#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_১৯
#তাজরীন_ফাতিহা
কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। আজকে শুক্রবার। মুসলিমদের জন্য ভীষণ পবিত্র একটি দিন। কর্মব্যস্ত মানুষের সাপ্তাহিক ছুটির দিন। রায়হানের জন্য অবশ্য ছুটি না। দুই জনকে টিউশনি পড়াতে হবে। প্রত্যেক শুক্রবার রাহমিদকে সঙ্গে নিয়ে জুমার নামাজে যায় রায়হান। এছাড়াও মাঝে মাঝে রাহমিদকে মসজিদে নেয় সে। ইমাম সাহেব প্রায়ই বলেন রাহমিদকে নিয়ে যেতে এতে করে বাচ্চাদের মসজিদ প্রীতি বাড়বে। তাছাড়া বাচ্চাদের নিয়ে মসজিদে যাওয়া নবীজী (সাঃ) এর সুন্নত। রায়হান রাহমিদকে গোসল করিয়ে দিচ্ছে। বাচ্চাটা খালি লাফালাফি করছে। স্থির থাকছে না। রায়হান ভালো করে সাবান দিয়ে ডলে গোসল করিয়ে দিচ্ছে। রাহমিদ পানি দিয়ে ভাইকেও গোসল করিয়ে দিলো। রায়হান ধমকে উঠলে আরও বেশি করে পানিতে দাফাদাফি করে। ওকে গোসল করিয়ে দিয়ে দ্রুত নিজে গোসল করে বের হলো। সকালে একটা টিউশনি ছিল। ওটা পড়াতে পড়াতে সময় চলে গেছে। শুক্রবারে মসজিদে আগে আগে যাওয়াও রাসূল (সাঃ) এর সুন্নত। ইসলামকে নিজের জীবনের প্রতিটা পদে মেনে চলার চেষ্টা করে রায়হান। যদিও ঠিকভাবে পারেনা তবুও নিজের সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পারে সবই মানার চেষ্টা করে। গোসল করে রুমে এসে দেখে রাহমিদ উদোম গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। লাফালাফি করছে বাচ্চাটা। আজকে ওর জন্য ঈদের মতো আনন্দের দিন। সপ্তাহে কয়েকটা দিন ভাই তাকে বাইরে নিয়ে যায়। তার মজাই লাগে। সারাদিন বাসায় থাকতে কার ভালো লাগে। রায়হান বললো,
“আপনি লেংটু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? লাজ শরম নেই। দাঁড়ান আপনাকে দ্রুতই সুন্নতে খৎনা করিয়ে দিবো তাহলে যদি একটু লাজ লজ্জা আসে শরীরে।”
রাহমিদ ভাইয়ের কথা বুঝে নি। সুন্নতে খৎনা আবার কি? বাচ্চা মানুষ বড়রা কি বলে কিছুই বুঝতে পারেনা সহজে। ফ্যালফ্যাল করে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। রায়হান রাহমিদের জন্য দুইটা পাঞ্জাবি কিনেছিল। একটা সাদা আরেকটা নীল রঙের। ওর মধ্যে সাদা পাঞ্জাবিটা বের করে ওকে পড়িয়ে দিলো। প্যান্ট পড়ালো। বাচ্চাটার প্যান্ট টাখনুর উপর গুটিয়ে দিলো। নিজেও একটা অফ হোয়াইট কালারের পাঞ্জাবি পড়ে নিলো। রুদকে আসেপাশে দেখছে না অনেকক্ষণ। বাচ্চাটা আবার কোথায় গেলো। সে রাহমিদের চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে রুদকে ডাক দিলো।
“রুদ, রুদ পাখি কোথায় আপনি?”
রুদ রান্না ঘরে ছিল। প্লেট, বাটি গুছিয়ে নিয়ে এসেছে। নাহলে পাশের ঘরের আপুটা বকে। ওনাদেরও তো রাঁধতে হয়। রাতের বেলা সব ধুয়ে সিংকে রেখে আসে। কখনো ভাইয়া আবার কখনো সে ওগুলো গুছিয়ে নিয়ে এসে ঘরের এক কোনায় রেখে দেয়। ভাইয়ের ডাক শুনে রান্না ঘর থেকে দৌঁড়ে আসলো। এসে দেখে বড় আর ছোট ভাই রেডি হচ্ছে। সে দৌঁড়ে এসে বড় ভাইয়ের পা জড়িয়ে ধরলো। রায়হান রাহমিদকে আতর মেখে দিচ্ছিলো। হঠাৎ করে কেউ পা জড়িয়ে ধরায় বুঝলো ওটা রুদ। আতর দেয়া শেষ করে বোনকে আদর করলো কিছুক্ষণ। একা একা থাকবে দেখে মন খারাপ করতে নিষেধ করলো। তারা নামাজ পড়েই চলে আসবে। রুদ ভাইয়ের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। তারপর রাহমিদকে আদর করে দিলো। সূরা ফাতিহা পড়ে ফুঁ দিয়ে দিলো দুই ভাইকেই। রায়হান এটা দেখে মুচকি হাসলো। রুদ টা বড় হয়ে গেছে। কেমন বড় বোনের মতো তাদেরকে ফুঁ দিয়ে দিলো। এইটুকু বয়সে কি বুঝদার! মাশা আল্লাহ। রায়হান জিজ্ঞাসা করলো,
“এটা কে শিখিয়েছে?”
“ইমাম হুজুর। আয়াতুল কুরসী পড়ে ফুঁ দিতে হয় কিন্তু আমি এখনো পুরোটা পারিনা তাই সূরা ফাতিহা আর ছোট্ট দুইটা সূরা পড়ে ফুঁ দিছি। হুজুর বলেছেন এতে নাকি বিপদ মুক্ত থাকে।”
রায়হান বোনের কথায় খুশি হলো। বোনের মাথায় চুমু দিয়ে রাহমিদের ছোট্ট ছোট্ট হাত ধরে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো।
_____
রাহমিদ ভাইয়ের হাত ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে। চারপাশ দেখে সে ভীষণ খুশি। মসজিদে এসে আরও খুশি হয়ে গেলো। কি সুন্দর পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে সাদা মেঝে। কত মানুষ এসেছে নামাজে। রাহমিদ মসজিদে ঢুকেই দৌঁড় দিয়ে ইমাম সাহেবের পিছনে চলে গেলো। রায়হান থামাতে চেয়েও পারেনি। এতো গুলো মানুষের সামনে ও বাচ্চাটার পিছনে দৌড়াবেই বা কিভাবে। রাহমিদ নাহয় বাচ্চা তাই চিপা চাপা দিয়ে চলে যেতে পেরেছে সে তো পারবে না। হতাশ হয়ে একটা কাতারে বসে খুতবা শুনতে শুনতে রাহমিদকে নজরে রাখলো। বাচ্চাটা হারিয়ে গেলে বা ওকে না দেখতে পেলে কেঁদে অস্থির হয়ে যাবে। রায়হান দেখলো রাহমিদ ইমাম সাহেবের পাঞ্জাবি টানছে একবার, আরেকবার আরেক মুসল্লির পাঞ্জাবি টানছে। মসজিদের অনেকই বিরক্ত রাহমিদকে ছোটাছুটি করতে দেখে। বাংলাদেশের মসজিদ গুলোতে বাচ্চাদের নিয়ে গেলে মুরুব্বীরা বিরক্ত হন। এখনো হচ্ছেন। রায়হান রাহমিদকে ডাকতে পারছে না জোরে। কারণ খুতবা হচ্ছে। একটু পর নামাজের জন্য কাতার করতে বললো। রায়হান যে সারিতে বসে ছিল সেখান থেকে উঠে দাঁড়ালো। কোত্থেকে রাহমিদ ছুটে এসে ভাইয়ের পা জড়িয়ে ঝুলে পড়লো। রায়হান ওকে দেখে বললো,
“রাহমিদ দুষ্টুমি করে না। এখন নামাজ পড়ানো হবে। চুপচাপ বসে থাকো নাহয় ভাইয়া যা যা করছি তা করো। বুঝেছো। দুষ্টুমি করলে সবাই বকা দিবে।”
রাহমিদ ঘাড় নাড়িয়ে ভাইয়ের কথায় সম্মতি জানালো। নামাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। রায়হান রাহমিদকে তার পাশে দাঁড় করিয়ে দিয়ে একামত বাঁধলো। রাহমিদ ভাইয়ের দেখাদেখি হাত বাঁধলো। রুকু করতে গিয়ে রাহমিদ একেবারে সিজদায় চলে গেলো। রায়হানের এতো হাসি পেলো। হাসি কন্ট্রোল করে নামাজ পড়তে লাগলো। একটু পর তাশাহুদ পড়তে বসার সময় বাচ্চাটা দাঁড়িয়ে হাত বাঁধলো। যখন দেখলো সবাই বসে আছে সেও বসলো। বেশিক্ষণ বসে থাকতে না পেরে পিছন থেকে ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরলো। রায়হান ওকে নিয়েই দাঁড়িয়ে পড়লো আবার সিজদা দিলো।
ভাইয়ের কোলে বেশিক্ষণ স্থির থাকতে না পেরে অন্য মুসুল্লিদের পাশে বসলো। অনেকে সরিয়ে দিলো। অনেকে কিছুই বললো না। খানিকক্ষণ পর সে ফ্লোরে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। নামাজ শেষ করে রায়হান দেখলো রাহমিদ ইমাম সাহেবের জায়নামাজের সামনে শুয়ে আছে। সবাই একে একে বের হয়ে যেতে লাগলো। যাদেরকে রাহমিদ নামাজের সময় ডিস্টার্ব করেছে এর মধ্যে কেউ কেউ রায়হানকে বাচ্চা নিয়ে মসজিদে আসতে নিষেধ করে দিলো। রায়হান কিছু বললো না। বাচ্চাটা কোথাও স্থির থাকতে পারেনা। নামাজ শেষে ইমাম সাহেবের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে বাসায় চলে আসলো। রাহমিদ নামাজ পড়তে আসায় ইমাম সাহেব কতগুলো চকলেট দিয়েছে। বাচ্চাটা খুশি মনে ওগুলো নিয়ে বাসায় এসেছে। যতবারই রাহমিদ মসজিদে যায় ইমাম সাহেব ওকে চকলেট দেন। রাহমিদ মসজিদে যাওয়ার জন্য এতে আরও উৎসাহ পায়।
_______
—–
পোলাও, রোস্ট, গরুর মাংসের গন্ধে চারপাশ মৌ মৌ করছে। রায়হান বাসায় ঢুকে দেখলো পাশের ঘরের আপুটা অনেক রান্নাবান্না করছে। হয়তোবা কোনো মেহমান দাওয়াত দিয়েছে। মাত্র টিউশন করিয়ে আসলো। ক্লান্ত লাগছে। তার উপর আবার খাবারের গন্ধে তার খালি পেট মুচড়ে উঠছে। নিজের বরাদ্দকৃত রুমে যেয়ে দেখলো রুদ রাহমিদকে ভাত খাওয়াতে চেষ্টা করছে কিন্তু রাহমিদ খেতে চাচ্ছে না। কিছু একটা চাচ্ছে। রায়হানকে রুমে ঢুকতে দেখে রাহমিদ দৌঁড়ে ভাইয়ের কাছে গেলো। পা জড়িয়ে ধরে বললো,
“গোত্ত কাবো।”
রায়হানের বুকে কামড় দিয়ে উঠলো। গোশত কই পাবে। নিশ্চয় পাশের ঘর থেকে গোশতের ঘ্রাণ পেয়েছে। নিজেদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় টাইপ অবস্থা সেখানে গোশত কিনবে কোথা থেকে। সে হাঁটু মুড়িয়ে বসে বললো,
“গোশত কোথায় পাবো সোনা। গোশত খেলে অসুখ করবে। পেটে ব্যথা করবে। তুমি কষ্ট পাবে। ওসব খেতে হয়না।”
“চবাই যে কায় মুজা মুজা করে। উসুক করবি কেনু?”
“সবাই খেলেও আমাদের খাওয়া বারণ। আমাদের খেলে অসুখ করবে। যেদিন অসুখ করবে না সেদিন আনবো ঠিক আছে কলিজা।”
“না, না ইখুনি কাবো।”
রাহমিদ জিদে হাত পা ছোড়াছুড়ি করছে। রায়হান অনেক কষ্টে ওকে বোঝালো। কোনোভাবেই মানতে চাচ্ছে না বাচ্চাটা। পটল ভাজি আর ডাল দিয়ে রাহমিদকে ভাত খাইয়ে দিল। খাওয়ানোর সময় বলছিল, এগুলোকে গোশত বলে। এগুলো খেলে ওগুলোও পাবে। রাহমিদ খেয়েছে অল্প। রুদ মন খারাপ করে ভাত খাচ্ছে। রাহমিদ টা কত গোশত খুঁজলো কিন্তু ভাইয়া অপারগ। কিছু করার নেই। বড় ভাইয়ার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। রুদ মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলো,
“আল্লাহ্ আমার ভাইয়াকে আপনি অনেক টাকা পয়সা দেন নাহলে আমাদের যেন কখনো ভালোমন্দ কিছু খেতে ইচ্ছা না করে এমন বানিয়ে দেন। ছোট ভাইয়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে দেন। আপনি রাহমিদের মন খারাপ ভ্যানিশ করে দেন মাবুদ।”
চলবে…
#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২০
#তাজরীন_ফাতিহা
তিনদিন ধরে রায়হানের ভীষণ জ্বর। বিছানা থেকে উঠতে পারছে না একেবারেই। তাও কষ্ট করে উঠে নিজের এবং ভাইবোনের জন্য রান্না করেছে কোনরকম। দাঁড়াতে গেলেই থরথর করে কেঁপে উঠে। বাসার বাইরেও যেতে পারছে না। বাইরে গেলে ওষুধ কিনে আনতে পারতো। ঘরের মধ্যে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তিই সে। প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ সওদাপাতি ঘরে নেই। কে আনবে? রায়হান তো বিছানা ছেড়েই উঠতে পারছে না। শুধু ভাত রান্না করে কোনরকম মাড় দিয়ে খায়। জীবনটা যাতে বাঁচে। রুদ ভাইয়ের শিয়রের পাশে বসে মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। রাহমিদ দুই দিন ধরে কোনো কিছুই খেতে পারছে না। শুধু মাড় দিয়ে ভাত খায় কিভাবে? ছোট্ট অবুঝ রাহমিদ ভাইয়ের গায়ের উপরে উঠে মুখ ধরে কত যে অভিযোগ জানায়। তার অজস্র অভিযোগ। এই যেমন এখন বলছে,
“ভাইয়ুর উসুক ভালু হোবে কোবে? কেনু উসুক করিছে? ও ভাইয়ু হাতবে না ? মুজা মুজা কাবার কবে কাবো? পুচা কাবার কাই না। তালাতালি সুস্থু হই যাও।”
এরকম নানা অভিযোগ ছোট্ট অবুঝ বাচ্চাটা তিনদিন ধরে করছে। রায়হান জ্বরে অচেতন হয়ে এইসব আদুরে অভিযোগ শোনে। এসব কথা শুনে নিজের বুকটা পুড়লেও কিছু করার নেই। আল্লাহ্ তার শরীর দূর্বল, অচল করে দিয়েছেন। চাইলেও কিছু করতে পারবে না সে। আচ্ছা জ্বর কমছে না কেন? তিনদিন হতে চললো এখনো জ্বর নামার কোনো নামগন্ধ নেই। অবশ্য নাপা খেতে পারলে হয়তোবা একটু কমতো।
রুদ টা যতটুকু পারে তার চেয়েও বেশি করেছে এই তিনদিনে। ভাতের চাল নিজেই ধুয়ে চুলায় বসিয়েছে। শুধু মাড়টাই গালতে পারেনা বাচ্চাটা। তবুও এর মধ্যে একদিন রায়হানকে না জানিয়ে মাড় গালতে গিয়েছিলো পুরো পায়ের উপর মাড় পড়েছে। ইস্ পুরো জায়গাটা পুড়ে গেছে। কি চিৎকার দিয়েছিল বাচ্চাটা! একেবারে গলাফাটা চিৎকার। ভাবলেই রায়হানের বুকটা ফেঁটে যায়। মাথায় অজস্র যন্ত্রণা হয়। এই বয়সের বাচ্চার কি এইসব কাজ আদৌ পারার কথা? অথচ তাদের মতো অনাথদের এই বয়সেই পটু হতে হয় সব কাজে নাহলে বেঁচে থাকবে কিভাবে? নিজেকে তো এই যন্ত্রণার পৃথিবীতে টিকিয়ে রাখতে হবে। কেউ আগ বাড়িয়ে তাদের দায়িত্ব নিবেও না, তাদেরকে পালবেও না। দিনশেষে তাদের মতো অনাথদের সুখ, দুঃখের সাথী কেউই হবে না।
“জীবনযুদ্ধে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের শিক্ষক আবার নিজেরাই ছাত্র।”
_____
—-
জ্বর আজকে মোটামুটি ছেড়েছে রায়হানের। টানা সাতদিন ভোগান্তি গিয়েছে। উফ এই সাতদিন তার দুর্বিষহ গিয়েছে। রুদ টার পা কাপড় দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে এখনো খুলেনি। অনেকদিন হয়েছে বাচ্চাটার পা পুড়েছে। প্রথমে পেস্ট দিয়ে অনেক্ষণ রেখে দিয়েছিল। পরে পেস্ট ধোঁয়ার পর দেখে পুরো লাল হয়ে গিয়েছে পা টা। তখন স্যাভলন দিয়ে একটুকরো কাপড় দিয়েই রায়হান পা টা বেঁধে দিয়েছিল। আজকে ব্যান্ডেজ খুলে দেখবে কি অবস্থা? যদি খারাপ অবস্থা হয় ধার দেনা করে হলেও রুদকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে।এসবই ভাবছিল এতক্ষণ রায়হান। রুদকে ডাক দিলো।
“রুদ, রুদ..”
ভাই ডাকতে না ডাকতেই ঘরে আসলো রুদ। রাহমিদের হাত, পা ধুইয়ে এনেছে। রুদের চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। রাহমিদের বুকের কাছটা ভেজা। তারমানে এতক্ষণ এই পন্ডিত টয়লেটে ছিল। দুনিয়ার যত অকাজ, কুকাজ এই পন্ডিতের দ্বারাই সম্ভব। সুযোগ পেলেই টয়লেটে গিয়ে পানি হাতাবে। মানা করলেও শোনে না এই বিচ্ছুটা। রুদ ছোট ভাইয়ের হাত ধরে ঘরে ঢোকালো। তারপর দুম করে পিঠে থাপ্পড় মারলো। রাহমিদ শব্দ করে কেঁদে উঠে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। রুদ বলতে লাগলো,
“বেশি বেড়েছো ইদানীং। পঁচা ছেলে। মেরে একদম ভর্তা করে ফেলবো। সারাদিন ডেকেও পাইনা। ওই ঘরে আবার কেন গিয়েছিলে? মার খেতে? সেদিন মার খেয়ে শিক্ষা হয়নি? খেলনার জন্য মার খেয়েছো যে ভুলে গেছো আবার আজকে কোন সাহসে ওই ঘরে গেলে। পিটিয়ে পিঠের ছাল উঠিয়ে দেয়া দরকার তোমার। ভাইয়া অসুস্থ হয়েছে আর উনি ফুর্তি করতে পাশের ঘরে যায়। আরেকবার খালি দেখি কি করি দেখো তোমাকে।”
চোখ রাঙিয়ে শাসিয়ে শাসিয়ে কথাগুলো বলে থামলো রুদ। রায়হানের মনে হলো মা বুঝি সন্তানকে শাসন করছে। রাহমিদ এখনো গড়াগড়ি করে কাদঁছে। বোন মেরে আবার বকাও দিচ্ছে। রায়হান উঠে রাহমিদকে কোলে নিলো। রুদকে বললো,
“রাহমিদ ছোট না, এভাবে বকে না। ভুল করলে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিবে। হঠাৎ হঠাৎ হাত উঠাবে না। ও বোঝে কিছু? এভাবে মারা টা ঠিক হয়নি রুদ।”
“ভাইয়া ও ওই ঘরে খাবার খুঁজতে গিয়েছিল। বাটি নিয়ে যেয়ে বলে একটু গোশত খাবো। কেমন লাগে বলো। ওই ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এটা শুনে তাড়াতাড়ি ওকে নিয়ে রুমে আসি। তোমাকে বলতে চাইনি কিন্তু….”
কথাগুলো বলে রুদ হুহু করে কেঁদে দিলো। রায়হানের চোখ দিয়েও পানি বের হয়ে গেছে। তার ভাই গোশত খুঁজতে ওই ঘরে গিয়েছিল। ভাইয়ের কোলে রাহমিদ কেঁদেই যাচ্ছে। রায়হান ওকে নিয়ে অনেক্ষণ হাঁটলো আর কি যেন চিন্তা করতে লাগলো।
______
“ভাই গরুর গোশতের কেজি কত করে?”
“সাতশো পঞ্চাশ। পুরাই তাজা গরুর মাংস। লইয়া যান। কয় কেজি দিমু?”
” না না আমি নিবো না। এমনিতেই জিজ্ঞাসা করলাম। এতো দাম কেন ভাই?”
“দাম তো একটু হইবোই। এক্কেরে ফ্রেশ গরু। যেদিন কমবো হেইদিন কিন্নেন তাইলে। যান অহন। হুদাই ডিস্টার্ব কইরেন না।”
রায়হান কথা না বাড়িয়ে চলে আসলো। শুধু দামটাই জিজ্ঞাসা করতে এসেছিল। এতো দাম হবে বুঝতে পারেনি। রাহমিদ টা খালি গরুর গোশত খেতে চায়।
“আচ্ছা এক কাজ করলে কেমন হয় মুরগির গোশত কিনে রান্না করে ওটা রাহমিদকে গরুর গোশত বলে চালিয়ে দিবে। ফার্মের মুরগি একটা কত পরবে কে জানে? অনেকদিন গোশতের বাজারে আসা হয়না তার।”
এসব ভাবতে ভাবতে মুরগির দোকানের সামনে দাড়ালো। দোকানিকে ফার্মের মুরগির দাম জিজ্ঞাসা করলো,
“ফার্মের মুরগি কত করে?”
” একশো পঞ্চাশ আছে, দুইশো আছে, তিনশো আছে আপনে কোনডা নিবেন কন?”
“একশো পঞ্চাশের টা দেন আংকেল।”
“আইচ্ছা। ওই একটা দেড়শোর মুরগি দে তো। কাইট্টা দিমু?”
রায়হান ভাবলো কেটে দিলে টাকা নিবে। বাসায় গিয়ে নিজেই কষ্ট করে কেটে বেছে নিবে। শুধু শুধু টাকা খরচ করার দরকার নেই। বললো,
“লাগবে না। আপনি প্যাকেট করে দিন।”
“আইচ্ছা।”
দোকানদার প্যাকেট করে দিলো। রায়হান গোশত রান্না করতে যা যা লাগে সব অল্প অল্প করে কিনে নিলো। অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। মাসটা চালাতে অনেক কষ্ট করতে হবে। যাই হোক ভাইটা খেয়ে খুশি হলেই হলো। এতেই তার খুশি। মনে মনে অনেক কথা ভাবতে ভাবতে বাসার পথে হাঁটা দিলো।
______
মুরগি বাছতে গিয়ে রায়হানের নাজেহাল অবস্থা। মুরগির চামড়া, নাড়িভুড়ি পরিষ্কার করতে কি যে কসরত করতে হয়েছে। রায়হান রাহমিদকে মুরগি দেখায়নি। মুরগি রাহমিদ চিনে। দেখালেই বলতো,
“মুগ্গি ইনেছো কেনু? আমি গুরু কাবো। ইটা কাবো না।”
তারপর শুরু করতো হাত, পা ছোড়াছুড়ি। আলু দিয়ে মুরগির ঝোল করেছে। আলু দিয়েছে যাতে বেশি করে খেতে পারে। যে কয়দিন ইচ্ছা হবে রুদ, রাহমিদ খাবে। প্লেটে ভাত নিয়ে এসে রাহমিদকে বললো,
“কলিজা দেখেন গরুর গোশত। খাবেন না?”
রাহমিদ এতক্ষণ বোনের সাথে খেলছিল। রায়হানই রুদকে বলেছে রাহমিদকে রান্নাঘরে না যেতে দিতে। রুদও ভাইয়ের কথা মতো ওকে খেলাধুলায় ব্যাস্ত রেখেছে। ভাইয়ের কথা শুনে বাচ্চাটা লাফিয়ে উঠলো। “মুজা, মুজা” বলে হাতে তালি দিতে লাগলো। রায়হান হেঁসে ওকে খাইয়ে দিচ্ছে। বাচ্চাটা মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে মজা করে খাচ্ছে। পাশের ঘরে গরুর গোশত রান্না করা দেখে সেদিন খাওয়ার জন্য তার কাছে কি যে বায়না করলো। রায়হানের খুব খারাপ লেগেছিল। আজকে ভাইয়ের হাসি মুখ দেখে ভালোই লাগছে। একটু প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে অবশ্য। তাতে কি? ভাইয়ের মুখে হাসি ফুটানোই আসল উদ্দেশ্য। রুদকেও খাইয়ে দিলো। রুদের মুখটাও আজকে খুশি খুশি। রুদ মুখ ফুটে যদিও কখনো কিছু চায়না কিন্তু এই বাচ্চাটারও তো ভালো মন্দ খেতে ইচ্ছা করে। ভাইয়ের কষ্টের কথা ভেবে কখনো বলে না ঠিকই কিন্তু ছোট্ট মন তো ঠিকই ভালো কিছু খাওয়ার বাসনা জাগায়।
চলবে…