জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-২৭+২৮

0
77

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২৭
তাজরীন ফাতিহা

ভোরের নির্মল বাতাস রায়হানের বরাবরই পছন্দের। রাহমিদকে সাথে নিয়ে নামাজ পড়তে গিয়েছিল। এখন নামাজ থেকে ফিরছে দুই ভাই। ছোট্ট রাহমিদ ভাইয়ের আঙ্গুল ধীরে ঝুলে ঝুলে আসছে। কখনো আবার লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে। রায়হান মুচকি হেঁসে ছোট্ট ভাইয়ের কান্ডকারখানা দেখছে।

মাস দুই আগে রাহমিদটা কত বড় একটা মুসিবত থেকে সেরে উঠলো। টানা একমাস বাচ্চাটা বিছানায় পড়া ছিল। রায়হান নিজের পড়াশোনা, নাওয়া খাওয়া ফেলে ছোট্ট ভাইয়ের যত্ন নিতো দিনরাত। রায়হানের কঠোর পরিশ্রমের ফলেই আল্লাহ্ বাচ্চাটাকে এই গুরতর আঘাত থেকে তাড়াতাড়ি সারিয়ে তুলেছেন। ভাইকে আবারও আগের মতো হাসতে খেলতে দেখে তার পরাণ জুড়ায়। এইতো তার রাহমিদ। টোটন সোনা। আদুরে বিড়ালের মতো কিভাবে লাফাচ্ছে। ভাবতেই রায়হানের চোখ ভিজে উঠে।

বাবা থাকলে সে, ছোট্ট রাহমিদ আর বাবা মিলে বাবার দুই হাত জড়িয়ে দুইজনই নামাজে যেতে পারতো। ভাগ্যের পরিহাসে বাবা নামক বটগাছটা রায়হানদের নেই। ছোট্ট ভাইবোনগুলোর প্রতি তার ভারী মায়া কাজ করে। এই বয়সেই বাবা, মার আদর থেকে বাচ্চাগুলো বঞ্চিত। চোখের পানি সন্তপর্নে মুছে রায়হান রাহমিদকে বললো,

“এভাবে লাফাচ্ছেন কেন কলিজা?”

“মুজা মুজা।”

রাহমিদের উৎফুল্ল কণ্ঠ।

“কিসের মুজা? পায়ের না হাতের?”

রায়হানের রসাত্মক কণ্ঠ। রাহমিদ ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,

“এহ…ইন..না। মুজা মুজা।”

ভাইয়ের রাগ বুঝে রায়হান হেঁসে বললো,

“পড়ে ব্যথা পাবেন তো। তখন মুজা বের হয়ে যাবে।”

“বের অবে না। তুমিও নাফাও।”

“আমি বুড়ো মানুষ। লাফানোর বয়স আমার নেই। তুমিই লাফাও।”

রাহমিদ কোনো কথা না বলে চারপাশ দেখতে দেখতে হাঁটছে। মুখে চকলেট ভরা। ইমাম হুজুর ওকে মসজিদে গেলেই দেয়। আজকেও ব্যতিক্রম হয়নি। বাচ্চাটা খুশিমনে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে খাচ্ছে আর হাঁটছে। হঠাৎ ওর হাঁটার মাঝে একজন বোরকা পরিহিত মহিলার সাথে জোরে ধাক্কা খেলো। রায়হান কিছু বলার আগেই রাহমিদ বলে উঠলো,

“ওই চোকে দেকো না। দাক্কা দিলে কিনো? হাতে বিতা পিয়েছি না। উফফ বিতা!”

মহিলাটি এইটুকু বাচ্চার পাকনা পাকনা কথায় মজা পেলো মনে হয়। উত্তরে বললো,

“খুব বেশিই ব্যথা পেয়েছো নাকি বাবু? মলম লাগিয়ে দিবো?”

রাহমিদকে কেউ বাবু বললে রাহমিদ ভীষণ রাগ করে। অভিমানে মুখ ফুলিয়ে টুলিয়ে বসে থাকে। ভাই, বোনের কেউ বললে তার উপর চিল্লানো শুরু করে। আজকেও মুখ ফুলিয়ে পাঞ্জাবি টানতে টানতে বললো,

“কে বাবু? আমি বলো।”

“তুমি বড় নাকি? আসলে তোমাকে ছোট্ট লাগছে। একেবারে পিচ্চি। পন্ডিতের মতো।”

রাহমিদ ঝট করে মহিলাটির হাতে খামচি দিয়ে বসলো। মহিলাটি উফ শব্দ করে তার মোজা পড়া হাতটা চেপে ধরলো।

রায়হান পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মহিলাটিকে বললো,

“দুঃখিত আন্টি। আসলে ছোট তো বুঝতে পারেনি। আপনি কিছু মনে করবেন না।”

মহিলাটি অদ্ভুত দৃষ্টিতে রায়হানের দিকে তাকিয়ে আছে। রায়হান কথা বলেই ভাইকে টেনে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। মহিলাটি ওদের যাওয়ার দিকে কেমন চোখে যেন এখনো তাকিয়ে আছে। ওই চোখ জোড়ায় কিছু তো একটা নিশ্চয়ই আছে। নিকাবের আড়ালে ভীষণ অদ্ভুত সেই চোখ!
_____

“দিন দিন বেশি বাড়ছো তুমি?”

রুদ রাহমিদকে ধমকাচ্ছে। বড় ভাইয়ের মুখে আজকের সমস্ত ঘটনা শুনে রুদ রাহমিদকে চোখ রাঙিয়েছে। নেইলকাটার দিয়ে নখ কাটছে আর ভাইকে ধমকাচ্ছে। রাহমিদ কিছুতেই নখ কাটবে না। অথচ রুদ আজকে ছাড়বে না। নখ কেটেই ছাড়বে। রুদ নখ কাটতে গেলেই হাত নাড়াচাড়া করায় নেইলকাটারের কোনা লেগে আঙুলের চামড়া উঠে এসেছে। রাহমিদ জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো। রায়হান রান্নাঘর থেকে দৌঁড়ে আসলো। এসে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,

“কি হয়েছে?”

রাহমিদ বড় ভাইকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললো,

“ইখানে বিতা দিছে। উফফ বিতা!”

বলেই ফুঁ দিয়ে কেঁদে উঠলো। রায়হান চট করে আঙ্গুল ধরে মুখে ঢুকিয়ে দিলো। আঙ্গুল চুষে দিলো। তারপর স্যাভলন লাগিয়ে দিলো। রুদকে ধমকে বললো,

“রুদ ওকে আঘাত করো কেন? ও ছোট না? বেশি হাত চলে তোমার। আরেকবার এরকম করলে অনেক মারবো তোমায়।”

রুদ বড় ভাইয়ের ধমক শুনে মাথা নিচু করে চোখের পানি ছেড়ে দিলো। রায়হান রাহমিদকে কোলে নিয়েই রান্নাঘরে চলে গেলো। দেখতেই পেলো না তার কথায় তার আদুরে বোনটা কি পরিমাণে কষ্ট পেয়ে কাদঁছে। রাহমিদের এক্সিডেন্টের পর রায়হান বোনের প্রতি একটু বেশিই গা ছাড়া ভাব। সেটা খালি চোখে না দেখলেও সূক্ষ্ম চোখে ঠিকই ধরা যায়।
____

“ভাত খেয়ে বেশি বেশি শক্তি বাড়ান আর মানুষকে খামচি দিতে থাকুন। এটা ছাড়া আপনি পারেনই বা কি?”

রায়হান রাহমিদকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে আর বকছে। তবে আদুরে বকা। রুদ পাশে বসে চুপচাপ খাচ্ছে। কোনো কথা বলছে না। রায়হান রাহমিদকে খাওয়ানো শেষে মুখ ধুইয়ে দিলো। রাহমিদ বললো,

“আজকি উসুদ কাবো না? বলো বলো উসুদ কিতে কসটো।”

“তোমাকে মাইর দিবো। মাইর খেলে ওষুধ খেতে কষ্ট হবে না। সব গুলোই তো লিকুইড দুইটা মাত্র বড় ওষুধ সেটাও পানিতে মিশিয়ে খাওয়াই আর উনার ওষুধ না খাওয়ার হাজারটা বাহানা।”

রাহমিদ মুখ কালো করে রাখলো। রায়হান ওকে ওষুধ খাইয়ে নিজে ভাত খেতে বসলো। রুদ তখনো ভাত খাচ্ছে। আজকে গলা দিয়ে তেমন ভাত নামছে না তার। ভাইয়ের তার প্রতি অবহেলা সে কিছুতেই মানতে পারেনা। মূলত আজকে ভাত খাওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না। ভাই কষ্ট পাবে দেখে চুপচাপ খেতে বসেছে।এখনো মাথা নিচু করে একটা একটা ভাত মুখে দিচ্ছে।

হঠাৎ করেই সামনে থেকে কে যেন প্লেট নিয়ে গেলো। রুদ মাথা উঁচিয়ে দেখলো রায়হান প্লেটে ভাত মাখাচ্ছে। ভাত মাখিয়ে লোকমা বাড়িয়ে দিলো। রুদের চোখে আবারও পানি টলমল করছে। রায়হান লোকমা বাড়িয়ে বললো,

“বড় হচ্ছো রুদ। নানা প্রতিকূল পরিবেশ পাড়ি দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। কখনো কখনো তোমার কাছের প্রিয় মানুষ থেকেও বিরাট ধাক্কা খাবে, ধোঁকা পাবে তবুও তোমায় টিকতে হবে, হাসিমুখে চলতে হবে, খেতে হবে, ঘুমাতে হবে। এককথায় সবই করতে হবে ধাক্কাটা সামলিয়ে। এই বয়সেই এসব শিখলে বড় হলে এসব তোমার কাছে কিছুই মনে হবে না। পৃথিবীতে কাউকে একশো ভাগ ভালবাসতে নেই, বিশ্বাস করতে নেই। কারণ দিনশেষে আমরা কাছের মানুষের কাছেই সব চেয়ে বড় ধাক্কাটা পাই।”

ভাতের লোকমা রুদের মুখে দিয়ে আবারও বলতে লাগলো,

“ভাইয়ের প্রতি অভিমান হয়েছে?”

রুদ মাথা নাড়িয়ে না বললো। রায়হান বললো,

“যখন আমি থাকবো না তখন কিভাবে থাকবে? সামান্য ধমকে এতো কষ্ট পেলে হবে কলিজা?”

রুদ কেঁদে উঠে ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরলো। রায়হান এক হাতে বোনকে জড়িয়ে অনেক আদর করলো। এই ভাইবোনই তো তার জীবন। এদের বকলে তারও তো খারাপ লাগে।
____

দিন যায়। মাস যায়। রাহমিদ, রুদ, রায়হান বড় হচ্ছে। তিনটা অনাথের জীবন কেটে যাচ্ছে সুখ, দুঃখে। তবে দুঃখের পাল্লা বেশি ভারী এদের মতো অনাথদের। মানুষের জীবনই একটা পেন্ডুলামে ঘেরা। এই সুখ, এই দুঃখ। এসব মিলেই জীবন।
______
—-

“ওই দিল তোর খবর কিরে?”

রুস্তম চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছে আর দিলদার কে বলছে। দিলদার ভোঁতা মুখে বসে আছে। রুস্তম ভাইয়ের গ্যাং তাকে গুতিয়ে এখানে এনেছে। এলাকায় শুনেছে রুস্তম ও তার গ্যাং নাকি একটু সভ্য হয়েছে। অথচ তার সাথে কি আচরণটা করলো এসব ভেবেই তার মন খারাপ। ভোঁতা মুখেই বললো,

“আছি ভাই কোনরকম।”

“কোনরকম ক্যা? অনেক দিন তগো এলাকায় যাওন পড়ে না। আফজাল চাচা কেমন আছে রে?”

“ভালাই। তয় চাচী বেশি ভালা নাই। রোগ শোকে শরীর ভাইঙ্গা গেছে।”

“আহারে। বেচারারা খুবই ভালো মনের মানুষ তয় এতিম পোলামাইয়া গো এট্টু খোঁজ রাখতে পারতো। তুই তো ওগো খোঁজই পাস নাই। মার্কামারা পোলাপান। আমি তুড়ির মইধ্যে খুঁইজা পাইলাম আর তুই?”

দিলদার আবারও ভোঁতা মুখ করে বসে রইলো। সব সময় তাকে খোঁচা না দিলে রুস্তম ভাইয়ের পেটের ভাত হজম হয়না। রায়হানদের খোঁজ পাওয়া গেছে শুনে তার ভীষণ ভালো লাগলো। খুশি হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

“ওরা কেমন আছে ভাই?”

“আল্লাহর রহমতে ভালাই তয় মাস তিন আগে ছোট্ট বাচ্চাটার বড় এক্সিডেন্ট হইছিলো। তিন জনই মারাত্মক জখম হইছিল। এহন আল্লাহর অশেষ রহমতে ভালাই আছে।”

চায়ে চুমুক দিতে দিতে কথা শেষ করলো রুস্তম। দিলদার বললো,

“ওরা কই থাকে ভাই? আমি একটু দেখতাম ওগোরে। অনেক মনে পড়ে বাচ্চা গুলান রে।”

“আইচ্ছা আমার লগে যাইস। পরশু ওগোরে দেখতে যামু। তৈরি হইয়া থাকিস। তুই তো আবার মার্কামারা। কাজের সময় গায়েব। মার্কামারার যত মার্কামারা কাজ কাম।”

খোঁচায় দিলদার আবারও চুপসে গেলো।

চলবে…

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২৮
তাজরীন ফাতিহা

শহরের এই জায়গাটা নিরিবিলি। চারপাশে কোলাহল কম। উত্তরে একটা দোতলা সুন্দর বাড়ি। বাড়ির ছাদে বিভিন্ন জাতের ফুল, ফল গাছ রোপণ করা হয়েছে। বাড়ির মালিক শৌখিন দেখলেই বুঝা যায়। তবে বাড়ির বাইরের দিকটা সুন্দর হলেও ভিতরে চলছে তুমুল গণ্ডগোল। বাড়ির একমাত্র মেয়ের সাথে সমানে তর্ক চলছে মা ইয়াসমিন আহমেদের।

“আমার জীবনের ডিসিশন তুমি নিবে? বোরকা পরতে বলো পড়ি। তাই বলে কারো সাথে কথা বলা যাবে না এটা কেমন কথা?”

“তুমি একটা বেয়াদব। সারাজীবন মানুষের সন্তানকে শিক্ষিত করেছি কিন্তু তোমায় শিক্ষিত করতে পারিনি। কথাবার্তার কোনো আদব লেহাজ নেই। ফড়ফড় করে যা মুখে আসে বলা শুরু করো। যার ঘরে যাবে তার জীবনটা কয়লা বানিয়ে রাখবে। তোমার ঔদ্ধত্যপনায় আমি চরম বিরক্ত।”

“তো আমার ঔদ্ধত্যপনা দেখো না। চোখ বন্ধ করে রাখো। যত্তসব।”

বলেই মেয়েটি প্রস্থান করলো।

মেয়েটির নাম ইফরা সাবরিয়াহ। বাবা সারোয়ার হোসাইন ও মা ইয়াসমিন আহমেদের একমাত্র কন্যা। বাবা সরকারি কলেজের প্রফেসর আর মা ইয়াসমিন আহমেদ হাই স্কুলের শিক্ষক। উভয়ই আদর্শে ভরপুর হলেও একমাত্র কন্যা ইফরা সাবরিয়াহ প্রচণ্ড জেদি ও বেপরোয়া। তার জেদ ও বেপরোয়া স্বভাবের একমাত্র কারণ ছোটবেলা থেকে মা, বাবা কর্মজীবী হওয়ায় আদর, ভালোবাসা কম পাওয়া। দাদীর কাছেই বেশিরভাগ সময় লালিত পালিত হওয়া ইফরা সাবরিয়াহ এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরীক্ষার্থী। একমাত্র দাদীর সাথে তার সখ্যতা নজরকাড়া।
_____

“মেয়ে যে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে সে দিকে তোমার খেয়াল আদৌ আছে? একটু শাসন করলে কি তোমার মান খুইয়ে যাবে। ওই মেয়ের মুখ যেভাবে চলে একে বিয়ে দিতে কি পরিমাণ কসরত করতে হয় দেখে নিও।”

ইয়াসমিন আহমেদ কঠিন স্বরে কথাগুলো বলে স্বামী সারোয়ার হোসেনের দিকে তাকালেন। সারওয়ার হোসেন কিছু একটা লিখছিলেন। স্ত্রীর কথায় চশমা খুলে টেবিলে রাখলেন। বললেন,

“মেয়েকে শাসন ছোট থেকে করেছিলে? এই বয়সে শাসন করে কি কোনো ফায়দা আছে? শাসনের বয়সে শাসন করো নি এখন মেয়ের উপর চিল্লালে হবে। ঠাণ্ডা মাথায় বুঝাও। আমার ইফরা অতটাও বেয়াদব আর বেপরোয়া না। হ্যাঁ এটা ঠিক ছোট থেকে আমাদের আদর, ভালোবাসা মেয়েটা কম পেয়েছে তাই বিগড়েছে। এখন তাকে ভালোবেসেই বুঝাতে হবে। তার জেদ ভাঙতে ঠাণ্ডা মাথার মানুষ লাগবে। যে তাকে বুঝবে, ভুল করলে ঠাণ্ডা মাথায় বুঝিয়ে দিবে এমন কারো কাছেই মেয়েকে দিবো। আমার মেয়ে কি ফেলনা নাকি? বিয়ে দিতে কসরত করতে হবে কেন?”

“আহা তোমার মেয়ের জন্য ঠাণ্ডা মাথার রাজপুত্র এসে হাজির হবে নে। যত্তসব আহ্লাদপনা! যেমন বাপ তেমন মেয়ে। কোনো কিছুতেই কেয়ার করি না টাইপ।”

মুখ ঝামটিয়ে ইয়াসমিন আহমেদ চলে গেলেন। তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সারোয়ার হোসেন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেয়ের জন্য তারও টেনশন হয়। মেয়েটা দিন দিন এমন বেপরোয়া হচ্ছে কেন আল্লাহ্ জানে। মুখে যতই বলুক মেয়ে তার আদরের। যেই সেই ছেলের কাছে মেয়েকে তিনি বিয়ে কখনোই দিবেন না।

মেয়ের জন্য কয়েকজন পাত্র এসেছিল অবশ্য। একটাও সারোয়ার হোসেনের মন মতো না। সে আর তার স্ত্রী মেয়েকে দ্রুতই বিয়ে দিতে চান কারণ অল্প বয়সে বিয়ে করা সুন্নত। ইসলাম অল্প বয়সে বিয়ের ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছে। দরকার হলে বিয়ের পর পড়াশোনা করবে। একমাত্র মেয়েকে একজন সুপাত্রের হাতে তুলে দিতে পারলেই তিনি চিন্তামুক্ত হবেন।

হায়াত মউতের কথা তো বলা যায়না। তাদের পরিবার এমনিতেই ধর্মভীরু। তারা দুনিয়ায় না থাকলে মেয়েকটাকে কে দেখে রাখবে এই চিন্তা তাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে। আল্লাহ্ দ্রুত একজন সুপাত্র মিলিয়ে দিক।
______
—-

সময় খুব দ্রুত চলে যায়। এইতো সেদিন রায়হান রাহমিদকে কোলে নিয়ে দুধ খাইছেছে, গোসল করিয়েছে, খাইয়ে দিয়েছে। ছোট্ট ছোট্ট হাত, পা দিয়ে রাহমিদ ভাইয়ের কোলে ঘুমিয়ে থাকতো, একটু বড় হয়ে সারা ঘর মাতিয়ে রাখতো। এখনো রাখে তবে আস্তে আস্তে রাহমিদ ভালোই বড় হয়ে গিয়েছে।

আজকে তার স্কুল জীবনের প্রথম দিন। রায়হান ওকে কেজিতে ভর্তি করিয়ে দিবে। রায়হান বাসায় বসিয়ে লেখাপড়ার খাতেখড়ি রাহমিদকে দিয়ে দেয়ায় আর প্লে, নার্সারিতে পড়াবে না। একেবারে কেজিতে ভর্তি করিয়ে দিবে।

রাহমিদ আজকে খুশি। ভাইয়া তাকে কোথাও নিয়ে যাবে। তাই সকাল সকাল তাকে তৈরি করাচ্ছে। রায়হান রাহমিদকে জামা পড়িয়ে দিচ্ছে আর বলছে,

“উফ এতো লাফালাফি করছো কেন? চুপচাপ দাড়াও।”

“মজা ভাইয়ু মজা।”

“তোমার সবকিছু এতো মজা লাগে কেন?”

রায়হান রাহমিদকে শার্ট পড়াচ্ছে। প্যান্ট ইন করিয়ে দিলো। টাখনুর উপরে প্যান্ট গুটিয়ে দিলো। মাথায় চিরুনি করে দিলো।

রুদ আরও বড় হয়েছে। এবার ক্লাস ফ্লোরে পড়ে। এখন আগের থেকে আরও বুঝদার হয়েছে। অল্প বয়সেই বাচ্চাটা অনেক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। ছোট ভাইকে আগলে আগলে রাখে। শাসন করে, আদর করে, ভাত খাইয়ে দেয়। বেশিরভাগ সময় রায়হানের হাতেই রাহমিদ খাবার খায় তবে বড় ভাইয়ের ভার্সিটি, টিউশনি থাকায় এই দায়িত্ব রুদই পালন করে। রুদ স্কুল থেকে এসেই রাহমিদের দেখাশোনা করতো। এখন থেকে রাহমিদও স্কুলে থাকবে তাই রুদের দায়িত্ব কিছুটা কমবে।

রায়হান ছোট ভাইকে নিয়ে বের হওয়ার আগে রুদকে আদর করলো কিছুক্ষণ। রুদ রাহমিদকে আদর করে বললো,

“ভদ্র বাচ্চার মতো হয়ে থাকবে। দুষ্টুমি একেবারেই করবে না। তুমি বেশি দুষ্টুমি করো। স্কুলে অনেক বাচ্চা থাকবে সবার সাথে মিলেমিশে থাকবে বুঝেছো?”

“বুঝেচি। তুমি যাবে না আপুনি?”

“আমি কোথায় যাবো? আমি তো স্কুল করিই। তুমিও করবে এখন থেকে।”

“থাক তোমাকে লাগবে না। ভাইয়ু থাকবে আমার সাথি।”

রুদ ভাইকে দোয়া পড়ে সারা গা মুছিয়ে দিলো। বাইরে যাওয়ার যে সমস্ত দোয়া আয়ত্ত করেছিল সব পড়ে দুই ভাইকেই ফুঁ দিয়ে দিলো। দুই ভাই বোনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে গেলো।
______

রায়হান স্কুলে যেতে যেতে রাহমিদকে অনেক উপদেশ দিচ্ছে। রাহমিদ বাচ্চাটা ভাইয়ের কথা বুঝার চেষ্টা করছে। বড় ভাই সাথে থাকলে পৃথিবীর সব কিছু সে জয় করে আসতে পারবে। সে ভাবছে কোথায়ও ঘুরতে যাচ্ছে সে। আসলে যে পড়াশোনা করার জন্য তার জীবনের একটা অধ্যায় শুরু হচ্ছে বাচ্চাটা সেটা বুঝতে পারছে না। ভাইয়ের হাতের আঙুল ধরে আস্তে আস্তে হেঁটে যাচ্ছে সে।

স্কুলে ঢুকে রাহমিদ হা হয়ে গেলো। এতো এতো বাচ্চাদের ভিড়ে তাকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না। এই এতগুলো বাচ্চা কোথা থেকে এসেছে? এটা কিসের জায়গা? এরকম নানা হাবিজাবি চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। শেষে না বুঝে ভাইকে জিজ্ঞাসা করলো,

“ইটা কিসের জায়গা ভাইয়ু? এতো বাচ্ছা কেনো ইখানে?”

“এটা পড়াশোনার জায়গা। এখন থেকে তুমিও এখানে পড়বে। তোমার অনেক সাথী আছে এখানে। তুমি তো বাসায় একা থেকে বোরিং হয়ে যেতে। এখন তোমার বয়সী অনেক বাচ্চা আছে এদের সাথে পড়বে, খেলবে, মজা করবে।”

“তুমিও থাকবে? আমার সাথে পড়বে, খেলবে, মজা করবে?”

“উহু। আমি তোমায় প্রতিদিন এখানে দিয়ে যাবো আর নিয়ে আসবো।”

“আমার ভয় করচে ভাইয়ু। তুমিও সাথে থাকো।”

রায়হান ছোট্ট ভাইয়ের ভয় মাখা চেহারা দেখে আর কিছু বললো না। কারণ এখন যদি রায়হান বলে সে থাকবে না তাহলে রাহমিদ এখানেই গড়াগড়ি খাওয়া শুরু করবে। রাহমিদের যেই রাগ! চিল্লিয়ে কান্না না শুরু করে এই দোয়াই করছে রায়হান।

রাহমিদকে তার নির্ধারিত ক্লাসরুমে বসিয়ে রায়হান পাশে বসলো কিছুক্ষণ। স্যার আসার আগ অবধি রায়হান রাহমিদের সাথে বসে ছিল। গল্প করেছে, ভাইকে অনেক কিছু বুঝিয়েছে। স্যার এসে পড়লে রায়হান রাহমিদকে আদর করে ক্লাসের বাইরে বেরিয়ে গেলো। রাহমিদ ভাইকে চলে যেতে দেখে ছলছল চোখে ভাইয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ভাইকে দরজার সামনে দেখে খুশি হয়ে চুপ করে থাকলো। রায়হান ইশারায় পড়ায় মনোযোগ দিতে বললো।

রাহমিদ যেই একটু সামনে তাকিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিয়েছে অমনি রায়হান ওখান থেকে সরে পড়লো। রায়হানের ভার্সিটিতে যেতে হবে। রাহমিদ তাকে দেখলে পড়ায় মনোযোগ না দিয়ে তার দিকে বার বার তাকাতো তাই সে দ্রুতই সরে এসেছে।

রাহমিদ সামনে থেকে চোখ সরিয়ে দরজায় তাকিয়ে দেখলো ভাই নেই। সারা জায়গায় তাকিয়ে তাকিয়ে ভাইকে খুঁজছে কিন্তু ভাইয়ের কোনো অস্তিত্ব নেই আশেপাশে। যখন বুঝলো ভাই ফাঁকি দিয়ে তাকে একলা অপরিচিত জায়গায় রেখে চলে গেছে তখন চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করলো। স্যার ও আশেপাশের স্টুডেন্টরা হকচকিয়ে গেলো। ক্লাসের মধ্যে রাহমিদকে কাঁদতে দেখে স্যার এগিয়ে গিয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করলো,

“কি হয়েছে বাবু? কাদঁছো কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?”

রাহমিদ কোনো কথা না বলে কাঁদতেই থাকলো। অনেকবার জিজ্ঞাসা করার পর রাহমিদ ছোট্ট করে বললো,

“ভাইয়ু কুথায়? আমি ভাইয়ুর কাছে যাবো।”

স্যার বুঝলো বাচ্চাটার পরিস্থিতি। এই বয়সে বাচ্চারা এমন করবে এটাই স্বাভাবিক তবে প্লের বাচ্চাদের এমন করতে দেখেছেন উনি কিন্তু কেজির বাচ্চার এমন কান্না প্রথম দেখেলেন। বাচ্চাটাকেও ছোট লাগছে। মনে হয় মা, বাবা আগে আগে ক্লাসে উঠিয়ে দিয়েছে। যাইহোক কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে রায়হানকে ডাকা হলো। রায়হান এসে দেখলো রাহমিদ চিল্লিয়ে কাদঁছে। রায়হান দ্রুত ভাইয়ের কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো। নানা কথা বলে বাচ্চাটার কান্না থামালো। ভাইকে দেখে রাহমিদ কান্না থামিয়ে ভাইকে জড়িয়ে গলায় মুখ গুঁজে রাখলো। স্যার বাকি ক্লাসটায় রায়হানকে অ্যালাউ করলো ক্লাসে।

ভাইয়ের সাথে রাহমিদ শান্ত বাচ্চার মতো বাকি ক্লাসটুকু করলো। সুন্দর করে বাকি ক্লাসের পড়া বুঝলো।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে