জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-২৫+২৬

0
7

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২৫.১ (অতীতের খণ্ডাংশ: গল্পের মোড়)
#তাজরীন_ফাতিহা

রায়হানের বাবা খন্দকার রাতিব ইকবাল একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি সব কিছুতে ছিলেন দুর্দান্ত। পড়াশোনা, খেলাধুলা, ইসলামিক জ্ঞানের আদলে গঠিত এই চরিত্রটি গ্রামের সকলের কাছে ছিল আস্থাভাজন এবং সুন্দর মনের একজন। মানুষটি ছিল ছোটবেলা থেকেই শান্ত, বিনম্র। মা রেজোওয়ানা বেগমের আদর্শ ছিল তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যমান।

রাতিব ইকবালের বয়স যখন তেরো তখন তার জীবনের আদর্শকে তিনি চিরতরে হারিয়ে ফেলেন। মায়ের সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলো মনে করলে তিনি ভীষণ পীড়িত হতেন। মা কিভাবে মারা গেলো তা তার মস্তিষ্কে ঐসময় অতো না ঢুকলেও বড় হওয়ার পর ভালোভাবেই ঢুকেছিল। মায়ের উভয় কিডনি বিকল হয়ে গিয়েছিল। তার বাবা খন্দকার ইকরাম উল্যাহ প্রথম প্রথম স্ত্রীর সেবা যত্নের ত্রুটি না করলেও এক সময় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন। রেজোওয়ানা বেগমের অসুস্থতা ছিল অনেক দিনের। আর স্বভাবতই পুরুষ মানুষ বেশিদিন একা থাকতে পারেনা। তাই হঠাৎ করে স্ত্রীর মৃত্যুতে তার মধ্যে তেমন শোক পরিলক্ষিত হয়নি।

রেজোওয়ানা বেগমের মৃত্যুর একমাসের মাথায় রাতিব ইকবালের বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। রাতিব ইকবাল প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। প্রথমত মায়ের মৃত্য, দ্বিতীয়ত বাবার দ্বিতীয় বিয়ে সব মিলিয়ে রাতিব ইকবাল ভিতরে ভিতরে একেবারেই ভেঙে পড়েছিলেন।
______

লোকে বলে, “মা মরলে বাপ হয়ে যায় তালই” কথাটা রাতিব ইকবাল খুব ভালোভাবেই টের পেয়েছিল। সৎ মায়ের অত্যাচার সেই কিশোর বয়স থেকেই সহ্য করে বড় হয়েছেন তিনি। পরবর্তীতে সৎ মায়ের তিন সন্তান হয়েছিল। দুইজন ছেলে আর একজন মেয়ে। রাতিব ইকবাল নামের একজন সন্তান যে ইকরাম উল্যাহর ছিল সেটাই তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তার বড় সন্তান রাতিবের প্রতি তিনি ছিলেন নির্লিপ্ত।

সেই নির্লিপ্ততার অনুতাপে পুড়েই বোধহয় শেষ সময়ে তিনি তার সম্পত্তির অর্ধেক বড় ছেলে রাতিব ইকবালকে লিখে দিয়ে গেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতেই পরবর্তীতে বিরাট এক ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল রাতিব ইকবালের সুখের একটুকরো নীড়।
______
——

খন্দকার রাতিব ইকবালের যুবক বয়সের এক টুকরো প্রশান্তি ছিল তার স্ত্রী জাইয়ানা আনজুম। পনেরো বছর পর স্ত্রী জাইয়ানাই তার শুষ্ক জীবনে পরিস্ফুটিত পুষ্পের ন্যায় ফুটেছিল। সৎ মায়ের অত্যাচার, শাসনে মায়ের আদর্শে গড়ে উঠা ছেলেটি পরবর্তীতে হয়ে উঠেছিল বেপরোয়া, উশৃঙ্খল। পাড়ায় গুন্ডামি করা তার জন্য হয়ে উঠেছিল ডাল ভাতের ন্যায়। যদিও গুন্ডামি করলেও কখনো খারাপ কাজ তার দ্বারা হয়নি। ছোটবেলার ইসলামের আদর্শ একটু হলেও তার মধ্যে জিইয়ে ছিল।

সন্তানরা বাবা, মায়ের ছত্রছায়া থেকে দূরে সরে গেলে বিগড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। মানুষ খারাপ পথে পা বাড়ায় বয়ঃসন্ধিকালেই বেশি। তেমনি রাতিব ইকবালও বয়ঃসন্ধিকালের মতো এতো সংবেদনশীল সময়ে বাবা, মা কারো ছায়া না পেয়ে বিগড়ে গিয়েছিল। প্রায় প্রতিদিনই রাতিব ইকবালের সাথে সৎ মায়ের একটা বিরাট দ্বন্দ্ব লাগতো। সৎ ভাই বোন গুলোও ছোট বয়স থেকে বুঝে গিয়েছিল রাতিব ইকবাল তাদের সৎ ভাই। তাই বড় ভাই হিসেবে কোনো সম্মান তারা রাতিব ইকবালকে দিতো না।

ছোট বোনটা রাতিবের প্রতি সামান্য মায়া দেখালেও পরবর্তীতে মায়ের কান ভাঙানিতে বড় ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা সব মুছে গিয়েছিল।
______
—–

রায়হানের মা জাইয়ানা আনজুম ছিলেন মামার কাছে মানুষ হওয়া বাবাহীন মেয়ে। তার জন্মের আগে বাবাকে হারিয়ে ফেলায় লোকেরা তাকে অপয়া ভাবতো। দাদার বাড়ি থেকে তার মাকে বের করে দিয়েছিল তার মতো অপয়া, অলক্ষ্মী মেয়ে গর্ভে ধারণ করার জন্য। ছোট বেলা থেকে মামার আদরে ভালোবাসায় বড় হয়েছেন জাইয়ানা আনজুম। মামা সালমান ফারুকী ছিলেন নিঃসন্তান। তাই মামীও জাইয়ানা আনজুমকে চোখে হারাতো। জাইয়ানা যখন সদ্য যুবতী হয়েছে তখন তার জন্মদাত্রী মাকেও চিরতরে হারিয়ে ফেলে। তখন বাবা, মা হীন জাইয়ানাকে মামা আগলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেন।

এক সময় রাতিব ইকবালের পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে। প্রস্তাব মূলত রাতিবের দূরসম্পর্কের এক খালা পাঠিয়েছিল। রাতিবের বাবার সাথে কথা বলেই সে প্রস্তাব পাঠায়। রাতিবের বাবা জাইয়ানাকে দেখে ছিলেন এক আত্মীয়ের বিয়ে বাড়িতে। বিয়ে বাড়ির এক কোনায় বোরকা পরিহিত একটা মেয়েকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে তার ভালো লেগে যায়। নম্র, ভদ্র এই মেয়েটিকে বড় ছেলে রাতিবের পুত্রবধূ করার জন্য মন আকুপাকু করছিল। তবে এক সময় বাবা ছেলের মনোমালিন্য বাড়ায় এই চিন্তা ধামচাপা পড়ে গিয়েছিল।
____

বাড়ির বড় ছেলের বিয়ে ধুমধাম করেই হয়েছিল। তবে রাতিব ইকবাল ছিল পুরো নির্লিপ্ত। জাইয়ানার সাথে বিয়ের প্রথম প্রথম রাতিব ইকবাল বড় অসস্তিতে পড়ে গিয়েছিল। আস্তে আস্তে তার বেয়াড়াপনা জাইয়ানা নিজ উদ্যোগে ঠিক করেছিলেন।

রাতিব ইকবাল ও জাইয়ানা দম্পত্তির কোল আলো করে তাদের প্রথম সন্তান খন্দকার রায়হান জাইমের আগমন ঘটে বিয়ের এক বছরের মাথায়। সুখের পুষ্পবৃষ্টি বর্ষিত হতে থাকে দম্পত্তি যুগলের সংসারে। ছোট্ট রায়হানের আধো আধো বুলি সকলের মন কেড়ে নিয়েছিল। ছোট রায়হান তার ছোট্ট ছোট্ট হাত, পা, চোখ নাড়িয়ে কিসব যে বলতো তা বাবা রাতিব ইকবালের কাছে এক একটি রঙিন বসন্তের ন্যায় ছিল।

রায়হানের বয়স যখন চৌদ্দ বছর তখন তাদের পরিবারে আগমন ঘটে আরেক পতুলের। আকীকা করে পুতুলটির নাম রাখা হয়, খন্দকার রুদাইফা জিনাত। বাবা, মা, ভাইয়ের কাছে যে ছিল আদরের মনি। মায়ের শাসন, বাবা ও ভাইয়ের ভালোবাসায় বড় হতে থাকে ছোট্ট পুতুলটি। বাবা রাতিব ইকবাল অল্প বয়সে বিগড়ে গেলেও বিয়ের পর ইসলামকে মনে প্রাণে লালন করেন। মায়ের আদর্শকে আবারও নিজের মনে কঠোরভাবে লালন করার চেষ্টা করেন।

সন্তানদেরকে ইসলামের দীক্ষায় দীক্ষিত করে ভালোভাবেই। বিশেষ করে রায়হানকে ছোট বেলা থেকেই মসজিদে নিয়ে যেতো নামাজ পড়ার জন্য। বাবা পাগল রায়হানও বাবার হাত ধরে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে মসজিদে যেতো।
_______

সৎ ভাইবোনের রাতিব ইকবালের প্রতি ক্ষোভ ছিল তাদের সবার থেকে বেশি সম্পত্তি পাওয়ায়। সৎ মায়ের প্ররোচনায় নানা ফন্দি আঁটতে থাকে কিভাবে এদেরকে পথের ভিখারী করা যায়। সব সময় তক্কে তক্কে থাকতো কিভাবে তাদেরকে হেনস্তা করা যায়। খন্দকার রাতিব ইকবাল সৎ মা এবং ভাইবোনের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেই আলাদা বাড়ি তৈরি করেন। এটা দেখে সৎ মা ও ভাইবোনেরা ভিতরে ভিতরে সাপের মতো ফুঁসতে থাকে।

সমস্যা বাধে জাইয়ানা যখন আবারও গর্ভধারণ করে। সবাই ছি ছি শুরু করে। এই বুড়ো বয়সে আবার বাচ্চা। রায়হান তখন সতেরো বছরের আর রুদ তিন বছরের। চারপাশের মানুষের বিষাক্ত কথার বানে জাইয়ানা আনজুম প্রতিনিয়ত মূর্ছা যেতে থাকেন। সন্তান বড় হয়ে গেলে আবার সন্তান নিলে অনেকেই কটু কথা বলে। তবে এসব কটু কথার প্রচার অবশ্য করেছিল রাতিব ইকবালের সৎ পরিবার।

যেদিন রাহমিদ হলো সেদিন রাতিব ইকবালের পরিবারে খুশির বন্যা বয়ে গেলো। রায়হান ও রুদ দুজনেই খুব খুশি ছোট্ট আরেকটি পুতুলের আগমণে। রাতিব ইকবাল খুশিতে কেঁদে উঠে ছোট্ট রাহমিদের কানে আযান দিয়েছিল।

খন্দকার রায়হান জাইম এবং খন্দকার রুদাইফা জিনাতের ভাইয়ের নাম রাখা হলো, খন্দকার রাহমিদ জাইফ।

তিন ভাই বোনের মধ্যে রাহমিদ ছিল সব চেয়ে বেশি কিউট। তারা তিন ভাই বোনই ভীষণ সুন্দর ছিল। রায়হান মায়ের মতো চেহারা পেলেও রঙ পেয়েছিল বাবার। রুদ আর রাহমিদ পুরোটাই মা, বাবার মিশ্র চেহারা পেয়েছিল। রায়হান শ্যামলা হলেও চেহারায় ছিল অদ্ভুত সুন্দর মাধুর্যতা। তিনটি জীবন্ত পুতুলের মা, বাবা হয়ে খন্দকার রাতিব ইকবাল আর জাইয়ানা দম্পত্তির খুশির অন্ত ছিল না। তবে সুখ যে ক্ষণস্থায়ী তা তারা টের পায়নি বোধহয়।
_____

রায়হানদের পরিবারে খুশির অন্ত না থাকলেও অন্য এক পরিবারে ছিল সীমাহীন হিংসা ও একটি পরিবারকে চিরতরে মুছে ফেলার পরিকল্পনা।

ভাগ্যের পরিহাস রায়হানদের পরিবারকে পরবর্তীতে কোথায় নিয়ে যায় সেটাই দেখবার বিষয়।

চলবে…..

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২৫.২(অতীত রহস্য উন্মোচন)
তাজরীন ফাতিহা

দুঃখ সুখের এক অপূর্ব প্রাপ্তি রাহমিদ জাইফ। “সন্ধি ছায়া” নামক বাড়িটিতে এক টুকরো নূর নেমে এসেছিল যেন। তিন তিনটি রত্ন নিয়ে রাতিব ইকবালের খুশির সীমানা ছিল না। রাহমিদের জন্মের পর পরই বিরাট আয়োজনে যেদিন আকীকা দেয়া হয় সেদিনই রাহমিদ এক দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গিয়েছিল। বাচ্চাটা কিভাবে যেন খাটের কিনারায় এসে গিয়েছিল। তৎক্ষণাৎ বাবা রাতিব ইকবাল চলে আসায় বাচ্চাটাকে বাঁচায়। রাহমিদ জন্মের পর থেকেই জাইয়ানা নানা জটিলতার মুখে পড়েছিল। এর জন্য রাহমিদের ঠিকমতো যত্নআত্তি করতে পারেনি সে। বাবা রাতিব ইকবাল আর ভাই রায়হানই ছোট্ট বাচ্চাটার দেখাশোনা করতো তাদের সাধ্য মতো। জাইয়ানা শুধু দুগ্ধ পান করাতো।
____

“জাইম ভাইয়ের দেখাশোনা করেছো?”

রাতিব ইকবাল খোশমেজাজে জিজ্ঞাসা করলো। আজকে তার মনটা একটু বেশিই ফুরফুরা। কারণ অবশ্য আছে একটা। তাছাড়াও ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলতে গেলে তার মন মেজাজ এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। রায়হান বুঝলো বাবা কোনো কারণে ভীষণ খুশি। পাঁচমাসের ভাইয়ের দেখাশোনা রায়হানই বেশি করে। মাও করেন তবে রাহমিদ জন্মের পর বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন দেখে দেখাশোনা ঠিকভাবে করতে পারেননি। রায়হান বাবার পাশে বসে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বললো,

“আপনার কনিষ্ঠ রাজপুত্র ওরফে রত্নের সেবা করে আমি কৃতার্থ হয়েছি। দয়া করে আপনিও কৃতার্থ হন বাপজান।”

রায়হানের কথার ঢঙে রাতিব ইকবাল দাঁত বের করা হাসি দিলেন। এই হাসিতে আওয়াজ নেই। মুচকি হাসিও না আবার জোরে হাসিও না। এই হাসিতে দাঁত দেখা যায়। মুচকি হাসি সুন্নত। আমাদের নবীজী (সাঃ) উচ্চস্বরে বা জোরে হাসতে নিষেধ করে দিয়েছেন তাই রাতিব ইকবাল হাসির ব্যাপারে খুবই সচেতন। কোনোভাবেই যেন হাসির আওয়াজ শোনা না যায় সেভাবেই তিনি হাসার চেস্ট করেন।

তাদের কথপোকথনের মাঝেই ছোট্ট রুদ কোথা থেকে যেন উড়ে এসে বাবার কোলে মুখ লুকালো। রাতিব ইকবাল মেয়েকে পেয়ে অনেকক্ষণ মন ভরে আদর করলেন। তার দুই রাজপুত্রের মাঝে একটি মাত্র রাজকন্যা। আদরটা তাই সবার থেকে বেশিই করেন বাবা রাতিব ইকবাল। রুদ বাবার গলা ধরে ঝুলে বললো,

“বাবু দুষ্টু করে। আমাল কোলে উতে না। আচকে মালিচি। বাবু ব্যা ব্যা করি কেদেচে।”

“ভাইকে কেন মেরেছো? তোমাকে মারবো এখন।”

মায়ের কথা শুনে রুদ বাবার কোলে আরও ঘাপটি মেরে পড়ে থাকলো। রাতিব ইকবাল বললেন,

“কার এতো দুঃসাহস আমার রাজকন্যার গায়ে হাত দিবে। সামনে আসুক দেখি। কি করি দেখবেনে।”

“এসেছি। কি করবেন তাড়াতাড়ি করুন।”

হাত মুছতে মুছতে রাতিব ইকবালের সামনে দাঁড়ালো জাইয়ানা আনজুম। রাতিব ইকবাল মুখ শুকনো করে ফেললেন। রায়হান মুখ ঘুরিয়ে মা, বাবার আড়ালে হেঁসে ফেললো।

“কি হলো। মুখ লটকিয়ে চুপ করে আছেন কেন? যা করার তাড়াতাড়ি করুন। আপনার এই গুনধর কন্যারত্নকে আমিই তো বকলাম। একটু পর মারবোও। আপনার যা দেখানোর তাড়াতাড়ি দেখান।”

জাইয়ানা শীতল কণ্ঠে বলে উঠলো। শাড়ি পরিহিত এই রাগী নারীর প্রেমেই তো পিছলে পড়েছিলেন রাতিব ইকবাল আরও আঠারো বছর আগে। এরকম করে শাসন করেই তো মানুষ বানিয়েছিলেন তাকে এই জেদি, রাগী নারী। রাতিব ইকবাল চুপসানো গলায় বললেন,

“ইয়ে মানে তুমি ছাড়া সবাইকে দেখাবো বলেছি। তোমাকে বলি নি তো। রেগে আছো নাকি?”

“নাটক কম করুন। আমি তো আপনার সামনেই বকলাম আপনার আদরিণী কন্যাকে। আমাকে দেখেই তো আপনি এই কথা বলেছেন। এখন ঢং করছেন কেন?”

কিছুটা রাগী সুরে জাইয়ানা আনজুম বললেন। রাতিব ইকবাল স্ত্রীকে আর চটাতে চাইলেন না। তাই কোমল কণ্ঠে বললেন,

“ও তো ছোট। ওকে মেরে তুমিই তো পরে বেশি কষ্ট পাবে। তাই বকা, মারা বাদ দাও আনা।”

“আনা” ডাকটির মধ্যে মনে হয় মধু আছে। এই এক ডাকেই জাইয়ানা আনজুম গলেছিলেন আঠারো বছর আগে। এমনকি এখনো এই ডাকেই তিনি ঘায়েল হন। জাইয়ানার মুখভঙ্গি স্বাভাবিক হয়ে আসলো মুহূর্তের মাঝে। তবে ছেলেমেয়েদের সামনে তা দেখাতে নারাজ তিনি। তাড়াহুড়া কণ্ঠে বললো,

“হয়েছে হয়েছে। ঢং রেখে আপনার আদরের কন্যাকে একটু শাসন করুন। দিন দিন বেশি দুষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আজকে রাহমিদকে ধুম ধুম করে মেরে দৌঁড় দিয়েছে। বাচ্চাটা সারাদিন কেঁদেছে। এতক্ষণ ভাইয়ের কোলে ঘাপটি মেরে ছিল এখন আপনার কোলে ঘাপটি মেরেছে। ওকে না মারতে মারতে বেশি আদুরী আপনি আর আপনার বড় রাজপুত্রই বানিয়েছেন।”

রায়হান এতক্ষণ বাবা মায়ের খুনসুটি দেখে মজাই পাচ্ছিলো। হঠাৎ করে তার দিকে অ্যাটাক আসায় তার হাসিখুশি মুখ চুপসে গেলো। আরও অ্যাটাক আসার আগে আস্তে করে উঠে চলে গেলো সে। রুদও বড় ভাইকে চলে যেতে দেখে দৌঁড়ে ভাইয়ের কাঁধে উঠে চলে গেলো। শুধু রয়ে গেলো বেচারা রাতিব ইকবাল। সব দোষের জন্য কথা তাকেই শুনতে হবে এখন। জাইয়ানা আবার বললো,

“দেখলেন কেমন করে উঠে গেলো। কিছু বলতে নিলেই ওনারা পালিয়ে যান। নবাবের বেটা আর বেটি। যেন আমার কথা শুনতেই পায়নি। কত বড়…”

জাইয়ানাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে হাত ধরে পাশে বসিয়ে দিলেন রাতিব ইকবাল। স্ত্রীর কাঁধে হাত জড়িয়ে বললেন,

“মাথা ঠাণ্ডা করো আনা। ওরা ছোট। এতো বকলে হয়। জিনাত নিজেই তো ছোট, অবুঝ। ও কি বুঝে বলতো? ছোট ভাইকে মারলে যে ব্যথা পাবে এটা কি বুঝেছে আমার জিনাত মা। ওসব বাদ দাও। আর তিন মাস পর আমাদের হজ। সব বন্দোবস্ত করে এসেছি আজ। তোমার না হজ করার কত ইচ্ছে। এতদিন পর আল্লাহ্ হজের তৌফিক দিয়েছেন। সবাই মিলে হজে যাবো। তুমি, আমি, জাইম, জিনাত আর আমাদের ছোট্ট জাইফ। আমাদের পরিবারের ছোট হাজী সাহেব হবেন তিনি।”

কথাটা বলেই রাতিব ইকবাল মুচকি হাসলেন। জাইয়ানাও আজকে অনেক খুশি। তার কত দিনের ইচ্ছা হজের। তার স্বামী ও সন্তানের সাথে হজে যাবেন ভেবেই তিনি খুশিতে কেঁদে দিলেন। রাতিব ইকবাল স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরলেন। তার নিজেরও কান্না পাচ্ছে। তাদের কতদিনের শখ আল্লাহর ঘর দেখার। এতদিন শখ থাকলেও সাধ্য ছিল না। এখন আল্লাহর রহমতে তার শখ, সাধ্য দুটোই আছে। আলহামদুলিল্লাহ।
_____
—–

সুখ, হাসি, দুঃখ সবকিছুর সমন্বয়ে আড়াই মাস কেটে গেছে। আর কয়দিন পরই হজের জন্য যাত্রা করবেন রাতিব ইকবাল ও তার পরিবার। সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছেন তারা। যেহেতু কয়েকদিনের জন্য বাইরের দেশে যাবেন তারা তাই রাতিব ইকবাল ঠিক করেছেন পরিবার নিয়ে কোথাও ঘুরে আসবেন। অনেকদিন পরিবারকে সময় দেয়া হয় না।

আজকে এসেই জাইয়ানাকে তার এই আশার কথা বললেন। জাইয়ানা খুশি মনে রাজী হয়ে গেলো। ঠিক হলো সন্ধ্যায় বের হবেন তারা। কিন্তু রায়হানের পরীক্ষা থাকায় সে যেতে রাজি হয় নি। রুদও বড় ভাই যাবে না দেখে যাবে না। বাচ্চাটা ভাইয়ের ন্যাওটা। অবশ্য বাবারও ন্যাওটা। তবে আজকে রুদের এমনিতেই যেতে ইচ্ছা করছে না। রাতিব ইকবাল আর জোর করেনি। বাচ্চা মানুষ যেটা ইচ্ছা হবে তাই করবে।

রায়হান, রুদ কেউ যাবে না দেখে রাহমিদকেও রেখে গেলো। আজকে বেশিক্ষণ ঘুরবে না বলে ঠিক করলো। যেদিন তিন সন্তান নিয়েই ঘুরতে পারবে সেদিন বেশি করে ঘোরাফেরা করা যাবে। ঘুমন্ত রাহমিদকে আদর করে রায়হানের তত্ত্বাবধানে রেখে তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে বলে বেরিয়ে গেলো। বিয়ের পর পর এভাবেই ঘুরতে গিয়েছিল একবার। তখন শশুর বেঁচে ছিল। জাইয়ানার কি যে শরম লেগেছিল সেদিন। শশুরের সামনে স্বামীকে নিয়ে একা একা ঘুরতে যাচ্ছেন ভেবেই তিনি লজ্জায় মরে যাচ্ছিলেন। আজকেও হঠাৎই লজ্জা লাগছে ছেলেমেয়েদের রেখে বুড়ো বয়সে ঘুরতে এসেছেন ভেবে।

গাড়িতে উঠেই জাইয়ানার পুরোনো স্মৃতি গুলো বেশি উঁকি দিতে লাগলো আজকে। রাতিব ইকবাল গাড়ি চালাচ্ছেন আর স্ত্রীর লজ্জালু মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। ভালোই লাগছে আজকের তার। অনেকদিন পর স্ত্রীকে নিয়ে কোথাও বের হচ্ছেন তিনি। কাজের প্রেশারে জাইয়ানাকে সময়ই দেয়া হয় না ঠিকমতো। আজকে সময় দিতে পেরে ভালোই লাগছে তার।

আজকে গাড়ির ব্রেকে কেমন সমস্যা করছে। হঠাৎ করেই গাড়ির ব্রেক কাজ করছে না। রাতিব ইকবাল কোনোভাবেই ব্রেক করতে পারছিলেন না। হঠাৎ বাম সাইড দিয়ে বড় ট্রাক এসে গাড়িটাকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো। ধাক্কায় গাড়িটা ছিটকে অনেক দূর চলে গেলো। মুহুর্তের মাঝেই সব কিছু কেমন থমকে গেলো।
_____

“সন্ধি ছায়া” বাড়িটায় অনেক মানুষ। যে বাড়িটা পাঁচজনের হাসিতে ঝলমল করতো সেই বাড়িটায় আজকে কান্নার রোল পরে গেছে। দুটো লাশ ঢুকছে বাড়িটায়। বেরিয়েছিল দুটি জীবন। আসলো দুটি লাশ। রায়হান কেমন পাথর হয়ে গেছে। লাশের খাটিয়া তার সামনে অথচ সাদা কাফন সরিয়ে মুখ দুটো দেখার শক্তি তার নেই। তার সমস্ত শক্তি কে যেন শুষে নিয়েছে। পাশে রুদ পুতুল খেলছে। সবার কান্নায় বাচ্চাটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ভয় কাটাতে পাশের বাসার একজন বাচ্চাটাকে পুতুল দিয়েছে। সেটা নিয়েই খেলছে সে। আট মাসের রাহমিদ রায়হানের কোলে হাত, পা নাড়াচ্ছে। ওকে নিয়েই দৌঁড়ে নিচে নেমেছে রায়হান।

রায়হান রাহমিদকে নিয়েই খাটিয়ার পাশে বসলো। সাদা কাপড়টা সরাতে লাগলো কাঁপা হাতে। তার মা, বাবা আর দুনিয়াতে নেই কথাটা সে বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না। কাপড় সরাচ্ছে আর মনে মনে প্রার্থনা করছে লাশ দুটো যেন অন্য কারো হয়। কাপড় সরিয়ে রায়হান ছিটকে গেলো।

মুখ একেবারে থেতলে গিয়েছে তার মা, বাবার। মায়ের পরনের সেই বোরকা, বাবার সাদা পাঞ্জাবি। যদিও পাঞ্জাবি আর সাদা নেই। রক্তে মাখামাখি হয়ে গিয়েছে। এটা যে তার মা, বাবা তা চিনতে একটুও সময় লাগেনি রায়হানের। কাঁদবে না বলেও হুহু করে কেঁদে উঠলো সে। তার সাথে পল্লা দিয়ে কোলের রাহমিদও চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো। বাচ্চাটা কি বুঝেছে তার মা, বাবা এই দুনিয়া থেকে হারিয়ে গিয়েছে চিরজীবনের জন্য? আর কেউ তাকে দুধ খাওয়াবে না, আদর করবে না এটা কি বাচ্চাটা বুঝলো! রুদ পুতুল রেখে ভাইয়ের কাছে দৌঁড়িয়ে আসলো। ভয় মিশ্রিত গলায় জিজ্ঞাসা করলো,

“কান্দ কেনু?”

বলে রুদও ভাইয়ের সাথে কেঁদে দিলো। রুদকে রায়হানের সৎ ফুপি উপরে নিয়ে চলে গেলো। বাচ্চাটার মা, বাবা যে আর দুনিয়ায় নেই এটা কেউই তাকে বললো না। রায়হানকে কেউ থামাতে পারছে না। আজকে বাবার সৎ পরিবারের সবাই এসেছে। তারাও মেকি কান্না কাঁদছে। রায়হানকে এসে তার সৎ দাদি ধরলো। কেঁদে উঠে রায়হানকে থামতে বললো। দাদীর ভালোবাসা না পাওয়া রায়হান সরল মনে এই ছোঁয়াকে ভালোবাসা ভাবলো। রাতিব ইকবাল কখনোই তার সৎ মা, ভাই, বোনের সম্পর্কে সন্তানের কাছে কোনো খারাপ মন্তব্য করেনি। তাই বোধহয় অবুঝ রায়হান এটাকেই নির্মল ভালোবাসা ভেবেছে।
____

বাবা মায়ের দাফন শেষে রায়হান বিধ্বস্ত অবস্থায় বাসায় ঢুকার আগেই দেখলো রুদ মেঝেতে পড়ে আছে। মা, বাবার জন্য কাদঁছে বাচ্চাটা। সামনে রায়হানের সৎ ফুপি রণমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে। পিছনে আরও তিনজন নারী দাঁড়ানো। দুইজন রায়হানের সৎ চাচী আর একজন সৎ দাদি। কেউই বাচ্চাটাকে উঠাচ্ছে না। রায়হানের বুকে কামড় দিয়ে উঠলো। রুদ মা, বাবার জন্য কাদঁছে ভেবে দ্রুত বাসায় ঢুকে বাচ্চাটাকে উঠালো সে। রায়হানকে দেখে তিন নারী মেকি আদর দেখাতে লাগলো। বিধ্বস্ত রায়হান এদের ছলনাকে ভালোবাসা ভেবে অন্য কিছু ভাবার অবকাশ পেলো না।
______

“এই আপদকে বিষ খাইয়ে মারা লাগবে। সেদিন মারতে চেয়েছিলাম কিন্তু বড় আপদটা চলে আসায় পারি নি। দুধের সাথে আজকে মিশিয়ে খাওয়াবো। কি বলেন আম্মা।”

রায়হানের ছোট চাচা কথাটা বলে উঠলো। সবাই এক রুমে এসব পরিকল্পনা করছে। রায়হানের বড় চাচা বলে উঠলো,

“ওদের আব্বা, আম্মাকে তো মারতাম না। ওই ছোটটা ছেলে হওয়াতে মেরে ফেলছি গাড়ির ব্রেক নষ্ট করে। রাতিব্বার তো কপাল আম্মা। দুই দুইটা পোলা। আর আমাদের মেয়ে। ওর উপ্রে আমার সেই ছোট বেলা থেকে ভীষণ রাগ। সব ওয় আর ওর আওলাদ একলা পাবে। আব্বায় যে কামডা করছে আম্মা মোটেও ভালো করে নাই। ওয় বাইচ্চাই থাকতো। খালি ওর সম্পত্তিই ওরে আর আর ওর বউরে শেষ করলো। ভাবছিলাম পুরা পরিবাররেই নিশ্চিহ্ন কইরা দিবো কিন্তু ওই তিনডা কই মাছের জান তো যায়ই নাই পরে শুনি। রাগে পুরা শরীর জ্বলতাছিল আমার।”

ওই রুমের উপস্থিত সবাই ভীষণ অবাক হলো। শুধু সৎ মা ছাড়া। রাতিব ইকবাল আর জাইয়ানা আনজুমকে তাদের বড় ভাই মারছে। কথাটায় প্রথমে অবাক হলেও মনে মনে খুশিই হলো। দুটো আপদ বিদায় হয়েছে। একজন শুধু খুশি হতে পারেনি। ওই একজনের চোখে এদের বিশ্রী নোংরা কথা বিষের মতো ঠেকলো।
_____

“জাইম তুমি আইজকাই এই গ্রাম ছাইড়া চইলা যাইবা। তোমার ভাই, বোন কেউই এইহানে নিরাপদ না। সবই তো শুনলা আইজকা। এদের লাহান মানুষরূপী পিচাশদের সাথে তুমি একলা কিছুতেই পারবা না। আমি চাই না এই নরপিশাচদের সম্পত্তির লোভে তোমরা তিইনজন বলি হও। পুলিশের কাছে গেলেও তুমি সাহাইয্য পাইবা না কারণ তোমার বড় শয়তান চাচার পুলিশ গো লগে মেলা খাতির। এরা তোমাগো পক্ষে কোনো কালেই রায় দিতো না। তোমার চাচার লগে আমার মেলা দিন থেইকা উঠাবসা তাই ওর নাড়ী নক্ষত্র সব জানি।”

এতক্ষণ রায়হানের এক দুঃসম্পর্কের চাচা কথাগুলো বলে শেষ করলো। রায়হান পাথরের মতো হয়ে গিয়েছে। এগুলো কি শুনলো। তার বাবা, মায়ের খুনিকে এতোদিন আপন ভেবেছে। এদের এতো রকমের চেহারা দেখে রায়হান পাথুরে মূর্তি হয়ে গিয়েছে। আর কিছু ভাবার অবকাশ সে পেলো না। তার পুরো দুনিয়া ঘুরতে লাগলো। কি শুনলো এসব সে!
জীবন যে তার সাথে খেলা শুরু করেছে এটা রায়হান সেইদিনই বুঝে গিয়েছিলো। রায়হান রাহমিদ ও রুদকে নিয়ে সেদিনই বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলো। শুধু সম্পত্তির বলি তার ভাইবোনকে সে কোনোদিনও হতে দিবে না। এদের সাথে একলা লড়াই করে কিছুতেই পারবে না সে। এই পৃথিবীতে আইনও টাকায় কেনা গোলাম।

চলবে….

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২৬(রাহমিদ😘)
তাজরীন ফাতিহা

“প্রথম প্রথম দুধের অভাবে রাহমিদ প্রচণ্ড কান্না করতো। ওকে কোনোভাবেই থামিয়ে রাখা যেতো না। কারো কোলেই রাহমিদ যেতে চাইতো না। আমি কোলে নিয়ে থাকতাম। তাও অনেক সময় ওর কান্না কিছুতেই কমাতে পারতাম না। একবার কি হয়েছিল জানেন ভাই?”

রায়হান হাসপাতালের ফ্লোরে বসে উপরের দিকে তাকিয়ে ভাঙা কণ্ঠে রুস্তমকে বলে উঠলো।

রুস্তমও রায়হানের পাশে বসে ওর দিকে তাকিয়ে মনোযোগ সহকারে রায়হানের তিক্ত অতীত শুনছে। তার চোখ ভিজা। গালে চোখের পানি শুকিয়ে আছে। রুস্তম বললো,

“কি হয়েছিল?”

রায়হান আগের মতো থেকেই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো,

“রাহমিদের বয়স তো কম। মাত্র আট মাস বয়স। রাতে মায়ের বুকের দুধ খেতে খেতেই ও ঘুমিয়ে যেতো। মা মারা যাওয়ার পর অনেকদিন ফিডারের দুধ খাইয়ে রেখেছে ওকে। ও আমার সাথেই ঘুমাতো কারণ আর কারো সাথেই বাচ্চাটা থাকতে চাইতো না। ভালোই হয়েছে থাকতে চাইতো না নাহলে ওকেও কখন আব্বু, আম্মুর মতো….”

বলতে বলতে হঠাৎই গলা ধরে আসলো রায়হানের। ওই প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে আবারও বললো,

“তো সেইদিন ঘুমিয়ে আছি। পাশে রাহমিদ ছোট্ট হাত, পা ছড়িয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অনেক কষ্ট হয়েছিল ওকে ঘুম পাড়াতে। যেহেতু দুধের শিশু ওরা মায়ের ওম ছাড়া ঘুমাতে পারে না। তবুও অনেক কাঁদার পর ঘুমিয়ে পড়েছিল বাচ্চাটা। হঠাৎ মাঝ রাতে আমার বুকের উপরে কারো থাবা অনুভব করি। ঠাস করে চোখ খুলে দেখি রাহমিদ ঘুমের ঘোরেই বুকের দুধ খুঁজছে। যেহেতু আমি ছেলে মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই আমার কাছে ও যেটা খুঁজছে সেটা পাবে না। উঠে ফিডার বুকের পাশে লাগিয়ে ওকে খাইয়েছি। আমার এটুটুকুন দুধের ভাইকে আমি ছোট থেকে এই হাতে মানুষ করেছি ভাই। এই হাতে..”

রায়হান হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে হাত দুটো বাড়িয়ে রুস্তমকে দেখাতে লাগলো। পাগলের মতো বলতে লাগলো,

“আমার সেই ছোট্ট দুধের ভাইকেও আল্লাহ্ কেড়ে নিতে এসেছেন ভাই। আপনারা আল্লাহরে বলেন, আমার ভাইরে ছেড়ে দিতে। আমার ভাইরে ফিরাই দিতে। ও আমার কলিজার টুকরা ভাই। আজকে সাত দিন ওই আইসিইউ রুমের মধ্যে কেমনে আছে বাচ্চাটা? আমার সেই ছটফটে কলিজাটা কেমনে নিশ্চুপ, নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে ভাই? সারা ঘর মাতিয়ে রাখা সেই ছোট্ট আদুরে ছানার কোনো রেসপন্স নাই দেখছেন আপনি? আমার কলিজা পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। মা, বাবারে নিয়ে আল্লাহ্ আমারে জীবন্ত পাথর বানিয়ে ফেলছে। আল্লাহরে বলেন এখন আমারে জীবন্ত লাশ বানিয়ে এই দুনিয়ায় না রাখতে। আমার কোল খালি করতে, আমার কলিজা কেড়ে নিতে আপনারা আল্লাহরে নিষেধ করেন ভাই।”

বলতে বলতে হুহু করে কেঁদে উঠলো রায়হান। রুস্তমের চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়াচ্ছে। কি বলে সান্ত্বনা দিবে বুঝে উঠতে পারছে না সে। রায়হান আবারও ছটফট করতে করতে বলে উঠলো,

“ওই ছোট্ট শরীরটায় কতগুলো সূচ ফুটে আছে। কতগুলো ইনজেকশনের সূচ আমার ছোট্ট আদুরে কলিজার শরীরে আছে দেখেছেন আপনি ভাই? ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে কিন্তু বলতে পরছে না। আমি বা রুদ একটু মারলে সারা ঘর গড়াগড়ি খেতো আমার কলিজাটা। সেই কলিজা এখন কতগুলো সূচ নিয়ে নিস্তেজ, নিশ্চুপ হয়ে সাতদিন পড়ে আছে। আল্লাহ্ এবার সবাইকে ঈদ দিলেও আমাকে দিয়েছে একরাশ দুঃখ, যাতনা, কলিজা ছাই হওয়া কষ্ট। এতো সুন্দর উপহার পেয়ে আল্লাহর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। শুকরিয়া জ্ঞাপন করি।”

রায়হানের আহাজারি, কান্না হাসপাতালে উপস্থিত সকলের কানে বারি খাচ্ছে। সকলেরই চোখে পানি এসে গিয়েছে ওর আহাজারি শুনে।

আল্লাহ তায়ালা কি এই করুণ আহাজারি শুনতে পেলেন?
_____
—-

আজকে দশ দিন হলো রায়হানের হাসপাতালের জীবনের। জীবনের তিক্ত অনুভূতির সাক্ষী হতে রায়হানের এই হাসপাতাল জীবনের সূচনা হয়েছিল। নামাজের বিছানায় চোখের পানি ফেলতে ফেলতে চোখের পানি সব শুকিয়ে গেছে মনে হয়।

এই রায়হানকে চেনা যায়না। এই রায়হান হাসে না, কথা বলে না, খায় না। শুধু খুদা মেটাতে একটু খাবার মুখে নেয় এই যা। সেটাও আবার রুস্তম জোর করে খাইয়ে দেয় বলে। রুদের ব্যান্ডেজ খুলা হয়েছে পরশু দিন। এখন ও মোটামুটি ভালোই মুভমেন্ট করতে পারে। পরিপূর্ণ সুস্থতার পথেই রুদ।

রায়হানের মাথায় আর হাতে এখনো ব্যান্ডেজ দিয়ে মোড়ানো। ওযু করতে পারেনা তাই তায়াম্মুম করে নামাজের বিছানায় বসে চোখের পানি ফেলে আর আল্লাহর কাছে আহাজারি করে রাহমিদ কে তাঁর বুকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য। আবার মাথায় আঘাতের ফলে কিছু ভুলে গেলে রুস্তমের কাছে করুণ আকুতি করে চিল্লায়। কি এক দুর্বিষহ জীবন রায়হানের! যেন একটুকরো বিষাদ।
______

“২৪৮ নম্বর রুমের বাচ্চাটা রেসপন্স করছে। জরুরী বিভাগে যার বাচ্চা ভর্তি দ্রুত চলে আসুন।”

সাদা পোশাক পরিহিত একজন নার্স চিল্লিয়ে কথাগুলো বললো। রুস্তমের বিশ্বাস হচ্ছে না। কত নম্বর রুম বললো। “২৪৮” হ্যাঁ এই রুমেই তো রাহমিদকে শিফট করেছিল গতকাল। জরুরী বিভাগে বাচ্চাটাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য।

যেহেতু এটা সরকারি হাসপাতাল সেহেতু ভালো মানের ডাক্তার এতদিন ছিল না। গত পরশু এসেছে। এসেই বাচ্চাটাকে আরেকবার পরীক্ষা, নিরীক্ষার জন্য তাদের অনুমতি নিয়েই জরুরি বিভাগে ভর্তি করেছেন তারা।

রুস্তম আশেপাশে রায়হানকে খুঁজতে লাগলো। খবরটা শুনে রায়হান আবার দৌঁড় দিয়েছে নাকি সেটাই দেখলো। যখন দেখলো রায়হানের অস্তিত্ব আশেপাশে নেই তখন দৌঁড়িয়ে নামাজ কক্ষে প্রবেশ করলো। যা ভেবেছিল তাই। নামাজের বিছানায় সিজদারত অবস্থায় পড়ে আছে রায়হান। পাশে রুদও ভাইয়ের দেখাদেখি নামাজ পড়ছে।

এদের তিনভাইবোনের ভালোবাসা তাকে ভীষণ মুগ্ধ করে। মনে হয় তাকে কেন এমন ভাই, বোন আল্লাহ্ দিলো না?

নামাজ শেষের জন্য রুস্তম অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। রায়হান সিজদায় পড়ে অনেকক্ষণ কাঁদলো প্রতিদিনের মতো। কিছুক্ষণ পর সিজদা থেকে উঠে জায়নামাজ ভাঁজ করে রাখার সময় রুস্তমের কথা শুনে হাত থেকে জায়নামাজ পড়ে গেলো।

এক দৌঁড়ে জরুরি বিভাগের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে রায়হান আর তার পিছে রুস্তম, রুদ।

দরজায় হঠাৎ এত মানুষ দেখে ড. শামসুল আলম অবাক হন কিছুটা। এই বিভাগে রোগীর আত্মীয় ছাড়া হঠাৎ করে কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ। এরা কারা? দুইজন নার্স যেয়ে রায়হানদের আটকালো। “কাকে চায়?” “আপনারা কারা” এসব প্রশ্ন করে রায়হানদের বের করে দিতে উদ্যত হলে রায়হান বলে উঠলো,

“আমার কলিজা, আমার রাহমিদ নাকি রেসপন্স করছে? তাহলে আমাকে বের করে দিতে চাচ্ছেন কেন? আমি ওর ভাই।”

নার্স ও ডাক্তার যেহেতু নতুন তাই রায়হানের এই কয়দিনের উদ্বিগ্নতা, আহাজারি কোনো কিছু সম্পর্কেই তারা অবগত নন। একজন পুরোনো নার্স এসে রায়হানের কথা ড. শামসুল আলমকে বললো,

“স্যার পেশেন্টের ভাই ইনি। নাম রায়হান।”

” আই সি। ওর অ্যাগ্ৰিসেভনে্সেই বুঝেছি বাচ্চাটার কেউ হবে হয়তো। তবে এতো দেরি করে আসলেন কেন ইয়াং ম্যান।”

“নামাজে ছিলাম স্যার।”

“আচ্ছা আচ্ছা। ঠিক আছে। আল্লাহ্ তায়ালাকে ডেকেছেন বিধায় বাচ্চাটা রেসপন্স করেছে মনে হয়। আপনি একটু কিছু কথা বলে দেখুন। বাচ্চাটা কিছু বলে কিনা দেখেন।”

বয়সে অনেক বড় হয়েও ছোট একজনকে আপনি করে বলায় বুঝা যায় কত মার্জিত এই লোক। রুস্তমের ডাক্তারের ব্যবহার অনেক ভালো লাগলো।
____

রায়হান রাহমিদের বেডের পাশে বসে আছে। আজকে দশ দিন পর তার কলিজার মুখ দেখতে পাচ্ছে সে। চেহারায় জায়গায় জায়গায় ব্যান্ডেজ, কাটা দাগ তবুও বাচ্চাটার মায়াবী বদন একটুও ম্লান হয়নি যেন। রায়হান চোখের পানি ছেড়ে ডেকে উঠলো,

“আমার রাহমিদ রে। কই চলে গিয়েছিলে ভাইকে ধোঁকা দিয়ে? অনেক মারবো তোমায়। ভাইয়ের সাথে কথা বলবে না? ভাইয়ের প্রতি অভিমান জন্মেছে তোমার। এতদিন কষ্ট পাচ্ছো দেখে ভাইয়ের প্রতি তোমার অনেক রাগ তাইনা কলিজা। আমার টোটন সোনা কথা বল। বলবিনা কথা?”

রায়হান রাহমিদের ব্যান্ডেজ মাখা শরীরে আলতো করে হাত বুলিয়ে বলে যেতে থাকলো তার কয়েকদিনের জমানো অজস্র কথা। রুদও পাশে বসে কেঁদে দিয়েছে। তার ছোট্ট ভাইটা কিভাবে শুয়ে আছে? তার ভালো লাগছে না ভাইকে এভাবে দেখতে। সারা ঘর মাতিয়ে রাখা সেই ছোট্ট রাহমিদকে চাই তার।

রুস্তম পাশে দাঁড়িয়ে এই তিন মায়ার ঢালির জন্য দোয়া করছে। বাচ্চাটা যাতে কথা বলে এটাই চায় সে। রায়হানের কষ্ট আর দেখতে পারছে না সে। কত কত মানুষকে জীবনে কাঁদিয়েছে সে অথচ আজকে চায় হাসুক একজন। তার দোয়ার বদৌলতে হলেও হাসুক রায়হান।

“ভাইয়ু কুব বিতা। ইখানে বিশি বিশি বিতা।”

অস্ফুট স্বরে রাহমিদের আওয়াজ। রায়হান, রুদ, রুস্তম তিন জনই স্তব্ধ। সকলের মুখে বিরাট পাথর নেমে যাওয়ার স্বস্তি।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে