জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-২৩+২৪

0
106

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২৩
#তাজরীন_ফাতিহা

দেখতে দেখতে পঁচিশটা রোযা সম্পূর্ণ হবে আজকে। দুপুর তিনটে। কাঠফাঁটা রোদে চারপাশ যেন ঝলসে যাচ্ছে। রায়হান ফুটপাতে হাঁটছে। হাতে এক পোয়া বেসন আর দুইটা মাঝারি আকারের বেগুন ঝুলছে পলিথিনে। রোদের তেজে রায়হান ঘেমে নেয়ে একাকার। আজকে টিউশনির প্রেশারটা বেশি ছিল। রোযার কয়েকদিন একটু বেশিই পরিশ্রম করতে হচ্ছে তাকে। যেহেতু মুসলিমদের বছরে দুইটা আনন্দের দিন আসে সেহেতু দুটো ঈদে রায়হান যথাসম্ভব ভাইবোন দুটোকে নিজের সাধ্যের মধ্যে জামাকাপড় দেয়ার চেষ্টা করে। নিজের জন্য কিছু না কিনলেও ভাইবোন দুটোর জন্য সে কিনবেই। টিউশনির টাকায় সারা মাস চালাতে তার হিমশিম খেতে হয়। তাই এই মাসে চেষ্টা করে স্টুডেন্টদের সময় বেশি দিতে। এতে অভিভাবকরা খুশি হয়ে বোনাস দেয়। মানে টিউশনির টাকার সাথে কয়টা টাকা বেশি বোনাস দেয়। যেহেতু তার ভার্সিটি বন্ধ থাকে তাই কোনো সমস্যা হয়না।

রায়হান পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই মসজিদে পড়ে। মসজিদে ফজরের সালাত আদায় করে বাসায় এসে কুরআন তেলাওয়াত করে বেরিয়ে পড়ে টিউশনের উদ্দেশ্যে। সকাল সাতটায় বের হয়। বাসায় আসে কোনোদিন তিনটায় আবার কোনোদিন চারটায়। টানা কয়েক ঘণ্টা অমানুষিক পরিশ্রম করে বাসায় এসে আবার ভাইবোনদের জন্য কিছু ভাজা পোড়া করে। সাধ্যের মধ্যে শরবত আর কিছু ফলমূল রাখার চেস্টা করে। সব সময় অবশ্য ফল থাকে না। ফলের যে দাম। আগুন একেবারে!

দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতিতে রায়হানদের মতো মানুষদের চলতে হয় হিসেব করে। অন্যান্য মাসে দাম যেমন তেমন কিন্তু রোযার মাসে দাম হয়ে যায় আরও দ্বিগুণ। যা নিম্নবিত্ত, রায়হানের মতো খেটেখাওয়া মানুষদের জন্য খুবই কষ্টকর ও কষ্টসাধ্য। রমাদানে যদিও রায়হানের ঘরে ভুঁড়ি ভুঁড়ি বাজার করা হয়না তবুও ওই একটু ছোলা বুট, মুড়ি এগুলোতেই চলে যায় বেশ কিছু খরচা। প্রতিদিন অবশ্য তাদের ভাজা পোড়া বা বুট মুড়ি থাকে না। কোনো কোনো দিন ভাত, পানি দিয়েও ইফতার সারে তারা তিন ভাইবোন। সেদিন রাহমিদ টা প্রচুর জ্বালায়। পাশের ঘরে ভালোমন্দ খাবার দেখে এসে তারও ছোট্ট মনে খেতে ইচ্ছা করে এসব খাবার।

অবশ্য পাশের ঘরের আপুটা দুই দিন ইফতারি দিয়ে গিয়েছেন। রায়হান কিছু দিতে পারেনি এখনো। তাদের ইফতারি বেশিরভাগই থাকে ভাত নাহলে ছোলা মুড়ি। মাঝে মধ্যে একটু পিঁয়াজু। শুধু ছোলা মুড়ি আর একটু পিঁয়াজু কি কারো বাসায় ইফতারি হিসেবে পাঠানো যায়। তাই আজকে বেসন আর বেগুন কিনেছে। মসুর ডাল ভিজিয়ে রেখে এসেছে। ভাজা পোড়া কয়েকটা বানিয়ে আজকে ওনাদের দিবে। রাহমিদ টাও খুব খুশি হবে আজকে। এসব ভেবে রায়হানের ক্লান্ত দেহে একটুকরো প্রশান্তি বয়ে গেলো। ভাইবোন গুলো খুশি হলেই সে খুশি।
_____

রায়হান ঘরে ঢুকে প্রথমে গোসল করলো। আজকে বেজায় গরম পড়েছে। গোসল করে বের হয়ে দেখলো রাহমিদ বিছানায় বসে পা ছড়িয়ে তার আনা বেসন আর বেগুন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। যেন খুব গভীরভাবে কোন কিছু পর্যবেক্ষণ করছে সে। রুদ রুমে নেই। ও বিছানায় রাহমিদের পাশে বসে বললো,

“পন্ডিত মশাই কি করছে?”

“দেখচি।”

“কি দেখছো?”

রাহমিদ উৎফুল্ল হয়ে বললো,

“আজ মুজা মুজা লান্না হোবে?”

রায়হান মজা করে বললো,

“না তো। আপনাকে কে বলেছে এই কথা প্রিন্স রাহমিদ ওরফে পন্ডিত সাহেব?”

রাহমিদ মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে ফিচ ফিচ করে হেঁসে বললো,

“আমি যানি।”

রায়হান হেঁসে উঠে রাহমিদের পেটে নাক দাবিয়ে আদর করতে লাগলো। রাহমিদ খিলখিল করে হেসে উঠলো। রুদ একটা বাসনে পানি আর বটি নিয়ে এসেছে। দুই ভাইকে হাসতে দেখে নিজেও হেঁসে ফেললো। ওগুলো রেখে বড় ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরলো। রায়হান পিছনে ফিরে রুদের কপালে গালে আদর করলো। রুদও হেঁসে ভাইয়ের গালে, কপালে, মাথায় চুমু দিলো। এটা দেখে রাহমিদ রুদের দিকে মাথা আর গাল এগিয়ে দিলো। রুদ হেঁসে ওকে বললো,

“না তুমি দুষ্টু। তোমাকে আদর দিবো না। আমার একটাই ভাই। তোমাকে কুড়িয়ে পেয়েছি আমরা। তাই না ভাইয়ু?”

রায়হানও সায় জানিয়ে গম্ভীর মুখে বললো,

“হ্যাঁ আসলেই। এরকম বিচ্ছু আমাদের ভাই হতেই পারে না। খামচি দেয়া যার জন্মগত স্বভাব। আমরা কেউই খামচি দিতে পারিনা। ইনি খামচির উপর পিএইচডি করা মানুষ। খামচির রাজা প্রিন্স রাহমিদ।”

রাহমিদ প্রথমে বোনের কথা পাত্তা না দিলেও ভাইয়ের গম্ভীর মুখে বলা কথা বিশ্বাস করে ফেললো। মুহূর্তেই তার চেহারার রঙ পাল্টে কান্না কান্না ভাব জুড়ে গেলো। সে ভাইয়ের কোল থেকে নামার জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলো। চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলো। রায়হান ও রুদ থতমত খেলো। ছোট ভাইকে কি বেশি কষ্ট দিয়ে ফেললো দুইজন। রুদ ফিক করে হেসে বললো,

“ভাইয়ু মজা করেছে রাহমিদ। আমিও মজা করেছি। তুমি তো আমার ছোট্ট আদুরে ভাইটুস।”

রায়হান রাহমিদকে আদর করে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,

“পৃথিবী এক দিকে আর আমার ভাইবোন একদিকে। ওই একদিকের দুই ভাগ আপনারা দুইজন। আল্লাহ ও রাসূলের পর সব চেয়ে বেশি ভালোবেসেছিলাম আমার মা, বাবাকে কিন্তু তারা আমার ভালোবাসাকে দূরে ঠেলে হারিয়ে গেছে দূর অজানায়। এখন তো এই পৃথিবীতে আমার ভালোবাসার আছেই মাত্র দুইজন মানুষ। আমার কলিজা। আমার জীবনে ভালোবাসার মানুষের সংখ্যা খুবই সীমিত। নেই বললেই চলে। আপনারা আমার কাছে সাত রাজার ধনের থেকেও অনেক বেশি মূল্যবান। বুঝেছেন কলিজা?”

রাহমিদ ভাইয়ের এত ভারী ভারী কথা বুঝতে পারেনি তবে ভালোবাসা ঠিকই বুঝেছে। সে আদুরে বিড়াল ছানার মতো ভাইয়ের কোলে লেপ্টে রইলো। রায়হান রুদ আর ওকে ঝাপটে জড়িয়ে রাখলো। তিন ভাইবোন ভালোবাসার প্রতীক হয়ে একে অপরের সাথে মিশে রইলো। দৃশ্যটা চমৎকার!
____
—-

আজকে ইফতারিতে রায়হান আয়োজন করেছে ট্যাংয়ের শরবত, ছোলা, মুড়ি, পিঁয়াজু, বেগুনি আর আলুর চপ। সবই অল্প অল্প করে বানিয়েছে। এতো আয়োজন রায়হান করেনা। আজকে করেছে পাশের ঘরে ইফতারি দিবে বলে। একটা প্লেটে সব সাজিয়ে রুদকে দিলো পাশের ঘরে দিয়ে আসতে। এর মধ্যে রাহমিদ বায়না করলো সে প্লেট নিবে। প্লেট নেয়ার জন্য রীতিমত পা ঝাপটাতে লাগলো। রুদ উপায় না পেয়ে ওকে দিলো। রাহমিদ ছোট দুইটা হাতে প্লেট ধরে হাঁটতে লাগলো। রুদ ভাইয়ের পিছে পিছে যেতে লাগলো। পরে টোরে যায় নাকি এই ভয়ে।

দুই ভাইবোন ইফতারি দিয়ে এসে নিজেরাও বসলো। আজকে রাহমিদের চোখ চকচক করছে। পিঁয়াজু, বেগুনি খাবে। ইতিমধ্যেই দুটো খেয়ে ফেলেছে সে। রাহমিদ প্রতিদিন হাফ হাফ করে রোযা রাখে। এরকম করে ওর চারটা রোযা হয়েছে। এভাবে রোযা রাখতে পেরে সে খুবই খুশি। রুদ মাথায় হিজাব পড়েছে। এই হিজাবটা রায়হান তাকে আরবি পড়তে কিনে দিয়েছিল। বাসায় বেশিরভাগ সময়ই ও এই হিজাবটা পড়ে থাকার চেষ্টা করে।

মাগরিবের আজান দিচ্ছে। রায়হান “বিসমিল্লাহ” বলে খেজুর মুখে দিলো। রুদ আর রাহমিদও ভাইয়ের দেখাদেখি বিসমিল্লাহ বলে খেজুর খেলো। ফলের মধ্যে শুধু খেজুরটাই তাদের ইফতারিতে থাকে। রুদ আর রাহমিদের জন্য আলাদা দুইটা পিঁয়াজু, বেগুনি আর আলুর চপ রেখে একটা করে পিঁয়াজু, বেগুনি ও আলুর চপ মেখে বুট মুড়ি বানালো। এগুলো খেয়ে একেবারে সেহেরিতে ভাত খাবে সে। মাঝখানে আর ক্ষুধা লাগবে না।

রায়হান ইফতারি শেষে “আলহামদুলিল্লাহ” বলে নামাজে চলে গেলো। রাহমিদও ভাইয়ের সাথে নামাজে যেতে চেয়েছিল কিন্তু আজকে বেশি খাওয়ায় পেট ফুলে ঢোল হয়ে আছে। রাহমিদ বিছানায় ফোলা পেট নিয়ে হাত, পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে।

রুদ নামাজ শেষে ছোট ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে হেঁসে ফেললো। উঠে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। বাচ্চাটা একটু ভালোমন্দ দেখলেই খাওয়ার জন্য কেমন পাগলামি করে। আজকে এক হাতে পিঁয়াজু আরেক হাতে বেগুনি নিয়ে কিভাবে খাচ্ছিলো। ভাবলেই হাসি পায় আবার দুঃখও লাগে। ছোট্ট ভাইটা ভালোমন্দ কত পছন্দ করে অথচ সামর্থ্য নেই তাদের। কষ্ট পেয়ে আর কি হবে। আল্লাহ্ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। ভাইয়া বলেছে ,

“বিপদে ধৈর্য ধরে যারা তারাই সফল।”

ভাইয়া প্রায়ই কুরআনের একটা আয়াত তিলওয়াত করে বাংলায় অনুবাদ করে বলে,

“নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে সস্তি রয়েছে।”
~(সূরা ইনশিরাহ, আয়াত ৫-৬)

মহান রবের প্রতি ভাইয়ের অগাধ বিশ্বাস। তাকে এবং রাহমিদকেও এভাবেই গড়ে তুলছে তাদের বড় ভাই। কোনোভাবেই রবের প্রতি বিশ্বাস, ভরসা হারানো যাবে না। রুদ এসব ভাবতে ভাবতেই বড় ভাইকে ঘরে ঢুকতে দেখলো। রায়হান রাহমিদকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে বলল,

“কি হয়েছে ওর?”

রুদ বললো,

“ভাইয়ু রাহমিদ আজকে বেশি খেয়ে ফেলেছে। এখন লড়তে চড়তে পারছে না।”

রায়হান উদ্বিগ্ন গলায় বললো,

“বলেছি এসব ভাজা পোড়া কম খেতে কিন্তু এই বিচ্ছু একটা কথাও শোনে না।”

রায়হান গ্যাস্ট্রিকের সিরাপ কিনে এনে বাচ্চাটাকে খাইয়ে দিলো। রাহমিদ খেতে না চাইলে জোর করে ধমকিয়ে খাইয়েছে। পরে পেটে গ্যাস হলে অনেক সমস্যা হবে। যা রায়হান মোটেও চায়না। ভাইবোনদের অসুখে সব চেয়ে ব্যথিত সেই হয়। রাহমিদটার এমনিতেই অসুখ বিসুক লেগেই থাকে। কোথা থেকে কি হয় বলা তো যায় না। সে কোনো রিস্ক নিতে রাজি নয়।

চলবে…..

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২৪.১
#তাজরীন_ফাতিহা

ঈদের দুই দিন বাকি। রায়হান ঠিক করেছে এবার ভাইবোনকে নিয়ে ওদের পছন্দমতো জামা কিনে দিবে। টিউশনির টাকা সবাই মোটামুটি বোনাস সহই দিয়েছে। হাতে ভালো একটা অ্যামাউন্ট আছে। রাহমিদটা খেলনার জন্য কেমন করে। এবার ওকে ওর পছন্দমতো কয়েকটা খেলনা কিনে দিবে। দেখা যাক কতটুকু সাধ্যে কুলায়। আজকে ইফতারি করে মার্কেটে নিয়ে যাবে দুইজনকে। ভাইবোনকে তাদের পছন্দ অনুযায়ী জামাকাপড় কিনে দিবে ভেবেই তার মনটা পুলকিত হয়ে যাচ্ছে।

রায়হান আজকে তাড়াতাড়ি বাসায় যাচ্ছে। যেহেতু ঈদের আর মাত্র দুইদিন বাকি তাই তার স্টুডেন্টদের সবাই এখন ছুটিতে আছে। ওরা অনেক আগে থেকেই ঈদের শপিং করা শুরু করে দিয়েছে। এখনো করছে। যার যেমন সামর্থ্য তেমনই তো খরচ করবে। তার সাধ্য অল্প। আর সে আলহামদুলিল্লাহ অল্পতেই তুষ্ট। রায়হানের যখন বাবা, মা ছিল তখন সেও তো কত শপিং করেছে। সেইসব স্মৃতি মনে করে লাভ নেই। ওগুলো অতীত। অতীত মনে করা মানে দগ্ধ হওয়া। স্মৃতি মনে রাখা ভালো তবে যে স্মৃতি পীড়া দেয় সেই স্মৃতি মনে না রাখাই কল্যাণকর।
_____

“ভাই, এরাম কইরা খুঁইজা আদো কোনো লাভ হইবো বইলা আপনের মনে ওয়?”

রুস্তমের চ্যালা আব্বাস কথাটা হতাশার সুরে বললো। রুস্তম উদাস দৃষ্টিতে অদূরে তাকিয়ে আছে। আজকে কতটা দিন হয়ে গেল রায়হানের খোঁজ করছে সে। যদিও রায়হানের সাথে তার সখ্যতা অতটা গাঢ় ছিল না কিন্তু তিনটা এতিম ছেলেমেয়ের প্রতি তার কেন যেন একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল। সেই মায়া থেকেই এক সময় ওদের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে। কেন যে এতো মায়া তৈরি হলো আল্লাহই জানে? এখন সে চাইলেও ওদেরকে ভুলতে পারেনা। রুস্তম খানিকক্ষণ পর বলে উঠলো,

“জানিস জীবনে নামাজ কালামের ধারে কাছেও যায়নি কিন্তু কয়েকদিন ধরে নামাজ পড়া শুরু করেছি। কারণ কি জানিস?”

রুস্তম তার চ্যালা দের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বললো। তার চ্যালাপ্যালারা একে অন্যের দিকে তাকালো। তারপর কিছু ভাবলো। কিন্তু ভেবেও কিছু প্রশ্নের উত্তর পেলো না। অতঃপর রুস্তমের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। অর্থাৎ এটার উত্তর তাদের জানা নেই। রুস্তম জানতো ওরা কেউই পারবে না তবুও জিজ্ঞাসা করেছে। সে দৃষ্টি রাস্তার পানে রেখে উত্তর দিলো,

“রায়হান একবার কইছিল, ভাই সব সময় চেষ্টা করবেন পাঁচ বার আল্লাহ্ তায়ালাকে হাজিরা দিতে কারণ এই পৃথিবীতে মানুষ আপনের কোনো চাওয়া পূরণ না করলেও মহান রব তার বান্দাদের কোনো চাওয়া অপূর্ণ রাখেন না। বান্দার জন্য সর্বোত্তম জিনিসটিই মহান রব বাছাই করেন। আপনে গো পৃথিবীর সব কাম কাইজ করারই সময় থাকে। শুধু নামাজ পড়ারই সময় থাকে না। মনে রাইখেন, পৃথিবীতে যে কাজগুলা করেন তা অবশ্যই নামাজের থেইকা গুরুত্বপূর্ণ না। নামাজ আমগো উপ্রে আল্লাহ্ তায়ালা ফরজ কইরা দিছে। অর্থাৎ এইডা পড়োনই লাগবো এইখানে কোনো অজুহাতই কামে আইবো না। জানিস এই কতা গুলো তহন এক কান দিয়া ঢুকাইয়া আরেক কান দিয়া বাইর কইরা দিছিলাম। কয়েকদিন আগ পইজন্ত এইসব কতা আমারে নাড়াইতে পারে নাই। এহন জিগা কি এমন হইছে যে আপনে এহন এইগুলান কইতাছেন?”

রুস্তমের সাঙ্গপাঙ্গরা এক মনে তাদের শ্রদ্ধেয় ভাইয়ের কথা শুনছে। রুস্তমের প্রশ্নে তারাও মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। অর্থাৎ তারা জানতে চায়। রুস্তম আবারও বলা শুরু করলো,

” জানিস রায়হানকে একদিন বেলা এগারোটার দিকে মসজিদে ঢুকতে দেহি। তহন আমি চায়ের দোকানে বসে চা খাইতেছিলাম। ওকে এই অসময়ে মসজিদে ঢুকতে দেখে আমি ভীষণ অবাক হইছিলাম। এহন তো কোনো নামাজের ওক্ত না। তাইলে রায়হান এইসময়ে এহানে কি করে? অনেকক্ষণ পর যহন ওয় বের হয় তহন ওরে ডাকি। ওরে জিগাই এই অসময়ে এহানে কি? জানোস ওর উত্তর কি আছিলো?”

রুস্তমের সাঙ্গপাঙ্গরা অতি উৎসাহী হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

“কি ভাই?”

“ওর উত্তর আছিলো, ভাই একটা বিপদে পড়ছিলাম তাই আল্লাহর কাছে বিপদটার কথা বললাম। মসজিদের ইমাম সাহেব বলছে, আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে কিছু চাইলে নাকি আল্লাহ্ তা দেন। চাওয়ার মতো চাইলে আল্লাহ্ কহোনোই ফিরায় না। ওর ওই কথাটা আমাকে ভিতর থেকে এট্টু হইলেও নাড়াইয়া দিছিলো। তারপরও ক্যান জানি নামাজ কালাম পড়তাম না। কিন্তু কিছু চাওয়ার থাকলে কহনো কিছু না চাওয়া আমি আল্লাহর কাছে মনে মনে হইলেও চাইতাম। আল্লাহয় এই গুনাহগারের দোয়া কবুল করছিল কিছু। সব করে নাই হয়তো ঐগুলান আমার লাইগ্যা অকল্যাণকর আছিলো নাইলে আমিই আল্লাহর কাছে চাওয়ার মতো চাইতে পারি নাই। তবুও মহান আল্লাহ আমার মতো পাপী, বেনামাজীর চাওয়া পূরণ করছিল ওইডাই তো অনেক।”

এটুকু বলে রুস্তম একটু শ্বাস নিলো। তারপর আবার বলতে শুরু করলো,

“কয়দিন আগে আৎকা মনে হইলো, আইচ্ছা আল্লাহ তায়ালার কাছে যদি নামাজ পইড়া কায়মনোবাইক্যে কিছু চাই তাইলে নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা ফিরাইবো না। এরম কইরা জীবনের পোর্থম নামাজ পড়লাম আর চাইলাম। জানিস ওইদিন নামাজ পইড়া কি যে প্রশান্তি পাইছি। তারপর থেইক্কা আমি নামাজ ছাড়ি না। যদিও সব ওয়াক্ত পড়তে পারি না। তবুও জট্টুক পড়ছি। আলহামদুলিল্লাহ এহন চেষ্টা করি নামাজ পড়ার। আমার বিশ্বাস আছে আল্লাহ্ আমারে ফিরাইবো না। একদিন না একদিন রায়হানের দেখা আমি পামুই পামু ইংশাআল্লাহ।”

এতক্ষণ ধরে রুস্তম ভাইয়ের কথা মুগ্ধ হয়ে শুনছিল তার সাঙ্গপাঙ্গরা। ভাইয়ের শেষ কথার সাথে তারাও সমস্বরে “ইংশা আল্লাহ্” বলে উঠলো।
______
—-

রায়হানদের আজকের ইফতারি তে ছিল ভাত আর শুঁটকি ভর্তা। আর রাহমিদের জন্য দুটো ডালের বড়া। রাহমিদটা ভাজা পোড়া না থাকলে ঝামেলা করে। এখন আর কাঁদবে না। ঝামেলাও করবে না। মাগরিব পড়ে এসে দুই ভাইবোনকে নিয়ে ঈদের শপিং করতে বের হলো। রাহমিদ, রুদ দুইজনই আজকে খুশি। ভাইয়ের সাথে এই প্রথম কোথাও দুই ভাইবোন যাচ্ছে। খুশি তো লাগবেই।

রায়হান নিজের সাধ্যের মধ্যে ভাই বোনদের শপিং করে দিলো। রাহমিদকে দুইটা পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছে। পাঞ্জাবি দুইটার দাম সাড়ে আটশো করে রেখেছে। রুদকে দুইটা ফ্রক কিনে দিয়েছে। দুটোর দাম নিয়েছে সাতশো। অনেক দামাদামি করে কম টাকায় চারটা জামা কিনেছে। হাতে টাকা বেশি না থাকায় তার জন্য আর কিছু কিনলো না। ঈদের বাজার। দোকান এখন আগুন হয়ে আছে। অনেক দোকান ঘুরেছে। সাধ্যের মধ্যে একটা পাঞ্জাবিও নেই। কালকে নাহয় আরেকবার এসে ঘুরে যাবে।

রাস্তায় তিন ভাইবোন হাঁটছে। রাহমিদ একবার ভাইয়ের আঙ্গুল ধরে হাঁটছে। খানিকক্ষণ পর আবার বোনের আঙ্গুল ধরে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে রায়হান রাহমিদকে জিজ্ঞাসা করলো,

“আজকে তুমি খুশি কলিজা?”

“অনেক খুচি।”

রাহমিদ খুশি খুশি গলায় বললো। রায়হান বললো,

“তোমাকে এবার খেলনাও কিনে দিবো। বলো তো কি খেলনা চাও?”

“গারি। বুম বুম করে যিটা চলে।”

“আচ্ছা বুম বুম করা গাড়ি কিনে দিবো তোমায়।”

রায়হান এবার রুদকে জিজ্ঞাসা করলো,

“তোমার কি লাগবে রুদ পাখি?

“কিছু না ভাইয়ু। আমি তো জামা কিনেছিই। তুমি একটা জামা কিনো। আমাদের জন্য তো কিনেছোই আর কিছু কিনা লাগবে না।”

“আমি তো আমার জন্য কিনবোই কাল। তোমাকে চুলের ব্যান্ড আর একটা মাথার হিজাব কিনে দিবো।”

“লাগবে না ভাইয়ু। আমার তো আছেই।”

“চুপ। আমি যখন বলেছি তখন কিনে দিবোই।”

ভাইয়ের ধমকে রুদ আর কিছু বলার পেলো না। চুপচাপ ভাইয়ের কেনাকাটা দেখলো। রায়হান রাহমিদকে খেলনা আর রুদকে তার প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।

রাহমিদ টেম্পুতে চড়ে ভীষণ খুশি। এই প্রথম একটা গাড়িতে করে কোথাও গিয়েছে আবার বাসায় যাচ্ছে। টেম্পু যখন সাই সাই করে চলে তখন তার খুব আরাম লাগে। রুদেরও টেম্পুতে চড়ে ভালো লাগছে। রায়হান ভাইবোনদের খুশি খুশি মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশান্তি খুঁজে পেলো।

কিন্তু নিয়তি বোধহয় আজকের এই খুশি চাইলো না। কোথা থেকে একটা বাস এসে হুট করে টেম্পুটায় ধাক্কা মারলো রায়হান কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। মুহূর্তেই রায়হান ছিটকে মাটিতে পড়ে গেলো। শক্ত গাছের গোঁড়ায় ধাক্কা খেয়ে মাথা থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হলো। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। জ্ঞান হারানোর আগে কানে এলো,

“মেয়ে বাচ্চাটা আঘাত কম পেয়েছে। ছেলে বাচ্চাটাকে কেউ হাসপাতালে নিয়ে যাও। বাচ্চাটার অবস্থা শোচনীয়। বাঁচবে কিনা সন্দেহ।”

এরপর চিল্লিয়ে কাউকে বললো,

“বাচ্চা দুটোকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে চলো। কুইক।”

কয়েকজন রায়হানকে ধরাধরি করে উঠালো। রায়হান চক্ষু মুদার আগে অস্পষ্ট সুরে বললো,

“আমার রাহমিদ, রু…..।”

বীভৎস এক ঘটনার সাক্ষী হলো রাতটা।

চলবে…..

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২৪.২(বর্ধিতাংশ)
#তাজরীন_ফাতিহা

সামনে এতো ভিড় দেখে রুস্তম ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা এগিয়ে গেলো। মূলত তারা এখানে সমিতি থেকে টাকা উঠাতে এসেছিল। প্রত্যেক বছরই আসে। রুস্তম এগিয়ে গিয়ে দেখলো দুটো রক্তাক্ত বাচ্চাকে গাড়িতে তোলা হচ্ছে। রুস্তমের মন হঠাৎই কামড় দিয়ে উঠলো। আহারে এতো ছোট বাচ্চা দুটো কত রক্তাক্ত হয়েছে। মেয়ে বাচ্চাটার থেকে ছেলে বাচ্চাটা বেশি আহত। আচ্ছা বাচ্চা দুটোর বাবা, মা কই? নিশ্চয়ই ওনারাও এক্সিডেন্ট করেছে।

রুস্তম ভিড় ঠেলে আরও সামনে আগালো। বিরাট গাছের পাশে জটলা দেখে এগিয়ে গেলো। একটা ছেলেকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। রুস্তমের খুব খারাপ লাগছে হঠাৎ করেই। জীবনে অনেক এক্সিডেন্ট দেখেছে কিন্তু আজকে কেন যেন মনটা বেশি কামড়াচ্ছে। অজানা ভয়ে বুকটা ধুরু ধুরু করছে। আরেকটু সামনে এগিয়ে রুস্তম দেখলো রক্তাক্ত হয়ে একটা ছেলে পড়ে আছে। বুকটা কামড়ে ধরলো কেন যেন। রুস্তম কি যেন একটা ভাবলো। হঠাৎ করেই দৌঁড়ে গিয়ে ছেলেটার মুখ থেকে রক্ত খানিকটা সরালো। এটা দেখে সবাই চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। রুস্তম দেখলো, তার বহু প্রতীক্ষিত রায়হানকে। রুস্তমের সাঙ্গপাঙ্গরা যারা চেঁচামেচি করছিল ওদেরকে ধমকে ধামকে চুপ করালো। রুস্তম ভাবছে যাকে এতদিন ধরে খুঁজে ফিরেছে, আল্লাহর কাছে যাদেরকে একবার হলেও দেখা করিয়ে দিতে বলেছে তাকে এই বেশে এমন অবস্থায় দেখবে কল্পনাও করেনি। রুস্তম চিল্লিয়ে তার সাঙ্গপাঙ্গদের বললো,

“হাসপাতালে নিতে হইবো। তাড়াতাড়ি গাড়ি লইয়ায়। মাইনষের কাম খালি তামশা দ্যাহা। কতক্ষণ হইছে এক্সিডেন্ট হইছে অথচ খাড়াইয়া খাড়াইয়া তামাশা দ্যাহে।”

রুস্তমের হুকুমে তার চ্যালারা গাড়ি নিয়ে আসলো। তারপর রুস্তম বাচ্চা দুটোকে খুঁজলো। ততক্ষণে বাচ্চা দুটোকে একজন হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে। কয়েকজনকে হাসপাতালের নাম জিজ্ঞাসা করে রুস্তম রায়হান কে নিয়ে ওই হাসপাতালেই রওনা হলো। গাড়িতে বসে মনে মনে খারাপ কিছু যেন না হয় তার প্রার্থনা করতে লাগলো। মহান রবের কাছে কতো মোনাজাতে রায়হান কে একবার হলেও দেখতে চেয়েছে। আল্লাহ্ তাকে এ কি দেখালো! এর থেকে তো না দেখানোই ভালো ছিল। রুস্তম রায়হানের হাত শক্ত করে ধরে চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি ছেড়ে দিলো। অস্ফুট স্বরে বললো,

“আল্লাহ্ খারাপ কিছু কইরো না।”
_____
—-

গত রাতে বাসের ব্রেক হঠাৎ করেই নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বড় সরো একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায় রায়হানদের সাথে। ঈদের বাকি আর মাত্র একদিন। এতো আনন্দ, খুশির মধ্যে এই এতিম বাচ্চাগুলোর খুশি নিমেষেই মুছে গেলো। ওদের আনন্দ ভাগ্য তো মুছে গেছে যেইদিন ওরা অনাথ হয়েছে সেইদিনই। কি এক বিভীষিকাময় রাত ছিল কাল! ভাবলেও গা শিউরে ওঠে।

কালকে এক্সিডেন্টের পর যখন সবাই জড়ো হয়েছিল তখন এতো ছোট্ট বাচ্চাগুলোর এই মর্মান্তিক অবস্থা দেখে আঁতকে উঠেছে সেখানে উপস্থিত সকল মানুষ। রাহমিদের মায়াবী বদন রক্তে মাখামাখি ছিল। রুদ আঘাত খানিক কম পেলেও ভালো রকমের একটা অ্যাকসিডেন্ট ওদের উপর দিয়ে গিয়েছে।

সব চেয়ে মর্মান্তিক ছিল, অ্যাকসিডেন্টের পর রাহমিদের থেকে কয়েক হাত দূরে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়া ছিল তার বুম বুম করা ভাঙাচোরা গাড়ি টা। ছোট্ট হাত দিয়ে ধরা সেই গাড়িটি নিয়ে তার কতো ইচ্ছে দুই সেকেন্ডের মধ্যে ধুলিস্যাৎ হয়ে গেলো

মাঝে মাঝে কিছু পরিস্থিতি শুনলে বা দেখলে মনে হয়, এরকমটা হওয়া কি খুবই জরুরি ছিল?
_____

রায়হানের মাথার ট্রিটমেন্ট করা হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন,

“রোগীর কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরবে। তবে রোগীকে উত্তেজনা মূলক কিছু বলবেন না। এই যাত্রায় আল্লাহর রহমতে মাথায় গুরুতর কিছু হয়নি। তবে শরীরে, মাথায় ভালোই আঘাত পেয়েছে। এর জন্য পরে সমস্যা হতে পারে। উনি মাথায় বেশি চাপ নিতে পারবেন না। ভুলে যেতে পারেন আবার অল্পক্ষণের মধ্যেই মনে পড়বে অবশ্য। অর্থাৎ অতি দ্রুত কিছু ক্যাপচার করতে তার সমস্যা হতে পারে। উন্নত চিকিৎসা করালে পরিপূর্ণভাবে সুস্থ হওয়ার সম্ভবনা আছে।”

রুস্তম শক্ত হয়ে ডাক্তারের সব কথাই শুনেছে। ডাক্তার রায়হানকে উত্তেজিত হতে নিষেধ করেছে কিন্তু ভাইবোনের কথা স্মরণ করে যদি নিজেই উত্তেজিত হয় রুস্তম কিভাবে সামাল দিবে। কি থেকে কি হয়ে গেলো। রুস্তম আর কিছু ভাবতে পারলনা।
_____

“আমার রাহমিদ কি বেঁচে নেই? ওরে একটু দেখবো। আমার কলিজার টুকরাটা কই? কেউ একটু বলেবেন ভাই।”

প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বললো রায়হান। কিছুক্ষণ আগেই জ্ঞান ফিরেছে রায়হানের। তীব্র মাথা ব্যাথা নিয়ে চোখ খুলে তাকিয়েই রাহমিদ আর রুদের কথা জিজ্ঞেস করেছে। ডাক্তার কাউকেই দেখা করতে দিতে চাইছিল না কিন্তু রোগীর পাশে একজনের থাকা দরকার ভেবে রুস্তমকে থাকতে বলেছেন।

রায়হান জ্ঞান ফিরেই রুস্তমকে দেখে অবাক হয়েছিল। প্রথমে সে কোথায় বুঝে উঠতে পারছিল না। পরে আস্তে আস্তে সব মনে পড়ার পর রুস্তমকে চিনেতে পারে। রুস্তমকে দেখেই ভাইবোনদের কথা জিজ্ঞাসা করতে থাকে। রুস্তম কিছু বলতে পারছিল না। তার বুক কাঁপছে। কিভাবে কি বলবে কথাই সাজাতে পারছিল না। অন্যদিকে রায়হান রুস্তমকে এমন দোনামনা করতে দেখে উত্তেজিত হয়ে উপরোক্ত কথাটি বলে। কথাটুকু বলতে গিয়ে রায়হানের শরীর, মুখ সব কাঁপছিল। রুস্তম স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। মৌনতা ভেঙে বললো,

“ওরা আল্লাহর রহমতে ভালাই আছে। তুমি উত্তেজিত হইতাছো কেন? চুপচাপ শুইয়া থাহো।”

“ভাই আমি অজ্ঞান হওয়ার আগে নিজ কানে শুনেছি রুদ আঘাত কম পাইলেও আমার রাহমিদের অবস্থা ভালো না। বাঁচার সম্ভবনা নাকি….”

এতটুকু বলেই রায়হান হুহু করে কেঁদে দিলো। তারপর চিল্লিয়ে বললো,

“আল্লাহ্ আমাকে দুনিয়ায় রাখছে কেন? আর কত হারাবো আমি? প্রথমে বাবা, মা এখন আবার আমার ভাইবোন। আমি আর সহ্য করতে পারছি না ভাই। আল্লাহ রে বলেন আমাকেও নিয়ে যেতে। এই পৃথিবীতে আমাকে জ্যান্ত লাশ বানিয়ে রেখে আল্লাহ আমাকে আর কত বাঁচাবে? আল্লাহর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ ভাই। অনেক কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞতা থেকেই চাই আমার ভাইবোনের কিছু হইলে যেন আমাকেও বাঁচিয়ে না রাখে।”

রায়হানের চোখ থেকে অজস্র পানি পড়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। হঠাৎই মাথায় হাত দিয়ে গুঙিয়ে উঠলো। রুস্তম তড়িঘড়ি করে রায়হানকে ধরলো। বললো,

“কিছুই হয় নাই। তুমি শান্ত হও। ডাক্তার উত্তেজিত হইতে নিষেধ কইরা দিছে। ওই বাচ্চু খাড়াইয়া আছোস কেন? যা ডাক্তার ডাক।”

বাচ্চু দ্রুত গিয়ে ডাক্তার ডেকে আনলো। ডাক্তার রুস্তমকে কিছুক্ষণ ধমকালো। রোগীকে উত্তেজিত করতে নিষেধ করেছেন সেখানে রোগী উত্তেজিত হলো কিভাবে? রায়হানকে একটা ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে দিলো। রায়হান কিছুক্ষণ ঘুমাবে।

রায়হান ঘুমিয়ে পড়লে রুস্তম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। রায়হান ঘুমিয়ে থাকলে আর উত্তেজিত হবে না। এখন ওর রেস্টের দরকার।
______
—–

রাহমিদকে আইসিইউতে নেয়া হয়েছে। বাচ্চাটার অবস্থা গুরুতর। আজকে দুইদিন ধরে বাচ্চাটা আইসিইউতে ভর্তি। রায়হান আইসিইউর সামনে দাড়িয়ে আছে। গত দুই দিন ওকে দমিয়ে রাখতে পারলেও আজকে আর পারেনি কেউ। ঘুমের ইনজেকশন দেয়ার আগেই ব্যান্ডেজ বাঁধা শরীর নিয়ে এসেছে ভাইকে দেখতে। আজকে ঘুম ভেঙে গেলে রুস্তমকে বলতে শুনেছে রাহমিদ আইসিইউতে আছে। তাই আর দেরি না করে দ্রুত আইসিইউর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ডাক্তারকে আইসিইউ থেকে বের হতে দেখে তাড়াতাড়ি ডাক্তারের সামনে গেলো। জিজ্ঞাসা করলো,

“আমার রাহমিদ কেমন আছে?”

ডাক্তার রায়হানকে দেখে চমকালো। এক রোগী আরেক রোগীর খোঁজ করছে। ডাক্তার মাস্ক নামিয়ে বললো,

“আপনি কে? রোগীর খোঁজ করছেন কেন? আপনার অবস্থাও তো ভালো না।”

“আমি রোগীর ভাই। ওর অভিবাবক আমি। বলুন না ও কেমন আছে?”

“এখনো রেসপন্স করছে না তবে শ্বাস নিচ্ছে। যেহেতু বাচ্চা শরীর। আঘাত তার জন্য মারাত্মক ছিল। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন। উনি ছাড়া এই এই অবস্থা থেকে কেউই বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারবে না। আল্লাহর কাছে সাহায্য চান। আমারা সাধ্য মতো চেষ্টা করছি।”

এতটুকু বলেই ডাক্তার চলে গেলো। রায়হান ওখানেই বসে পড়ে চিৎকার করে উঠলো। জোরে জোরে বলতে লাগলো,

“ও আল্লাহ আমি আর কত হারাবো? আমি যে ক্লান্ত আল্লাহ্। আমার থেকে আর কত কিছু কেড়ে নিবেন মালিক? আপনার কি আমার প্রতি একটুও মায়া হয় না? আমি কি এতটাই নগণ্য আর এতটাই বোঝা আপনার কাছে? আমার থেকে কেন সব কিছু কেড়ে নেয়া হচ্ছে মালিক? আমার অপরাধ কি? আমি কি একটু ভালো থাকা ডিজার্ভ করিনা আল্লাহ্? ওইটুকু বাচ্চা কি অপরাধ করেছে মালিক? দরকার হলে আমাকে নিয়ে যান তবুও আমার এই কলিজার টুকরা গুলোকে ভালো রাখেন।”

দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ে উপরের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ছেড়ে জোরে জোরে কথাগুলো বলে থামলো। হঠাৎ ঘাড়ে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে তাকালো। দেখলো রুদ ব্যান্ডেজ বাঁধা শরীরে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর কেঁদে উঠে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো। রায়হানও কেঁদে উঠে ঝাপটে জড়িয়ে রাখলো রুদকে।

এ কান্না থামার নয়। পুরো হাসপাতাল জুড়ে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে শুধু রায়হানদের এই কান্নার সাক্ষী হচ্ছে হাসপাতালের মানুষজন আর অদূরে দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলা রুস্তম ও তার গ্যাং।

রায়হানের আহাজারীতে সবাই মনে মনে চাইলো,

“আল্লাহ্ ছেলেটার মুখে হাসি ফুটিয়ে দাও। ওর সকল দুঃখ মুছে সুখের হাসি ফোঁটাও মালিক।”

মালিক শুনবে কি এতগুলো মানুষের আর্জি?

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে