#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২১
#তাজরীন_ফাতিহা
চারপাশ গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত। নিশ্চুপ চারিপাশ। পুরো শহরটা ঘুমে আচ্ছন্ন। কোনো আওয়াজ নেই আশেপাশে। মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। কানের কাছে রি রি শব্দ হচ্ছে। রায়হান জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। রাত সাড়ে তিনটা। ভার্সিটির পড়া পড়েছে এত রাত ধরে। আজকে চোখে ঘুম নেই তার। ইদানীং কেমন বিষণ্ন লাগে। কিছুই ভালো লাগে না। দিনশেষে সবারই মন খুলে কথা বলার, আগলে রাখার মানুষ থাকে কিন্তু তার কেউ নেই। কিচ্ছু নেই। সব কেমন নিরিবিলি। নিঃসঙ্গ, গুমোট আদলে গড়া তার জীবন। বাইরে অন্ধকারে একদৃষ্টে তাকিয়ে এসবই ভেবে চলছে সে। রায়হান ভাবে। শুধুই ভেবে যায়। কি যে ভাবে মাঝে মাঝে সেটাই বলতে পারবে না সে। জীবনটা কোনো এক অজানায় গিয়ে তো একসময় না একসময় ঠেকবে। সেটা ভালো কিংবা মন্দ।
আচ্ছা, সুখী কিভাবে হওয়া যায়? কি করলে মনে একটু শান্তি পাবে? জীবন হলো এক ঘুটঘুটে অমানিশা। কেউ আনন্দে কাটায়, কেউ সীমাহীন কষ্টে জীবন পাড় করে। দুটোই তো জীবন। পার্থক্য কি শুধু আনন্দ আর কষ্টে? হবে হয়তো। তার কাছে জীবন মানে ভিন্ন। জীবন মানে তার কাছে এক বুক হতাশা, কষ্ট, ভাইবোনদের দেখাশোনা করা, তাদের আবদার পূরণ করতে না পারার ব্যর্থতা, নিঃসঙ্গ জীবনযাপন, মানুষের কথা শোনা, কারো সাথে মিশতে না পারা সব কিছুর সংমিশ্রণ। অনেকে কল্পনায় বাঁচে, ফ্যান্টাসিতে ভোগে এইসবও কি জীবন? এইসবে আনন্দ পাওয়া যায়? আচ্ছা, কল্পনা, ফ্যান্টাসিতে যারা ভোগে তারা কি সুখী? এরকম কোনো মানুষ থাকলে জিজ্ঞাসা করা যেতো আদোতেই তারা সুখী কিনা। রাহমিদের কান্নার আওয়াজে রায়হানের ভাবনা চিন্তার বিচ্যুতি ঘটলো। তাকিয়ে দেখলো রাহমিদ বসে দুই হাত দিয়ে চোখ ডলছে আর কান্না করছে। রায়হান উঠে ওর কাছে গেলো। জিজ্ঞাসা করলো,
“ঘুম ভাঙ্গলো কিভাবে আপনার? কে আমার টোটন সোনার ঘুম ভাঙিয়েছে? কি লাগবে কলিজা বলেন।”
“সুসু দিবো।”
“আচ্ছা তাই? মহৎ কার্য সমাধানে উঠেছেন তাহলে।”
কথাটা বলেই রায়হান রাহমিদকে কোলে নিয়ে টয়লেটে গেলো। টয়লেট করিয়ে রুমে এনে ঘুম পাড়িয়ে দিতে লাগলো কিন্তু রাহমিদ আজকে বোধহয় আর ঘুমাবে না। দুষ্টুমি করছে বাচ্চাটা। শুইয়ে দিলে আবারও বসে পড়ে। জোর করে দুই বার ঘুম পাড়াতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু বিচ্ছুটা ঘুমাচ্ছে না। কি জ্বালা! সারাদিন নির্ঘুম থাকায় ক্লান্তিতে রায়হানের চোখ বুঝে আসছে যেন। রাহমিদকে ঘুম না পাড়িয়ে সে ঘুমাবে কিভাবে? রায়হান শুয়ে থেকেই বললো,
“রাহমিদ ঘুমাও। এতো রাতে দুষ্টুমি করছো কেন?”
“গুম নাই। চুকে গুম নাই।”
হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বাচ্চাটা ভাইকে দেখাচ্ছে তার ঘুম নেই। রায়হানের এখন সত্যি ক্লান্ত লাগছে। একটু পর আযান দিয়ে দিবে। একটুও যদি না ঘুমায় তাহলে সারাদিন কোনো কাজই করতে পারবে না। এদিকে বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছেও না। মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে যেন। উফফ বিরক্তিকর! রায়হান চোখ বন্ধ করলো। চোখটা লেগে আসছে সেই সময় রাহমিদ ভাইয়ের বুকের উপরে উঠে বলতে লাগলো,
“ভাইয়ু গুমাও কিনো? আমাকি রিকে গুমাও কিনো?”
রায়হান ঘুম ঘুম কণ্ঠে জবাব দিলো,
“তো কি করবো? তোমাকে নিয়ে নাচবো? তুমি তো ঘুমাচ্ছ না, ভাইয়ু কে ঘুমাতে দাও। তুমিও ঘুমাও।”
“নো নো। গুম পায় না। চুকে গুম নাই। গুম কই পাবু?”
ভাইয়ের বুকের উপরে উঠে ভাইয়ের চোখে, মুখে হাত বুলিয়ে বলে উঠলো বাচ্চাটা। রায়হানের এখন খারাপ লাগছে। এভাবে কতক্ষণ। সে রাহমিদকে বললো,
“ঘুমাতে বলেছি রাহমিদ। বেশি জ্বালাচ্ছো কিন্তু তুমি। না ঘুমালে ভূত এসে কামড় দিবে নে তোমাকে।”
ভূতের কথা শুনে বাচ্চাটা ভয় পেলো। ভাইয়ের বুকের উপর বসা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। রায়হানের মুদে আসা চক্ষু ফট করে খুলে গেলো। এমন ঝাঁপিয়ে পড়ায় কিছুটা ভয়ও পেয়েছে রায়হান। বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরলো সে। মাথায়, শরীরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
” কিছু নেই। ঘুমান। বেশি দুষ্টুমি করলে আসবে কিন্তু। ঘুমান প্রিন্স।”
“ভুতু নাই? ভুতু কই? বয় পাই তো। ভুতুকে তুমি চলি যেতি বলো।”
“আরে বাবা বললাম তো কিছু নেই। ঘুমাও। না ঘুমালে আসবে। ঘুমালে কিচ্ছু করবে না।”
বলেই মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতে লাগলো। রায়হানের হাত আস্তে আস্তে অচল হয়ে পড়ছে। গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবে ওই সময় রাহমিদ আবারও নড়াচড়া করতে লাগলো। বাচ্চাটা উসখুস করছে। বুঝে আসা কণ্ঠে রায়হান জিজ্ঞাসা করলো,
“আজকে কি হলো তোমার? এতো জ্বালাচ্ছো কেন রাহমিদ?”
“কিদা লাগচে।”
রায়হানের চোখ ধপ করে খুলে গেলো। এতো রাতে রাহমিদের খুদা লেগেছে। কখনো তো রাতে খুদা লাগে না বাচ্চাটার। আজকে কি হয়েছে কে জানে। ঘুম ঘুম চোখেই রাহমিদকে নিয়ে উঠে বসলো সে। জিজ্ঞাসা করলো,
“কি খাবে?”
“চিপস কাবো।”
“কি মুসিবত! তোমার জন্য এখন চিপস পাবো কোথায়? অতিরিক্ত করছো তুমি আজকে। সব কিছু দিতে দিতে চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছি নাকি। সারাক্ষণ এটা খাবো, ওটা খাবো। এগুলো খুবই খারাপ রাহমিদ।”
ভাইয়ের বকা শুনে বাচ্চাটা মন খারাপ করলো। রায়হান ওর মন খারাপ করা দেখে উঠে একটা আলু নিয়ে রান্না ঘরে গেলো। রাহমিদকে একটা মোড়ায় বসিয়ে দিলো। আলু গোল গোল করে কেটে লবণ দিয়ে মাখিয়ে নিলো। কড়াইতে অল্প তেল দিয়ে তাতে পিছ করা আলু গুলো ছেড়ে দিলো। আস্তে আস্তে আলু গুলো তেলে ভাঁজা করলো। আলু কুড়কুড়ে হয়ে গেলে প্লেটে নামিয়ে ঠাণ্ডা করে রাহমিদকে খাইয়ে দিতে লাগলো। রাহমিদকে খাইয়ে দিতে দিতেই ফজরের আযান দিয়ে দিলো। হতাশার একটা নিঃশ্বাস বের হয়ে হলো রায়হানের মুখ থেকে। আজকে সারাদিন দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি সে। আবার আগামীকাল রাতে ঘুমাতে পারবে। এখন ফজর পড়ে সকাল, দুপুরের রান্নাবান্না করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে তারপর স্টুডেন্ট পড়িয়ে সেই রাত আটটা, নয়টায় ঘরে আসবে। নিয়তি বড়ই অদ্ভুত!
______
—–
“রায়হান দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল এক্সাম কিন্তু একমাস পর থেকেই। এক্সাম ফি তাড়াতাড়ি জমা দিয়ে দিতে বলেছে ইমরান স্যার। তুই তো এক সপ্তাহ ধরে আসিস না। এতো গ্যাপ যে কেন দিস আল্লাহ্ জানে। আমরা সবাই আগামীকাল জমা দিবো। তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম এতদিন। তুই টাকা নিয়ে আসিস।”
সাইমুন একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো। পাশে জুবায়ের, হাবিব, ইমন বসে বসে কোলড্রিংকস খাচ্ছে। রায়হান পানি খাচ্ছিলো। সাইমুনের কথাগুলো শুনে পানি খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। আগামীকাল টাকা জমা দিতে হবে কিন্তু তার হাতে তো এক টাকাও নেই আপাতত। এই মাসটায় একটু বেশিই খরচ হয়ে গেছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। পরীক্ষার বেশিদিন নেই। অথচ তার ভালো কোনো প্রিপারেশন নেই। সারাদিন এতো কাজের পর ক্লান্তিতে আর পড়তে বসতে ইচ্ছা করেনা। যতই কষ্ট হোক কয়েকদিন ভালো করে পড়তে হবে দরকার হলে টিউশনি কয়েকদিন বন্ধ রাখতে হবে। নাহলে ফেল করলে এই সেমিস্টারেই থাকা লাগবে। আল্লাহ্ সাহায্য করো। জুবায়েরের কথায় ঘোর কাটলো রায়হানের।
“তুই শালায় কই মরোস ক তো? ডাকতাছি কতক্ষণ ধইরা আর শালায় দুনিয়ার বাইরে চইলা গেছে মনে হয়। কিছু একটা কইলেই হইলো। কি যে ভাবতে লাগে আল্লাহ্ জানে।”
তার সব বন্ধুদের মধ্যে জুবায়েরের মুখটা খারাপ। যাকে তাকে গালি দিয়ে বসে। রায়হান অনেকদিন মানা করেছে কথায় কথায় মুখ খারাপ না করতে তাও শোনে না। যদিও এখন আগের থেকে সংযত হয়ে কথা বলে তবুও শোধরায়নি পুরোপুরি। রায়হান বোতলের সিপ বন্ধ করে বললো,
“আমি কয়দিন পর টাকা দিবো। তোরা দিয়ে দে। হাতে আপাতত টাকা নেই। টিউশনির টাকা পরের মাসে পাবো। পরের মাসেই টাকা দিবো।”
হাবিব বললো,
“কিন্তু ইমরান স্যার মানবো না তো। হেইদিন ক্লাসে আইসা নানা কতা শুনায় দিছে। জলদি দিতে বলছে না দিলে নাকি পরীক্ষায় বসাইবো না।”
“আমার কাছে তো এখন টাকা নেই কোথা থেকে দিবো। স্যারের সাথে কথা বলতে হবে। যদিও ওনাকে মানানো সহজ হবে না জানি। তবুও বলতে তো হবেই।”
জুবায়ের বললো,
“শালার পিছনে বাশ ভরে দিতে পারলে ভালো লাগতো। রাশেইদ্দা একটা আর এই ইমরাইন্না একটা। পুরা ডিপার্টমেন্টটারে পায়ের নিচে রাহে। ভাব দেহায় যেন রাজা ভিক্টোরিয়া। ওগো ভাবের খেতা পুড়ি। কিছু কওন যায়না তাগোরে। যত্তসব টুট… টুট… টুট।”
“মুখের ভাষা খারাপ করছিস কেন? আর রাজা ভিক্টোরিয়া কে?” রায়হান বলে উঠলো।
“রানীর জায়গায় রাজা কইছি। না বুঝার কি আছে। মাথায় বিখ্যাত বড়লোক্স বেডা লোকের নাম আইতাছিল না। শালারে হেইদিন একটা ম্যাথ বুঝাই দিতে কইলাম। কয় সারাবছর না পইড়া পরীক্ষার আগে আগে নাটক মারাও। তার লাগ্যাইতো পরীক্ষায় বড় বড় ডিম পাও। কত বড় কথা ভাব তুই। কিছু কওয়া যাইবো না তারে। কইলেই ছ্যাত কইরা উঠে। পুরাই…..”
“থাম থাম। আর কিছু বলা লাগবে না। মুখটা কন্ট্রোল কর।”
রায়হান ওকে থামিয়ে দিলো। নাহলে এই টেপ রেকর্ডার চলতেই থাকতো। রাজা ভিক্টোরিয়া এই কথাটা শুনে হাসি পাচ্ছিলো তাদের। তবে হাসে নি কেউই। রেগে আছে এমনিতেই তারা হাসলে কেলেঙ্কারি ঘটিয়ে ফেলতো।
_____
—-
“আন্টি এই মাসের টাকাটা যদি একটু তাড়াতাড়ি দিতেন। খুবই দরকার ছিল টাকাটা।”
কথাটা রায়হান আবীরের আম্মুর কাছে খুবই দোনামোনা করে বললো। মাসের আজকে আট তারিখ। পরীক্ষার ফি স্যারকে বলে নয় তারিখ পর্যন্ত নিয়েছে অর্থাৎ কালকেই টাকা দেয়ার লাস্ট ডেট। অথচ হাতে এখনো টাকা আসে নি। তাই আজকে না বলে পারেনি। খুব দরকার না হলে রায়হান টাকা চাইতো না। আবীরের আম্মু বললেন,
“টাকা তো এখনো হাতে পাইনি। তুমি একটু অন্য জায়গা থেকে ম্যানেজ করো। ওর আব্বু এই মাসে হাতে টাকা দেয়নি এখনো।”
রায়হানের বুকটা কষ্টে ফেঁটে গেলো যেন। স্টুডেন্ট পড়ালে টাকা দিতে তারা এত অনিহা দেখায় যেন রায়হানকে তারা শুধু শুধু টাকা দেয়। আজকে আরও দুইজনের কাছে চেয়েছিল সবারই একই অজুহাত। রায়হানের এতো শরম করেছে কথাগুলো বলতে অথচ তারা প্রত্যেকেই নির্লিপ্ত। কালকেই লাস্ট ডেট পরীক্ষার ফি দেয়ার। কত কষ্টে স্যারকে ম্যানেজ করেছে সেই জানে। এসব ভেবেই তার চোখটা ভিজে উঠলো। সন্তপর্নে তা মুছে ফেললো। মনে মনে বলে উঠলো,
“আল্লাহ্ পথ দেখাও। একটা উপায় বাতলে দাও মালিক। আমাকে ধৈর্য দাও রাহমানুর রহিম।।”
চলবে….
#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২২
#তাজরীন_ফাতিহা
সন্ধ্যে নামলে পাখিরা নীড়ে ফেরে। কর্মজীবী মানুষ ক্লান্ত পথিকের ন্যায় বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় থাকে। কেউ কেউ আরও আগে বা পরে বাড়ির পথে বেরিয়ে পড়ে। রায়হান মাগরিবের নামাজ পড়ে রাস্তায় একাকী হাঁটছে। তার ভালো লাগছে না কিছুই। সন্ধ্যা পার হয়ে রাতের আধারে ধরণী আচ্ছাদিত হচ্ছে। কিন্তু রায়হানের ভাবমূর্তির কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। সে এক মনে রাস্তায় হেঁটে চলছে। কোথায় যাচ্ছে জানে না সে। বাড়িতে যে ছোট দুইজন ভাইবোন আছে যারা তার অপেক্ষায় অপেক্ষারত সেটাও সে ভুলে গেছে খানিকক্ষণের জন্য। পৃথিবীর এই নিষ্ঠুরতায় সে ক্লান্ত, জর্জরিত, আতঙ্কিত। মাথায় পরীক্ষার ফি এর চিন্তা। কিভাবে জোগাড় করবে টাকাগুলো? পরীক্ষায় বসতে পারবে কি? নাকি এই বর্ষেই থাকতে হবে আবার? তার পক্ষে একই বর্ষে দুইবার থাকা সম্ভব না। কি করবে ভেবেই কোনো কুলকিনারা পাচ্ছে না সে। শেষমেষ কোনো উপায় না পেয়ে জগতের সৃষ্টিকর্তা, নিজের সৃষ্টিকর্তা মহান রবের কাছে তার না বলা আর্জি গুলো পেশ করলো আসমানের দিকে তাকিয়ে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মালিক কি তার আর্জি শুনলো? শুনেছে তো অবশ্যই কারণ রবের নিকট সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর বিষয়ও অগোচর হয় না।
____
রাত সাড়ে নয়টায় রায়হান বাসায় ফিরলো। সচরাচর রায়হান এতো দেরি কখনোই করে না। আজকেই এতটা দেরি করে বাসায় এসেছে। রায়হান নিজেদের বরাদ্দকৃত রুমে ঢুকতে গিয়ে দেখলো রাহমিদ নিজ হাতে ভাত খাচ্ছে দুই পা ছড়িয়ে। রুদ ভাত মাখিয়ে দিয়েছে আর বাচ্চাটা কোনরকম ভাত খাচ্ছে। যদিও ভাত বেশিরভাগ পড়ে যাচ্ছে তবুও বাচ্চাটা হাল না ছেড়ে নতুন উদ্যমে ভাত খাচ্ছে। রায়হান অনেক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখলো। রাহমিদটা বড় হয়ে যাচ্ছে। আগে রায়হান কে না দেখলে কত কান্না করতো এখন আর কাঁদে না। আচ্ছা, তার যদি কিছু হয় বা সে যদি না থাকে এই বাচ্চা দুটো কি এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারবে? ইদানীং এসব বিদঘুটে ভাবনা এতো পরিমাণে আসে মনে হয় শীঘ্রই কিছু একটা ঘটতে চলেছে। আল্লাহ্ খারাপ কিছু না ঘটাক। এই পৃথিবীতে ভাইবোনদের নিয়ে একটু ভালো থাকতে চাওয়া ছাড়া তার আর কিছু চাওয়ার নেই। এসব ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করলো সে। রায়হান কে দেখে রুদ দৌঁড় দিয়ে আসলো। উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞাসা করলো,
“ভাইয়া সারাদিন কোথায় ছিলে?”
“এইতো কাজে। কেন?”
“ভাইয়া তুমি বাইরে থাকলে আমার চিন্তা হয় অনেক। কোথায় থাকো, কই যাও বলতেও তো পারবো না। বিপদ অপদের তো কোনো ঠিক ঠিকানা নাই। তুমি একটা ছোট্ট কমদামী বাটন ফোন কিনিও।”
“বাটন ফোনের কথা তোমায় কে বলেছে?”
“পাশের ঘরের আপুটা বলছিল আজকে। তুমি না আসায় রাহমিদ তোমাকে অনেক খুঁজেছে, কেঁদেছে। তখন উনি ফোনের কথা বলেন। আমি বলেছি আমাদের কোনো ফোন নাই। ফোনের অনেক দাম। আপুটা বলেছে বাটন কমদামী সেট পাওয়া যায় নাকি। আচ্ছা ভাইয়া সেকেন্ড হ্যান্ড ফোন কি?”
“অন্যের ইউজ করা ফোন কম দামে বিক্রি করলে সেটাকে সেকেন্ড হ্যান্ড ফোন বলে। কেন বলো তো?”
রায়হানের যদিও কথা বলতে ইচ্ছা করছে না তবুও রুদকে কষ্ট দিতে চাচ্ছে না। সারাদিন সে বাসায় থাকে না। ভাইবোন গুলোরও তো তার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে। রুদ ভাইয়ের কথা শুনে কিছু ভাবলো। তারপর বললো,
“বাটন ফোনের দাম বেশি নাকি সেকেন্ড হ্যান্ড ফোনের দাম বেশি?”
“সেটা মডেল অনুযায়ী ভেরিফাই করে।”
রুদ অতি উৎসাহী হয়ে বললো,
“ভাইয়া একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ফোন কিনবে? ফোনটা নাকি টাচ।”
“কোথায় পাবো? তোমাকে এসব কে বলেছে?”
“ওই আপুই বলেছেন। ওনাদের ফোন নাকি বিক্রি করবে। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো আমরা বাটন ফোন কিনবো নাকি সেকেন্ড হ্যান্ড ফোন কিনবো? আমি কিছু বলি নাই।”
“ও আচ্ছা ভেবে দেখি। ভাত খেয়েছো?”
“না খাইনি। রাহমিদও সারাদিন খায়নি। ওকে জোর করে ভাত খাইয়ে দিতে চেয়েছি ও নাকি খাবে না। কেমন লাগে বলো?”
এর মধ্যে রাহমিদ প্লেট রেখে কখন হেঁটে এসেছে ওরা কেউই খেয়াল করেনি। ভাইয়ের গা বেয়ে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে ছলছল নয়নে বললো,
“মালচে। বেশি করি মাইর দিছে পাচায়।”
রাহমিদ পাছা দেখিয়ে দিলো। রায়হান ভাইয়ের ছলছল নয়নে তাকিয়ে কি যেন খুঁজে পেলো। আজকে জড়িয়ে ধরার শক্তি পেলো না। কেমন হাঁসফাঁস লাগছে তার। মাথাটা কেমন ব্যথা করছে। বিষাক্ত লাগছে সব কিছু। আজকে কিছুই ভালো লাগছে না। রাহমিদ কে নামিয়ে মুখ হাত ধুয়ে শুয়ে পড়লো। ভাতও খেলো না। কারণ যতক্ষণ জেগে থাকবে চিন্তায় চিন্তায় সে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। এর থেকে একটু ঘুমিয়ে নেয়া যাক। জাগতিক সকল চিন্তা, কষ্ট, ক্লেশ থেকে সাময়িকভাবে তো মুক্তি পাওয়া যাবে এই ঢের। রায়হান সারাদিনের ক্লান্তিতে খুব তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়লো। রাহমিদ ভাইয়ের বুকের উপরে উঠে শুয়ে থাকলো। বোনের কাছে আজকে যাবে না।
রুদ দুই ভাইয়ের কাণ্ড দেখলো। বড় ভাই না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে এতে তার খুব খারাপ লাগছে। ভাইয়ার কি বেশি খারাপ লাগছে আজকে। কিছুই যে বললো না আজকে। অন্যান্য দিন তো এসে তাদের ভাইবোনের সাথে কত গল্প করে কিন্তু আজকে এতো নির্জীব কেন ভাই। কোনো সমস্যা হয়েছে কি? এসব ভাবতে ভাবতে সব কিছু গুছিয়ে রাখলো। সে আর কিছু খেলো না। ভাইয়া কিছু খায়নি। সে কিভাবে ভাইকে ছাড়া খাবে। বাসনকোসন এক পাশে রেখে ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ভাইয়ের গলা জড়িয়ে সেও ঘুমিয়ে পড়লো।
______
—–
রায়হান ভার্সিটির ক্যান্টিনে বসে আছে। আজকে আসতে চায়নি কিন্তু কি মনে করে যেন আসলো। স্যারের সাথে আজকে শেষ কথা বলবে। রায়হান জানে ইমরান স্যার কখনোই মানবে না তবুও শেষ একটা চেষ্টা করে দেখবে সে। যথারীতি ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। আজকে ইমরান স্যারের বদলে বাদল স্যার এসেছে। রায়হানের বুক ধড়ফড় করে উঠলো। স্যার না আসলে কিভাবে তার সমস্যার কথাটা বলবে। আজকেই তো শেষ তারিখ ছিল পরীক্ষার ফি দেয়ার। টেনশনে রায়হান ঘেমে উঠতে লাগলো। বাদল স্যার ক্লাসের মধ্যেই বললো,
“তোমাদের ইমরান স্যার কয়েকদিন আসবে না। তোমাদের পরীক্ষার ফি যাদের বাকি আছে তারা কালকে বা পরশু আমাকে জমা দিবে। আজকে কিছু সমস্যার জন্য নিতে পারছিনা। পরীক্ষার আর বেশিদিন বাকি নেই। প্রিপারেশন কেমন নিচ্ছো সবাই?”
সকলে সমস্বরে বলে উঠলো,
“ভালো স্যার।”
শুধুমাত্র রায়হান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো। চোখ দুটো পানিতে ছলছল করছে। তার মুখ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বের হয়ে গেলো,
“আলহামদুলিল্লাহ।”
মহান রব ঠিকই তার আর্জি কবুল করেছেন। হয়তোবা টাকা পাঠিয়ে দেননি কিন্তু একটা সমাধান ঠিকই পাঠিয়েছেন। আল্লাহর কাছে তার বান্দা কিছু চাইলে মহান রব তা ফিরিয়ে দেননা। একটা না একটা ব্যবস্থা ঠিকই করে দেন। আবারও সে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো। দুই দিনের মধ্যে একটা না একটা টিউশনির টাকা ঠিকই পেয়ে যাবে সে। আল্লাহর উপর ভরসা আছে। মালিক যেহেতু সময় দিয়েছে এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে।
_____
—-
বেশ কিছুদিন পর। রায়হানের দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষ। ভালোভাবেই পরীক্ষা শেষ করেছে সে। এখন ফলাফল ভালো হলেই চিন্তামুক্ত। কালকে থেকে রোযা শুরু। যদিও রমাদানে তার মতো মানুষের এক্সট্রা কোনো বাজারের চিন্তা থাকে না তবুও একটা পবিত্র মাসের আগমণ তাকে চিন্তিত করে ঠিকই। কিভাবে এই পবিত্র মাসটা কাটাবে, কিভাবে ইবাদত করলে এই পবিত্র মাসে পরিপূর্ণ সওয়াব পাওয়া যাবে এসবই তার ভাবনায় কিলবিল করতে থাকে। তাছাড়া রাহমিদ রুদ দুইজনই ভাজা পোড়া খেতে পছন্দ করে। গতবার রাহমিদ এটার জন্য কেমন করলো ভাবলেই তার খারাপ লাগে। এবার চেষ্টা করবে কিছু ভাজা পোড়া রাখতে। যদিও সে জানে না কতটুকু পারবে।
চারপাশে মাইকে সেহেরির জন্য ডাকা হচ্ছে। রায়হানের ঘুম ভেঙে গেলো। ভাত তো রান্না করা হয়নি। সে দ্রুত উঠে ভাত আর ঢেঁড়স ভাজি করলো। সেহেরির অল্প সময় বাকি। ইতোমধ্যে রুদও উঠে গেছে। রুদ সবকটা রোযা রাখতে না পারলেও চেষ্টা করে ভাইয়ের সাথে রাখতে। গতবার রেখেছিল দশটা। এবার দেখা যাক কয়টা রাখতে পারে।
রায়হান এক প্লেটেই তার আর রুদের খাবার বেড়ে নিলো। রুদকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও এক লোকমা মুখে পুড়লো। হঠাৎ করে রাহমিদের কান্নার আওয়াজে মুখে খাবার নিয়েই ওকে কোলে নিলো। বাচ্চাটা ঘুমের ঘোরে কাউকে পাশে না পেয়ে কেঁদে উঠেছে। রায়হান ওকে কোলে নিয়েই দ্রুত ভাত খেতে লাগলো। রাহমিদ ভাইবোনকে খেতে দেখে নিজেও হা করলো। সেটা দেখে রায়হান মুচকি হেঁসে বললো,
“তুমিও সেহেরি করবে?”
রাহমিদ ঘনঘন মাথা নাড়াতে লাগলো অর্থাৎ সেও করবে। রায়হান হেঁসে ওকেও এক লোকমা খাইয়ে দিলো। বাচ্চাটা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে খেতে লাগলো। রায়হান এটা দেখে বুঝলো রাহমিদের অনেক খুদা লেগেছে। সে আরেক লোকমা বাড়িয়ে দিলো। বাচ্চাটা এবারও খুব আয়েশ করে ভাত মুখে নিয়ে চিবুতে লাগলো। এর মধ্যেই মসজিদের মাইকে বলে উঠলো,
“সম্মানিত এলাকাবাসী সেহেরির আর মাত্র বিশ মিনিট বাকি। এখনো যারা সেহেরি করেননি তারা অতি দ্রুত সেহেরি করে নিন। সেহেরি খাওয়ার আর মাত্র বিশ মিনিট বাকি আছে।”
সেহেরির সময় শুনে রায়হান দ্রুত রুদ আর রাহমিদকে খাইয়ে নিজে কোনরকম খেয়ে পানি খেলো। এর মধ্যেই সেহেরির সময় শেষ হয়ে গেছে। ফজরের আজান শুনে মসজিদে যাওয়ার জন্য ওযু করে পাঞ্জাবি গায়ে দিলো। রাহমিদও পাঞ্জাবি নিয়ে দৌঁড়িয়ে বোনের কাছে গেলো। রুদ বাসনকোসন গুছিয়ে রাখছে। ভাইয়া ধুয়ে দিয়েছে তার কাজ শুধু গুছিয়ে রাখা। রাহমিদ এসেই বোনের জামা টানতে টানতে বললো,
“পলিয়ে দাও। মুসজিদে জাবু। তালাতালি পলাও ভাইয়ু চলি যাচ্চে।”
রুদ অবাক হয়ে তাকালো। রাহমিদ যে পাঞ্জাবি নিয়ে এসেছে এতেই আশ্চর্য হয়েছে। ভাবনা থেকে বেরিয়ে রাহমিদকে পাঞ্জাবি পরিয়ে দিলো। পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে দেয়ার সময়ও বোনকে দিলো না। রাহমিদ পাঞ্জাবি পড়েই ভাইয়ের কাছে দৌঁড়ে গেলো। রায়হান রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল পথিমধ্যে রাহমিদকে পাঞ্জাবি পড়ে তার দিকে ছুটে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো। রাহমিদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ফোকলা হেঁসে বললো,
“মুসজিদে জাবু।”
রায়হান হাঁটুমুড়ে বসে রাহমিদের পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে দিলো। পাজামা টাখনুর উপরে গোটালো। রাহমিদ পাজামা গোটাতে চায়না। সে আবার নিচু হয়ে পাজামা নামিয়ে দিতে চাইলো। রায়হান তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“টাখনুর নিচে ছেলেদের জন্য প্যান্ট পড়া হারাম সোনা। এভাবেই সুন্দর লাগছে। মাশাআল্লাহ।”
“হালাম কি?”
“হারাম মানে নিষদ্ধ। যেটা করা উচিত নয়।”
“নিচিদ্দ কেনু?”
“কারণ আমাদের ইসালমে এটা নিষেধ। আমাদের নবীজী (সাঃ) এটাকে নিষেধ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
“তোমাদের পুরুষদের কেউ যদি টাখনুর নিচে কাপড় লটকিয়ে রাখে সে জাহান্নামী। অর্থাৎ পোশাকের যে অংশটুকু টাখনুর নিচে থাকবে সে অংশটুকু দোযখের আগুনে জ্বলবে।” (সহীহ বুখারী)
অপর হাদীসে এসেছে,
“যে লোক টাখনুর নিচে কাপড় রাখাকে গর্ববোধ করে বা ঔদ্ধত্য দেখিয়ে কাপড় পড়া থেকে বিরত থাকে না সে জাহান্নামী।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
“সুতরাং এই দুইটা হাদিস থেকে বুঝলাম কোনো অবস্থাতেই টাখনুর নিচে কাপড় পড়া যাবে না। বুঝেছো কলিজা।”
“বুঝেচি।” বলে হেঁসে দিলো।
অতঃপর দুই ভাই মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। রাতের আধারে বড় ভাইয়ের আঙ্গুল ধরে ছোট ভাইয়ের মসজিদে যাওয়ার দৃশ্যটি রুদের কাছে দারুন লাগলো।
চলবে….