জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-২৯+৩০

0
9

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২৯
তাজরীন ফাতিহা

চারদিকে আধো আলো আধো অন্ধকার। ফজর পড়ে ইফরা ছাদে আসে প্রতিদিন। আজকেও এসেছে। এসেই গাছ গুলোর পরিচর্যা করে। ফুল গুলো ছুঁয়ে দেখে। আবার কখনো ছিঁড়ে কানে লাগায়। ফল দেখা দিলে খাওয়ার উপযোগী হলে ছিঁড়ে ধুয়ে ছাদেই খাওয়া শুরু করে। তার কাছে এই ছাদ বাগানটা বেশ প্রিয়। ছোট বেলা থেকে এই ছাদ আর দাদুমনি ছিল তার একমাত্র সঙ্গী।

বর্তমানে আরও দুইটা সঙ্গী অবশ্য আছে। একটা বই আরেকটা তার পোষা বিড়াল লামজা। আদুরে বিড়াল। ওর সাথে সাথেই থাকে। গা ঘেষে ঘুমায়। ইফরা সবার সাথে খিটখিটে আচরণ করলেও লামজার সাথে সে কখনোই উচুঁ কণ্ঠে কথা বলেনি। বিড়ালটাও বেশ ইফরা ভক্ত।

ইফরার স্বভাব রগচটা। কারো সাথেই সে নরম স্বরে কথা বলতে পারে না। এই জন্য তার বন্ধুবান্ধব বেশিদিন টিকে না। একজন ছেলে কথা বলতে এসেছিল সেদিন। ইফরার কথার ধাঁচে এই মুখো আর হয়নি। ইফরাকে এসেই হাসিমুখে বললো,

“হাই কেমন আছো? আমি তোমার ক্লাসমেট।”

ইফরা মুখ গম্ভীর করে রগচটে গলায় প্রতিউত্তর করেছিল,

“আপনাকে বলেছি পরিচয় দিতে? মেয়ে দেখলেই আগ বাড়িয়ে ফাত্রামি করতে মন চায়। দূর হন। আর শুনুন আমি ভালো নেই। এতক্ষণ ভালোই ছিলাম কিন্তু এখন মুড খারাপ হয়ে গিয়েছে। তাই খারাপ আছি।”

ছেলেটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। ছেলেটার বলদা নজরে তাকানোতে ইফরা মেজাজ হারানোর আগেই বেঞ্চ থেকে উঠে অন্যদিকে চলে গিয়েছিল। মায়ের কানে এই খবর কিভাবে যেন চলে গিয়েছে। ইফরার মায়ের কাছে খবরটা পৌঁছেছিল এমন,

“ইফরা ছেলেটার সাথে কথা বলছিল।”

আসলে ঘটনা অন্য। এই ঘটনার রেশ ধরেই ইয়াসমিন আহমেদ ইফরাকে কথা শুনিয়েছিলেন সেদিন। এইসব ভেবে ইফরার মন মেজাজ আবারও খারাপ হতে লাগলো। আজকে কলেজে যেতে তার মোটেও ইচ্ছা করছে না। বাসায় থাকলেই তো তার মার চিল্লাচিল্লি, ঘ্যানর ঘ্যানর শোনা লাগবে।

ইফরা আর কিছু না ভেবে তার দাদির রুমে চলে গেলো। এই একটা মানুষের কাছে সে প্রশান্তি পায়। রুমে ঢুকেই দেখলো দাদি কোরআন মজিদ রেহালে রাখছে। অর্থাৎ তার কোরআন পড়া শেষ। ইফরা গিয়ে দাদীর কোলে মুখ গুজলো। দাদী সালমা হোসেন নাতনির মাথায়, সারা শরীরে ফুঁ দিয়ে দিলো। জিজ্ঞাসা করলো,

“কিগো নাতিন মন খারাপ নি?”

ইফরা কোলে মুখ আরও গুঁজে বললো,

“অনেক বেশি মন খারাপ দাদুমণি। তোমার ছেলের বউ সারাক্ষণ ঝগড়া করে আমার সাথে। তুমি বকে দিও তো।”

“ওই বিটির কামই তো খালি আমার নাতনির পিছনে লাগা। বজ্জাত মেয়েছেলে। থাক আমি বইকা দিবো নে। তুমি আবার খবরদার মায়ের লগে গলা উচাইয়া, চোখ রাঙ্গাইয়া কথা কইয়ো না। এডা কিন্তু চরম বেয়াদবি, গুনাহ। আমার লগে তো ঝগড়া, কাইজ্জা লাইগ্যাই থাহে তোমারে নাকি মানুষ বানাইতে পারি নাই। তাইলে কি বনমানুষ বানাইছি তোমারে? ওই হারুনের বিটির যা তা কথা।”

ইফরার হাসি পেলো। দাদুমনি ক্ষেপে গেলে তার মাকে নানার নাম ধরে সম্বোধন করে। “হারুনের বেটি।” ইফরার কাজ শেষ। আজকে দাদুমনির সাথে মায়ের বিরাট একটা ঝগড়া হবে। তার আফসোস হচ্ছে সে কলেজে থাকবে। নাহলে ঝগড়াটা দেখতে পেতো। তার মা, বাবাকে বকা খেতে দেখলে চরম আনন্দ লাগে। এই দুটো মানুষ তার চোখের বিষ। কেন যেন ইফরা তাদের দেখতে পারেনা। হয়তোবা ছোট বেলা থেকে তাকে দূরে দূরে রাখা, বান্ধবীদের বাবা মার সাথে তাদের দারুন সখ্যতা, খুনসুঁটিই এর মূল কারণ।
_____
—–

“রায়হান শোনো?”

এশার নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হতে নিলেই ইমাম হুজুর ডেকে উঠলেন রায়হানকে। রায়হান খোশমেজাজে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিলো। ইমাম হুজুর সালামের জবাব দিলো। রায়হানকে বসতে বললো। রায়হান বসলো। নরম গলায় বললো,

“কেমন আছো রায়হান?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি। আপনি কেমন আছেন ইমাম আংকেল?”

“ভালোই তবে ইদানিং বুকে ব্যথা হয়। খাওয়াদাওয়ায় অরুচি এসে গিয়েছে।”

রায়হান উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞাসা করলো,

“কেন কি হয়েছে ইমাম আংকেল?”

“জানি নারে বেটা। অনেক চিন্তা ভাবনা মনে উঁকি দেয়। চিন্তায় চিন্তায় বুকে ব্যথা উঠে যায়। সবই আল্লাহর রহমত। তোমার ভাই, বোন কেমন আছে?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছে। রাহমিদকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি একমাস হয়। দোয়া করবেন যেন মানুষের মতো মানুষ হতে পারে।”

“ও বলেছিল। ওদের দুই ভাইবোনকে কুরআন পড়াই। ভালোই মাথা দুজনের। বাচ্চাটা কায়দা পড়ছে। দ্রুতই ক্যাপচার করে ফেলতে পারে। শীগ্রই কায়দার পর আমপাড়া ধরবে। রুদাইফার থেকে অনেক বুদ্ধিমান হবে আল্লাহর এই ছোট্ট বান্দা। আল্লাহর রহমতে তোমাদের তিন ভাইবোনের ব্রেইন ভালো। আল্লাহ্ তোমাদের কবুল করুক। আমার দোয়া সব সময় তোমাদের সাথে থাকবে বেটা।”

রায়হান লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নামিয়ে রাখলো। আসলে প্রশংসা সে ঠিক নিতে পারেনা। প্রশংসা করার মতো তার কিছুই নেই। তবুও ইমাম হুজুরের সাথে দেখা হলেই তাদের তিন ভাইবোনের প্রশংসা শুনতে হয় আর সাথে অনেক দোয়া নিতে হয়। রায়হান মনে মনে ইমাম হুজুরের নেক হায়াত কামনা করলো। হুজুর যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায় এই কামনাই মনে মনে করলো সে। ইমাম হুজুর এবার ভীষণ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন,

“রায়হান একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম। তুমি কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?”

রায়হান বিনয়ী ভঙ্গিতে বললো,

“বলুন আংকেল।”

“তুমি বিয়ে শাদী কবে করবে?”

রায়হান ভীষণ বিব্রত হলো। এই বয়সেই বিয়ের কথা ভাবছে না সে। মাত্র তেইশ শেষ হলো। চব্বিশে পড়েছে কয়দিন হলো। এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে তাও আবার তার মতো অনাথকে। কে করবে? এসব ভাবনার মাঝেই ইমাম হুজুর আবারও বললেন,

“দেখো আমি জানি তুমি বিব্রত হচ্ছো। তোমার ভাই বোনকে নিয়ে তুমি অনেক কষ্ট করছো। ওদেরও কিন্তু দেখাশোনার মানুষ দরকার। তুমি সারাদিন বাইরে বাইরে থাকো। ওদেরও কিন্তু তোমাকে প্রয়োজন পড়তে পারে কিন্তু তুমি টিউশনি, ভার্সিটি করিয়ে ওদেরকে ঠিকমতো সময় দিতে পারো না। চাইলে কিন্তু বিয়েটা করে ফেলতে পারো। আল্লাহ্ তোমার সকল চাওয়া সহজ করে দিবেন। ইসলাম কিন্তু তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে বলেছে। দেরিতে বিয়ে করাকে অনুৎসাহিত করেছে। এখন দেখো তুমি কি করবে?”

রায়হান বিব্রত ভঙ্গিতে লাজুক বদনে এখনো মাথা নুইয়ে রেখেছে। এভাবে কেউ তাকে ডিরেক্ট বিয়ের কথা বলবে সেটা সে কল্পনাও করেনি। হ্যাঁ অনেকেই রায়হান কে তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলতে বলেছিল এর মধ্যে আফজাল হোসেনও ছিলেন। বাচ্চা দুটোকে নিয়ে অথৈ সাগরে যখন পড়েছিল তখনই বিয়ের ব্যাপারে তাকে বলেছিল। ইমাম হুজুরের ডাকে রায়হান ভাবনা থেকে বের হয়ে বললো,

“এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে নিয়ে কিছু ভাবছি না আংকেল। বিয়ে করলে আমার বাচ্চা ভাইবোন গুলোকে উনি নিজের মনে নাও করতে পারেন। আমার ভাইবোনকে অবহেলার নজরে কেউ দেখুক আমি তা কখনো চাই না। দেখি আল্লাহ্ কবে তৌফিক দেন। আল্লাহ্ ভাগ্যে রাখলে বিয়ে হবে না রাখলে হবে না এটা আমি বিশ্বাস করি। তবে ভাইবোন আমার ফার্স্ট প্রায়োরিটিস।”

“সবই বুঝলাম বাবা। কিন্তু জীবনে তুমি কি কখনোই বিয়ে করবে না? একদিন না একদিন তোমাকে সব কিছু ফেইস করতেই হবে তাহলে এখন করলে সমস্যা কি? আর তুমি সব কিছু নেগেটিভ ভাবছো কেন? তোমার ভাই, বোনকে দেখবে না সেটা ভাবছো কেন? আল্লাহ্ চাহে তো দেখতেও পারে। বেশি বেশি দোয়া করো আল্লাহর কাছে আল্লাহ্ তোমাকে নিশ্চয়ই নিরাশ করবেন না। বিয়ে কিন্তু খারাপ না বাবা। ভয় পাচ্ছো কেন তুমি?”

“আসলে আমার ভাইবোন ছাড়া আমার কেউ নেই। ওদেরকে কেউ অবহেলা করলে আমি সহ্য করতে পারবো না তাই বিয়ের চিন্তা করছি না। আর তাছাড়াও আমাকে মেয়ে কে দিবে? আমার মতো এতিম, চালচুলোহীন, বেকার মানুষের হাতে এ যুগে কোন আল্লাহর বান্দা কন্যা দান করবেন বলুন আংকেল।”

“সেটা তোমাকে ভাবতে হবে না। মেয়ে আমার কাছে আছে। আমার খুবই কাছের একজন। আমার ভাস্তি। আমার খুবই আদরের। এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিবে। তুমি ঠকবে না আল্লাহর রহমতে তবে মেয়ের রাগটা একটু বেশি। এমনিতে আমাদের মেয়ে খুবই ভালো। বিয়ে হলে আল্লাহ্ তোমার সংসারে বরকত বাড়িয়ে দিবেন। তুমি অহেতুক চিন্তা করো না। তুমি রাজি কিনা আমাকে চিন্তাভাবনা করে জানিও।”

রায়হান এতো লজ্জা পেলো সাথে বিব্রতও হলো। জীবনে প্রথম বিয়ের প্রস্তাব পেয়েছে মেয়ের চাচার কাছ থেকে। তার এতো লজ্জা লাগছে বলার বাইরে। কোনরকম পরে জানাবে বলে রায়হান তাড়াহুড়া করে মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেলো।
_____

বাসায় এসে রায়হান প্রথমে বাথরুমে ঢুকে মুখ, হাত, পা ধুলো। তার কেমন যেন লাগছে। তাকে কেউ বিয়ের প্রস্তাব দিবে কোনোদিন কল্পনাও করেনি। তাও আবার এই বয়সে। সে তো ভেবেছে আজীবন চিরকুমার থাকা লাগবে তার। কারণ তার না আছে ইনকাম, না আছে সহায় সম্বল। কিছুই নেই একটা মেয়ের আকৃষ্ট করার মতো। তবুও ইমাম হুজুর কি দেখে রায়হানকে পছন্দ করলেন কে জানে? মাথাটা ঝাকিয়ে অহেতুক চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ফেললো।

রুমে ঢুকে দেখলো আজকের রুমটা কেমন গুমোট। এরকম তো কখনো হয়না তাহলে আজকে এমন লাগছে কেন তার? রুদ কোথায়? রাহমিদ কই? সে বাইরে থেকে আসলেই আগে তাকে জড়িয়ে ধরে। চুমু খায়। তার ভাইবোন গুলো কই গিয়েছে? রায়হান রুদের নাম ধরে ডাকলো।

সারাশব্দ না পেয়ে রানানঘরে গিয়ে দেখলো রুদ হাঁটুতে মুখ ঢুকিয়ে কেমন ভয়ার্ত ভঙ্গিতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদঁছে। পাশে রাহমিদও বোনকে জড়িয়ে কাদঁছে। রায়হানের বুকে কামড় দিয়ে উঠলো। তার ভাইবোন কাদঁছে কেন? সে দ্রুত গিয়ে রাহমিদ আর রুদকে জড়িয়ে ধরলো। জিজ্ঞাসা করলো,

“কি হয়েছে সোনা? তোমরা কাদঁছো কেন? কে বকেছে তোমাদের?”

রুদ ভাইকে দেখে আরও শব্দ করে কেঁদে দিলো। রাহমিদও বোনের কান্নার তালে কেঁদে উঠলো। রায়হান অনেকবার জিজ্ঞাসা করলো তবুও রুদ কিচ্ছু বললো না। রাহমিদ কান্নার মাঝেই বললো,

“আপুনি আজকে সারাদিন কেঁদেছে ভাইয়ু। কিচ্চু কাইনি সারাদিন।”

রায়হানের মনে কামড় দিয়ে যাচ্ছে। তার রুদ তো এভাবে কাঁদে না। কে কি বলেছে তার বোনকে। অনেকক্ষণ পর রুদের কান্না কিছুটা কমে এলে রায়হান রুদকে জড়িয়ে রেখেই উঠে দাঁড়ালো। ভাত বেড়ে ভাত খাইয়ে দিলো যত্নসহকারে দুই ভাইবোনকেই। রুদ বেশি খেতে পারলো না। বাচ্চাটাকে কেমন ট্রমাটাইজড লাগছে। কি হয়েছে বলছেও না তাকে। রায়হানের ভালো লাগছে না কিছুই।

রাহমিদকে ঘুম পাড়িয়ে দেখলো রুদ ঘুমায় নি। কেমন যেন কাঁপছে বাচ্চাটা। রায়হান রুদকে জড়িয়ে রাখলো অনেকক্ষণ। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিতে দিতে বললো,

“কি হয়েছে বাচ্চা? আমার কলিজা কথা বলে না কেন? ভাইয়ু কে বলবে না কি হয়েছে?”

রুদ তাও কিছু বলছে না। রুদ তো কখনো এমন করে না। কি হয়েছে বাচ্চাটার। কিভাবে কাঁপছে। ধক করে উঠলো তার বুক। খারাপ কিছু হয়নি তো তার কলিজার সাথে। রুদকে বুক থেকে উঠিয়ে কাঠিন্য গলায় জিজ্ঞাসা করলো,

“এখনই বলবে কে কি বলেছে? নাহলে ভাই কিন্তু ভীষণ রাগ করবো।”

ভাইয়ের ধমকে রুদ অনেকক্ষণ দোনামনা করে আস্তে করে বললো,

“উনি আমাকে বাজেভাবে ছুঁয়েছে ভাইয়ু। আমি ভীষণ ব্যথা পেয়েছি বুকে। তুমিও তো আমায় আদর করো, ছোও কই আমার তো বাজে লাগে না ভাইয়ু। তাহলে ওনার ছোঁয়া আমার এতো বাজে লেগেছে কেন?”

কথাটা বলেই ভাইয়ের গলায় মুখ গুঁজে কান্না করে দিলো রুদ। ভাইয়ের কাছে এই কথাটা বলতে তার এতো সংকোচ হচ্ছিলো। বোন হলে অনায়াসে বলে ফেলা যেতো কিন্তু ভাইয়ের বেলায় অনেক বিব্রত লাগছিল তার। এই প্রথম মায়ের অভাব তাকে অনেক ব্যথিত করেছে। ভাইয়ের দিকে আর না তাকিয়ে সারারাত ভাইয়ের কাঁধেই মুখ গুজে পড়ে রইলো। শেষ রাতে রুদ ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুমাতে পারলো না মূর্তির মতো বসে থাকা রায়হান। কত চিন্তা যে তার মাথায় খেলে গেলো তা পরিমাপ করা যাবে না।

চলবে,

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৩০
তাজরীন ফাতিহা

“জানোয়ারের বাচ্চা তোদের কারণে ছোট ছোট বাচ্চা মেয়েগুলোও রেহাই পায়না। এতো নরপিচাশ কেন তোরা?”

কলার ধরে স্কুলের দারোয়ানকে ইচ্ছেমতো শাসাচ্ছে রায়হান। দারোয়ান কলার ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,

“কি করছি আমি? কোনো প্রমাণ আছে? অহেতুক গেঞ্জাম করতাছেন ক্যান?

রায়হানের শিরা দপদপ করে জ্বলে উঠলো। এক পর্যায়ে রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে চোয়াল বরাবর ঘুষি মেরে বসলো রায়হান। অনেকেই জড়ো হয়ে গিয়েছে সেখানে। যেহেতু স্কুল সেহেতু মানুষজন অনেক থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কয়েকজন শিক্ষক দৌঁড়ে এসে রায়হানকে ছাড়ালো। আজকে রায়হানের গায়ে যেন শক্তি ভর করেছে। যে রায়হান এতো শান্ত, হাজার কথায় মুখে রা কাটে না সেই রায়হানের এমন ভাবমূর্তি রুদকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। রুদ কল্পনাও করেনি তার ভাইয়ের এতো রাগ। রায়হানকে অনেক কষ্টে চেপে ধরে একজন শিক্ষক জিজ্ঞাসা করলো,

“কি হয়েছে? এরকম অসহায় বাবার বয়সী একজন মানুষের গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন?”

রায়হান ফুঁসতে ফুঁসতে বললো,

“ও অসহায় বাবার বয়সী? ও একটা জানোয়ার। মানুষরূপী এরকম জানোয়ার দিয়ে আমাদের সমাজটা ভরে গেছে। এদেরকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলা দরকার। ওকে এখানেই কবর দিয়ে দিবো আমি। কোন সাহসে ও আমার বোনকে ব্যাড টাচ করে? এরকম কত মেয়েকে না জানি প্রতিনিয়ত এই জালিম, নরপিচাশ, কুলাঙ্গারের নোংরা স্পর্শের শিকার হতে হয় আল্লাহ্ মালুম।”

শিক্ষক কয়েকজন হতভম্ব হয়ে গেলো। দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করলো এসব সত্যি কিনা। দারোয়ান সাথে সাথে নাকচ করে দিলো। শিক্ষক এরপর মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বললো,

“তোমাদের কারো সাথে ও এরকম করেছে?”

অনেকই বলতে পারছে না সংকোচবোধের কারণে। কয়েকজন মেয়ে এগিয়ে এসে দারোয়ানের কুকীর্তির কথা স্বীকার করলো। রায়হান এখনো ফুঁসছে। রুদ একটু দূরে কাচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। খুব বিব্রত হচ্ছে সে তার মুখের ভঙ্গিমায় তা বোঝা যাচ্ছে। কেমন যেন কাঁপছেও বাচ্চাটা। এতো ছোট বয়সে এরকম বাজে একটা ঘটনার শিকার হবে বুঝতে পারেনি সে।

রায়হানের সব কিছু ধ্বংস করে ফেলতে ইচ্ছা করছে। তার বোনের বিব্রত মুখ তাকে ভিতর থেকে মেরে ফেলছে। কালকে সারারাত ঘুমাতে পারেনি। তার শরীর জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিলো। তার এতটুকুন বোন ভিতরে ভিতরে কি পরিমাণ বিধ্বস্ত রায়হান একটু হলেও উপলব্ধি করতে পারছে। তার কলিজা পুড়ছে। তার ভাইবোনের বিপদের শেষ নেই। এই দুনিয়ায় এতো পরীক্ষা দিতে হচ্ছে তাদের ভাইবোনকে। রায়হান আর ভাবতে পারছে না।

সেদিনই দারোয়ানকে চাকরি থেকে বের করে দেয়া হলো। পুলিশে দিতে চেয়েছিল কিন্তু দারোয়ান সন্তান, বউ এর দোহাই দিয়ে সকলের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। রায়হানের পা ধরে অনেক্ষণ আহাজারি করায় রায়হান পুলিশে দিতে নিষেধ করে। যাদের সাথে অসভ্যতামী করেছে প্রত্যেকের পায়ে ধরে মাফ চাইয়েছে শিক্ষকরা। দারোয়ান যাওয়ার আগে রায়হান শুধু বললো,

“মানুষ হওয়ার চেষ্টা করবেন। বয়স তো কম হলো না। কয়দিন পর কবরে যাবেন। আল্লাহর কাছে কি নিয়ে দাঁড়াবেন? এতো কুরুচিপূর্ণ কাজটা করতে আপনার হাত কাঁপলো না। নিজের মেয়ের বয়সী এই বাচ্চাটার সাথে, এই মেয়েগুলোর সাথে সর্বশেষ মায়ের জাতের সাথে এরকম জঘন্য কাজটা করতে বিবেকে বাঁধলো না? মনে রাখবেন, একদিন আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। আমরা মানুষ ছেড়ে দিলেও ওই আসমানের মালিক যিনি সব কিছুর পুংখানুপুংখ হিসেব রাখেন তিনি কিন্ত ছাড়বেন না। তার কাছে করায়গণ্ডায় হিসেব দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকুন। মনে রাখবেন, আল্লাহ্ ছাড় দেয় কিন্তু ছেড়ে দেয়না।”

বুকে একরাশ কষ্ট চেপে কথাগুলো বলে মুখ ঘুরিয়ে ছোট্ট বোনকে আদর করেছে কিছুক্ষণ। এই বাচ্চাটা তার কলিজা। তার কলিজা গুলোর গায়ে কেউ আঁচড় দিলে তার সমস্ত দেহে জ্বলুনি শুরু হয়। আজকে এখানে খুনাখুনি হয়ে যেতো। আল্লাহ্ মনে মায়াদয়া না রাখলে এখনই রায়হান প্রলয় ঘটিয়ে ছাড়তো। ভাই হয়ে এরকম মানুষরূপী হায়েনাদের থাবা থেকে বোনটাকে সে রক্ষা করতে পারলো না। এই আফসোস তার চিরকাল থাকবে।
_____

আজকে রুদকে ক্লাস করতে দেয়নি। সাথে করে বাসায় নিয়ে এসেছে। বোনকে গোসল করতে পাঠিয়ে নিজে রান্না বসালো। মন মেজাজ তার মোটেও ভালো না। বোনের চিন্তায় সে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। একবার যেহেতু এরকম ঘটনা ঘটেছে তাহলে সামনে যে হবে না তার নিশ্চয়তা কি? মানুষরূপী হায়েনাদের কি অভাব আছে আমাদের সমাজে? এসব নানারূপ চিন্তা তাকে অস্থির কিরে তুলছে।

কোনরকম ডিম ভুনা আর ডাল রান্না করলো। রাহমিদ স্কুল থেকে আসলে ওকে খাইয়ে দিবে। তার ভাইটা ভালো মন্দ খাবার ছাড়া খেতে পারেনা। তাই প্রতিদিনই ওর জন্য ডিম থাকে। ওর সাধ্যের মধ্যে তরকারি রাখার চেষ্টা করে। প্রতিদিন গোশত খাওয়ানোর সাধ্য তার নেই। বাচ্চাটাকে তাই ডিম গোশতের মসলা দিয়ে কষিয়ে রান্না করে দেয়। সে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিলে বাচ্চাটা আয়েশ করেই খায়।

রায়হান রান্না শেষ করে রুমে এসে দেখলো রুদ ভিজা চুল নিয়ে শুয়ে আছে। বাচ্চাটার শরীর কাঁপছে। জ্বর টর এলো নাকি আবার। রায়হান দ্রুত গিয়ে রুদের কপালে হাত দিলো। বেশ গরম লাগছে। উঠে গামছা আনলো। যত্ন সহকারে ভিজা চুল মুছিয়ে দিলো। রুদ ভাইয়ের কোলে কাঁপা শরীর গুটিয়ে দিলো। ভিজা চুল মুছে হাত পায়ে সরিষার তেল মেখে দিলো। ভাত বেড়ে এনে মাখিয়ে খাইয়ে দিলো।

বাচ্চাটা এখনো ভাইয়ের সাথে লেপ্টে আছে। খাওয়ানো শেষ করে রুদকে নাপা খাওয়ালো। এরপর বিলি কেটে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। বাচ্চাটা অল্পের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লো। রায়হান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। বোনের জন্য তার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। দিন দিন রুদটা বড় হচ্ছে। আগামী দিন কিভাবে পার করবে সেটা ভেবেই তার মাথা ফেটে যাচ্ছে যেন।
____

রায়হান রাহমিদকে নিয়ে বাসায় আসলো। তার মুখ ভীষণ গম্ভীর। রাহমিদের সারা গায়ে কাদার ছড়াছড়ি। বন্ধুদের সাথে খেলতে গিয়ে কাদা মাখিয়ে এসেছে। এতটুকু বয়সেই বন্ধু জুটিয়ে ফেলেছে সেয়ানাটা। এতো বিচ্ছু এই পিচ্চি। রায়হানের ভাবনার বাহিরে। রায়হান বাসায় এসেই গোসলখানায় ঢুকিয়েছে। গায়ে পানি ঢেলে বলছে,

“তোমার বাঁদরামি কবে কমবে? তোমাকে কি মাইরে ঘুরায়?”

“না চিপসে ঘুরায়।”

রাহমিদ পানি গায়ে ঢাললেই লাফিয়ে উঠে দাঁত বের করে কথাটা বললো। রায়হান আগের মতোই মুখ গম্ভীর করে বললো,

“চিপসে ঘুরায় মানে?”

“মাথায় খালি চিপস ঘুরে। তুমি তো খাওয়াও না। খেলায় জিতলে আমার বন্ধুরা চিপস খাওয়াবে বলেছে। আমিও রাজি হয়েছি চিপসের লুভে। তুমি তো চিপস টা নিতে দিলে না। আমি জিতেছিলাম দৌঁড়ে।”

রাহমিদ উচ্ছ্বাসিত গলায় বললো। পরক্ষণেই চিপস টা খেতে পারেনি দেখে মুখ কালো করে ফেললো।

রায়হানের এখন জগৎসংসার বিরক্ত লাগে। ভাইবোনের একটা আবদার পূরণ করার সামর্থ্য আল্লাহ্ তাকে দেয়নি। ভাইয়ের ইনোসেন্ট চেহারার আদলে কালো মুখটা তাকে খুবই কষ্ট দিলো। তাড়াতাড়ি সাবান ঢলে গোসল করিয়ে বের করলো রাহমিদকে। সারা শরীর, মাথা ভালো করে মুছিয়ে দিয়ে ভাত বাড়লো। ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দেয়ার সময় রাহমিদ বললো,

“গোশত টা মজা হয়েছে ভাইয়ু। আলু দাও।”

“আলু তো দেইনি আজ। আজকে ঝোল রাখিনি। একটু ডাল নিবো?”

“নাও। মজা মজা।”

রাহমিদ মাথা নাড়িয়ে ভাত চিবুচ্ছে আর বলছে।

রুদ এখনো ঘুমিয়ে আছে। রায়হান আর জাগায় নি বাচ্চাটাকে। ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। এতে যদি বিভীষিকাময় অধ্যায়টা ভুলে থাকতে পারে তাহলে ঘুমানোই সই।
_____
—-

প্রায় অনেকদিন পার হয়েছে। রায়হান অনেকদিন ধরে রাহমিদকে মুসলমানি করাতে চেয়েছিল পারেনি। আজকে করাবে। ইমাম হুজুর সুন্নতে খৎনা করাবেন। ইমাম হুজুরের সামনে রায়হান এখন সচরাচর পড়ে না। দেখলেই বিয়ের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। রায়হান বলে দিয়েছে এখন আপাতত বিয়ের ব্যাপারে ভাবছে না। ভাইবোন আরেকটু বড় হোক তারপর দেখা যাবে। ইমাম হুজুর বলেছেন তোমার যেদিন মর্জি হবে বলো। মেয়ে তাহলে আরেকটু বড় হোক। তখনই বিয়ের ব্যাপারে ভাববেন। এ সম্পর্কে মেয়ের বাবা, মাকে জানিয়ে রাখবেন তিনি।
____

রাহমিদকে খৎনা করানোর সময় সে এমন জোরে চিৎকার দিলো। যেই সেই চিৎকার না আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে তোলা চিৎকার। লাফালাফি তো আছেই। চিল্লিয়ে একটা কথাই কেবল আউড়াচ্ছে,

“আমাকে মেরে ফেললো। আমার গুরুত্বপূর্ণ অংশ কেটে ফেললো।”

রায়হানের এতো হাসি পেলো কিন্তু হাসলো না। বাচ্চাটা অবুঝ। কতকিছুই না তার ভাবনা দোল খায়। খৎনা করানো শেষ হলে রাহমিদকে লুঙ্গি পড়িয়ে দিলো। বাচ্চাটা হাত, পা ছড়িয়ে বিছানায় পড়ে আছে। রুদের ছোট্ট ভাইয়ের জন্য ভারী মায়া লাগলো। মাথায় হাত বুলিয়ে নানা গল্প বললো। রায়হানকে দেখে রাহমিদ জিদে হাত, পা ছড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। রায়হান হেঁসে ফেললো। বললো,

“সব ঠিক হয়ে যাবে। চাপ নিচ্ছেন কেন? আপনি না স্ট্রং পারসন। প্রিন্স টোটন ওরফে রাহমিদ সোনা।”

রাহমিদ জিদে হাত দাপিয়ে বললো,

“আমি সুসু দিবো কিভাবে?”

“যেভাবে বলা হয়েছে সেভাবেই দিবেন। ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করার দরকার নেই। আল্লাহ্ ভরসা।”

বেশি দিন লাগলো না রাহমিদের সেরে উঠতে। ভালোভাবেই সুস্থ হয়ে উঠলো বাচ্চাটা।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে