁদেছে সে। তারপর কিছু হয়নি এমন ভাব করে সোজা বরের আনা সিএনজিতে উঠে বসেছে। সারোয়ার হোসেন গাড়ি সাজিয়ে রেখেছিলেন তবে রায়হান কিছুতেই গাড়িটা নিতে রাজি হয়নি। রায়হানের আত্মসমান প্রবল এই সম্পর্কে তার ধারণা হয়ে গিয়েছে তাই আর বেশি জোরাজোরি করেননি সারোয়ার হোসেন।
খুব অল্প আয়োজনে বিয়েটা হয়ে গেলো। কি হবে ধৈর্যবান রায়হান জাইম আর রগচটে ইফরা সাবরিয়াহর বিবাহিত জীবনে? আগামী দিন আদৌ সুখকর হবে কি? এটাই দেখার বিষয়।
চলবে….